আরিফ রহমান

টাঙ্গাইল শাড়ির বুনন শিল্পকে ‘অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের’ স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেসকো)। মঙ্গলবার ভারতের দিল্লিতে ইউনেসকো কনভেনশনের চলমান ২০তম আন্তরাষ্ট্রীয় পর্ষদের সভায় সর্বসম্মতিক্রমে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এই সিদ্ধান্ত যখন নেওয়া হচ্ছে, তখন হাজার মাইল দূরে টাঙ্গাইলের পাথরাইল কিংবা বাজিতপুরের কোনো এক তাঁতি হয়তো মাকু হাতে ঘাম মুছছেন। খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে ‘স্বীকৃতি’র কথা, কিন্তু এই সনদের পেছনে রয়েছে কয়েক শতাব্দীর নীরব বিবর্তন, দেশভাগের যন্ত্রণা এবং জলের রসায়নে তৈরি এক জাদুকরী বুননকৌশল—যা সাধারণ দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না।
টাঙ্গাইল শাড়ি কেবল একটি পোশাক বা পরিধেয় বস্ত্র নয়; এটি বাংলার ভৌগোলিক বাস্তবতা এবং বসাক সম্প্রদায়ের টিকে থাকার একদীর্ঘ শ্বাসপ্রশ্বাসের নাম। এই অন্তর্ভুক্তি বিজ্ঞান ও শিল্পের স্বীকৃতি—যা টাঙ্গাইলের শাড়িকে জামদানি বা সাধারণ তাঁত থেকে আলাদা করে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। সংবাদের আড়ালে থাকা সেই অজানা গল্পগুলোই এই বুননশিল্পের আসল প্রাণভোমরা।
সবাই জানেন, টাঙ্গাইল শাড়ি টাঙ্গাইলে তৈরি হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন? কেন এই শাড়ি সাভার, নরসিংদী বা অন্য কোনো জেলায় বানালে ‘টাঙ্গাইল’ হয় না?
এর উত্তর লুকিয়ে আছে টাঙ্গাইলের মাটি ও জলের বিশেষ গুণাগুণে। ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে এর স্বীকৃতির মূলেও ছিল এই ভূগোল।
গবেষণা ও স্থানীয় প্রবীণ কারিগরদের মতে, টাঙ্গাইল শাড়ির সুতা প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় যে ‘মাড়’ দেওয়া হয়, তাতে ব্যবহৃত পানির একটি বিশেষ ভূমিকা আছে। ধলেশ্বরী ও লৌহজং নদীর অববাহিকার পানির পিএইচ মান এবং এতে মিশে থাকা খনিজ উপাদান সুতার রং ধারণক্ষমতা এবং কোমলতা নির্ধারণ করে দেয়। পশ্চিম বাংলার ফুলিয়াতে কারিগরেরা একই সুতা ও নকশা ব্যবহার করা সত্ত্বেও টাঙ্গাইলের সেই বিখ্যাত ‘খসখসে অথচ মোলায়েম’ ফিনিশিং আনতে পারেননি। এই ‘ফিনিশিং’ বা শাড়ির শেষ স্পর্শটিই টাঙ্গাইল শাড়ির আসল রহস্য, যা কেবল এই নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের পানিতেই সম্ভব।
তা ছাড়া টাঙ্গাইলের বাতাসে আর্দ্রতার যে প্রাকৃতিক ভারসাম্য, তা সুতা ছিঁড়ে যাওয়া রোধ করে এবং তাঁতিকে একটানা কাজ করতে সাহায্য করে। এটি এমন এক ‘মাইক্রো-ক্লাইমেট’ বা অণু-জলবায়ুগত সুবিধা, যা কৃত্রিমভাবে কারখানায় বা এসির বাতাসে তৈরি করা প্রায় অসম্ভব।
ইতিহাস বলছে, উনিশ শতকের শেষ দিকে টাঙ্গাইল শাড়ির বিবর্তন শুরু। কিন্তু এর নেপথ্যে ছিল এক বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব। আদি টাঙ্গাইল শাড়ি আজকের মতো ছিল না। এর নকশায় আমূল পরিবর্তন আসে স্বদেশি আন্দোলনের সময়। কিন্তু আসল ‘গেম চেঞ্জার’ ছিলেন টাঙ্গাইলের বসাক তাঁতিরা, যারা জ্যামিতিক বুদ্ধিমত্তায় ছিলেন অসামান্য।
অজানা বিষয়টি হলো—টাঙ্গাইল শাড়ি ‘জামদানি’র কাজিন বা নিকটাত্মীয় হলেও এর বুননকৌশল সম্পূর্ণ ভিন্ন। জামদানিতে নকশা তোলা হয় সুতা ঘুরিয়ে, যা অনেকটা এমব্রয়ডারির মতো এবং এতে প্রচুর সময় লাগে। কিন্তু টাঙ্গাইল শাড়ির বুননে তিরিশ ও চল্লিশের দশকে ‘জাকার্ড’ মেশিনের ব্যবহার শুরু হওয়ার পর এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। বসাকরা জাকার্ডের পাঞ্চ কার্ডে এমন জটিল গাণিতিক হিসাব বসিয়েছিলেন যে শাড়ির জমিন ঠিক রেখে পাড়ে অত্যন্ত ভারী ও নিখুঁত নকশা ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়, যা হাতে আঁকার চেয়েও সূক্ষ্ম।
‘নকশা আঁকা’ আর ‘নকশা বোনা’র মধ্যে যে গাণিতিক ফারাক, তা টাঙ্গাইলের তাঁতিরা বংশপরম্পরায় মস্তিষ্কে ধারণ করেন। একটি শাড়ির জমিনে কত হাজার সুতা থাকবে এবং পাড়ের ডিজাইনের জন্য কতগুলো ‘ঘর’ বাদ দিতে হবে—এই হিসাবটি কোনো খাতায় লেখা থাকে না, এটি থাকে তাঁতির আঙুলের ডগা ও তাঁর মস্তিষ্কের নিউরনে। একে অনায়াসেই বলা যায় ‘তাঁতের অ্যালগরিদম’।
ইউনেসকোর ফাইলে হয়তো লেখা আছে ‘কটন বা সিল্ক’। কিন্তু টাঙ্গাইল সুতি শাড়ির যে মুচমুচে অথচ আরামদায়ক ভাব, তার সিক্রেট রেসিপিটি খুব কম মানুষই জানেন। সাধারণ তাঁতের শাড়িতে ভাতের মাড় ব্যবহার করা হয়। কিন্তু টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী ও খাঁটি তাঁতিরা ব্যবহার করেন ‘খইয়ের মাড়’ এবং তার সঙ্গে নির্দিষ্ট অনুপাতে চুন ও তেলের মিশ্রণ।
খইয়ের মাড় সুতাকে এমন এক মসৃণতা দেয়, যা সাধারণ ভাতের মাড় দিতে পারে না। এরপর সুতাগুলোকে কড়া রোদে শুকানো হয় এবং ভোরবেলার শিশিরে ভেজানো হয়—এই গরম ও ঠান্ডার ‘শক ট্রিটমেন্ট’ সুতাকে করে তোলে শক্ত কিন্তু নমনীয়। স্থানীয় ভাষায় এই প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় ‘শানা’ দেওয়া। এটি শাড়ির আয়ু বাড়ায় বহুগুণ। একজন ক্রেতা যখন শাড়িটি প্রথমবার ধোবেন, তখন মাড় চলে যাবে, কিন্তু সুতার বুনন আলগা হবে না—এটাই টাঙ্গাইল শাড়ির ‘ইঞ্জিনিয়ারিং’।
১৯৪৭-এর দেশভাগ এবং ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় টাঙ্গাইলের বহু দক্ষ বসাক তাঁতি ভারতের নদীয়া জেলার ফুলিয়া ও সমুদ্রগড়ে গিয়ে বসতি গড়েন। ফলে ভারতেও ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ নামে একটি বিশাল বাজার ও শিল্প গড়ে ওঠে।
গত বছর ভারত যখন টাঙ্গাইল শাড়িকে নিজেদের জিআই পণ্য হিসেবে দাবি করেছিল, তখন দুই দেশের মধ্যে বড় ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি হয়। কিন্তু বুননশৈলীর গভীরে গেলে দেখা যায়, বাংলাদেশের টাঙ্গাইল এবং ভারতের ফুলিয়ার টাঙ্গাইলের মধ্যে গত কয়েক দশকে একটি মৌলিক চরিত্রগত পার্থক্য তৈরি হয়ে গেছে।
প্রথমত, বাংলাদেশের টাঙ্গাইল শাড়িতে এখনো ৮০-১০০ কাউন্টের অতি সূক্ষ্ম সুতা ব্যবহারের প্রবণতা বেশি। অন্যদিকে, বাণিজ্যিক প্রসারের কারণে ফুলিয়ায় কিছুটা মোটা সুতা ও সিন্থেটিক মিশ্রণের ব্যবহার বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, নকশার দর্শন। বাংলাদেশের কারিগরেরা এখনো প্রকৃতির মোটিফ—যেমন মাছের আঁশ, ধানের শিষ, কলকা বা লতাপাতার সনাতন রূপ ধরে রেখেছেন। অন্যদিকে, ভারতের বুননে আধুনিক ও ফিউশনধর্মী নিরীক্ষা বেশি। তৃতীয়ত, টেক্সচার। বাংলাদেশের টাঙ্গাইল শাড়ির সেই সনাতন ‘খসখসে’ ভাবটি অটুট, যা ফুলিয়ার ‘সফট ফিনিশ’ শাড়ি থেকে আলাদা।
টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে কথা বললে সাধারণত মাকু চালানো পুরুষ তাঁতির ছবিই চোখের সামনে ভাসে। কিন্তু এই শিল্পের ৫০ শতাংশের বেশি কাজ করেন নারীরা, যা কখনোই খবরের শিরোনামে আসে না।
শাড়ি বোনার আগে সুতা ছড়াতে হয়, যা স্থানীয়ভাবে ‘নলি ভরা’ নামে পরিচিত। এই কাজটি অত্যন্ত ধৈর্যের এবং এটি মূলত বাড়ির নারীরাই করেন। ভোর চারটায় ঘুম থেকে উঠে, সংসারের কাজ সেরে, সুতা রং করা, শুকানো এবং নলি ভরার কাজ করেন তাঁরা। তাঁতের খটখট শব্দে যদি পুরুষদের ঘাম থাকে, তবে সেই সুতার প্রতিটি প্যাঁচে মিশে আছে নারীদের অদৃশ্য শ্রম ও মমতা।
টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপাদন যেমন বৈচিত্র্যময়, এর বিপণনব্যবস্থা বা ‘হাট কালচার’ নিজেও একটি গবেষণার বিষয়। বাজিতপুর ও করটিয়ার হাট বসে খুব ভোরে, সূর্য ওঠার আগে।
এর পেছনে রয়েছে ঐতিহাসিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণ। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে মহাজনদের শোষণ এবং পুলিশি ঝামেলা এড়াতে তাঁতিরা অন্ধকারে লেনদেন শেষ করতে চাইতেন। সেই প্রথা আজও রয়ে গেছে। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো হাটের লেনদেন পদ্ধতি। এখানে উচ্চস্বরে দাম হাঁকানো হয় না। কাপড়ের নিচে হাত দিয়ে ক্রেতা ও বিক্রেতা আঙুলের ইশারায় দরদাম ঠিক করেন, যাতে পাশের জন বা অন্য কেউ সেই গোপনীয়তা ভাঙতে না পারে। এই ‘গোপন বাণিজ্য’ টাঙ্গাইল শাড়ির সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
টাঙ্গাইল শাড়ি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—যন্ত্র যত দ্রুতই চলুক না কেন, মানুষের হাতের স্পর্শ, ধলেশ্বরীর জল আর বসাকদের জ্যামিতিক মেধার যে সংমিশ্রণ, তা কোনো অ্যালগরিদম নকল করতে পারে না। ইউনেসকোর তালিকায় স্থান পাওয়া মানে এখন থেকে এই শাড়ি আর কেবল ‘পণ্যের’ কাতারে থাকল না, এটি হয়ে উঠল মানবজাতির সৃজনশীলতার এক বৈশ্বিক নিদর্শন।

টাঙ্গাইল শাড়ির বুনন শিল্পকে ‘অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের’ স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেসকো)। মঙ্গলবার ভারতের দিল্লিতে ইউনেসকো কনভেনশনের চলমান ২০তম আন্তরাষ্ট্রীয় পর্ষদের সভায় সর্বসম্মতিক্রমে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এই সিদ্ধান্ত যখন নেওয়া হচ্ছে, তখন হাজার মাইল দূরে টাঙ্গাইলের পাথরাইল কিংবা বাজিতপুরের কোনো এক তাঁতি হয়তো মাকু হাতে ঘাম মুছছেন। খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে ‘স্বীকৃতি’র কথা, কিন্তু এই সনদের পেছনে রয়েছে কয়েক শতাব্দীর নীরব বিবর্তন, দেশভাগের যন্ত্রণা এবং জলের রসায়নে তৈরি এক জাদুকরী বুননকৌশল—যা সাধারণ দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না।
টাঙ্গাইল শাড়ি কেবল একটি পোশাক বা পরিধেয় বস্ত্র নয়; এটি বাংলার ভৌগোলিক বাস্তবতা এবং বসাক সম্প্রদায়ের টিকে থাকার একদীর্ঘ শ্বাসপ্রশ্বাসের নাম। এই অন্তর্ভুক্তি বিজ্ঞান ও শিল্পের স্বীকৃতি—যা টাঙ্গাইলের শাড়িকে জামদানি বা সাধারণ তাঁত থেকে আলাদা করে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। সংবাদের আড়ালে থাকা সেই অজানা গল্পগুলোই এই বুননশিল্পের আসল প্রাণভোমরা।
সবাই জানেন, টাঙ্গাইল শাড়ি টাঙ্গাইলে তৈরি হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন? কেন এই শাড়ি সাভার, নরসিংদী বা অন্য কোনো জেলায় বানালে ‘টাঙ্গাইল’ হয় না?
এর উত্তর লুকিয়ে আছে টাঙ্গাইলের মাটি ও জলের বিশেষ গুণাগুণে। ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে এর স্বীকৃতির মূলেও ছিল এই ভূগোল।
গবেষণা ও স্থানীয় প্রবীণ কারিগরদের মতে, টাঙ্গাইল শাড়ির সুতা প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় যে ‘মাড়’ দেওয়া হয়, তাতে ব্যবহৃত পানির একটি বিশেষ ভূমিকা আছে। ধলেশ্বরী ও লৌহজং নদীর অববাহিকার পানির পিএইচ মান এবং এতে মিশে থাকা খনিজ উপাদান সুতার রং ধারণক্ষমতা এবং কোমলতা নির্ধারণ করে দেয়। পশ্চিম বাংলার ফুলিয়াতে কারিগরেরা একই সুতা ও নকশা ব্যবহার করা সত্ত্বেও টাঙ্গাইলের সেই বিখ্যাত ‘খসখসে অথচ মোলায়েম’ ফিনিশিং আনতে পারেননি। এই ‘ফিনিশিং’ বা শাড়ির শেষ স্পর্শটিই টাঙ্গাইল শাড়ির আসল রহস্য, যা কেবল এই নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের পানিতেই সম্ভব।
তা ছাড়া টাঙ্গাইলের বাতাসে আর্দ্রতার যে প্রাকৃতিক ভারসাম্য, তা সুতা ছিঁড়ে যাওয়া রোধ করে এবং তাঁতিকে একটানা কাজ করতে সাহায্য করে। এটি এমন এক ‘মাইক্রো-ক্লাইমেট’ বা অণু-জলবায়ুগত সুবিধা, যা কৃত্রিমভাবে কারখানায় বা এসির বাতাসে তৈরি করা প্রায় অসম্ভব।
ইতিহাস বলছে, উনিশ শতকের শেষ দিকে টাঙ্গাইল শাড়ির বিবর্তন শুরু। কিন্তু এর নেপথ্যে ছিল এক বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব। আদি টাঙ্গাইল শাড়ি আজকের মতো ছিল না। এর নকশায় আমূল পরিবর্তন আসে স্বদেশি আন্দোলনের সময়। কিন্তু আসল ‘গেম চেঞ্জার’ ছিলেন টাঙ্গাইলের বসাক তাঁতিরা, যারা জ্যামিতিক বুদ্ধিমত্তায় ছিলেন অসামান্য।
অজানা বিষয়টি হলো—টাঙ্গাইল শাড়ি ‘জামদানি’র কাজিন বা নিকটাত্মীয় হলেও এর বুননকৌশল সম্পূর্ণ ভিন্ন। জামদানিতে নকশা তোলা হয় সুতা ঘুরিয়ে, যা অনেকটা এমব্রয়ডারির মতো এবং এতে প্রচুর সময় লাগে। কিন্তু টাঙ্গাইল শাড়ির বুননে তিরিশ ও চল্লিশের দশকে ‘জাকার্ড’ মেশিনের ব্যবহার শুরু হওয়ার পর এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। বসাকরা জাকার্ডের পাঞ্চ কার্ডে এমন জটিল গাণিতিক হিসাব বসিয়েছিলেন যে শাড়ির জমিন ঠিক রেখে পাড়ে অত্যন্ত ভারী ও নিখুঁত নকশা ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়, যা হাতে আঁকার চেয়েও সূক্ষ্ম।
‘নকশা আঁকা’ আর ‘নকশা বোনা’র মধ্যে যে গাণিতিক ফারাক, তা টাঙ্গাইলের তাঁতিরা বংশপরম্পরায় মস্তিষ্কে ধারণ করেন। একটি শাড়ির জমিনে কত হাজার সুতা থাকবে এবং পাড়ের ডিজাইনের জন্য কতগুলো ‘ঘর’ বাদ দিতে হবে—এই হিসাবটি কোনো খাতায় লেখা থাকে না, এটি থাকে তাঁতির আঙুলের ডগা ও তাঁর মস্তিষ্কের নিউরনে। একে অনায়াসেই বলা যায় ‘তাঁতের অ্যালগরিদম’।
ইউনেসকোর ফাইলে হয়তো লেখা আছে ‘কটন বা সিল্ক’। কিন্তু টাঙ্গাইল সুতি শাড়ির যে মুচমুচে অথচ আরামদায়ক ভাব, তার সিক্রেট রেসিপিটি খুব কম মানুষই জানেন। সাধারণ তাঁতের শাড়িতে ভাতের মাড় ব্যবহার করা হয়। কিন্তু টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী ও খাঁটি তাঁতিরা ব্যবহার করেন ‘খইয়ের মাড়’ এবং তার সঙ্গে নির্দিষ্ট অনুপাতে চুন ও তেলের মিশ্রণ।
খইয়ের মাড় সুতাকে এমন এক মসৃণতা দেয়, যা সাধারণ ভাতের মাড় দিতে পারে না। এরপর সুতাগুলোকে কড়া রোদে শুকানো হয় এবং ভোরবেলার শিশিরে ভেজানো হয়—এই গরম ও ঠান্ডার ‘শক ট্রিটমেন্ট’ সুতাকে করে তোলে শক্ত কিন্তু নমনীয়। স্থানীয় ভাষায় এই প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় ‘শানা’ দেওয়া। এটি শাড়ির আয়ু বাড়ায় বহুগুণ। একজন ক্রেতা যখন শাড়িটি প্রথমবার ধোবেন, তখন মাড় চলে যাবে, কিন্তু সুতার বুনন আলগা হবে না—এটাই টাঙ্গাইল শাড়ির ‘ইঞ্জিনিয়ারিং’।
১৯৪৭-এর দেশভাগ এবং ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় টাঙ্গাইলের বহু দক্ষ বসাক তাঁতি ভারতের নদীয়া জেলার ফুলিয়া ও সমুদ্রগড়ে গিয়ে বসতি গড়েন। ফলে ভারতেও ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ নামে একটি বিশাল বাজার ও শিল্প গড়ে ওঠে।
গত বছর ভারত যখন টাঙ্গাইল শাড়িকে নিজেদের জিআই পণ্য হিসেবে দাবি করেছিল, তখন দুই দেশের মধ্যে বড় ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি হয়। কিন্তু বুননশৈলীর গভীরে গেলে দেখা যায়, বাংলাদেশের টাঙ্গাইল এবং ভারতের ফুলিয়ার টাঙ্গাইলের মধ্যে গত কয়েক দশকে একটি মৌলিক চরিত্রগত পার্থক্য তৈরি হয়ে গেছে।
প্রথমত, বাংলাদেশের টাঙ্গাইল শাড়িতে এখনো ৮০-১০০ কাউন্টের অতি সূক্ষ্ম সুতা ব্যবহারের প্রবণতা বেশি। অন্যদিকে, বাণিজ্যিক প্রসারের কারণে ফুলিয়ায় কিছুটা মোটা সুতা ও সিন্থেটিক মিশ্রণের ব্যবহার বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, নকশার দর্শন। বাংলাদেশের কারিগরেরা এখনো প্রকৃতির মোটিফ—যেমন মাছের আঁশ, ধানের শিষ, কলকা বা লতাপাতার সনাতন রূপ ধরে রেখেছেন। অন্যদিকে, ভারতের বুননে আধুনিক ও ফিউশনধর্মী নিরীক্ষা বেশি। তৃতীয়ত, টেক্সচার। বাংলাদেশের টাঙ্গাইল শাড়ির সেই সনাতন ‘খসখসে’ ভাবটি অটুট, যা ফুলিয়ার ‘সফট ফিনিশ’ শাড়ি থেকে আলাদা।
টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে কথা বললে সাধারণত মাকু চালানো পুরুষ তাঁতির ছবিই চোখের সামনে ভাসে। কিন্তু এই শিল্পের ৫০ শতাংশের বেশি কাজ করেন নারীরা, যা কখনোই খবরের শিরোনামে আসে না।
শাড়ি বোনার আগে সুতা ছড়াতে হয়, যা স্থানীয়ভাবে ‘নলি ভরা’ নামে পরিচিত। এই কাজটি অত্যন্ত ধৈর্যের এবং এটি মূলত বাড়ির নারীরাই করেন। ভোর চারটায় ঘুম থেকে উঠে, সংসারের কাজ সেরে, সুতা রং করা, শুকানো এবং নলি ভরার কাজ করেন তাঁরা। তাঁতের খটখট শব্দে যদি পুরুষদের ঘাম থাকে, তবে সেই সুতার প্রতিটি প্যাঁচে মিশে আছে নারীদের অদৃশ্য শ্রম ও মমতা।
টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপাদন যেমন বৈচিত্র্যময়, এর বিপণনব্যবস্থা বা ‘হাট কালচার’ নিজেও একটি গবেষণার বিষয়। বাজিতপুর ও করটিয়ার হাট বসে খুব ভোরে, সূর্য ওঠার আগে।
এর পেছনে রয়েছে ঐতিহাসিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণ। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে মহাজনদের শোষণ এবং পুলিশি ঝামেলা এড়াতে তাঁতিরা অন্ধকারে লেনদেন শেষ করতে চাইতেন। সেই প্রথা আজও রয়ে গেছে। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো হাটের লেনদেন পদ্ধতি। এখানে উচ্চস্বরে দাম হাঁকানো হয় না। কাপড়ের নিচে হাত দিয়ে ক্রেতা ও বিক্রেতা আঙুলের ইশারায় দরদাম ঠিক করেন, যাতে পাশের জন বা অন্য কেউ সেই গোপনীয়তা ভাঙতে না পারে। এই ‘গোপন বাণিজ্য’ টাঙ্গাইল শাড়ির সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
টাঙ্গাইল শাড়ি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—যন্ত্র যত দ্রুতই চলুক না কেন, মানুষের হাতের স্পর্শ, ধলেশ্বরীর জল আর বসাকদের জ্যামিতিক মেধার যে সংমিশ্রণ, তা কোনো অ্যালগরিদম নকল করতে পারে না। ইউনেসকোর তালিকায় স্থান পাওয়া মানে এখন থেকে এই শাড়ি আর কেবল ‘পণ্যের’ কাতারে থাকল না, এটি হয়ে উঠল মানবজাতির সৃজনশীলতার এক বৈশ্বিক নিদর্শন।

টাঙ্গাইল শাড়ির নাম এলেই এক ধরনের মমতাভরা গর্ব জেগে ওঠে। আজ যে শাড়িকে আমরা টাঙ্গাইল শাড়ি নামে চিনি, একসময় তার নাম ছিল ‘বেগম বাহার’। টাঙ্গাইল অঞ্চলের তাঁতিরা বহু প্রজন্ম ধরে যে বয়ন-কৌশল বাঁচিয়ে রেখেছেন, তার শিকড় প্রাচীন বাংলারই ইতিহাসে।
১ ঘণ্টা আগে
ইউনেসকোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় এবার যুক্ত হলো বাংলাদেশের শতাব্দীপ্রাচীন টাঙ্গাইল শাড়ি বয়নশিল্প। ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ বা অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কী? ইউনেসকো কবে থেকে এই স্বীকৃতি দিচ্ছে? এই স্বীকৃতি কেন গুরুত্বপূর্ণ? কীভাবে হয় ইউনেসকোর ঐতিহ্য তালিকাভুক্তি?
৪ ঘণ্টা আগে
বগুড়ার দত্তবাড়িয়ায় বিড়ালকে জবাই করে হত্যা কিংবা পাবনার ঈশ্বরদীতে সদ্যজাত আটটি কুকুর ছানাকে বস্তায় ভরে পুকুরে ফেলে মেরে ফেলার ঘটনা—সম্প্রতি এমন নিষ্ঠুরতা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সন্তান হারিয়ে মা কুকুরের আর্তনাদের ভিডিও নাড়া দিয়েছে মানুষের বিবেককে।
৯ ঘণ্টা আগেআজ ১০ ডিসেম্বর, আন্তর্জাতিক প্রাণী অধিকার দিবস। বাংলাদেশের জাতীয় চিড়িয়াখানা দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সময় ছবি তুলেছেন ঢাকা স্ট্রিমের ফটো এডিটর, ফটো সাংবাদিক আশরাফুল আলম।
৯ ঘণ্টা আগে