leadT1ad

স্ট্রিম এক্সপ্লেইনার/বাংলাদেশ কেন ‘ইউরোফাইটার টাইফুন’ কিনতে যাচ্ছে, এই বিমানের বৈশিষ্ট্য কী

প্রতিটি বিমানের দাম প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ৮ থেকে ১৬টি বিমান কেনার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বিষয়টি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত নয়। তবু সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর দেখায় যে বাংলাদেশ উন্নত পশ্চিমা প্রযুক্তির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। প্রতিরক্ষা বাজেট বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে এটি বিমান বাহিনীর আধুনিকায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান ইউরোফাইটার টাইফুন কিনছে বাংলাদেশ। স্ট্রিম গ্রাফিক

বাংলাদেশ বিমান বাহিনী (বিএএফ) তাদের বহর আধুনিকায়নের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। শক্তিশালী অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান ইউরোফাইটার টাইফুন কিনতে ইতালীয় প্রতিষ্ঠান লিওনার্দো এসপিও’র সঙ্গে চুক্তি করেছে। মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) বিমানবাহিনী সদর দপ্তরে এই সম্মতিপত্র সই করা হয়।

তবে বিমান সংখ্যা, কনফিগারেশন, সরবরাহের সময়সীমা ও ব্যয়ের মতো তথ্য এখনো প্রকাশ করা হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়া ও চীনের তৈরি পুরোনো বিমান নির্ভরতার পর এই পদক্ষেপ বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর জন্য একটি বড় আধুনিকায়ন পদক্ষেপ। এই সিদ্ধান্ত দক্ষিণ এশিয়ার আকাশ-ক্ষমতার ভারসাম্যেও প্রভাব ফেলতে পারে।

বাংলাদেশ ইউরোফাইটার টাইফুন কেন চাইছে?

বাংলাদেশের এই সিদ্ধান্ত দেশের সামরিক খাতে বৃহত্তর আধুনিকায়ন কৌশলের অংশ। আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি, প্রযুক্তিগত চাহিদা ও ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন, সব মিলিয়েই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে বিমান বাহিনী প্রধানত পুরোনো মিগ-২৯, এফ-৭, ও ইয়াক-১৩০ বিমানের ওপর নির্ভরশীল। এসব যুদ্ধবিমান আর আধুনিক হুমকি মোকাবিলায় সক্ষম নয়।

১. আকাশে প্রতিরোধক্ষমতা ও প্রতিরক্ষা জোরদার

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশ সীমান্ত ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা সংকটে পড়ছে। টাইফুনের উন্নত সক্ষমতা আকাশসীমা রক্ষায় কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। প্রয়োজন হলে দ্রুত প্রতিক্রিয়া, আকাশ প্রতিরক্ষা ও সামুদ্রিক টহলে এটি বাড়তি শক্তি যোগাবে।

ভারতের অস্বস্তি এড়াতে ফরাসি রাফাল কেনার বদলে বাংলাদেশ অন্য ইউরোপীয় দেশের প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছে। এতে রাশিয়া বা চীনের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতাও কমবে। রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে এসইউ-৩৫ কেনা সম্ভব নয়। এই চুক্তি কার্যত পশ্চিমা সিস্টেমের দিকে বাংলাদেশের একটি কৌশলগত ঝোঁকও দেখায়।

২. সামরিক আধুনিকায়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধি

বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বড় হওয়ার পাশাপাশি প্রতিরক্ষা খাতেও বিনিয়োগ বাড়ছে। পুরোনো বিমান সরিয়ে উন্নত ক্ষমতার নতুন যুদ্ধবিমান অন্তর্ভুক্ত করা এখন সময়ের দাবি। টাইফুন চতুর্থ প্রজন্মের উন্নত শ্রেণির যুদ্ধবিমান, যা বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বর্তমান সামর্থ্যের তুলনায় অনেক এগিয়ে।

এটি আকাশ থেকে আকাশে যুদ্ধ, স্থল হামলা ও নজরদারিসহ সব ক্ষেত্রেই কার্যকর। বাংলাদেশের বহুমুখী যুদ্ধবিমান চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। বিভিন্ন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ভূরাজনৈতিক জটিলতার কারণে রাশিয়ার সস্তা বিমানগুলোর দিকে আর আগের মতো ঝোঁক রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে টাইফুন একটি বাস্তবসম্মত সমাধান হয়ে উঠেছে।

৩. আমদানি উৎসে বৈচিত্র্য ও দীর্ঘমেয়াদি লাভ

টাইফুন বেছে নেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ ইউরোপীয় প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ সুবিধাও পাবে। লিওনার্দো বাংলাদেশে অবকাঠামো স্থাপন বা অংশবিশেষ স্থানীয়ভাবে সংযোজনের সুবিধাও দিতে পারে। এতে স্থানীয় শিল্পও লাভবান হবে। পাশাপাশি, নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা সরবরাহকারীদের ওপর নির্ভরতা কমবে।

ইউরোফাইটার টাইফুন
ইউরোফাইটার টাইফুন

ইউরোফাইটার টাইফুনের প্রধান বৈশিষ্ট্য

ইউরোফাইটার টাইফুন একটি দুই ইঞ্জিনবিশিষ্ট এবং অত্যাধুনিক ডিজাইনের বহুমুখী যুদ্ধবিমান। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি এবং স্পেনের বহুজাতিক সহযোগিতায় এটি তৈরি হয়। এ বিমান আকাশ-থেকে-আকাশ ও আকাশ-থেকে-স্থল উভয় ধরনের হামলা করতে পারে। এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:

১. গতি ও পারফরম্যান্স

বিমানটি দুটি ইউরোজেট ইজে২০০ টার্বোফ্যান ইঞ্জিন দিয়ে চালানো হয়। এটি বর্তমানে বাজারের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ইঞ্জিনগুলোর একটি। টাইফুন ঘণ্টায় প্রায় ২ হাজার ৪৯৫ কিলোমিটার বেগে উড়তে সক্ষম।

বিমানটি প্রতি সেকেন্ডে ৩১৫ মিটার উচ্চতায় উঠতে পারে এবং সর্বোচ্চ ৬৫ হাজার ফুট পর্যন্ত উড়তে সক্ষম। একবার জ্বালানি নিলে এটি ১ হাজার ৩৮৯ কিলোমিটার উড়তে পারে।

২. সেন্সর

এর ডিজিটাল ফ্লাইট কন্ট্রোল সিস্টেম বিমানকে অত্যন্ত নিয়ন্ত্রণযোগ্য করে, যা ডগফাইটে বাড়তি সাফল্য এনে দেয়। টাইফুন তার তীক্ষ্ণ সেন্সর, অসাধারণ গতিবেগ এবং উচ্চমানের ডগফাইটিং ক্ষমতার জন্য সুপরিচিত। উন্নত রাডার, মিসাইল ও ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম এর ক্ষিপ্রতা আরও বাড়িয়ে দেয়।

৩. বহুমুখী যুদ্ধক্ষমতা

টাইফুন একই মিশনে আকাশ থেকে আকাশ ও আকাশ থেকে স্থলভাগে উভয় ধরনের হামলা করতে পারে। এটি তথ্য সংগ্রহ, শত্রুর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, আর আকাশ প্রতিরক্ষার সামগ্রিক চিত্র তৈরিতেও সহায়তা করে।

দূর-পাল্লার আকাশযুদ্ধের জন্য স্থল আক্রমণের ক্ষেত্রে স্টর্ম শ্যাডো ক্রুজ মিসাইল ও গাইডেড বোমা বহন করতে পারে। বিমানটি সর্বোচ্চ ৭ হাজার ৬০০ কেজি জ্বালানি বহনে সক্ষম।

৪. নকশা ও সুরক্ষা ব্যবস্থা

টাইফুনের কাঠামোর ৭০ শতাংশ উন্নতমানের কম্পোজিট দিয়ে তৈরি। যুদ্ধবিমানটির মোট পৃষ্ঠের মাত্র ১৫ শতাংশ ধাতব, যার ফলে রাডার-নির্ভর সিস্টেম থেকে এটি অনেকটাই আড়ালে থাকে। এর ওজন প্রায় ৩০ শতাংশ কম, যা উড্ডয়নক্ষমতা বাড়ায়। রাডারে কম ধরা পড়া এবং দ্রুত গতি বিমানটিকে প্রায় স্টেলথ বিমান বা রাডার ফাঁকি দিয়ে উড়তে সক্ষম বিমানের বৈশিষ্ট্য দেয়।

ইউরোফাইটার টাইফুন মূলত চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান হলেও, উন্নত প্রযুক্তি ও আধুনিকীকরণের কারণে একে 'উন্নত চতুর্থ প্রজন্ম' হিসেবেও গণ্য করা হয়।

ইউরোফাইটার টাইফুন কেনার এই উদ্যোগ বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতায় এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তন নির্দেশ করে। বহু বছর ধরে পুরোনো প্রযুক্তিনির্ভর বহর পরিচালনার পর বাংলাদেশ এখন এমন এক যুগে প্রবেশ করছে, যেখানে আকাশ-সুরক্ষা শুধু প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেই নয়, কৌশলগত অবস্থান নির্ধারণেও বড় ভূমিকা রাখবে। টাইফুনের মতো উন্নত যুদ্ধবিমান যুক্ত হওয়া শুধু সামরিক শক্তি বাড়াবে না; বরং আঞ্চলিক নিরাপত্তায় বাংলাদেশের উপস্থিতিকে আরও দৃশ্যমান ও প্রভাবশালী করবে।

ইউরোপীয় প্রযুক্তি, বহুমুখী যুদ্ধক্ষমতা, উন্নত সেন্সর, উচ্চ গতিশীলতা এবং ভবিষ্যতে স্থানীয় শিল্পের অংশগ্রহণ, সব মিলিয়ে এটি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ হিসেবে একটি কৌশলগত অর্জন হবে। যদিও ব্যয় ও রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ সামনে থাকবে, তবু এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে তারা আধুনিক যুদ্ধবিমান সক্ষমতার দিক থেকে আর পিছিয়ে থাকতে চায় না।

আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা, ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা ও নিরাপত্তা চাহিদার প্রেক্ষাপটে ইউরোফাইটার টাইফুন হতে পারে বাংলাদেশের আকাশ-রক্ষার নতুন ভিত্তি। আর সামরিক আধুনিকায়নের পথে একটি আত্মবিশ্বাসী অগ্রযাত্রার প্রতীক।

Ad 300x250

সম্পর্কিত