leadT1ad

দেড়শো বছরের রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরিতে সপ্তাহে পাঠক ৫-৭ জন

১৫০ বছরের পুরোনো ‘রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরি’। সংগৃহীত ছবি

পুরান ঢাকার জনাকীর্ণ রাস্তা। রিকশার টুংটাং ও মানুষের কোলাহল পেরিয়ে পাটুয়াটুলীর ব্রাহ্মসমাজ কার্যালয়। ভেতরে ঢুকলে মনে হয়, সময় থমকে গেছে। চারদিক নিস্তব্ধ। দ্বিতল এই কার্যালয় ভবনের উপরতলায় ছিল ১৫০ বছরের পুরোনো ‘রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরি’।

জরাজীর্ণ ভবনটির দ্বিতীয় তলা আর ব্যবহারযোগ্য নেই। সামনের দেয়াল ভেদ করে জন্মেছে গাছ। বের হয়ে আছে শেকড়। ভাঙাচোরা ফটক দিয়ে ঢুকতেই সামনে পড়েন দুজন। লাইব্রেরির কথা জানতে চাইলে হতাশ কণ্ঠে উত্তর, ‘লাইব্রেরি তো চলে না, তাও ৫-৬ বছর।’

ফেরার পথে পা বাড়াতেই দেখা মেলে সুভাষ চন্দ্র সিংহের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘লাইব্রেরি বন্ধ হয়নি, চলছে। তবে স্থান পরিবর্তন হয়েছে।’ জরাজীর্ণ ভবন ছেড়ে এটির এখন ঠাঁই পাশের মন্দির লাগোয়া একটি ছোট কক্ষে। জানালেন, তিনিই এখন এটি দেখাশোনা করেন।

সুভাষ চন্দ্রই পথ দেখালেন। তবে আঁকাবাঁকা সংকীর্ণ সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময় বুকটা ধক করে উঠে– ইতিহাসের সাক্ষী একটি প্রতিষ্ঠানের প্রবেশপথ এমন কেন? ভেতরে গিয়ে সেই ভয় সত্য হলো, যেন কবরের নিস্তব্ধতা। বড় কথা, বই নেই বললেই চলে। অথচ আধুনিক ভারতের অন্যতম রূপকার ও রেনেসাঁসের অগ্রদূত রাজা রামমোহন রায়ের স্মৃতিধন্য পাঠাগারটিতে এক সময় ছিল দেশ-বিদেশের নানা বই। ১৮৭১ সালে প্রতিষ্ঠার পর দশকের পর দশক জ্ঞানপিপাসুদের পদচারণায় মুখর থাকত। জনাকীর্ণ সেই গ্রন্থাগারই এখন ধুঁকছে পাঠকশূন্যতায়।

কমতে কমতে বই নেমেছে হাজারের নিচে

পাঠাগার বলতেই চোখের সামনে ভাসে বইয়ে ঠাসা কক্ষ। তবে এই পাঠাগারে তার ছিঁটে ফোটাও নেই। সুভাষ চন্দ্রের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দিলে বলেন, ‘লাইব্রেরির আলমারিগুলোর দিকে তাকালে বুকটা হুঁ হুঁ করে ওঠে। একসময় যেখানে হাজার হাজার বই ছিল আজ টিকে আছে এক হাজারেরও কম।’

পাটুয়াটুলীর ব্রাহ্মসমাজ কার্যালয়। ছবি: গুগল ম্যাপ থেকে সংগৃহীত
পাটুয়াটুলীর ব্রাহ্মসমাজ কার্যালয়। ছবি: গুগল ম্যাপ থেকে সংগৃহীত

সামনাসামনি দেখলে অবশ্য ৫-৬ শর বেশি হবে বলে মনে হয় না। যেগুলো টিকে আছে তার গায়েও অযত্ন ও অবহেলার ছাপ। কোথাও পোকায় খেয়েছে তো কোথাও খুলে যাচ্ছে বাঁধাই। অধিকাংশ বইয়ের পাতা হলুদ হয়ে গেছে। স্পর্শ করলেই যেন ঝুরঝুর করে ঝরে পড়বে ইতিহাসের একেকটি পাতা।

সুভাষ চন্দ্র জানান, একসময় এই লাইব্রেরি ছিল দুষ্প্রাপ্য ও মূল্যবান বইয়ের সমৃদ্ধ ভান্ডার। রাজা রামমোহন রায়ের রচনাবলি, ব্রাহ্ম ধর্মের আদি নথিপত্র এবং তৎকালীন সমাজ সংস্কারের দলিল হিসেবে বিবেচিত বহু গ্রন্থ এখানে সংরক্ষিত ছিল। বর্তমানে যার কিছুই নেই।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলেন, ‘বহু বছর ধরে সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ নেই। সংরক্ষণে নেওয়া হয়নি কার্যকর ব্যবস্থা। এতে অধিকাংশ বই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’

শুধু শুক্রবার খোলে, পাঠক আসে ৫ থেকে ৭ জন

বই না থাকার প্রভাব দেখা গেছে গ্রন্থাগারটির পাঠকের সংখ্যায়। ঐতিহাসিক লাইব্রেরি হওয়ার পরও এখানে পাঠক আসে না বললেই চলে। এ কারণে এখন সপ্তাহে শুধু শুক্রবারেই গ্রন্থাগারটি খোলা হয়। তবে এতেও পাঠকের উপস্থিতি হতাশাজনক- গড়ে পাঁচ থেকে সাতজন। তারাও আবার নিয়মিত নন।

লাইব্রেরির রেজিস্টার খাতা ও দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যারা আসেন তাঁদের অধিকাংশই গবেষক বা কৌতূহলী দর্শনার্থী। নিয়মিত বই পড়ার বা জ্ঞানচর্চার উদ্দেশ্যে আসা পাঠকের সংখ্যা এখন হাতেগোনা।

লাইব্রেরির ফটক। ছবি: গুগল ম্যাপ থেকে সংগৃহীত
লাইব্রেরির ফটক। ছবি: গুগল ম্যাপ থেকে সংগৃহীত

সংশ্লিষ্টরা জানান, সপ্তাহের অন্য দিনগুলো বন্ধ থাকলেও কেউ যদি বিশেষ প্রয়োজনে বা গবেষণার কাজে লাইব্রেরিটি দেখতে চান, তবে এটি খুলে দেওয়া হয়। এ ছাড়া একই প্রাঙ্গণে মন্দির থাকায় রোববারের প্রার্থনার দিন অনেক সময় দর্শনার্থীরা লাইব্রেরিটি ঘুরে দেখার সুযোগ পান।

তাঁরা আরও জানান, সারা বছর নিস্তব্ধ থাকলেও বছরে কিছু দিনে প্রাণের সঞ্চার হয় লাইব্রেরিটিতে। বিশেষ করে রাজা রামমোহন রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ব্রাহ্মসমাজ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মনীষীদের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে এখানে পাঠকদের আনাগোনা বাড়ে। এই দিনগুলোতে আলোচনা সভা বা স্মরণসভার আয়োজন হলে কিছু উৎসাহী মানুষ ও সাহিত্যপ্রেমীও জড়ো হন। তবে অনুষ্ঠান শেষে লাইব্রেরিটি ফিরে যায় তার চিরাচরিত নির্জনতায়।

সরকারি উদ্যোগের অভাব ও এক সংগঠনের লড়াই

রাজা রামমোহন রায় ভারতীয় উপমহাদেশেরই এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। অথচ তাঁর স্মৃতিবিজড়িত গ্রন্থাগারটি রক্ষায় সরকারিভাবে কখনোই উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এটি এককভাবে পরিচালিত হয় বাংলাদেশ ব্রাহ্মসমাজ, ঢাকার তত্ত্বাবধানে।

সুভাষ সিংহ বলেন, একটি বেসরকারি ট্রাস্টি বা ধর্মীয় সংগঠনের পক্ষে আধুনিক সংরক্ষণাগার গড়ে তোলা বা জরাজীর্ণ বইগুলোকে ডিজিটালাইজ করা দুরূহ। সরকারিভাবে যদি কোনো অনুদান বা কারিগরি সহায়তা পাওয়া যেত, তবে হয়তো এই অমূল্য সম্পদগুলো রক্ষা করা সম্ভব হতো।

তিনি আরও বলেন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এই হেরিটেজ সাইট বা ভেতরের সম্পদ রক্ষায় দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ কখনোই নেয়নি। ফলে একটি ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় দায়ভার ও টিকে থাকার লড়াইটা করতে হচ্ছে একান্তই ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক উদ্যোগে, যা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল।

অবশিষ্ট বইগুলোও দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে জানিয়ে লাইব্রেরিটির এ তত্ত্বাবধায়ক বলেন, এখনই যদি এগুলো সংরক্ষণের বা ডিজিটাল আর্কাইভিংয়ের ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরি হয়তো বইশূন্য এক কক্ষে পরিণত হবে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত