রেজাউর রহমান (১৯৪৪-২০২৫) স্যারের বক্তৃতা প্রথম শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রনমিকাল অ্যাসোসিয়েশনের কোনো এক জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক কর্মশালা অথবা অন্য কোনো অধিবেশনে। ‘যেখানেই জীবন টিকে গেছে, নানা রূপে, নানা কায়দায়, নানা প্রক্রিয়ায় -- সেখানেই জীবন গড়িয়ে গেছে এক জীবন থেকে অন্য জীবনে। এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতিতে। সহজতর জীবন থেকে উন্নততর জীবনে। তবে তা হয়নি লক্ষ-হাজার বছরের হিসাবে। হয়েছে ভূতাত্ত্বিক বয়সসীমায়। কোটি কোটি বছরের হিসাবে।’ এমন চিন্তা-ভারাক্রান্ত শব্দ আমাদের তখন আর কেউ বলেনি, যেন কার্ল সেগানের এক দূরাগত ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে কানে বেজে উঠল!
সে প্রায় ত্রিশ বছর আগের কথা, নব্বইয়ের দশকের শেষার্ধের কোনো এক বছরে। তিনি মহাবিশ্বে প্রাণ ও প্রাণের উদ্ভব বিষয়ে বক্তৃতা দিতেন। সেই সময়ে যখন অ্যাস্ট্রনমি বা জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে আমরা আধো আধো শিখছি, হাতে তথ্যের উৎস খুবই কম, ফেসবুক ইন্টারনেট তখন আসিমভের কল্পনার মত দূর-ভবিষ্যত, তখন প্রাণের মৌলিক বৈশিষ্ট্য ও সংজ্ঞায়ন বিষয়ে এত চমকপ্রদ আলোচনা আর কখনো আমরা শুনিনি।
স্বচ্ছ ট্রান্সপারেন্সিতে কোষের ছবি, বিচিত্র প্রাণের ছবি, মহাবিশ্বে প্রাণের বৈশিষ্ট্য, প্রাণ আসলে কী ইত্যাদি প্রশ্নগুলি আমাদের তরুণ মনে সাংঘাতিক আলোড়ন তুলেছিল।
রেজাউর রহমান বক্তৃতা দিতেন অত্যন্ত মৃদুভাষ্যে, ছোট ছোট বাক্যে, আস্তে আস্তে। স্যারের কথা শুনতে আমাদের কষ্ট হত, বুঝতে পারাটা ছিল আরও কষ্টের, কিন্তু চিন্তার যে-আলোড়ন তিনি আমাদের দিয়েছিলেন, তা ভাবলে আজও রোমহর্ষ হয়!
এই রোমাঞ্চকর রহস্যের হাতছানি আমরাও দিতে চাইলাম আমাদের ক্যাম্পাসের প্রকৌশল-বোদ্ধা শিক্ষার্থীদের জন্য। ১৯৯৮ সালের শেষে কিংবা ১৯৯৯ সালের শুরুর অর্ধে আমরা বুয়েটের সত্যেন বসু ক্লাবের পক্ষ থেকে ডক্টর রেজাউর রহমানকে অনুরোধ করলাম বুয়েটে বায়োলজি নিয়ে বক্তৃতা দিতে। তিনি তখন আণবিক শক্তি কমিশনের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। দু’দুবার আমরা চেষ্টা করেছিলাম, দুবারই আমরা ব্যর্থ হলাম।
না, স্যারের সময়াভাবে নয়, আমাদের সকল আয়োজন থাকা সত্বেও, বুয়েটে নানা অশান্তির কারণে দুবারই আমরা ব্যর্থ হলাম। তবে পরে আমরা তাঁকে আনতে পেরেছিলাম, এবং তাঁর মুখে শুনেছিলাম জীবনের সেই বাণী যা রবীন্দ্রনাথের কবিতায়ও ধ্বনিত হয়েছিল, 'সে পৃথিবীতে যেথা কল্প কল্প ধরি
প্রাণপঙ্ক সমুদ্রের গর্ভ হতে উঠি
জড়ের বিরাট অঙ্কতলে
উদ্ঘাটিল আপনার নিগূঢ় আশ্চর্য পরিচয়
শাখায়িত রূপে রূপান্তরে।'
এরপর জীবন ও উচ্চশিক্ষার নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে রেজাউর রহমানের সঙ্গে আবারও যোগাযোগ স্থাপিত হয় ২০০৯ সালে, ততদিনে আমি বাংলাদেশে থিতু হয়ে গেছি।
২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান বর্ষ উদযাপনের লক্ষ্যে আমরা জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাথমিক কর্মশালা আয়োজন করি, এটি আজও চালু আছে।
এই কর্মশালায় আমি আবারও খুঁজে বের করে রেজাউর রহমানকে নিয়ে আসি আদিপ্রাণের সেই পুরাতন কলতান শ্রবণের জন্য। স্যার তখন অবসরে। লেখালেখি আর নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডে, জ্যোতির্বিজ্ঞান কিংবা গণিতে ব্যস্ত।
আমরা অবশ্য রেজাউর রহমানকে বিজ্ঞানের গবেষক, কীটতত্ত্ববিদ ও বিজ্ঞান-লেখক বলেই চিনতাম। কিন্তু ইত্যবসরে তিনি গল্প ও কথাসাহিত্যেও হাত পাকিয়েছেন। অবশ্য তাঁর কথাসাহিত্যধর্মী গদ-ভঙ্গিমা তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থেও দেখা গেছে। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ভাষা-শহীদ গ্রন্থমালার ‘সাপ’ (১৯৮৫) বইটির উৎসর্গপত্রে তিনি লিখেছেন, “১৯৭১ সনের কোনো এক শ্বাসরুদ্ধকর অন্ধকার পল্লীরাত যাঁর আশ্চর্য কুশলী কণ্ঠে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল -- বেহুলা লখিন্দরের দুঃখ আরো সব অপরূপ রাত-জাগানী কিস্সা প্রস্তাব। আলগোছে হারিয়ে যাওয়া ‘ছায়েদালী নানার’ সেই দুঃখ-সুর আজো আমার কানে বাজে”।
‘সাপ’ বইটি অবশ্যই বিজ্ঞানের প্রাণী সাপকে নিয়ে রচিত, কথাসাহিত্যের সাপকে নিয়ে নয়। এই বইয়ের রেফারেন্সে ‘বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস’ বইটির নাম দেখে পরে আমি সে বইটি সংগ্রহ করেছিলাম। এর পর’বছরই তিনি প্রকাশ করলেন ‘মহাবিশ্বে জীবনের সন্ধান’ নামের বইটি, যার থেকে একদম শুরুতে আমি কোট করেছি।
এই বইটি রেজাউর রহমানের একটি অন্যতম অনন্য কীর্তি। মহাবিশ্বের অন্যত্র প্রাণ আছে কি না, থাকলে কীভাবে তা খুঁজব, সর্বোপরি প্রাণের বৈশিষ্ট্য কী এমন সব প্রশ্নের ঝাঁপি খুলে দিলেন স্যার তাঁর এই বইয়ে।
বইটি নিয়ে আমি এতই মুহ্যমান ছিলাম, একটা বড়সড় ‘গ্রন্থ সমালোচনা’ লিখে ফেলছিলাম ‘কালি ও কলমের’ জন্য।
এর পর থেকে নানা কাণ্ডে, কর্মে, অজুহাত এবং ছুতায় রেজাউর রহমানের সঙ্গে আমার সখ্য বাড়ে। আমরা ২০১৬ সাল থেকে রেজাউর রহমানকে বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রনমিকাল সোসাইটির সভাপতি করে জ্যোতির্বিজ্ঞানের আউটরিচ কর্মকাণ্ড চালাতে থাকি। তিনি আমৃত্যু এই সোসাইটির সভাপতি ছিলেন। স্যারের সঙ্গে অনেকবারই শকটে চড়ার এবং তাঁর সাথে দীর্ঘ আলোচনার সৌভাগ্য হয়েছিল। বই পড়ার ও সাহিত্যের আলোচনা করার সুযোগও হয়েছে। ২০২২ সাল থেকেই তিনি ক্রমে স্মৃতিভ্রষ্ট হচ্ছিলেন, চলাফেরাও কমিয়ে দিয়েছিলেন। ২০২৪ সালে বাংলা একাডেমি বিজ্ঞান সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। দীর্ঘজীবন বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখি ও কর্মকাণ্ডের এ এক স্মারক বিশেষ। আজ ২৬ অক্টোবর ২০২৫ রেজাউর রহমান গ্রহান্তরিত হলেন। প্রাণের রহস্য অনুসন্ধানের মশাল হস্তান্তরিত হল।
আমি আজীবন তাঁর সেই মৃদুভাষ্য, স্বল্পদীর্ঘ বাক্য আর অমায়িক ব্যক্তিত্বের সমাদর করব। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা।
লেখক: অধ্যাপক, তড়িৎকৌশল ও ইলেকট্রনিকস, বুয়েট