leadT1ad

শহুরে মধ্যবিত্তরা যে কারণে ‘প্রাণীপ্রেমী’ হয়ে উঠল

সেঁজুতি মাসুদ
সেঁজুতি মাসুদ

স্ট্রিম গ্রাফিক

কিছুদিন আগে ফেসবুকে ভাইরাল হয় একটি খবর। পাবনার ঈশ্বরদীতে সদ্যজাত আটটি কুকুরছানা বস্তায় ভরে পুকুরে ফেলে মেরে ফেলার অভিযোগে নেটিজেনদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। আরও কিছুদিন আগে গ্রামীণ ফোনের এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তাঁর আশ্রিত বিড়ালকে নিচে ফেলে দিয়ে আহত করার প্রতিবাদ করেন এক তরুণী। সেটি নিয়েও স্যোশাল মিডিয়ায় বেশ তোলপাড় হয়।

এগুলো গেল সামাজিকমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া গল্প। এর বাইরে আরও অনেক গল্প আছে। যেমন একজনের কথা ধরা যাক। তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উঁচু পদে আছেন, সুযোগ পেলেই গাড়ি ভর্তি খাবার নিয়ে ছুটে যান মোহাম্মদপুরের এক গলিতে। সেখানে তাঁর অপেক্ষায় থাকে এলাকার একদল কুকুর। কোভিড–১৯ মহামারির সময় যখন পুরো পৃথিবী এই প্রাণীগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, তখন প্রতিদিন মাস্ক পরে তিনি তাদের খাবার দিয়ে আসতেন। ওই এলাকার কুকুরগুলো আজও তাঁর নিত্য সঙ্গী।

পোষা প্রাণী একসময় আভিজাত্যের প্রতীক ছিল। অর্থবানদের জন্য কুকুর মানেই এলসেশিয়ান, জার্মান শেফার্ড বা পুডল। এদের অনেক প্রজাতি দারোয়ানের তত্ত্বাবধানে থাকত এবং তাদের প্রতিদিন মাংস খেতে দিতে হতো। কেউ কেউ অল্প সময়ের জন্য গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রীর কোলে খেলত। এক্ষেত্রে মানসিক আদান–প্রদানের চেয়ে ‘স্ট্যাটাস সিম্বল’ রক্ষা করাটাই বেশি গুরুত্ব পেত।

কিন্তু ইদানিং বাংলাদেশের পশুপ্রেমী মানুষের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো। পাড়ায়–মহল্লায় এখন পথকুকুর বা বিড়ালদের দেখাশোনা করার জন্য কাজ করছে বিভিন্ন ভলান্টিয়ার গ্রুপ। এদের খাবার, ভ্যাকসিন এবং নিরাপদ শোওয়ার জায়গার জন্য প্রচারণায় নামছেন অনেকে।

সারাদিনের কাজের চাপ শেষে ঘরে ফিরে অনেকে চাইলেও বন্ধু বা স্বজনের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ পায় না। ঠিক সেই সময়টায় পোষা প্রাণীটির একটু গা ঘেঁষে বসলে, মৃদু লেজ নেড়ে কিংবা চোখ তুলে নিজের উপস্থিতি জানান দিলে, এক ধরণের নিরব প্রশান্তি কাজ করে।

কখনোবা মোটা চটের ব্যাগ হাতে শীতে বা বৃষ্টিতে কুকুরদের বাঁচাতে চেষ্টা করছেন। বিভিন্ন সেলিব্রেটি এবং ইনফ্লুয়েন্সারদেরও এর অংশ হতে দেখা যাচ্ছে। পশুপাখির প্রতি মানবিক আচরণ করা নিয়ে এখন অনেকেই সোচ্চার। দেশের প্রাণিসম্পদ বিভাগ আর প্রাণী অধিকার নিয়ে সরকারিভাবে কাজ করেন তাদেরকেও আগের তুলনায় সক্রিয় বলে মনে হচ্ছে।

আজকাল উচ্চবিত্তদের পাশাপাশি মধ্যবিত্তরাও দেশি, বিদেশি বা হাইব্রিড বিড়াল–কুকুর কিনে পালতে আগ্রহী হচ্ছেন। এমনকি পোষা প্রাণীর পেছনে বেশ বড় অঙ্কের টাকা খরচ করতেও পিছপা হচ্ছেন না। বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বাড়িতে পোষা প্রাণী রাখা আগে শুধু অভিজাত শ্রেণির অভ্যাস হলেও শহরের বাইরের চিত্রটা বরাবরই ভিন্ন। খোলা জায়গা থাকায় গ্রামবাংলায় বিড়াল–কুকুর পালা বহুদিন ধরেই স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে দেখা হয়েছে।

তবে সেসব পশুপাখির যত্নআত্তির সঙ্গে এখনকার ট্রেন্ডের পার্থক্যটা লক্ষণীয়। সেই সময় পাত থেকে মাছের কাটা বা দুধ খেয়েই খুশি থাকত বাড়ির বিড়াল–কুকুর। কিন্তু এখন প্রাণী পুষতে খরচ প্রায় মানব শিশুর মতো—আলাদা খাবার, লিটার বক্স, প্রসাধনী; একই সঙ্গে ভ্যাকসিনেশন এবং নিয়ম করে খাবার–ঘুমের খোঁজ রাখা। সময় ও অর্থ—দুই দিক থেকেই ব্যয়বহুল।

গত পাঁচ বছরে, বিশেষ করে কোভিড–১৯ মহামারির পর থেকে পাড়ায় পাড়ায় বিড়াল বা কুকুর পোষার প্রবণতা বেশ বেড়েছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় এর পিছনে নানা কারণ উঠে এসেছে। যেমন ‘নেচার’-এর ২০২৫ সালের উপাত্ত অনুযায়ী, কুকুর বা বিড়াল মানুষকে সঙ্গ দেয়, যা মানসিকভাবে মানুষকে সতেজ রাখে, যা আভিজাত্য প্রদর্শনের চেয়েও বড় কারণ। ‘সায়েন্সডিরেক্ট’-এ প্রকাশিত বেশ কয়েকটি জার্নালে এই তথ্য উঠে এসেছে যে সামাজিকভাবে, একই সঙ্গে ব্যক্তি জীবনে কুকুর বা বিড়াল পালার যে উপকারিতা, সে তুলনায় এদের পেছনে খরচের পরিমাণটিকে কেউ তেমন বড় করে দেখেন না।

অনেক পরিবারে আজকাল মাইক্রো ফ্যামিলির ধারণা চলে এসেছে। বিশেষ করে কর্মজীবী বাবা–মাকে দেখা যায় একটি সন্তানের বেশি থাকে না। সন্তানের নিঃসঙ্গতা কাটাতে এবং মানবিক গুণ শেখানোর জন্য তাঁরা তখন বাড়িতে বিড়াল বা পাখি নিয়ে আসেন।

যেমন সাদিয়ার (ছদ্মনাম) কথা ধরা যাক। সাদিয়া বাড়িতে টুইঙ্কেল নামে একটি বিড়ালছানা এনেছিলেন তাঁর দশ বছরের মেয়েটির মানসিক একাকিত্ব দূর করার জন্য। মূলত এক প্রতিবেশীর পরামর্শে তাঁরা বিড়াল পালার সিদ্ধান্ত নেন। তারপর আসে সঙ্গী বিড়াল টাইগার, এবং এক বছরের মধ্যে ৩–৪টি ছানাপোনা—রীতিমতো বিড়ালবিশেষজ্ঞ বনে যান তিনি।

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ফেসবুকে অনেকেই আজকাল নিজেকে ‘বিড়ালের মা’ হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। সোশ্যাল মিডিয়া এ ক্ষেত্রে সম্ভবত বড় একটি ভূমিকা রেখেছে। বিভিন্ন বয়সের নারী–পুরুষ যখন পোষা প্রাণীদের সঙ্গে নিজের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের ছবি ও ভিডিও শেয়ার করছেন, তখন দেখে অন্যরাও এই অভিজ্ঞতা নিতে উৎসাহ বোধ করছেন।

শহুরে জীবনে মানুষের সঙ্গে মানুষের দূরত্ব প্রতিনিয়তই বাড়ছে। ব্যস্ততা, অবসর সময়ের অভাব এবং ফ্ল্যাট সংস্কৃতির চাপে ব্যক্তিজীবন ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে নিঃসঙ্গ। সারাদিনের কাজের চাপ শেষে ঘরে ফিরে অনেকে চাইলেও বন্ধু বা স্বজনের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ পায় না। ঠিক সেই সময়টায় পোষা প্রাণীটির একটু গা ঘেঁষে বসলে, মৃদু লেজ নেড়ে কিংবা চোখ তুলে নিজের উপস্থিতি জানান দিলে, এক ধরণের নিরব প্রশান্তি কাজ করে। কিছুক্ষণের জন্য হলেও একঘেয়ে জীবনের ক্লান্তি ভুলে থাকা যায়। মানুষের সঙ্গে প্রাণীর এই নীরব সখ্য যেন মানসিক শান্তির এক ছোট্ট আশ্রয়—যেখানে ভাষা নয়, মমতাই হয়ে ওঠে সবচেয়ে বড় বন্ধন।

লেখক: গবেষক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ

Ad 300x250

সম্পর্কিত