ফয়সাল মাহমুদ

বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তাদের কয়েক দশকের জোট ভেঙে ফেলেছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে নিজেদের উদার ও গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে নতুন করে তুলে ধরতেই বিএনপির এই অবস্থান পরিবর্তন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের ১৬ মাস পর এই পরিবর্তন এলো। গত বছরের ৫ আগস্ট দেড় দশকের শাসনের পর গণ-অভ্যুত্থানের মুখে হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী সরকারের পতন ঘটে। তাঁর শাসনামলে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, সমালোচক ও বিরোধী নেতাদের গ্রেপ্তার এবং ২০২৪ সালের আগস্টে বিক্ষোভকারীদের ওপর নৃশংস দমন-পীড়নের মতো ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছিল।
ঐতিহাসিকভাবে বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হাসিনার আওয়ামী লীগ কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ ও উদারপন্থী শক্তি হিসেবে দাবি করে আসছিল। যদিও সমালোচকরা বরাবরই এই দাবির সঙ্গে একমত ছিলেন নন।
এর বিপরীতে, আওয়ামী লীগের বিরোধিতার অভিন্ন স্বার্থে বিএনপি ও জামায়াত এক হয়েছিল। কিন্তু দল দুটির আদর্শিক পার্থক্য কখনোই গোপন ছিল না। বিএনপি জাতীয়তাবাদী বিশ্বদর্শনে বিশ্বাসী, অন্যদিকে ধর্মীয় রাজনীতিই জামায়াতের অস্তিত্বের মূল ভিত্তি।
২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট জিতেছিল। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত একসঙ্গে দেশ শাসন করা দল দুটির মধ্যকার পার্থক্যগুলো এখন সম্পূর্ণ বিবাদে পরিণত হয়েছে।
চলতি সপ্তাহে দলীয় সমর্থকদের উদ্দেশে এক বক্তব্যে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, তখন কী ঘটেছিল তা ‘মানুষ দেখেছিল’।
যদিও তারেক রহমান জামায়াতের নাম উল্লেখ করেননি, কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ এই ইঙ্গিত স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছে। জামায়াতে ইসলামী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। একই বক্তব্যে তারেক রহমান, ধর্মকে ব্যবহার করে ভোট চাওয়ার জন্যও জামায়াতকে অভিযুক্ত করেন।
গত মাসে একই ধরনের মন্তব্য করেছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি ‘ধর্মের নামে’ দেশকে বিভক্ত করার বিরুদ্ধে সবাইকে সতর্ক করে বলেন, বিএনপির রাজনীতি জাতীয় ঐক্য, গণতান্ত্রিক নীতি ও ১৯৭১ সালের মূল চেতনার ওপর ভিত্তি করে হওয়া উচিত।
বিএনপির সাম্প্রতিক বয়ান থেকে বোঝা যায়, তারা ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের সেই নৈতিক অবস্থানটি নিজেদের করে নিতে চায়, যা এতদিন আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র দখলে ছিল। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনাকে একপাক্ষিকভাবে নিজেদের কুক্ষিগত করে রেখেছিল। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিলেও, স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের প্রাথমিক উত্থানের জন্যও তিনি দায়ী ছিলেন। ১৯৭৫ সালে তিনি একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অন্য সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেছিলেন।
২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ক্ষমতায় থাকাকালীন হাসিনা সেই উত্তরাধিকারই বহন করেছেন। তিনি জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেন ও বিএনপির হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেন—যাঁদের মধ্যে দলটির দীর্ঘকালীন প্রধান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও রয়েছেন। খালেদা জিয়া বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এবং তাঁর দল ও পরিবারের ভাষ্যমতে তাঁর অবস্থা ‘অত্যন্ত সংকটাপন্ন’।
রাজনৈতিক বিরোধী ও সমালোচকদের ওপর হাসিনা সরকারের নির্মম দমন-পীড়ন ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনগুলোকে প্রহসনে পরিণত করেছিল।
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম এখন নিষিদ্ধ ও হাসিনা ভারতে নির্বাসিত। বর্তমান পরিস্থিতিতে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের বড় শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে। বিএনপি এখন এই ফাঁকা জায়গা পূরণ করতে চাচ্ছে। কিন্তু এ পথে বড় বাধা হলো তাদের দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামী।
জামায়াতের কাঁধে রয়েছে একাত্তরের ঐতিহাসিক দায় ও বোঝা। অন্যদিকে, সাধারণ ভোটারদের বড় অংশ এখন বহুত্ববাদী বা সব মতের রাজনীতি পছন্দ করে। জামায়াতের সঙ্গে জোট থাকলে এই উদারপন্থী মানুষদের কাছে টানা বিএনপির জন্য কঠিন। তাই নতুন ভোটারদের সমর্থন পেতে হলে বিএনপিকে অবশ্যই জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে।
তবে বিএনপি-জামায়াত ফাটল রাতারাতি তৈরি হয়নি। নির্বাচনের আগে ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন কি না, সংবিধান কীভাবে পুনর্গঠন করা হবে ও হাসিনা-পরবর্তী যুগে কোন রাজনৈতিক মডেল কার্যকর হবে—এমন মৌলিক প্রশ্নগুলো নিয়ে কয়েকমাস ধরেই দুই দলের দূরত্ব বাড়ছিল।
জামায়াত নির্বাচনের আগে ব্যাপক কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্য চাপ দিচ্ছিল; অন্যদিকে বিএনপি দ্রুত নির্বাচন ও ন্যূনতম সংবিধান সংশোধনের ওপর জোর দিয়েছিল। তাদের মতবিরোধ ধীরে ধীরে প্রকাশ্য বিবাদে রূপ নেয়।
তবে এই বিচ্ছেদ কেবল কৌশলগত মতবিরোধ নয়। এটি নতুন রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে ঘটা আদর্শিক পুনর্বিন্যাসের প্রতিফলন। আওয়ামী লীগ একসময় মধ্য-বাম, উদার-ধর্মনিরপেক্ষ যে স্থান দাবি করত, তা এখন শূন্য। ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারিত জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপি সেই স্থান দখলের সুযোগ দেখছে।
বিএনপির এই হিসাব-নিকাশ ভোটারদের পরিবর্তিত মেজাজের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। ২০২৪ সালের তরুণ নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থান, একদলীয় স্বৈরতন্ত্রের পতন ও শহুরে মধ্যবিত্ত ভোটারদের নাগরিক জাগরণ—সব মিলিয়ে গণতান্ত্রিক শাসন ও রাজনৈতিক মধ্যপন্থা বা মডারেশনের নতুন চাহিদা তৈরি হয়েছে।
বিএনপি বিশ্বাস করে, জামায়াতের ধর্মভিত্তিক ঝোঁক এই অনুভূতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। নিজেদের নতুনভাবে ব্র্যান্ডিং করার মাধ্যমে বিএনপি মনে করে, তারা এমন ভোটারদের আকৃষ্ট করতে পারবে যারা আওয়ামী লীগের স্বৈরতন্ত্র ও জামায়াতের ধর্মীয় রক্ষণশীলতা—এই দুয়ের ওপরই বিরক্ত।
এই নতুন যাত্রার লক্ষ্য ১৯৭১ সালের নৈতিক অবস্থান পুনরুদ্ধার করাও। কয়েক দশক ধরে, আওয়ামী লীগ জামায়াতের একাত্তরের ভূমিকার বিষয় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে বিএনপিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। এখন বিএনপি সেই বয়ান উল্টে দিচ্ছে।
১৯৭১ সালে জামায়াতের ভূমিকার নিন্দা করে দলটি অর্ধশতাব্দী ধরে চলা আওয়ামী লীগের আদর্শিক একচেটিয়াত্বকে চ্যালেঞ্জ করছে। এর মাধ্যমে তারা তরুণ নাগরিকদের আকৃষ্ট করতে চাচ্ছে, যারা ১৯৭১ সালকে কোনো দলের প্রতি আনুগত্যের চেয়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বয়ান দিয়ে বিচার করে।
এই রূপান্তরের প্রচেষ্টায় ঝুঁকিও রয়েছে। এই নতুন ব্র্যান্ডিং আসল নাকি সুবিধাবাদী, সে সন্দেহ দূর করতে হবে বিএনপিকে। বিএনপির নিজেদের দলের ভেতরের কিছু অংশও উদারপন্থী পরিচয়ের দিকে এই পরিবর্তনের বিরোধিতা করতে পারে।
তাছাড়া, হাসিনা-পরবর্তী রাজনীতিতে এখন নানামুখি প্রভাব বিরাজ করছে। ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ (এনসিপি)-এর মতো তরুণদের পরিচালিত দল এবং সুশীল সমাজের বিভিন্ন প্রতিনিধিরাও উদার-মধ্যপন্থী ভোটের জন্য প্রতিযোগিতা করছে। বিএনপি যদি ভিন্নমতের গণতন্ত্রপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে একত্রিত করতে না পারে, তবে ভোট ভাগাভাগি হয়ে তাদের লাভ কমে যেতে পারে।
তবে, আপাতত বিএনপির এই পুনর্বিন্যাসের পেছনের কৌশলগত যুক্তি জোরালো মনে হচ্ছে। দলটি এখন আর নিজেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী মধ্য-ডানপন্থী শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করছে না; বরং একটি বিস্তৃত গণতান্ত্রিক প্ল্যাটফর্মে রূপান্তরিত হওয়ার চেষ্টা করছে। এর লক্ষ্য সাবেক আওয়ামী লীগ ভোটার, শহুরে উদারপন্থী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন তরুণদের অন্তর্ভুক্ত করা।
এই পরিবর্তন সফল হবে কি না, তা নির্ভর করবে বিএনপি কতটা ধারাবাহিকভাবে নতুন এই আদর্শিক লাইন বজায় রাখতে পারে। পাশাপাশি জনগণ বিশ্বাস করে কি না যে জামায়াতের সঙ্গে বিচ্ছেদ নিছক নির্বাচনি কৌশল নয়, বরং নীতিগত সিদ্ধান্ত।
তবে এটি ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে যে, ২০২৫ সালের বিএনপি আর বিগত দশকের বিএনপি এক নয়। দলটির নেতারা এখন নতুন ভাষায় কথা বলছেন। যার মূলে রয়েছে অন্তর্ভুক্তি, অসাম্প্রদায়িকতা ও গণতান্ত্রিক সংস্কার।
জামায়াতের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ও একসময় আওয়ামী লীগের দখলে থাকা আদর্শিক অবস্থানে পা রেখে বিএনপি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট নতুন করে সাজাচ্ছে। যদি এই রূপান্তর টিকে থাকে, তবে ১৯৯০-এর দশকের পর থেকে দেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকবদল হতে পারে।
লেখক: দিল্লিস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস মিনিস্টার। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরায় প্রকাশিত লেখা থেকে অনূদিত।

বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তাদের কয়েক দশকের জোট ভেঙে ফেলেছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে নিজেদের উদার ও গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে নতুন করে তুলে ধরতেই বিএনপির এই অবস্থান পরিবর্তন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের ১৬ মাস পর এই পরিবর্তন এলো। গত বছরের ৫ আগস্ট দেড় দশকের শাসনের পর গণ-অভ্যুত্থানের মুখে হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী সরকারের পতন ঘটে। তাঁর শাসনামলে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, সমালোচক ও বিরোধী নেতাদের গ্রেপ্তার এবং ২০২৪ সালের আগস্টে বিক্ষোভকারীদের ওপর নৃশংস দমন-পীড়নের মতো ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছিল।
ঐতিহাসিকভাবে বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হাসিনার আওয়ামী লীগ কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ ও উদারপন্থী শক্তি হিসেবে দাবি করে আসছিল। যদিও সমালোচকরা বরাবরই এই দাবির সঙ্গে একমত ছিলেন নন।
এর বিপরীতে, আওয়ামী লীগের বিরোধিতার অভিন্ন স্বার্থে বিএনপি ও জামায়াত এক হয়েছিল। কিন্তু দল দুটির আদর্শিক পার্থক্য কখনোই গোপন ছিল না। বিএনপি জাতীয়তাবাদী বিশ্বদর্শনে বিশ্বাসী, অন্যদিকে ধর্মীয় রাজনীতিই জামায়াতের অস্তিত্বের মূল ভিত্তি।
২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট জিতেছিল। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত একসঙ্গে দেশ শাসন করা দল দুটির মধ্যকার পার্থক্যগুলো এখন সম্পূর্ণ বিবাদে পরিণত হয়েছে।
চলতি সপ্তাহে দলীয় সমর্থকদের উদ্দেশে এক বক্তব্যে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, তখন কী ঘটেছিল তা ‘মানুষ দেখেছিল’।
যদিও তারেক রহমান জামায়াতের নাম উল্লেখ করেননি, কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ এই ইঙ্গিত স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছে। জামায়াতে ইসলামী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। একই বক্তব্যে তারেক রহমান, ধর্মকে ব্যবহার করে ভোট চাওয়ার জন্যও জামায়াতকে অভিযুক্ত করেন।
গত মাসে একই ধরনের মন্তব্য করেছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি ‘ধর্মের নামে’ দেশকে বিভক্ত করার বিরুদ্ধে সবাইকে সতর্ক করে বলেন, বিএনপির রাজনীতি জাতীয় ঐক্য, গণতান্ত্রিক নীতি ও ১৯৭১ সালের মূল চেতনার ওপর ভিত্তি করে হওয়া উচিত।
বিএনপির সাম্প্রতিক বয়ান থেকে বোঝা যায়, তারা ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের সেই নৈতিক অবস্থানটি নিজেদের করে নিতে চায়, যা এতদিন আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র দখলে ছিল। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনাকে একপাক্ষিকভাবে নিজেদের কুক্ষিগত করে রেখেছিল। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিলেও, স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের প্রাথমিক উত্থানের জন্যও তিনি দায়ী ছিলেন। ১৯৭৫ সালে তিনি একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অন্য সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেছিলেন।
২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ক্ষমতায় থাকাকালীন হাসিনা সেই উত্তরাধিকারই বহন করেছেন। তিনি জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেন ও বিএনপির হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেন—যাঁদের মধ্যে দলটির দীর্ঘকালীন প্রধান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও রয়েছেন। খালেদা জিয়া বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এবং তাঁর দল ও পরিবারের ভাষ্যমতে তাঁর অবস্থা ‘অত্যন্ত সংকটাপন্ন’।
রাজনৈতিক বিরোধী ও সমালোচকদের ওপর হাসিনা সরকারের নির্মম দমন-পীড়ন ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনগুলোকে প্রহসনে পরিণত করেছিল।
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম এখন নিষিদ্ধ ও হাসিনা ভারতে নির্বাসিত। বর্তমান পরিস্থিতিতে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের বড় শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে। বিএনপি এখন এই ফাঁকা জায়গা পূরণ করতে চাচ্ছে। কিন্তু এ পথে বড় বাধা হলো তাদের দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামী।
জামায়াতের কাঁধে রয়েছে একাত্তরের ঐতিহাসিক দায় ও বোঝা। অন্যদিকে, সাধারণ ভোটারদের বড় অংশ এখন বহুত্ববাদী বা সব মতের রাজনীতি পছন্দ করে। জামায়াতের সঙ্গে জোট থাকলে এই উদারপন্থী মানুষদের কাছে টানা বিএনপির জন্য কঠিন। তাই নতুন ভোটারদের সমর্থন পেতে হলে বিএনপিকে অবশ্যই জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে।
তবে বিএনপি-জামায়াত ফাটল রাতারাতি তৈরি হয়নি। নির্বাচনের আগে ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন কি না, সংবিধান কীভাবে পুনর্গঠন করা হবে ও হাসিনা-পরবর্তী যুগে কোন রাজনৈতিক মডেল কার্যকর হবে—এমন মৌলিক প্রশ্নগুলো নিয়ে কয়েকমাস ধরেই দুই দলের দূরত্ব বাড়ছিল।
জামায়াত নির্বাচনের আগে ব্যাপক কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্য চাপ দিচ্ছিল; অন্যদিকে বিএনপি দ্রুত নির্বাচন ও ন্যূনতম সংবিধান সংশোধনের ওপর জোর দিয়েছিল। তাদের মতবিরোধ ধীরে ধীরে প্রকাশ্য বিবাদে রূপ নেয়।
তবে এই বিচ্ছেদ কেবল কৌশলগত মতবিরোধ নয়। এটি নতুন রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে ঘটা আদর্শিক পুনর্বিন্যাসের প্রতিফলন। আওয়ামী লীগ একসময় মধ্য-বাম, উদার-ধর্মনিরপেক্ষ যে স্থান দাবি করত, তা এখন শূন্য। ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারিত জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপি সেই স্থান দখলের সুযোগ দেখছে।
বিএনপির এই হিসাব-নিকাশ ভোটারদের পরিবর্তিত মেজাজের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। ২০২৪ সালের তরুণ নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থান, একদলীয় স্বৈরতন্ত্রের পতন ও শহুরে মধ্যবিত্ত ভোটারদের নাগরিক জাগরণ—সব মিলিয়ে গণতান্ত্রিক শাসন ও রাজনৈতিক মধ্যপন্থা বা মডারেশনের নতুন চাহিদা তৈরি হয়েছে।
বিএনপি বিশ্বাস করে, জামায়াতের ধর্মভিত্তিক ঝোঁক এই অনুভূতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। নিজেদের নতুনভাবে ব্র্যান্ডিং করার মাধ্যমে বিএনপি মনে করে, তারা এমন ভোটারদের আকৃষ্ট করতে পারবে যারা আওয়ামী লীগের স্বৈরতন্ত্র ও জামায়াতের ধর্মীয় রক্ষণশীলতা—এই দুয়ের ওপরই বিরক্ত।
এই নতুন যাত্রার লক্ষ্য ১৯৭১ সালের নৈতিক অবস্থান পুনরুদ্ধার করাও। কয়েক দশক ধরে, আওয়ামী লীগ জামায়াতের একাত্তরের ভূমিকার বিষয় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে বিএনপিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। এখন বিএনপি সেই বয়ান উল্টে দিচ্ছে।
১৯৭১ সালে জামায়াতের ভূমিকার নিন্দা করে দলটি অর্ধশতাব্দী ধরে চলা আওয়ামী লীগের আদর্শিক একচেটিয়াত্বকে চ্যালেঞ্জ করছে। এর মাধ্যমে তারা তরুণ নাগরিকদের আকৃষ্ট করতে চাচ্ছে, যারা ১৯৭১ সালকে কোনো দলের প্রতি আনুগত্যের চেয়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বয়ান দিয়ে বিচার করে।
এই রূপান্তরের প্রচেষ্টায় ঝুঁকিও রয়েছে। এই নতুন ব্র্যান্ডিং আসল নাকি সুবিধাবাদী, সে সন্দেহ দূর করতে হবে বিএনপিকে। বিএনপির নিজেদের দলের ভেতরের কিছু অংশও উদারপন্থী পরিচয়ের দিকে এই পরিবর্তনের বিরোধিতা করতে পারে।
তাছাড়া, হাসিনা-পরবর্তী রাজনীতিতে এখন নানামুখি প্রভাব বিরাজ করছে। ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ (এনসিপি)-এর মতো তরুণদের পরিচালিত দল এবং সুশীল সমাজের বিভিন্ন প্রতিনিধিরাও উদার-মধ্যপন্থী ভোটের জন্য প্রতিযোগিতা করছে। বিএনপি যদি ভিন্নমতের গণতন্ত্রপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে একত্রিত করতে না পারে, তবে ভোট ভাগাভাগি হয়ে তাদের লাভ কমে যেতে পারে।
তবে, আপাতত বিএনপির এই পুনর্বিন্যাসের পেছনের কৌশলগত যুক্তি জোরালো মনে হচ্ছে। দলটি এখন আর নিজেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী মধ্য-ডানপন্থী শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করছে না; বরং একটি বিস্তৃত গণতান্ত্রিক প্ল্যাটফর্মে রূপান্তরিত হওয়ার চেষ্টা করছে। এর লক্ষ্য সাবেক আওয়ামী লীগ ভোটার, শহুরে উদারপন্থী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন তরুণদের অন্তর্ভুক্ত করা।
এই পরিবর্তন সফল হবে কি না, তা নির্ভর করবে বিএনপি কতটা ধারাবাহিকভাবে নতুন এই আদর্শিক লাইন বজায় রাখতে পারে। পাশাপাশি জনগণ বিশ্বাস করে কি না যে জামায়াতের সঙ্গে বিচ্ছেদ নিছক নির্বাচনি কৌশল নয়, বরং নীতিগত সিদ্ধান্ত।
তবে এটি ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে যে, ২০২৫ সালের বিএনপি আর বিগত দশকের বিএনপি এক নয়। দলটির নেতারা এখন নতুন ভাষায় কথা বলছেন। যার মূলে রয়েছে অন্তর্ভুক্তি, অসাম্প্রদায়িকতা ও গণতান্ত্রিক সংস্কার।
জামায়াতের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ও একসময় আওয়ামী লীগের দখলে থাকা আদর্শিক অবস্থানে পা রেখে বিএনপি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট নতুন করে সাজাচ্ছে। যদি এই রূপান্তর টিকে থাকে, তবে ১৯৯০-এর দশকের পর থেকে দেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকবদল হতে পারে।
লেখক: দিল্লিস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস মিনিস্টার। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরায় প্রকাশিত লেখা থেকে অনূদিত।

যখন কোনো জাতিগত বা ধর্মীয় সংঘাত দেখা দেয়, তখন সম্পদের অভাব, ক্ষমতা ভাগাভাগির মতো মূল কারণগুলো নিয়ে আলোচনা না করে, বলা হয় যে এগুলো হলো মানুষের 'স্বাভাবিক' বা 'ঐতিহ্যগত' সমস্যা। এগুলো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।
৩৯ মিনিট আগে
কিছুদিন আগে ফেসবুকে ভাইরাল হয় একটি খবর। পাবনার ঈশ্বরদীতে সদ্যজাত আটটি কুকুরছানা বস্তায় ভরে পুকুরে ফেলে মেরে ফেলার অভিযোগে নেটিজেনদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। আরও কিছুদিন আগে গ্রামীণ ফোনের এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তাঁর আশ্রিত বিড়ালকে নিচে ফেলে দিয়ে আহত করার প্রতিবাদ করেন এক তরুণী।
৩ ঘণ্টা আগে
গাজার এই ধ্বংসলীলা জগতের সামনে রূঢ় প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে। পৃথিবীতে মানবাধিকার বলে কি আদতে কিছু আছে? নাকি এটি কেবল শক্তিশালী দেশগুলোর সুবিধামতো ব্যবহারের জন্য তৈরি একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার?
৭ ঘণ্টা আগে
সেদিন ফেসবুক ঘাঁটতে গিয়ে একটি গ্রুপ চোখে পড়ল, নাম ‘আনরেডি আপুদের ছবি’। গ্রুপে গিয়ে দেখলাম, বিনা অনুমতিতে বিভিন্ন বয়সী নারীর ছবি তুলে পোস্ট করা হচ্ছে। একটি ছবিতে দেখা গেল, বাসে বসে থাকা এক তরুণী ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ করে আছেন, গায়ের ওপর থেকে ওড়না খানিকটা সরে গেছে; আরেক ছবিতে ওষুধের দোকানে বোরকা ও হিজাব
৭ ঘণ্টা আগে