leadT1ad

সাক্ষাৎকারে ড. জাহিদ হোসেন

সাক্ষাৎকার/বাংলাদেশের অর্থনীতি: স্থিতিশীলতা ফিরেছে, কিন্তু গতি ফেরেনি

আগস্ট-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি ক্রান্তিকাল পার করছে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে কিছুটা স্বস্তি ফিরলেও সার্বিক কর্মচাঞ্চল্যে গতি ফেরানো এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা, সংকট উত্তরণের পথ এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে ঢাকা স্ট্রিম-এর সঙ্গে কথা বলেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক

প্রকাশ : ২৮ অক্টোবর ২০২৫, ১৯: ২৮
স্ট্রিম গ্রাফিক

ড. জাহিদ হোসেন, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নীতিমালার একজন বিচক্ষণ পর্যবেক্ষক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ সম্পন্ন করার পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনৈতিক অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও পোলান্ডে ১৪ বছরের শিক্ষকতা করছেন। ড. জাহিদ হোসেন ১৯৯৫ সালে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ে অর্থনীতিবিদ হিসেবে যোগ দেন। তিনি বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের ব্যাংক খাত, উন্নয়ননীতি পর্যালোচনাসহ বাংলাদেশ, দক্ষিণ এশিয়া ও বৈশ্বিক অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করেন তিনি। লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত এখন। সম্প্রতি দেশের অর্থনীতি, ব্যাংক খাত, উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি ও বৈষম্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ঢাকা স্ট্রিমের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।

ঢাকা স্ট্রিম: বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

ড. জাহিদ হোসেন: বর্তমান অর্থনীতির অবস্থাকে দুটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। প্রথমটি হলো সামষ্টিক স্থিতিশীলতা, যা গত ৫ আগস্টের আগের কয়েক বছর ধরে বেশ সংকটে ছিল। দ্বিতীয়টি হলো অর্থনীতির সার্বিক কর্মচাঞ্চল্য বা গতিশীলতা, যা এখন একটি স্থবিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

স্থিতিশীলতার দিক থেকে বললে, গত জুলাই-আগস্টের তুলনায় আমরা এখন অনেকটাই স্বস্তির জায়গায় আছি। যেমন, মূল্যস্ফীতির সূচক এখনো উচ্চ পর্যায়ে থাকলেও আগের মতো প্রতি মাসে লাফিয়ে বাড়ছে না, বরং এখন এটি নিম্নগামী। বেশ কয়েক মাস ধরেই খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত—উভয় ক্ষেত্রেই মূল্যস্ফীতি কমার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যদিও তা সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এখনো অনেক উপরে।

সামষ্টিক অর্থনীতির তৃতীয় চাপের জায়গা ছিল ব্যাংকিং খাত। এই খাতের দুর্দশা এখনো পুরোপুরি কাটেনি, তবে যে ‘রক্তক্ষরণ’ হচ্ছিল, তা মোটামুটি ঠেকানো গেছে। আগস্টের পর একটি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল যে, লুটপাটের শিকার হওয়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলবে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক দ্রুত কিছু ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেওয়া এবং প্রয়োজনীয় তারল্য সহায়তা দেওয়ায় সেই আতঙ্ক প্রশমিত হয়েছে।

ঢাকা স্ট্রিম: আপনি সামষ্টিক স্থিতিশীলতায় স্বস্তির কথা বলছেন। এই স্থিতিশীলতা অর্জনের পেছনে মূল চালিকাশক্তি কী ছিল, বিশেষ করে ডলার সংকট মোকাবেলায়?

ড. জাহিদ হোসেন: সামষ্টিক অর্থনীতির দ্বিতীয় বড় অস্থিতিশীলতা ছিল বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে তীব্র ডলার সংকট। ২০২২ সাল থেকে কৃত্রিমভাবে ডলারের দাম চেপে রাখার ভুল নীতি এই সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। তবে ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে পরিবর্তন আসায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও সাহসী নীতিগত সংস্কার করা হয়েছে।

এর সবচেয়ে বড় ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে রেমিট্যান্স প্রবাহে। সেপ্টেম্বরের পর থেকে আনুষ্ঠানিক বা ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। এর প্রধান কারণ হলো অর্থ পাচার অনেকাংশে বন্ধ হয়ে যাওয়া। যারা নিয়মিত মোটা অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচার করতেন, তারা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় এই ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। এর ফলে ডলারের জোগান যেমন বেড়েছে, তেমনি আমদানির ক্ষেত্রে দুর্বল চাহিদাও ডলারের ওপর চাপ কমিয়েছে। এই দুটি বিষয় মিলে বাজারে স্থিতিশীলতা এনেছে। পরিস্থিতি এখন এতটাই নিয়ন্ত্রণে যে, ডলারের দাম অতিরিক্ত কমে যাওয়ার আশঙ্কায় বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই বাজার থেকে ডলার কিনে দাম স্থিতিশীল রাখছে। এটি বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে একটি বড় উন্নতির লক্ষণ।

ঢাকা স্ট্রিম: ডলার বাজারের অস্বস্তির পাশাপাশি ব্যাংকিং খাত নিয়েও ব্যাপক উদ্বেগ ছিল। সেই খাতের ‘রক্তক্ষরণ’ ঠেকানোর ক্ষেত্রে অগ্রগতি কতটুকু?

ড. জাহিদ হোসেন: সামষ্টিক অর্থনীতির তৃতীয় চাপের জায়গা ছিল ব্যাংকিং খাত। এই খাতের দুর্দশা এখনো পুরোপুরি কাটেনি, তবে যে ‘রক্তক্ষরণ’ হচ্ছিল, তা মোটামুটি ঠেকানো গেছে। আগস্টের পর একটি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল যে, লুটপাটের শিকার হওয়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলবে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক দ্রুত কিছু ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেওয়া এবং প্রয়োজনীয় তারল্য সহায়তা দেওয়ায় সেই আতঙ্ক প্রশমিত হয়েছে। যদিও এখনো কিছু দুর্বল ব্যাংকে গ্রাহকদের চেক দিয়ে টাকা পেতে সমস্যা হচ্ছে, তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে—এই আস্থা তৈরি হওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি।

ঢাকা স্ট্রিম: কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। মার্চ পর্যন্ত এর পরিমাণ ৪ লক্ষ ২০ হাজার কোটি টাকা। এটা কি নতুন সংকট নির্দেশ করে?

ড. জাহিদ হোসেন: খেলাপি ঋণের পরিমাণ পরিসংখ্যানে বাড়ছে, যা দেখে অনেকে উদ্বিগ্ন হতে পারেন। তবে এর পেছনের কারণটি বুঝতে হবে। এর একটি বড় কারণ হলো, আগে খেলাপি ঋণ লুকানোর যে বিপজ্জনক প্রবণতা ছিল, তা এখন কমে আসছে। অর্থাৎ, কার্পেটের নিচ থেকে আসল চিত্র বেরিয়ে আসছে, যা অর্থনীতির জন্য একটি ইতিবাচক দিক।

এছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণ চিহ্নিত করার নীতিমালা আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করতে আরও কঠোর করেছে। আগে কোনো ঋণ একটানা ১৮০ দিন অনাদায়ী থাকলে তা খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতো, এখন তা ৯০ দিনেই করা হচ্ছে। এই নীতিগত পরিবর্তনের কারণেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ কাগজে-কলমে বাড়ছে। এর মানে এই নয় যে নতুন করে বিপুল পরিমাণে খেলাপি ঋণ তৈরি হচ্ছে। আগামী সেপ্টেম্বরের পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যাবে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির প্রবাহ সত্যিই বন্ধ হয়েছে কি না।

‘সেতুবন্ধন’ শীর্ষক এক বিশ্লেষণে আমরা দেখিয়েছিলাম, ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, একটি পরিবারের মাসে মাত্র দুই দিনের আয় বন্ধ হলেই তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে। এই ‘টোকা দিলেই পড়ে যায়’ এমন পরিবারের সংখ্যা অনেক। ২০২২ সালের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সেই তুলনায় মজুরি না বাড়া এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ যে দুর্দশায় পড়েছিল, তা থেকে এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি।

ঢাকা স্ট্রিম: আপনি স্থিতিশীলতায় উন্নতির কথা বললেও অর্থনীতির সার্বিক কর্মচাঞ্চল্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এই স্থবিরতার লক্ষণগুলো কোথায় সবচেয়ে স্পষ্ট?

ড. জাহিদ হোসেন: বিভিন্ন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আগস্ট পর্যন্ত রপ্তানি খাতে প্রবৃদ্ধি খারাপ ছিল না। কিন্তু এর বাইরে অর্থনীতির গতি সঞ্চারকারী অন্যান্য সূচক, বিশেষ করে বিনিয়োগে কোনো ইতিবাচক সাড়া মিলছে না।

জুলাই মাসের বিনিয়োগের পরিসংখ্যানে কিছুটা উন্নতি দেখা গেলেও বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা এখনো খুবই দুর্বল। আপনি ব্যাংকারদের জিজ্ঞাসা করলে তারা বলবেন, কর্পোরেট গ্রাহকদের কাছ থেকে নতুন ঋণের আবেদন আসছে না বললেই চলে। ব্যক্তিগত ঋণ, যেমন—গাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট কেনার ক্ষেত্রে সম্প্রতি কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ দেখা গেলেও সার্বিকভাবে নতুন বিনিয়োগ বা ব্যবসা সম্প্রসারণের কোনো জোরালো ইঙ্গিত নেই। এর অর্থ হলো, উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় চলতি মূলধনের (ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল) চাহিদা থাকলেও নতুন বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে, যা অর্থনীতির গতি ফেরানোর পথে সবচেয়ে বড় বাধা।

ঢাকা স্ট্রিম: অর্থনীতির এই ধীরগতির প্রভাব সাধারণ মানুষের জীবন ও দারিদ্র্যের ওপর কীভাবে পড়ছে?

ড. জাহিদ হোসেন: এখানেই সবচেয়ে বড় উদ্বেগের চিত্রটি ফুটে উঠেছে। সম্প্রতি পিপিআরসি-র জরিপে দেখা গেছে, ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৫ সালে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা প্রায় ১০ শতাংশ বেড়েছে। যদিও তাদের জরিপ পদ্ধতি বিবিএস-এর মতো না, তবুও এই বৃদ্ধি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা তুলে ধরে। সেটি হলো, আমাদের সমাজে একটি বিশাল ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ জনগোষ্ঠী রয়েছে, যারা দারিদ্র্যসীমার ঠিক উপরে বাস করে। যেকোনো ছোট ধাক্কা—যেমন পরিবারের কারো অসুস্থতা বা আকস্মিক ব্যয়—তাদের আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে ঠেলে দেয়।

‘সেতুবন্ধন’ শীর্ষক এক বিশ্লেষণে আমরা দেখিয়েছিলাম, ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, একটি পরিবারের মাসে মাত্র দুই দিনের আয় বন্ধ হলেই তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে। এই ‘টোকা দিলেই পড়ে যায়’ এমন পরিবারের সংখ্যা অনেক। ২০২২ সালের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সেই তুলনায় মজুরি না বাড়া এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ যে দুর্দশায় পড়েছিল, তা থেকে এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি।

ঢাকা স্ট্রিম: এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও কোন বিষয়গুলো অর্থনীতিকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করেছে?

ড. জাহিদ হোসেন: দুটি বিষয় এক্ষেত্রে বড় ‘শক অ্যাবজরবার’ বা রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করেছে। প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। কোভিডের পর থেকে বিদেশে যাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ বেড়েছে। বর্তমানে বিদেশে প্রায় ৮০ থেকে ৯০ লাখ বাংলাদেশি কর্মরত আছেন বলে ধারণা করা হয়। গত অর্থবছরে তারা ৩০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যার সিংহভাগই গেছে দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর কাছে। গ্রামভিত্তিক এই অর্থপ্রবাহ অর্থনীতিকে একেবারে ভেঙে পড়া থেকে রক্ষা করেছে।

দ্বিতীয় ইতিবাচক দিক হলো কৃষি খাত। গত আগস্টের বন্যার পর থেকে এ খাতে বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসেনি। রাজনৈতিক অস্থিরতা শহরকেন্দ্রিক হওয়ায় এর প্রভাব কৃষিতে তেমন পড়েনি। ফলে শস্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের উৎপাদন স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে চলেছে। তবে এই দুটি বিষয় অর্থনীতিকে ধরে রাখতে সাহায্য করলেও সংকট থেকে বের করে আনার জন্য যথেষ্ট নয়।

ব্যাংক একীভূতকরণের যে উদ্যোগ শুরু হয়েছে, আশা করি তা এই সরকারের সময়েই সম্পন্ন হবে। একবার এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে ভবিষ্যৎ সরকারের পক্ষে এটিকে পাল্টানো (রিভার্স) কঠিন হবে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো একটি নজির স্থাপন করা, যাতে ভবিষ্যতে একই ধরনের সমস্যার সমাধানের জন্য নতুন করে ‘চাকা আবিষ্কার’ করতে না হয়। আইন ও প্রক্রিয়াগুলো তৈরি হয়ে গেলে কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে।

ঢাকা স্ট্রিম: অর্থনীতির টেকসই পুনরুদ্ধারে ব্যাংকিং খাতের সংস্কারকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলা হচ্ছে। এই সংস্কার প্রক্রিয়াটি আসলে কতটা জটিল এবং এর অগ্রগতি কতটুকু?

ড. জাহিদ হোসেন: ব্যাংকিং খাতের সংস্কার অত্যন্ত জটিল একটি প্রক্রিয়া। এর দুটি দিক রয়েছে: একটি হলো নীতিগত (রেগুলেটরি) সংস্কার, অন্যটি কাঠামোগত (স্ট্রাকচারাল)।

নীতিগত ক্ষেত্রে কিছু গুণগত পরিবর্তন এসেছে। আগে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টেলিফোন করে চাঁদাবাজিসহ নানা অনিয়ম হতো বলে শোনা যেত; এখন সেই স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ হয়েছে। ঝুঁকিভিত্তিক সুপারভিশন, ব্যাংকের প্রকৃত সুবিধাভোগী মালিক চিহ্নিত করা এবং স্বজনদের ঋণ নেওয়ার সীমা পর্যবেক্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলোর পূর্ণাঙ্গ সুফল পেতে সময় লাগবে।

কাঠামোগত সংস্কারের পথটি আরও কঠিন। বাইরে থেকে ১৫-২০টি দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করার কথা বলা সহজ, কিন্তু বাস্তবে এর জন্য প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামো দেশে অনুপস্থিত ছিল। সংস্কারের জন্য গঠিত টাস্কফোর্সের আইনি বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছিল। এরপর আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ‘ব্যাংক রেজোলিউশন অর্ডিন্যান্স’ তৈরি করতে এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান দিয়ে ব্যাংকগুলোর সম্পদের অবস্থা নিরীক্ষা (এ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ) করাতেই অনেক সময় চলে গেছে। এরপর যখন একীভূতকরণের উদ্যোগ নেওয়া হলো, তখন ব্যাংকগুলোর ভেতর থেকেও প্রতিরোধ এসেছে। অর্থাৎ, প্রতিটি পদক্ষেপেই আমাদের ‘করে করে শিখতে হয়েছে’। এটি একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য বিশাল একটি ‘ফায়ার ফাইটিং’-এর মতো।

ঢাকা স্ট্রিম: এই সংস্কারগুলোর ভবিষ্যৎ কী? এগুলো কি কেবলই একটি সাময়িক উদ্যোগ, নাকি দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকবে বলে মনে করেন?

ড. জাহিদ হোসেন: আমাদের হাতে সংস্কারের রূপরেখা বা ‘কী করতে হবে’ তার একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা আছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ৫০০ পৃষ্ঠার টাস্কফোর্স রিপোর্টে তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। কিন্তু দিনশেষে শুধু পরিকল্পনা থাকলেই হবে না, একটি জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা (এ্যাকাউন্টেবল সিস্টেম) তৈরি করতে হবে।

ব্যাংক একীভূতকরণের যে উদ্যোগ শুরু হয়েছে, আশা করি তা এই সরকারের সময়েই সম্পন্ন হবে। একবার এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে ভবিষ্যৎ সরকারের পক্ষে এটিকে পাল্টানো (রিভার্স) কঠিন হবে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো একটি নজির স্থাপন করা, যাতে ভবিষ্যতে একই ধরনের সমস্যার সমাধানের জন্য নতুন করে ‘চাকা আবিষ্কার’ করতে না হয়। আইন ও প্রক্রিয়াগুলো তৈরি হয়ে গেলে কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে।

আমি তরুণ প্রজন্মের ওপর অত্যন্ত আশাবাদী। যারা এই পরিবর্তন ঘটিয়েছে, সেই ‘জেন-জি’ বা তরুণদের চিন্তাভাবনা আগের প্রজন্মের চেয়ে ভিন্ন। তারা ব্যক্তির দলীয় পরিচয়ের চেয়ে তার যোগ্যতা ও পারফরম্যান্সকে গুরুত্ব দেয়, যা সম্প্রতি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনের ফলাফলেও প্রতিফলিত হয়েছে। যদি এই ‘পারফরম্যান্স-ভিত্তিক’ এবং ‘জবাবদিহিমূলক’ সংস্কৃতি সমাজে প্রতিষ্ঠা পায়, তবেই এই সংস্কারগুলো টেকসই হবে এবং দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে।

ঢাকা স্ট্রিম: অতীতে প্রায়ই বলা হতো, 'রাজনৈতিক সদিচ্ছা' থাকলেই সংস্কার সম্ভব। কিন্তু আপনার বক্তব্যে মনে হচ্ছে, বিষয়টি এতটা সরল নয়। সংস্কার বাস্তবায়নে মূল বাধা বা সক্ষমতার সংকটটি আসলে কোথায়?

ড. জাহিদ হোসেন: আমার গত এক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আগে যখন সংস্কারের কথা উঠত, তখন আমাদের একটি বাঁধা উত্তর ছিল—‘রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব’। কিন্তু এখন আমি বুঝতে পারছি, সদিচ্ছা ছাড়া সংস্কার হয় না, তবে শুধু সদিচ্ছা থাকলেই সংস্কার হবে—এর কোনো গ্যারান্টি নেই। এর জন্য প্রয়োজন সংস্কার বাস্তবায়নের সক্ষমতা বা ‘ডেলিভারি ক্যাপাসিটি’।

ব্যাংকিং খাতের সংস্কার কোনোভাবেই ধীরগতির হতে দেওয়া যাবে না। শুরু হওয়া ব্যাংক একীভূতকরণ এবং অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ (একিউআর) প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ স্বচ্ছতার সঙ্গে ও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে। এখানে রাজনৈতিক বা গোষ্ঠীগত চাপ প্রতিহত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ নিশ্চিত করা জরুরি।

এই সক্ষমতা চারটি গোষ্ঠীর সমন্বিত ভূমিকার ওপর নির্ভরশীল:

১. ক্যাবিনেট: যেখানে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে অর্থ, পরিকল্পনা, জ্বালানির মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টারা একটি ‘টিম’ হিসেবে কাজ করবেন এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন।

২. আমলাতন্ত্র (বুরোক্রেসি): শুধু নির্দেশ দিলেই হবে না। মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যদি সংস্কার বাস্তবায়নে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা না করেন, তবে সেই উদ্যোগ সফল হবে না।

৩. ব্যবসায়ী সংগঠন (বিজনেস ফেডারেশন): আর্থিক খাত বা ব্যবসায়িক নিয়মকানুন সংক্রান্ত সংস্কারে এফবিসিসিআই-এর মতো সংগঠনগুলোর সমর্থন অপরিহার্য।

৪. নাগরিক সমাজ (সিটিজেন গ্রুপ): স্বাস্থ্য, শিক্ষা বা বিচার ব্যবস্থার মতো খাতে নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সমর্থন সংস্কারকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে।

যেকোনো বড় সংস্কারে এই চারটি শক্তিকে এক জায়গায় আনতে না পারলে, সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তা বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব। এখানেই আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ।

ঢাকা স্ট্রিম: অর্থনৈতিক উত্তরণে সামনে থাকা চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রতি আপনার পরামর্শ গুলো কী থাকবে?

ড. জাহিদ হোসেন: আমার প্রথম ও প্রধান পরামর্শ হবে বিনিয়োগের স্থবিরতা কাটানোর ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া। এর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে একটি সমন্বিত কৌশল নিতে হবে। শুধু নীতি প্রণয়ন করলেই হবে না, ব্যবসায়ীদের আস্থা ফেরাতে জ্বালানি-বিদ্যুৎ খাতের অনিশ্চয়তা দূর করতে হবে এবং নীতিমালার স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, ব্যাংকিং খাতের সংস্কার কোনোভাবেই ধীরগতির হতে দেওয়া যাবে না। শুরু হওয়া ব্যাংক একীভূতকরণ এবং অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ (একিউআর) প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ স্বচ্ছতার সঙ্গে ও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে। এখানে রাজনৈতিক বা গোষ্ঠীগত চাপ প্রতিহত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ নিশ্চিত করা জরুরি।

সবশেষে, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ‘বাস্তবায়ন সক্ষমতা’ (ডেলিভারি ক্যাপাসিটি) বৃদ্ধি করা। সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ, আমলাতন্ত্র এবং ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে। বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা সফল হবে না। তাই একটি সমন্বিত ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই হবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার মূল চাবিকাঠি।

ঢাকা স্ট্রিম: স্যার ধন্যবাদ আপনাকে।

ড. জাহিদ হোসেন: ধন্যবাদ ঢাকা স্ট্রিম ও ঢাকা স্ট্রিমের পাঠকদেরও।

শ্রুতিলিখন: মুজাহিদুল ইসলাম

Ad 300x250

সম্পর্কিত