স্ট্রিম ডেস্ক

স্লাভয় জিজেক আধুনিক বিশ্বের অন্যতম আলোচিত দার্শনিক। উদারনৈতিক পুঁজিবাদী সমাজে মানবাধিকারের যে ধারণা প্রবলভাবে প্রচলিত, জিজেক তার মূলে আঘাত হেনেছেন। তাঁর মতে, মানবাধিকারের আবেদনগুলো সমস্যার সমাধান নয়, তা বরং দুনিয়াতে বিদ্যমান বৈষম্য, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং বৈশ্বিক পুঁজিবাদের কাঠামোকে আড়াল করবার এক মতাদর্শগত কৌশল।
জিজেক দেখান যে, মানবাধিকারের আবেদন সাধারণত তিনটি ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত: ১. এটি গোঁড়ামির বিপরীতে কাজ করে; ২. এটি পছন্দের স্বাধীনতা এবং ভোগ-সুখের অধিকার নিশ্চিত করে; এবং ৩. এটি ক্ষমতার বাড়াবাড়ি থেকে প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করে। জিজেক এই তিনটি ভিত্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।
জিজেকের মতে, যখন উদারপন্থীরা বিশ্বজুড়ে 'গোঁড়ামি' (যেমন—ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, জাতিগত হিংসা) খুঁজে বেড়ায়, তখন সেই 'অশুভ' শক্তি প্রায়শই তাদের নিজেদের দেখার ভঙ্গি বা মতাদর্শিক দৃষ্টিকোণেই নিহিত থাকে। এই প্রসঙ্গে তিনি বলকান ট্রাজেডির কথা উল্লেখ করেছেন। ‘বলকান ট্রাজেডি’ বলতে বোঝানো হয় তুরস্কের হাতে ঘটানো আর্মেনিয়ার গণহত্যা আর পরে ১৯৯০-এর দশকে যুগোস্লাভিয়া ভেঙে যাওয়ার পরে সৃষ্ট জাতিগত সংঘাত, যুদ্ধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো।
জিজেক ১৯৯০-এর দশকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য কুখ্যাত বলকান অঞ্চলের উদাহরণ দেন। তিনি প্রশ্ন করেন: দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের একটি ভৌগোলিক অঞ্চল কখন 'বলকান'-এ পরিণত হলো—যা আজকের ইউরোপীয় ধারণায় জাতিগত বিদ্বেষ ও হিংসার প্রতীক? উত্তরটি হলো: ১৯ শতকের মাঝামাঝি, যখন ইউরোপীয় আধুনিকীকরণ পুরোপুরি বলকান অঞ্চলে প্রবেশ করে।
মধ্যযুগীয় ইউরোপীয়দের ধারণার সাথে আধুনিক ইউরোপীয় ধারণার বৈসাদৃশ্য চোখে পড়ার মতো। ১৬ শতকেই ফরাসি প্রকৃতিবিদ পিয়ের বেলন লিখেছিলেন যে, "তুর্কিরা কাউকে তুর্কির মতো জীবনযাপন করতে বাধ্য করে না।" এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, ১৪৯২ সালে ফার্ডিন্যান্ড ও ইসাবেলা স্পেন থেকে ইহুদিদের বিতাড়িত করার পর বহু ইহুদি আশ্রয় ও ধর্মীয় স্বাধীনতা পেয়েছিল তুর্কি ও অন্যান্য মুসলিম দেশে।
জিজেক প্রাসঙ্গিকভাবে এক ইতালীয় পর্যটক এন. বিসানির ১৭৮৮ সালের ইস্তাম্বুল সফরের বিবরণ তুলে ধরেন:
‘লন্ডন ও প্যারিসের অসহিষ্ণুতা দেখে অভ্যস্থ কোন মানুষ এখানে মসজিদ ও সিনাগগের মাঝে একটি চার্চ আর একজন দরবেশের পাশে একজন খৃষ্টাণ সন্ন্যাসীকে দেখে অবাক হবেন। আমি বুঝতে পারি না এই সরকার কীভাবে এর নিজ ধর্মের সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মগুলোকে নিজেদের বুকে স্থান দিয়েছে! ... আরও বিস্ময়কর হলো, সহনশীলতার এই মনোভাব সাধারণ মানুষের মধ্যেও আছে। এখানে আপনি তুর্কি, ইহুদি, ক্যাথলিক, আর্মেনীয়, গ্রীক এবং প্রোটেস্ট্যান্টদের ব্যবসা বা বিনোদন নিয়ে এমন সৌহার্দ্য নিয়ে আলোচনা করতে দেখবেন, যেন তারা একই দেশ ও ধর্মের মানুষ।’
অর্থাৎ, পশ্চিম আজ যে বহুসাংস্কৃতিক সহনশীলতাকে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক হিসেবে জাহির করে বেড়ায়, ১৮ শতকে তা উল্টো ইসলামের 'ক্ষয়' বা 'অবক্ষয়' হিসেবে খারিজ করা হয়েছিল। নেপোলিয়ন শাসনে ফ্রান্স থেকে বিতাড়িত কিছু সন্ন্যাসীর কথা উল্লেখ করে জিজেক বলেন, কোনো খ্রিস্টান রাষ্ট্র তাদের আশ্রয় না দেওয়ায় তারা তুর্কি সুলতানের অনুমতি নিয়ে আজকের বসনিয়ার সার্ব অংশে বসবাস শুরু করেন। খ্রিস্টানরা বলকান অঞ্চলে নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার আগত পর্যন্ত তারা সেখানে শান্তিতেই ছিলেন।
জিজেক এর পর একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোলেন। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, জাতিগত সহিংসতা কোথায় জন্মালো? স্পষ্টতই, পশ্চিমের নিজস্ব ইতিহাসের মধ্যেই এর জন্ম। হেগেলের 'রিফ্লেক্সিভ ডিটারমিনেশন' তত্ত্বের এক চমৎকার উদাহরণ এটি। তত্ত্বটি বলে যে, যখন একটি সমাজ অন্য কোনো সমাজকে খারাপ বা গোঁড়া হিসেবে বিচার করে, তখন সেই বিচার আসলে নিজেদেরই ভেতরের চাপা পড়া সহিংসতা বা ত্রুটির প্রতিফলন মাত্র। অর্থাৎ, যা দেখি, তা কেবল বাইরের সমস্যা নয়, বরং আমার ভেতরেরই প্রতিচ্ছবি। পশ্চিম ইউরোপীয়রা তুর্কিদফের যেসব বৈশিষ্ট দেখছে ও নিন্দা করছে, তা মূলত তাদের নিজেদেরই চালু করা জিনিস। তারা যা দমন করছে, তা তাদের নিজস্ব ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারের বিপথগামী রূপ।
জিজেক মনে করিয়ে দেন, ২০ শতকে তুর্কিদের বিরুদ্ধে আরোপিত দুটি বড় জাতিগত অপরাধ—আর্মেনীয় গণহত্যা ও কুর্দিদের ওপর নিপীড়ন— কোনো ঐতিহ্যবাদী মুসলিম শক্তি দ্বারা ঘটানো হয়নি। বরং তুরস্ককে একটি ইউরোপীয় জাতি-রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাওয়া সামরিক আধুনিকীকরণবাদীরাই এসব ঘটিয়েছিল। ইউরোপ ‘বলকান’ নামক অপরের ছদ্মবেশে মূলত নিজের ভেতরের চাপা পড়া সহিংসতা ও স্ববিরোধিতার প্রতিফলন দেখছে।
স্লোভয় জিজেক মনে করেন, আজকের উদার পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় এক ধরনের অদ্ভুত চালাকি চলে। তিনি এই কৌশলকে 'পুনঃ-প্রাকৃতিকীকরণ' (রি-নেচারাইলেশন) নাম দিয়েছেন। এর সহজ অর্থ হলো, সমাজে যে সমস্যাগুলো তৈরি হচ্ছে সেগুলোকে 'রাজনীতি' বা 'অর্থনীতির ফল' হিসেবে না দেখে, কেবল 'মানুষের জন্মগত স্বভাব' বা 'ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়' বলে প্রচার করা।
এই প্রক্রিয়ায় জনগণের জীবনের বাস্তব বড় বড় সমস্যাগুলো থেকে তাদের নজর সরে যায়। বর্তমানে সামাজিক অস্থিরতা, জাতিগত সংঘাত বা অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মতো গুরুত্বপূর্ণ জনজীবনের সমস্যাগুলো আর রাজনৈতিক বিতর্কের বিষয় থাকে না। এই সমস্যাগুলোকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয় মানুষের ব্যক্তিগত মনোভাব বা অভ্যাস হিসেবে।
যখন কোনো জাতিগত বা ধর্মীয় সংঘাত দেখা দেয়, তখন সম্পদের অভাব, ক্ষমতা ভাগাভাগির মতো মূল কারণগুলো নিয়ে আলোচনা না করে, বলা হয় যে এগুলো হলো মানুষের 'স্বাভাবিক' বা 'ঐতিহ্যগত' সমস্যা। এগুলো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।
এই প্রচারণার মধ্যে একটি গভীর মিথ্যাচার লুকিয়ে আছে। জাতিগত পরিচয়, ধর্মীয় বিশ্বাসের মতো বৈশিষ্ট্যগুলো ইতিহাস ও সমাজের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়। কিন্তু উদার গণতন্ত্র মিথ্যাভাবে প্রচার করে যে এগুলো হলো ব্যক্তির 'জন্মগত' বা 'সম্পূর্ণ নিজস্ব ইচ্ছা' বা 'পছন্দ'।
জিজেকের দাবি, বিশ্ব পুঁজিবাদের জন্য এই ছদ্ম-প্রাকৃতিকীকৃত জাতিগত-ধর্মীয় সংঘাতই সবচেয়ে সুবিধাজনক। কারণ, যখন সাধারণ মানুষ নিজেদের মধ্যে ধর্ম বা জাত নিয়ে মারামারি করে, তখন তারা ভুলে যায় যে আসল শোষণ আসছে সেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বা ক্ষমতা কাঠামোর কাছ থেকে। এভাবেই উদার গণতন্ত্র জনগণকে বড় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যা থেকে চোখ সরিয়ে, ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত বা জাতিগত ঝগড়ায় ব্যস্ত রাখে।
জিজেক প্রশ্ন তোলেন: মানবাধিকারের নামে আমরা যে 'বেছে নেয়ার স্বাধীনতা' ভোগ করি, তা কি সত্যিই মুক্ত? নাকি এটি এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত কৌশল?
ধরুন, একটি লোককে বলা হলো, ‘এই নাও স্বাধীনতা। এখন তুমি মুক্ত, তোমার চাকরিও নেই। কিন্তু ভয় নেই! তুমি বেকার নও, বরং তোমার সামনে এখন নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করার সুযোগ!’ অথবা, যখন জীবনের মৌলিক নিরাপত্তা (যেমন চিকিৎসা, পেনশন) চলে যায়, তখন বাজার ফিসফিস করে বলে, ‘চিন্তা কী! আপনি এখন নিজের মতো করে জীবন বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা পেয়েছেন। আপনি নিজেই ঠিক করুন, কীভাবে বাঁচবেন!’
জিজেক বলেন, এটা হলো এক ধরনের ছলনা। পুঁজিবাদ প্রথমে নিরাপত্তা কেড়ে নিয়ে মানুষকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়। আর তারপর সেই অনিরাপত্তাটিকেই 'নতুন স্বাধীনতা' হিসেবে বিক্রি করে।
এই সমাজে স্বাধীনতা তখনই মেলে, যখন আপনি আপনার জীবনবোধকে ব্যক্তিগত খেয়াল হিসেবে লুকিয়ে রাখেন। কিন্তু যখনই আপনি সমাজের চোখে সত্য বলে বিবেচিত কোনো বিশ্বাসকে দৃঢ়ভাবে তুলে ধরেন, তখনই আপনার সেই স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়। জিজেকের মতে, এই 'পছন্দের স্বাধীনতা' হলো একটি সুন্দর মুখোশ, যা বাজারের চাপ ও সমাজের চাপিয়ে দেওয়া বাধ্যবাধকতাকে আড়াল করে রাখে।
মানবাধিকারের তৃতীয় ভিত্তি অর্থাৎ ‘ভোগের স্বাধীনতা’ এবং ‘ক্ষমতার বাড়াবাড়ি থেকে মুক্তি’—এই দুটি ধারণার মধ্যেই এক বড় ফাঁক রয়েছে।
ধরুন, পশ্চিমা সমাজ যখন নারীর পোশাক বা স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলে, তখন তারা জোর দেয় ‘ইচ্ছামতো উপভোগের অধিকার’-এর ওপর। কিন্তু জিজেক বলেন, এটাও এক ধরনের চাপ।
কোন মানুষ এই পুঁজিবাদী পশ্চিমা মডেলের প্রলোভনের খেলায় অংশ নিতে চান না চাইলে সেই সমাজের অস্বস্তি শুরু হয়। পশ্চিম তখন বলে, 'আমরা সহনশীল, তবে আপনার বিশ্বাস যদি খুব গভীর হয়, তবে তা আমাদের সমাজের জন্য বিপজ্জনক।'
আসলে, স্বাধীনতা তখনই মেলে, যখন মানুষ সমাজের চাপানো ভোগের নিয়মে নিজেকে প্রকাশ করে।
জিজেক বলতে চান যে, উদার সমাজের সহনশীলতা আসলে এক ধরনের শর্তযুক্ত দূরত্ব।
আমরা প্রতিবেশীকে সম্মান করি, কিন্তু তার মানে হলো—আমরা যেন তার জীবনযাত্রায় নাক না গলাই বা তার বেশি কাছাকাছি না যাই। উন্নত সমাজে এখন এটিই প্রধান অধিকার, ‘আমাকে বিরক্ত কোরো না’। অর্থাৎ, নিরাপদ দূরত্বে থাকার অধিকার। এই সহনশীলতা কাউকে কাছে টানে না, বরং মানুষকে আলাদা করে রাখে।

স্লাভয় জিজেক আধুনিক বিশ্বের অন্যতম আলোচিত দার্শনিক। উদারনৈতিক পুঁজিবাদী সমাজে মানবাধিকারের যে ধারণা প্রবলভাবে প্রচলিত, জিজেক তার মূলে আঘাত হেনেছেন। তাঁর মতে, মানবাধিকারের আবেদনগুলো সমস্যার সমাধান নয়, তা বরং দুনিয়াতে বিদ্যমান বৈষম্য, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং বৈশ্বিক পুঁজিবাদের কাঠামোকে আড়াল করবার এক মতাদর্শগত কৌশল।
জিজেক দেখান যে, মানবাধিকারের আবেদন সাধারণত তিনটি ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত: ১. এটি গোঁড়ামির বিপরীতে কাজ করে; ২. এটি পছন্দের স্বাধীনতা এবং ভোগ-সুখের অধিকার নিশ্চিত করে; এবং ৩. এটি ক্ষমতার বাড়াবাড়ি থেকে প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করে। জিজেক এই তিনটি ভিত্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।
জিজেকের মতে, যখন উদারপন্থীরা বিশ্বজুড়ে 'গোঁড়ামি' (যেমন—ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, জাতিগত হিংসা) খুঁজে বেড়ায়, তখন সেই 'অশুভ' শক্তি প্রায়শই তাদের নিজেদের দেখার ভঙ্গি বা মতাদর্শিক দৃষ্টিকোণেই নিহিত থাকে। এই প্রসঙ্গে তিনি বলকান ট্রাজেডির কথা উল্লেখ করেছেন। ‘বলকান ট্রাজেডি’ বলতে বোঝানো হয় তুরস্কের হাতে ঘটানো আর্মেনিয়ার গণহত্যা আর পরে ১৯৯০-এর দশকে যুগোস্লাভিয়া ভেঙে যাওয়ার পরে সৃষ্ট জাতিগত সংঘাত, যুদ্ধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো।
জিজেক ১৯৯০-এর দশকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য কুখ্যাত বলকান অঞ্চলের উদাহরণ দেন। তিনি প্রশ্ন করেন: দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের একটি ভৌগোলিক অঞ্চল কখন 'বলকান'-এ পরিণত হলো—যা আজকের ইউরোপীয় ধারণায় জাতিগত বিদ্বেষ ও হিংসার প্রতীক? উত্তরটি হলো: ১৯ শতকের মাঝামাঝি, যখন ইউরোপীয় আধুনিকীকরণ পুরোপুরি বলকান অঞ্চলে প্রবেশ করে।
মধ্যযুগীয় ইউরোপীয়দের ধারণার সাথে আধুনিক ইউরোপীয় ধারণার বৈসাদৃশ্য চোখে পড়ার মতো। ১৬ শতকেই ফরাসি প্রকৃতিবিদ পিয়ের বেলন লিখেছিলেন যে, "তুর্কিরা কাউকে তুর্কির মতো জীবনযাপন করতে বাধ্য করে না।" এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, ১৪৯২ সালে ফার্ডিন্যান্ড ও ইসাবেলা স্পেন থেকে ইহুদিদের বিতাড়িত করার পর বহু ইহুদি আশ্রয় ও ধর্মীয় স্বাধীনতা পেয়েছিল তুর্কি ও অন্যান্য মুসলিম দেশে।
জিজেক প্রাসঙ্গিকভাবে এক ইতালীয় পর্যটক এন. বিসানির ১৭৮৮ সালের ইস্তাম্বুল সফরের বিবরণ তুলে ধরেন:
‘লন্ডন ও প্যারিসের অসহিষ্ণুতা দেখে অভ্যস্থ কোন মানুষ এখানে মসজিদ ও সিনাগগের মাঝে একটি চার্চ আর একজন দরবেশের পাশে একজন খৃষ্টাণ সন্ন্যাসীকে দেখে অবাক হবেন। আমি বুঝতে পারি না এই সরকার কীভাবে এর নিজ ধর্মের সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মগুলোকে নিজেদের বুকে স্থান দিয়েছে! ... আরও বিস্ময়কর হলো, সহনশীলতার এই মনোভাব সাধারণ মানুষের মধ্যেও আছে। এখানে আপনি তুর্কি, ইহুদি, ক্যাথলিক, আর্মেনীয়, গ্রীক এবং প্রোটেস্ট্যান্টদের ব্যবসা বা বিনোদন নিয়ে এমন সৌহার্দ্য নিয়ে আলোচনা করতে দেখবেন, যেন তারা একই দেশ ও ধর্মের মানুষ।’
অর্থাৎ, পশ্চিম আজ যে বহুসাংস্কৃতিক সহনশীলতাকে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক হিসেবে জাহির করে বেড়ায়, ১৮ শতকে তা উল্টো ইসলামের 'ক্ষয়' বা 'অবক্ষয়' হিসেবে খারিজ করা হয়েছিল। নেপোলিয়ন শাসনে ফ্রান্স থেকে বিতাড়িত কিছু সন্ন্যাসীর কথা উল্লেখ করে জিজেক বলেন, কোনো খ্রিস্টান রাষ্ট্র তাদের আশ্রয় না দেওয়ায় তারা তুর্কি সুলতানের অনুমতি নিয়ে আজকের বসনিয়ার সার্ব অংশে বসবাস শুরু করেন। খ্রিস্টানরা বলকান অঞ্চলে নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার আগত পর্যন্ত তারা সেখানে শান্তিতেই ছিলেন।
জিজেক এর পর একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোলেন। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, জাতিগত সহিংসতা কোথায় জন্মালো? স্পষ্টতই, পশ্চিমের নিজস্ব ইতিহাসের মধ্যেই এর জন্ম। হেগেলের 'রিফ্লেক্সিভ ডিটারমিনেশন' তত্ত্বের এক চমৎকার উদাহরণ এটি। তত্ত্বটি বলে যে, যখন একটি সমাজ অন্য কোনো সমাজকে খারাপ বা গোঁড়া হিসেবে বিচার করে, তখন সেই বিচার আসলে নিজেদেরই ভেতরের চাপা পড়া সহিংসতা বা ত্রুটির প্রতিফলন মাত্র। অর্থাৎ, যা দেখি, তা কেবল বাইরের সমস্যা নয়, বরং আমার ভেতরেরই প্রতিচ্ছবি। পশ্চিম ইউরোপীয়রা তুর্কিদফের যেসব বৈশিষ্ট দেখছে ও নিন্দা করছে, তা মূলত তাদের নিজেদেরই চালু করা জিনিস। তারা যা দমন করছে, তা তাদের নিজস্ব ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারের বিপথগামী রূপ।
জিজেক মনে করিয়ে দেন, ২০ শতকে তুর্কিদের বিরুদ্ধে আরোপিত দুটি বড় জাতিগত অপরাধ—আর্মেনীয় গণহত্যা ও কুর্দিদের ওপর নিপীড়ন— কোনো ঐতিহ্যবাদী মুসলিম শক্তি দ্বারা ঘটানো হয়নি। বরং তুরস্ককে একটি ইউরোপীয় জাতি-রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাওয়া সামরিক আধুনিকীকরণবাদীরাই এসব ঘটিয়েছিল। ইউরোপ ‘বলকান’ নামক অপরের ছদ্মবেশে মূলত নিজের ভেতরের চাপা পড়া সহিংসতা ও স্ববিরোধিতার প্রতিফলন দেখছে।
স্লোভয় জিজেক মনে করেন, আজকের উদার পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় এক ধরনের অদ্ভুত চালাকি চলে। তিনি এই কৌশলকে 'পুনঃ-প্রাকৃতিকীকরণ' (রি-নেচারাইলেশন) নাম দিয়েছেন। এর সহজ অর্থ হলো, সমাজে যে সমস্যাগুলো তৈরি হচ্ছে সেগুলোকে 'রাজনীতি' বা 'অর্থনীতির ফল' হিসেবে না দেখে, কেবল 'মানুষের জন্মগত স্বভাব' বা 'ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়' বলে প্রচার করা।
এই প্রক্রিয়ায় জনগণের জীবনের বাস্তব বড় বড় সমস্যাগুলো থেকে তাদের নজর সরে যায়। বর্তমানে সামাজিক অস্থিরতা, জাতিগত সংঘাত বা অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মতো গুরুত্বপূর্ণ জনজীবনের সমস্যাগুলো আর রাজনৈতিক বিতর্কের বিষয় থাকে না। এই সমস্যাগুলোকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয় মানুষের ব্যক্তিগত মনোভাব বা অভ্যাস হিসেবে।
যখন কোনো জাতিগত বা ধর্মীয় সংঘাত দেখা দেয়, তখন সম্পদের অভাব, ক্ষমতা ভাগাভাগির মতো মূল কারণগুলো নিয়ে আলোচনা না করে, বলা হয় যে এগুলো হলো মানুষের 'স্বাভাবিক' বা 'ঐতিহ্যগত' সমস্যা। এগুলো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।
এই প্রচারণার মধ্যে একটি গভীর মিথ্যাচার লুকিয়ে আছে। জাতিগত পরিচয়, ধর্মীয় বিশ্বাসের মতো বৈশিষ্ট্যগুলো ইতিহাস ও সমাজের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়। কিন্তু উদার গণতন্ত্র মিথ্যাভাবে প্রচার করে যে এগুলো হলো ব্যক্তির 'জন্মগত' বা 'সম্পূর্ণ নিজস্ব ইচ্ছা' বা 'পছন্দ'।
জিজেকের দাবি, বিশ্ব পুঁজিবাদের জন্য এই ছদ্ম-প্রাকৃতিকীকৃত জাতিগত-ধর্মীয় সংঘাতই সবচেয়ে সুবিধাজনক। কারণ, যখন সাধারণ মানুষ নিজেদের মধ্যে ধর্ম বা জাত নিয়ে মারামারি করে, তখন তারা ভুলে যায় যে আসল শোষণ আসছে সেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বা ক্ষমতা কাঠামোর কাছ থেকে। এভাবেই উদার গণতন্ত্র জনগণকে বড় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যা থেকে চোখ সরিয়ে, ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত বা জাতিগত ঝগড়ায় ব্যস্ত রাখে।
জিজেক প্রশ্ন তোলেন: মানবাধিকারের নামে আমরা যে 'বেছে নেয়ার স্বাধীনতা' ভোগ করি, তা কি সত্যিই মুক্ত? নাকি এটি এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত কৌশল?
ধরুন, একটি লোককে বলা হলো, ‘এই নাও স্বাধীনতা। এখন তুমি মুক্ত, তোমার চাকরিও নেই। কিন্তু ভয় নেই! তুমি বেকার নও, বরং তোমার সামনে এখন নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করার সুযোগ!’ অথবা, যখন জীবনের মৌলিক নিরাপত্তা (যেমন চিকিৎসা, পেনশন) চলে যায়, তখন বাজার ফিসফিস করে বলে, ‘চিন্তা কী! আপনি এখন নিজের মতো করে জীবন বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা পেয়েছেন। আপনি নিজেই ঠিক করুন, কীভাবে বাঁচবেন!’
জিজেক বলেন, এটা হলো এক ধরনের ছলনা। পুঁজিবাদ প্রথমে নিরাপত্তা কেড়ে নিয়ে মানুষকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়। আর তারপর সেই অনিরাপত্তাটিকেই 'নতুন স্বাধীনতা' হিসেবে বিক্রি করে।
এই সমাজে স্বাধীনতা তখনই মেলে, যখন আপনি আপনার জীবনবোধকে ব্যক্তিগত খেয়াল হিসেবে লুকিয়ে রাখেন। কিন্তু যখনই আপনি সমাজের চোখে সত্য বলে বিবেচিত কোনো বিশ্বাসকে দৃঢ়ভাবে তুলে ধরেন, তখনই আপনার সেই স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়। জিজেকের মতে, এই 'পছন্দের স্বাধীনতা' হলো একটি সুন্দর মুখোশ, যা বাজারের চাপ ও সমাজের চাপিয়ে দেওয়া বাধ্যবাধকতাকে আড়াল করে রাখে।
মানবাধিকারের তৃতীয় ভিত্তি অর্থাৎ ‘ভোগের স্বাধীনতা’ এবং ‘ক্ষমতার বাড়াবাড়ি থেকে মুক্তি’—এই দুটি ধারণার মধ্যেই এক বড় ফাঁক রয়েছে।
ধরুন, পশ্চিমা সমাজ যখন নারীর পোশাক বা স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলে, তখন তারা জোর দেয় ‘ইচ্ছামতো উপভোগের অধিকার’-এর ওপর। কিন্তু জিজেক বলেন, এটাও এক ধরনের চাপ।
কোন মানুষ এই পুঁজিবাদী পশ্চিমা মডেলের প্রলোভনের খেলায় অংশ নিতে চান না চাইলে সেই সমাজের অস্বস্তি শুরু হয়। পশ্চিম তখন বলে, 'আমরা সহনশীল, তবে আপনার বিশ্বাস যদি খুব গভীর হয়, তবে তা আমাদের সমাজের জন্য বিপজ্জনক।'
আসলে, স্বাধীনতা তখনই মেলে, যখন মানুষ সমাজের চাপানো ভোগের নিয়মে নিজেকে প্রকাশ করে।
জিজেক বলতে চান যে, উদার সমাজের সহনশীলতা আসলে এক ধরনের শর্তযুক্ত দূরত্ব।
আমরা প্রতিবেশীকে সম্মান করি, কিন্তু তার মানে হলো—আমরা যেন তার জীবনযাত্রায় নাক না গলাই বা তার বেশি কাছাকাছি না যাই। উন্নত সমাজে এখন এটিই প্রধান অধিকার, ‘আমাকে বিরক্ত কোরো না’। অর্থাৎ, নিরাপদ দূরত্বে থাকার অধিকার। এই সহনশীলতা কাউকে কাছে টানে না, বরং মানুষকে আলাদা করে রাখে।

কিছুদিন আগে ফেসবুকে ভাইরাল হয় একটি খবর। পাবনার ঈশ্বরদীতে সদ্যজাত আটটি কুকুরছানা বস্তায় ভরে পুকুরে ফেলে মেরে ফেলার অভিযোগে নেটিজেনদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। আরও কিছুদিন আগে গ্রামীণ ফোনের এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তাঁর আশ্রিত বিড়ালকে নিচে ফেলে দিয়ে আহত করার প্রতিবাদ করেন এক তরুণী।
৪ ঘণ্টা আগে
বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তাদের কয়েক দশকের জোট ভেঙে ফেলেছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে নিজেদের উদার ও গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে নতুন করে তুলে ধরতেই বিএনপির এই অবস্থান পরিবর্তন।
৭ ঘণ্টা আগে
গাজার এই ধ্বংসলীলা জগতের সামনে রূঢ় প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে। পৃথিবীতে মানবাধিকার বলে কি আদতে কিছু আছে? নাকি এটি কেবল শক্তিশালী দেশগুলোর সুবিধামতো ব্যবহারের জন্য তৈরি একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার?
৭ ঘণ্টা আগে
সেদিন ফেসবুক ঘাঁটতে গিয়ে একটি গ্রুপ চোখে পড়ল, নাম ‘আনরেডি আপুদের ছবি’। গ্রুপে গিয়ে দেখলাম, বিনা অনুমতিতে বিভিন্ন বয়সী নারীর ছবি তুলে পোস্ট করা হচ্ছে। একটি ছবিতে দেখা গেল, বাসে বসে থাকা এক তরুণী ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ করে আছেন, গায়ের ওপর থেকে ওড়না খানিকটা সরে গেছে; আরেক ছবিতে ওষুধের দোকানে বোরকা ও হিজাব
৮ ঘণ্টা আগে