জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে যে সুপারিশমালা সরকারের কাছে হস্তান্তর করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, তা জাতিকে ঐক্যের বদলে অনৈক্যের দিকে নিয়ে যাবে বলে মনে করছে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, এর মধ্য দিয়ে জাতীয় অনৈক্য প্রতিষ্ঠায় লিপ্ত হয়েছে ঐকমত্য কমিশন।
ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশমালায় তারা এমন কিছু সংযুক্তি দিয়েছেন, যেগুলোতে কোনো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়নি।
মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) সচিবালয়ে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের তিনি এমন মন্তব্য করেন।
সালাহউদ্দিন বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের সুপারিশমালা সরকারের কাছে পেশ করেছেন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে আমার ধন্যবাদ না দিয়ে উপায় নেই। কারণ, তারা অবশেষে তাদের প্রক্রিয়া বা কার্যক্রম সমাপ্ত করতে পেরেছেন। দ্বিতীয়ত, তারা জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার বদলে জাতীয় অনৈক্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা করেছেন।
‘যে জুলাই জাতীয় সনদে আমরা স্বাক্ষর করেছি, সেটার বাইরে অনেক আদেশ নতুন সনদে সংযুক্ত করা হয়েছে। জুলাই জাতীয় সনদে সম্ভবত ৮৪টি দফা রয়েছে। বিভিন্ন দফা নিয়ে আমাদের (বিএনপি) ও বিভিন্ন দলের কিছু ভিন্নমত আছে। এই ‘নোট অব ডিসেন্ট’ পরিষ্কারভাবে সেখানে উল্লেখ আছে।’ যোগ করেন তিনি। সালাহউদ্দিন বলেন, নোট অব ডিসেন্টের অর্থ হলো– যারা এটা দিয়েছে তারা যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে নিজেদের মতো করে সেই দফা বাস্তবায়ন করবে।
‘অথচ বিস্ময়করভাবে আজ যে সংযুক্তিগুলো দেওয়া হয়েছে সুপারিশমালায়, সেখানে এই নোট অব ডিসেন্টের কোনো উল্লেখ নেই। এমনকি গণভোট আয়োজনের ক্ষেত্রে তারা দুটো বিকল্প রেখেই বলেছেন যে, এটি জাতীয় নির্বাচনের আগে-পরে হতে পারে। সেটা সরকার বিবেচনা করবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আবার আলোচনা হতে পারে।’
তিনি বলেন, সংবিধান সংস্কার নামে নতুন একটি ধারণা যুক্ত করা হয়েছে। যেটা আগে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের টেবিলে ছিল না। আলোচনা হয়নি, ঐকমত্য হয়নি।
‘যদি সংবিধান সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়, সেটা সামনের জাতীয় সংসদে যারা নির্বাচিত হয়ে আসবেন তাঁরা সিদ্ধান্ত নেবেন। এ বিষয়ে কোনো সুপারিশ বা আলোচনা না হওয়ার পরেও পরবর্তী জাতীয় সংসদ একইসাথে সংবিধান সংস্কার কমিশনের ভূমিকা রাখবে, এটা তারা আরোপ করতে পারেন না। চাপিয়ে দিতে পারেন না,’ যোগ করেন সালাহউদ্দিন।
বিএনপির এই রাজনীতিবিদ বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে কেবল জাতীয় সংসদ গঠিত হওয়ার কথা। সংবিধান সংস্কার কমিশনের জন্য তো কোনো নির্বাচন হচ্ছে না। নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক যে ম্যান্ডেট সেটা হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করা। আমরা যে গণভোটের প্রস্তাব করেছি, সেটির মধ্য দিয়ে জুলাই জাতীয় সনদে জনগণ যদি সমর্থন দেয়, সেটা জনগণের সার্বভৌম সম্মতি হবে।
‘সুপারিশমালায় বলা হয়েছে, নিম্নকক্ষের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা-অনুপাতে আসনের মধ্য দিয়ে উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে তো এমন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সিদ্ধান্ত হয়েছে উচ্চকক্ষ গঠিত হবে ১০০ সদস্যে। তারা কীভাবে কোনো পদ্ধতিতে নির্বাচিত হবে, সেটার বিষয়ে তো ঐকমত্য হয়নি। কেউ ভোটের অনুপাতে চেয়েছে, আমরা চেয়েছি নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে,’ বলেন তিনি।
‘এখানে ভোটের অনুপাতে ভিত্তি করে তারা সরাসরি প্রস্তাব করে ফেললেন, এখানে কোনো ‘নোট অব ডিসেন্ট’-এর উল্লেখ নেই। গণভোটে নাকি সেই বিষয়টি উত্থাপিত হবে। প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা-অনুপাতে উচ্চকক্ষ গঠিত হবে কি হবে না; সে বিষয়ে জনগণ মতামত দেবে। কিন্তু এ বিষয়ে তো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়নি—এখানে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ আছে। এগুলো কোনোভাবেই বিবেচনা করা যায় না।’
সালাহউদ্দিন বলেন, আরও আশ্চর্য হওয়ার বিষয় হচ্ছে, তারা একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ২৭০ দিনের মধ্যে এসব সংস্কার বাস্তবায়ন না হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেটা সংবিধানে সংযুক্ত হবে। এটা হাস্যকর বিষয়। এগুলো কীভাবে সুপারিশে এলো, আমি জানি না।
মঙ্গলবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ তুলে দেন ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ।
সেখানে বলা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের জন্য ‘সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী’ জনগণের অনুমোদন প্রয়োজন এবং সেজন্য গণভোট অনুষ্ঠান, সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন ও ওই পরিষদের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার ‘অপরিহার্য’।
এই আদেশ জারির পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যথোপযুক্ত সময়ে অথবা নির্বাচনের দিন গণভোট হবে। সেজন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করতে হবে। গণভোটে জানতে চাওয়া হবে ভোটার জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশে সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবগুলোতে সম্মতি দিচ্ছেন কি না।
গণভোটে জনগণের সায় পেলে আগামী জাতীয় নির্বাচনের পর নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হবে। তারা একইসঙ্গে জাতীয় সংসদের সদস্য এবং সংবিধান সংস্কার পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
পরিষদ প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ থেকে ২৭০ পঞ্জিকা দিবসের মধ্যে জুলাই জাতীয় সনদ অনুসারে সংবিধান সংস্কার করবে।