leadT1ad

চীন-বাংলাদেশ সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি ও মার্কিন উদ্বেগ

বিমানবাহিনীর আধুনিকায়নের লক্ষ্যে চীন থেকে আনুমানিক ২.২ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ২০টি জে-১০সি মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান কেনার পরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ। এই উদ্যোগ দেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বৃদ্ধির একটি পদক্ষেপ হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান সামরিক ঘনিষ্ঠতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এমনকি বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক ঢাকার জন্য ইতিবাচক কিনা সে প্রশ্নও তোলা হয়েছে। এ নিবন্ধে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এবং এর সঙ্গে জড়িত ভূ-রাজনৈতিক বিষয়গুলো উপস্থাপন করা হয়েছে।

মুজাহিদুল ইসলাম
মুজাহিদুল ইসলাম

স্ট্রিম গ্রাফিক

বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা কয়েক দশকের পুরনো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা আরও গভীর হয়েছে। ১৯৭৫ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকেই চীন বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিকীকরণে সহায়তা করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চীনা ট্যাংক, নৌবাহিনীতে ফ্রিগেট ও ক্ষেপণাস্ত্র বোট এবং বিমানবাহিনীতে যুদ্ধবিমান যুক্ত হয়েছে। ২০০২ সালে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত "প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি" এই সম্পর্ককে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়, যার আওতায় সামরিক প্রশিক্ষণ ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর জন্য ২০টি চীনা জে-১০সি যুদ্ধবিমান কেনার সাম্প্রতিক উদ্যোগ এই প্রতিরক্ষা সম্পর্ককে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ৪.৫ প্রজন্মের যুদ্ধবিমানগুলো বিমানবাহিনীর পুরোনো এফ-৭ বিমানগুলোকে প্রতিস্থাপন করবে এবং বাহিনীর আধুনিকায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। 'ফোর্সেস গোল ২০৩০'-এর অধীনে সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিকায়নের যে পরিকল্পনা বাংলাদেশ সরকার নিয়েছে, এই পদক্ষেপ তারই অংশ। আশা করা হচ্ছে, যুদ্ধবিমানগুলো বাংলাদেশের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরে দেশের সামুদ্রিক অঞ্চলের সুরক্ষায় সক্ষমতা বাড়াবে।

এই সম্পর্ক ইঙ্গিত দেয় যে, বাংলাদেশ তার প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের জন্য কোনো একক দেশের ওপর নির্ভরশীল না থেকে একটি ভারসাম্যমূলক নীতি অনুসরণ করতে চাইছে। চীনের কাছ থেকে উন্নত প্রযুক্তি ও সামরিক সরঞ্জাম তুলনামূলকভাবে কম খরচে এবং কোনো কঠোর শর্ত ছাড়াই পাওয়া বাংলাদেশের জন্য একটি বড় আকর্ষণ। আর তা বাংলাদেশের কৌশলগত শক্তি অর্জনের আকাঙ্ক্ষারও প্রতীক।

বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

বর্তমানে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে একটি ‘কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্ব’ বিদ্যমান, যা ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরের সময় আনুষ্ঠানিক রূপ পায়। এই সম্পর্ক শুধু সামরিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং অর্থনীতি, বাণিজ্য ও অবকাঠামো উন্নয়নেও বিস্তৃত। চীন বর্তমানে বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার এবং অন্যতম প্রধান বিনিয়োগকারী দেশ। বিনিয়োগের উৎসও। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৭.৩৫ বিলিয়ন ডলার।

চীনের 'বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ' (বিআরআই)-এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, কর্ণফুলী টানেল, পায়রা বন্দর এবং বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পে চীনা বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। এই প্রকল্পগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সম্প্রতি দুই দেশের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নিয়েও আলোচনা চলছে, যা কার্যকর হলে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।

ভবিষ্যতে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক আরও গভীর হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি ও কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান চীনের জন্য আকর্ষণীয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য চীনের বিনিয়োগ, প্রযুক্তি ও বাজার সুবিধা প্রয়োজন।

আগামী এক দশকের মধ্যে একটি উন্নত দেশে রূপান্তরিত হওয়ার যে লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ এগোতে চাইছে, তা অর্জনে চীন একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হতে পারে। তবে এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাণিজ্য ঘাটতি এবং উন্নয়ন প্রকল্পের স্বচ্ছতার মতো কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে, যা মোকাবেলা করা প্রয়োজন।

চীনের সঙ্গে সামরিক সম্পর্কের ঝুঁকি

চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের এই ক্রমবর্ধমান সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে মনোনীত বেন্ট ক্রিস্টেনসেন সম্প্রতি মার্কিন সিনেটের শুনানিতে বলেছেন, তিনি দায়িত্ব পেলে চীনের সঙ্গে সামরিক সম্পর্কের ঝুঁকিগুলো নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করবেন। তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব, বিশেষ করে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা এবং গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে চীনা সম্পৃক্ততার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

এই উদ্বেগের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য বেশ কিছু ঝুঁকি দৃশ্যমান:

ভূ-রাজনৈতিক চাপ: যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ একটি চাপের মধ্যে পড়তে পারে। ওয়াশিংটন চায় না, বাংলাদেশ চীনের প্রভাব বলয়ে পুরোপুরি ঢুকে পড়ুক। চীনের কাছ থেকে বড় ধরনের সামরিক সরঞ্জাম কেনা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে অস্বস্তি তৈরি করতে পারে।

অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার ঝুঁকি: প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের জন্য একটিমাত্র দেশের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা কৌশলগতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। ভবিষ্যতে যদি চীন কোনো কারণে সহায়তা বন্ধ করে দেয় বা ভূ-রাজনৈতিক চাপে পিছু হটে, তবে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা সংকটে পড়তে পারে।

আঞ্চলিক উদ্বেগ: বাংলাদেশের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রতিবেশী দেশ ভারতের জন্যও একটি উদ্বেগের কারণ হতে পারে। যদিও বাংলাদেশ বরাবরই বলে আসছে যে তার সামরিক প্রস্তুতি কোনো নির্দিষ্ট দেশকে লক্ষ্য করে নয়, বরং আত্মরক্ষার জন্য। তবে ভারত এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব বৃদ্ধিকে সন্দেহের চোখে দেখে।

ঋণের ফাঁদের আশঙ্কা: যদিও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য সহায়ক, তবে কিছু বিশ্লেষক অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর জন্য নেওয়া ঋণের বিষয়ে ‘ঋণের ফাঁদে’র আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, যা শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতার আলোকে একটি বিবেচনার বিষয়।

তবে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি হলো ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’। এই নীতির আলোকে বাংলাদেশ সবসময়ই একটি ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি বজায় রাখার চেষ্টা করে। চীনের সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক এই নীতিরই একটি প্রতিফলন, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ তার জাতীয় স্বার্থকে সমুন্নত রাখতে চায়।

পরিশেষে

চীনের সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য একদিকে যেমন প্রতিরক্ষা সক্ষমতা ও কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন অর্জনের একটি সুযোগ, তেমনই অন্যদিকে এটি জটিল ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি করছে। জে-১০সি যুদ্ধবিমান কেনার সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও আত্মরক্ষার অধিকারের প্রতীক। তবে এর ফলে সৃষ্ট ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করা বাংলাদেশের কূটনীতির জন্য একটি বড় পরীক্ষা হবে। জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের মতো প্রধান শক্তিগুলোর সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার দক্ষতার ওপরই নির্ভর করবে এই পদক্ষেপটি বাংলাদেশের জন্য কতটা ফলপ্রসূ হবে।

লেখক: সাংবাদিক

Ad 300x250

সম্পর্কিত