leadT1ad

জাতীয় পার্টির ‘লাঙ্গল’ এখন কোন শস্য ফলাতে চায়?

সম্প্রতি জুলাই-পরবর্তী বংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জাতীয় পার্টি আবারও এক অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়া দলটি এখন নিজেদের প্রতীক “লাঙ্গল” নিয়েই টানাটানিতে ব্যস্ত। এই ভাঙ্গন কেবল নেতৃত্বের সংঘাত নয়, বরং দলটির দীর্ঘদিনের আদর্শিক সংকট এবং রাজনৈতিক কৌশলের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। প্রশ্ন উঠেছে, জাতীয় পার্টির এই লাঙ্গল আগামী দিনে আসলে কোন শস্য ফলাতে চায়? স্বাধীন রাজনীতির ফসল, নাকি আবারও কোনো ক্ষমতাসীন বলয়ের আশ্রয়ে থেকে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট ভোগ?

মো. শফিকুল ইসলাম
মো. শফিকুল ইসলাম

প্রকাশ : ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ১৭: ৪৫
স্ট্রিম গ্রাফিক

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জাতীয় পার্টি এক জটিল এবং বর্ণিল অধ্যায়। ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে জন্ম নেওয়া এই দলটি বারবার ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে, বারবারই মিত্রের ছায়াতলে গিয়ে নতুন সমীকরণ তৈরি করেছে। সম্প্রতি জুলাই-পরবর্তী পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দলটি আবারও এক অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়া দলটি এখন নিজেদের প্রতীক “লাঙ্গল” নিয়েই টানাটানিতে ব্যস্ত। এই ভাঙ্গন কেবল নেতৃত্বের সংঘাত নয়, বরং দলটির দীর্ঘদিনের আদর্শিক সংকট এবং রাজনৈতিক কৌশলের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। প্রশ্ন উঠেছে, জাতীয় পার্টির এই লাঙ্গল আগামী দিনে আসলে কোন শস্য ফলাতে চায়? স্বাধীন রাজনীতির ফসল, নাকি আবারও কোনো ক্ষমতাসীন বলয়ের আশ্রয়ে থেকে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট ভোগ?

ভাঙ্গনের ঐতিহাসিক পরম্পরা ও আদর্শিক সংকট

জাতীয় পার্টির ভাঙ্গন কোনো নতুন ঘটনা নয়। ১৯৯০ সালে পতনের পর থেকেই দলটি বিভিন্ন সময়ে খণ্ড-বিখণ্ড হয়েছে। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু থেকে শুরু করে নাজিউর রহমান মঞ্জু, নানা সময়ে শীর্ষ নেতারা দল ছেড়ে নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছেন। সাম্প্রতিক বিভাজনটি সেই ধারাবাহিকতারই অংশ, যেখানে জিএম কাদের, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ-রুহুল আমিন হাওলাদার এবং জিয়াউদ্দিন বাবলুর অনুসারীরা পৃথক শিবিরে অবস্থান নিয়েছেন।

মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এই সখ্যতা জাতীয় পার্টিকে একটি স্বতন্ত্র শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে দেয়নি, বরং তাকে একটি সহযোগী বা আশ্রিত দলে পরিণত করেছে।

এই বারবার ভাঙ্গনের মূল কারণ অনুসন্ধান করলে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রথমত, একটি গভীর আদর্শিক শূন্যতা। জাতীয় পার্টি একটি সুনির্দিষ্ট ও অটল আদর্শের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেনি, যা তার নেতাকর্মীদের একসূত্রে গেঁথে রাখতে পারে। দলের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য বা আদর্শিক বিশ্বাস না থাকায়, ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং ক্ষমতার সমীকরণই নেতাদের জন্য মুখ্য হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সুবিধাবাদী আঁতাত। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বা ক্ষমতার অংশীদার হতে দলটি বিভিন্ন সরকারের সঙ্গে জোট করেছে। এই আঁতাতগুলো যখন নেতাদের ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়, তখনই সৃষ্টি হয় দ্বন্দ্ব, যা শেষ পর্যন্ত ভাঙ্গনে রূপ নেয়। মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এই সখ্যতা জাতীয় পার্টিকে একটি স্বতন্ত্র শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে দেয়নি, বরং তাকে একটি সহযোগী বা আশ্রিত দলে পরিণত করেছে।

“সহযোগী” তকমা এবং স্বতন্ত্র পরিচয়ের চ্যালেঞ্জ

বিগত বছরগুলোতে জাতীয় পার্টির গায়ে “আওয়ামী লীগের সহযোগী” বা “গৃহপালিত বিরোধী দল”-এর যে তকমা লেগেছে, তা দলটির রাজনৈতিক ভাবমূর্তিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এই পরিচয় থেকে বেরিয়ে আসাটাই এখন তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে পরিবর্তনের হাওয়া বইছে, সেই প্রেক্ষাপটে টিকে থাকতে হলে জাতীয় পার্টিকে তার অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হবে।

এত সংকট সত্ত্বেও, জুলাই-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির একটি কৌশলগত প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। আগামী নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক এবং বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।

দলটিকে যদি একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে হয়, তবে কয়েকটি মৌলিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। প্রথমত, গণতান্ত্রিক পন্থায় নেতৃত্ব নির্বাচন এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন করা। দ্বিতীয়ত, জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনার সঙ্গে সংগতি রেখে একটি স্বচ্ছ রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে, যা দেশের মানুষ এবং গণতন্ত্রের স্বার্থকে প্রাধান্য দেবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আওয়ামী লীগ বা অন্য কোনো দলের “লেজুড়বৃত্তি” করবে না—এই বিশ্বাস জনগণের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করা। ফ্যাসিবাদী শাসনের সহযোগী হিসেবে যে কালিমা তাদের গায়ে লেগেছে, তা মোচনের জন্য স্বাধীন এবং বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করা ছাড়া বিকল্প নেই।

জুলাই-পরবর্তী রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির প্রাসঙ্গিকতা

এত সংকট সত্ত্বেও, জুলাই-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির একটি কৌশলগত প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। আগামী নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক এবং বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। যেহেতু দেশের অন্যতম প্রধান দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না, সেহেতু জাতীয় পার্টির মতো একটি প্রতিষ্ঠিত দলের অংশগ্রহণ নির্বাচনকে একপেশে হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে। এটি নির্বাচন কমিশন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্যও একটি স্বস্তির কারণ হতে পারে, কারণ এর মাধ্যমে তারা প্রমাণ করার সুযোগ পাবে যে নির্বাচনটি কেবল আওয়ামী-বিরোধী দলগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।

জাতীয় পার্টিকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা কেবল ক্ষমতার ভাগাভাগির জন্য রাজনীতি করে না, বরং দেশের মানুষের জন্য তাদের একটি স্বতন্ত্র পরিকল্পনা ও আদর্শ রয়েছে।

এই অংশগ্রহণমূলক আবহ তৈরি করার ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টি একটি অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে, যা তাদের দর-কষাকষির সামর্থ্যও কিছুটা বাড়াবে।

লাঙ্গলের চালক এবং আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক

আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির লাঙ্গল কোন ফসল ফলাবে, তা নির্ভর করবে চালকের ভূমিকার ওপর। একটি মজার কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে তাদের বিশাল ভোটব্যাংকের দিকে কি জাতীয় পার্টি হাত বাড়াবে? সত্যি হলো, আওয়ামী লীগ তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বিবেচনায় রেখেই কৌশল নির্ধারণ করবে। তারা অন্ধভাবে জাতীয় পার্টিকে সমর্থন দেবে না। বরং যে দলকে বা প্রার্থীকে সমর্থন দিলে তাদের রাজনীতিতে ফিরে আসার পথ সুগম হবে এবং নেতাকর্মীদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সম্ভাবনা তৈরি হবে, আওয়ামী লীগের সমর্থন সেদিকেই যাবে। এটি একটি অত্যন্ত হিসেবি রাজনৈতিক চাল হবে।

লাঙ্গল দিয়ে তারা কি গণতন্ত্রের নতুন শস্য ফলাবে, নাকি পুরনো আগাছাই জন্ম দেবে—তার উত্তর সময়ই বলে দেবে।

জাতীয় পার্টি যদি সেই ভোটব্যাংককে কাছে টানতে চায়, তবে তাদের আওয়ামী লীগের স্বার্থ দেখতে হবে, যা প্রকারান্তরে তাদের পুরনো “সহযোগী” পরিচয়ে ফিরিয়ে নেওয়ার ঝুঁকি তৈরি করবে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা: টিকে থাকা নাকি বিলীন হওয়া?

শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তাদের নিজেদের সিদ্ধান্তের ওপর। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মতো দুই প্রধান রাজনৈতিক শক্তির মাঝে চাপা পড়ে দলটির ভোটব্যাংক ক্রমশ সংকুচিত হয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে তাদের একটি “বিকল্প ন্যারেটিভ” বা বিকল্প রাজনৈতিক বয়ান তৈরি করতে হবে। দেশের মানুষ কেন বিএনপি বা অন্য দল বাদ দিয়ে জাতীয় পার্টিকে বেছে নেবে, তার একটি যৌক্তিক ও আকর্ষণীয় ব্যাখ্যা তাদের দিতে হবে।

জাতীয় পার্টিকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা কেবল ক্ষমতার ভাগাভাগির জন্য রাজনীতি করে না, বরং দেশের মানুষের জন্য তাদের একটি স্বতন্ত্র পরিকল্পনা ও আদর্শ রয়েছে। যদি তারা একটি মধ্যমপন্থী, গণতান্ত্রিক এবং স্বাধীন দল হিসেবে নিজেদের পুনর্গঠন করতে পারে, তাহলে হয়তো রাজনীতিতে টিকে থাকতে পারবে। অন্যথায়, বারবার ভাঙ্গন এবং সুবিধাবাদী রাজনীতির চক্রে পড়ে দলটি ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। লাঙ্গল দিয়ে তারা কি গণতন্ত্রের নতুন শস্য ফলাবে, নাকি পুরনো আগাছাই জন্ম দেবে—তার উত্তর সময়ই বলে দেবে।

লেখক : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক

Ad 300x250

সম্পর্কিত