বিয়ে করবেন নাকি আজীবন ব্যাচেলর থাকবেন? এই প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে যুগ যুগ ধরে। বিয়ের প্রসঙ্গ উঠলে কেউ পরামর্শ দেন, ‘বিয়ে মানে স্বাধীনতার শেষ।’কেউ আবার বলেন, ‘বিয়ে না করলেও তো জীবন চলে।’এত সব কথাবার্তার মধ্যেই ১৯৯৩ সাল থেকে ‘সিঙ্গেল ডে’ পর্যন্ত পালন হচ্ছে। দিনটি এখন এতটাই জনিপ্রয়তা পেয়েছে যে, চীনের অন্যান্য দিবসের চেয়ে সিঙ্গেল ডে’তে বেচাবিক্রি হয় অনেক বেশি। ২০২৪ সালে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সিঙ্গেল ডে উপলক্ষে চীনে বেচাবিক্রি ব্ল্যাক ফ্রাইডে ও সাইবার মানডের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি।
বিশ্বের ব্যাচেলর তরুণ–তরুণীরা রীতিমতো ‘পার্টি’র আয়োজন করে আনন্দ উৎসব করেন সিঙ্গেল ডে’তে। এসব দেখে মনে হতে পারে, বিবাহিতদের চেয়ে অবিবাহিতরাই বুঝি বেশি সুখী!
কিন্তু গবেষণা কী বলছে? আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেশনস (সিডিসি) বলেছে, অবিবাহিতদের তুলনায় বিবাহিতদের বেশি দিন সুস্থ থাকার আর বেশি দিন বাঁচার সম্ভাবনা রয়েছে। বিবাহিতরা একাকীত্ব আর বিষণ্নতার মতো মানসিক সমস্যায়ও কম ভোগেন। এসব মানদণ্ড বিবেচনা করে দাবি করা হয়েছে, বিবাহিতরা বেশি সুখী।
আবার আমেরিকার গবেষণা সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপে বলছে, ৪৩ শতাংশ বিবাহিতরা নিজেদের ‘খুব সুখী’ বলে দাবি করেছেন। অন্যদিকে মাত্র ২৪ শতাংশ অবিবাহিতরা বলেছেন, তাঁরা খুব সুখী।
তবে শুধুমাত্র সুখের খোঁজে বিয়ে করাকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বাজি বলে মনে করেন গবেষকেরা। তাঁরা এটাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, বিয়ে সুখের নিশ্চয়তা নয়। মনোবিজ্ঞানীরা যেমন ডেভিড বার্নস, ড্যানিয়েল গিলবার্ট, ও ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাকনাল্টি–কার্নি বলেছেন, সুখের নির্ভরতা সম্পর্কের মানের ওপর, কেবল বিয়ের ওপর নয়। কারণ, অনেক মানুষই শেষ পর্যন্ত ‘উপযুক্ত’ সঙ্গী খুঁজে পান না। ফলে তাঁদের জীবন পরিণত হয় রবীন্দ্রনাথের গানে—‘এরা সুখের লাগি প্রেম চাহে সুখ মেলে না…’। তারপর হয় বিবাহবিচ্ছেদ।
যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি বলছে, মার্কিন দম্পতিদের একটা বড় অংশের সম্পর্কের ছেদ ঘটে বিবাহবিচ্ছেদের মাধ্যমে। তারপরও অনেক মনোবিজ্ঞানী বিয়েকে সুখের নির্ভরযোগ্য সূচক বলে মনে করেন। তা এক বিস্ময়ই বটে। কারণ, এই মনোবিজ্ঞানীরাই আবার বলেছেন, পারস্পরিক সম্পর্ক সব সময় সমান তালে অতিবাহিত হয় না। ফলে বৈবাহিক জীবনে সুখ–অসুখের উত্থান–পতন থাকে।
গবেষকেরা বলছেন, ‘বিয়ে করুন, প্লিজ’। শর্ত একটাই, দুই জনের মাঝখানে যেন ভালোবাসা থাকে। সংগৃহীত ছবিজার্মানির একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ২৪ হাজার জার্মান দম্পতির ওপর জরিপ চালিয়েছে। তারা বলেছে, হানিমুন পর্বের পর থেকে দম্পতিদের সুখের মাত্রা নাকি কমতে থাকে। প্রায় ১৫ বছর ধরে গবেষণা চালিয়ে একই ধরনের ফলাফলে উপনীত হয়েছেন মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের এক অধ্যাপক। তিনি বলেন, ‘বিয়ের পর পরই দম্পতিদের সুখের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। তবে ধীরে ধীরে সেই মাত্রা কমতে কমতে বিবাহপূর্ব অবস্থায় ফিরে আসে।’
কোনো কোনো গবেষক আবার সুখের সঙ্গে আর্থিক সঙ্গতির সামঞ্জস্যও খুঁজে পেয়েছেন। তাঁদের মতে, বিবাহিত মানুষেরা অপেক্ষাকৃত বেশি আয় করে বলে তাঁরা সুখের উপকরণও বেশি কিনতে পারে। এই গবেষকদের সঙ্গে অবশ্য দ্বিমত পোষণ করেছেন ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার গবেষক ম্যাকনাল্টি এবং কার্নি। তাঁদের মতে, বিবাহ কারও জীবনে জাদুকরী সুখ আনতে পারে না। তবে তা সুখী ভবিষ্যৎ তৈরির সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে মাত্র।
গবেষকরা বলছেন, বিয়ে শুধু সামাজিক ও শারীরিক প্রয়োজন তা কিন্তু নয়। বিয়ের সঙ্গে জড়িত অর্থনৈতিক সম্পর্কও। আর সে কারণেই চীনা সরকার বিয়েতে উৎসাহিত করছে তরুণদের। কারণ, চীনে গত কয়েক দশকে জন্মহার সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে। এতে ঘাটতি দেখা দিয়েছে কর্মক্ষম মানুষের। আর এর প্রভাব পড়েছে সরাসরি অর্থনীতিতে। এ কারণে চীন সরকার বিবাহিত দম্পতিদের সন্তান গ্রহণ করতে নানা ধরনের প্রণোদনা দিয়ে থাকে। পাশাপাশি অবিবাহিতদের বিয়ে করতে উৎসাহিত করছে।
এদিকে জাপানেও জন্মহার আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। ২০২৪ সালে দেশটির জন্মহার নেমে এসেছে ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে। জন্মহার কমায় জনসংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে, যা সরাসরি প্রভাব ফেলছে কর্মশক্তি ও অর্থনীতিতে। এই সংকট মোকাবেলায় জাপান সরকার তরুণ–তরুণীদের বিয়ে ও সন্তান গ্রহণে উৎসাহ দিতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশটি নানা ধরনের প্রণোদনা প্যাকেজও ঘোষণা করেছে।
একই সংকটে ভুগছে দক্ষিণ কোরিয়াও। ২০২৪ সাল থেকে দেশটির সরকার নবজাতক শিশুর জন্য পরিবারকে মাসে প্রায় ৭৫০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত ভাতা দিচ্ছে। শিশুটি এক বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত এই আর্থিক সহায়তা অব্যাহত থাকে। পাশাপাশি, বাবা-মায়েরা অতিরিক্ত ছুটি, ট্যাক্স ছাড় ও বিনা খরচে ডে-কেয়ার সুবিধাও পাচ্ছেন। আরো অনেক দেশই এই সমস্যার পড়েছে।
তবু এত গবেষণা, এত পরিসংখ্যানের মাঝেও একটি সাধারণ সত্য রয়ে যায়। মানুষ সম্পর্কের প্রাণী। কারও হাত ধরা, কারও পাশে থাকা, কারও সঙ্গে জীবন ভাগ করে নেওয়া—এসবই তাঁকে বাঁচতে সাহায্য করতে পারে। তাই গবেষকেরা হালকা হাসি নিয়ে বলছেন, ‘বিয়ে করুন, প্লিজ’। শর্ত একটাই, দুই জনের মাঝখানে যেন ভালোবাসা থাকে।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, ডয়চে ভেলে. রিসার্চ গেট ও দ্য আটলান্টিক ম্যাগাজিন