leadT1ad

স্কুলেই কোডিং শুরু করা কিশোরের হাত ধরে যেভাবে এল মাইক্রোসফট

অনন্ত রায়হান
অনন্ত রায়হান

প্রকাশ : ২৮ অক্টোবর ২০২৫, ১৪: ৫৭
স্কুলেই কোডিং শুরু করেছিলেন বিল গেটস। স্ট্রিম গ্রাফিক

১৯৭০ সালের ১৮ নভেম্বর। সেদিনই যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলের লেকসাইড স্কুলের এক কিশোর প্রথমবারের মতো কম্পিউটার হাতে পেলেন। এরপর থেকে মাঝেমধ্যেই রাতে স্কুলের কম্পিউটার ল্যাবে আলো জ্বলতে দেখা যেত। চারপাশ নিস্তব্ধ, তার মধ্যেই শোনা যেত টাইপিংয়ের খচখচ শব্দ। সবাই স্কুল থেকে অনেক আগেই বাড়ি ফিরেছে, কিন্তু সে মনিটরের সামনে বসেই আছে।

সেই কিশোর কম্পিউটারে কোড লিখছে, আবার কখনও মুছে ফেলছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে হেলানও দিচ্ছে। আবার কিছু সময় পর কাজ শুরু করছে। এ শুধু একদিনের গল্প নয়, প্রায়ই এভাবেই ল্যাবে সময় কাটায় সে। সেই কিশোরের নাম উইলিয়াম হেনরি গেটস তৃতীয়। আমরা যাকে চিনি বিল গেটস নামে। আজকের মাইক্রোসফট, আজকের উইন্ডোজ—সবকিছুর শুরু সেই কিশোরের কৌতূহল থেকে।

বিল গেটস জন্মেছিলেন ১৯৫৫ সালের ২৮ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে। তাঁর পারিবারিক পরিবেশ ছিল শিক্ষাবান্ধব। কারণ, বাবা উইলিয়াম গেটস সিনিয়র ছিলেন আইনজীবীম আর মা মেরি ম্যাক্সওয়েল গেটস ছিলেন সমাজসেবী এবং স্কুল বোর্ডের সদস্য। তবে বিল গেটসের মন প্রথমেই আকৃষ্ট হয় যন্ত্রের কার্যপ্রণালীতে। কম্পিউটার কীভাবে কাজ করে, সেটা বুঝতে চাওয়া তাকে প্রোগ্রামিংয়ের দিকে টেনে নেয়।

মাইক্রোসফটের প্রথম অফিসে বিল গেটস ও অ্যালেন। সংগৃহীত ছবি
মাইক্রোসফটের প্রথম অফিসে বিল গেটস ও অ্যালেন। সংগৃহীত ছবি

বিল গেটস ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত পড়েছেন লেকসাইড স্কুলে। সেখানে স্কুল-কমিউনিটির উদ্যোগে ল্যাবে একটি ‘টেলিটাইপ মডেল ৩৩’ টার্মিনাল রাখা হয়েছিল। এটি টাইম-শেয়ারিং কম্পিউটার সিস্টেমে সংযুক্ত ছিল। সেখানে স্কুলের কিছু ছাত্র কম্পিউটার ব্যবহার করত, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করত।

তখন বিল গেটস ও তাঁর সহপাঠী পল অ্যালেন, কেন্ট ইভান্স, রিক ওয়াইল্যান্ড মিলে স্কুলে চালু করেন ‘লেকসাইড প্রোগ্রামার্স ক্লাব’। ক্লাবের কাজ ছিল স্কুলের কম্পিউটার ব্যবহারের সময়সূচি তৈরি করা, ‘বাগ’ খুঁজে বের করা আর প্রাথমিক মানের প্রোগ্রামিং চর্চা চালিয়ে যাওয়া।

তখন তাদের বয়স মাত্র তের-চৌদ্দ। গেটস ও অ্যালেন মিলে তৈরি করেছিল সহজ কিছু প্রোগ্রাম। তারা নানা উপায় খুঁজে বের করতেন, কীভাবে বেশি সময় কম্পিউটার ব্যবহারের অনুমতি পাওয়া যায়। কোনো সফটওয়্যারে ভুল ধরলে অতিরিক্ত সময় ব্যবহারের সুযোগ মিলত, তাঁরা সেই ভুল খুঁজতেন আনন্দের সঙ্গে। লেকসাইডের এসব অভিজ্ঞতা বিল গেটসকে প্রযুক্তিতে আগ্রহী করে তোলে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, স্কুলে পড়াকালীন সেই সময় তার মনে হতো, সাধারণ মানুষও একদিন কম্পিউটারের ব্যবহার শিখবে। এটা পৌঁছে যাবে ঘরে ঘরে, ব্যবহার সহজ হবে। সেই চিন্তাই গেটসের মাথায় ‘মাইক্রোসফট’ প্রতিষ্ঠার বীজ বোপন করে।

তখন বিল গেটস ও তাঁর সহপাঠী পল অ্যালেন, কেন্ট ইভান্স, রিক ওয়াইল্যান্ড মিলে স্কুলে চালু করেন 'লেকসাইড প্রোগ্রামার্স ক্লাব'। ক্লাবের কাজ ছিল স্কুলের কম্পিউটার ব্যবহারের সময়সূচি তৈরি করা, 'বাগ' খুঁজে বের করা আর প্রাথমিক মানের প্রোগ্রামিং চর্চা চালিয়ে যাওয়া।

স্কুল শেষ করে বিল গেটস ভর্তি হন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তাঁর আগ্রহ আরও গভীর হয়। অনেক রাত তিনি কাটিয়েছেন হার্ভার্ডের কম্পিউটার ল্যাবে। বিভিন্ন লেখা থেকে জানা যায়, তিনি প্রায়ই ল্যাবে ঘুমিয়ে পড়তেন। আবার জেগে উঠেই আবার কাজ শুরু করতেন।

১৯৭৫ সালে একদিন বিল গেটসের সেই পুরোনা স্কুলবন্ধু পল অ্যালেন ম্যাগাজিনে খবর পেলেন, ‘আলটেয়ার ৮৮০০’ নামে নতুন এক মাইক্রোকম্পিউটার এসেছে। খবরটা শুনে দুজনেই ভীষণ উৎসাহিত হলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন, এটার জন্য একটি প্রোগ্রামিং ভাষা বানাবেন। কয়েক সপ্তাহের নিরবচ্ছিন্ন পরিশ্রমের পর তাঁরা তৈরি করলেন ‘আলটেয়ার বিএএসআইসি’। এই সাফল্যই তাঁদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

কিছুদিন পর বিল গেটস আর অ্যালেন মিলে তৈরি করেন নিজেদের কোম্পানি, নাম দেন ‘মাইক্রোসফট’। এই নাম এসেছে ‘মাইক্রোকম্পিউটার’ আর ‘সফটওয়্যার’ শব্দ দুটি থেকে। ১৯৭৫ সালের ৪ এপ্রিল মাইক্রোসফট আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধিত হয়। তখন বিল গেটসের বয়স মাত্র একুশ।

সেই সময় অনেকেই ভাবতেন, কম্পিউটার শুধু বড় বড় প্রতিষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য। কিন্তু গেটসের বিশ্বাস ছিল, একদিন মানুষের ঘরে ঘরে থাকবে কম্পিউটার। তিনি হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন, প্রযুক্তি একদিন প্রতিদিনের জীবনেও জায়গা করে নেবে।

বিল গেটস। সংগৃহীত ছবি
বিল গেটস। সংগৃহীত ছবি

১৯৮০ সালে মাইক্রোসফট অনেক বড় সুযোগ পেয়ে যায়। ‘আইবিএম’ তাদের পার্সোনাল কম্পিউটারের জন্য একটি অপারেটিং সিস্টেম তৈরির দায়িত্ব দেয় বিল গেটসকে। গেটস ও তাঁর দল তৈরি করেন ‘এমএস-ডিস্ক অপারেটিং সিস্টেম’। এটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, আর মাইক্রোসফটের নাম ছড়িয়ে পড়ে প্রযুক্তি দুনিয়ায়।

তবে বিল গেটসের জীবনে সবচেয়ে বড় সাফল্য আসে ১৯৮৫ সালে। সেই বছর মাইক্রোসফট তৈরি করে ‘উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম’। এর মাধ্যমে তখন কোড না জেনেও ব্যবহারকারীরা শুধু ক্লিক করেই কম্পিউটার চালাতে সক্ষম হলেন। এতে কম্পিউটার ব্যবহার আরও সহজ হয়ে যায়। নব্বইয়ের দশকে উইন্ডোজ হয়ে ওঠে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যবহৃত অপারেটিং সিস্টেম। সে ধারা এখনও চলছে।

মাইক্রোসফটের এই দ্রুত সাফল্য যেমন তাকে প্রযুক্তি জগতের শীর্ষে পৌঁছে দেয়, তেমনি আসে নানা বিতর্কও। প্রতিযোগিতা, বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। তবুও গেটস তার পথ থেকে সরে যাননি। তিনি বলতেন, ‘আমরা শুধু ভবিষ্যৎটা একটু আগেই দেখতে পেরেছিলাম।’

দীর্ঘ দুই দশক মাইক্রোসফটকে নেতৃত্ব দেওয়ার পর গেটস ধীরে ধীরে কোম্পানির দৈনন্দিন কাজ থেকে সরে আসেন। ২০০০ সালে তিনি ও স্ত্রী মেলিন্ডা গঠন করেন ‘বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন’ (গেটস ফাউন্ডেশন)। এই সংস্থা এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি দাতব্য সংস্থা। আফ্রিকা ও এশিয়ার নানা দেশে তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ভ্যাকসিন কর্মসূচিতে কাজ করছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত