১৯৪৬ সালের অক্টোবর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। হিটলারের সাম্রাজ্যের পতন হয়েছে, কিন্তু পৃথিবী তখনও শিউরে উঠছে নাৎসিদের অপরাধে। তখন ন্যুরেমবার্গ শহরে শুরু হয় ইতিহাসের প্রথম আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এই শহরই একসময় ছিল নাৎসি প্রোপাগান্ডার (উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা) কেন্দ্র, যেখানে হিটলারের নির্দেশে আলবার্ট স্পেয়ার বানিয়েছিলেন আকাশভেদী সার্চলাইটের আলোর প্রাচীর ‘ক্যাথিড্রাল অব লাইট।
হিটলারের বন্ধু আলবার্ট স্পেয়ার ছিলেন নাৎসি জার্মানির প্রধান স্থপতি। যুদ্ধ উপকরণ প্রস্তুতি-বিষয়ক মন্ত্রীও হয়েছিলেন। ন্যুরেমবার্গ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত ২১ জন নাৎসি নেতার একজন ছিলেন তিনি। ১০ জন বড় বড় নাৎসি নেতা ফাঁসিতে ঝুললেন। কিন্তু তিনি বেঁচে গেলেন। কীভাবে?
কারণ, অন্যদের মতো আলবার্ট স্পেয়ার যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বলেননি, ‘আমি শুধু আদেশ মেনেছি।’ বরং বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে হিটলারের প্রসঙ্গ থেকে নিজেকে দূরে রাখেন এবং অপরাধের দায় ‘সমষ্টিগতভাবে’ স্বীকার করে নেন। এই কৌশলই তাঁকে মৃত্যুদণ্ড থেকে বাঁচায়।
‘ক্যাথিড্রাল অব লাইট। সংগৃহীত ছবি২০ বছর কারাভোগের পর ১৯৬৬ সালে আলবার্ট স্পেয়ার বার্লিনের স্প্যান্ডাউ কারাগার থেকে বের হন। তখনই শুরু হয় আরেক নাটক। মিডিয়ার আলোয় জন্ম হয় নতুন স্পেয়ারের। তাঁর আত্মজীবনী ‘ইনসাইড দ্য থার্ড রাইখ’ বেস্টসেলার হয়। তিনি সংবাদমাধ্যমে একের পর এক সাক্ষাৎকার দিতে থাকেন। ধীরে ধীরে তিনি তৈরি করেন নতুন পরিচয়। নিজেকে উপস্থাপন করতেন এমনভাবে যে তিনি হিটলারের অপরাধ সম্পর্কে কিছু জানতেন না, কিন্তু পরে তা জানার পর গভীর অনুতাপে ভুগেছেন। কেউ তাঁকে বলল ‘ভালো নাৎসি’, কেউ ‘অনুতপ্ত স্থপতি’।
কিন্তু তাঁর এই অনুশোচনা কি সত্যিকারের অনুতাপ, নাকি নিখুঁত অভিনয়?
আলবার্ট স্পেয়ার ছিলেন হিটলারের বন্ধু, আশ্রয়দাতা আর পৃষ্ঠপোষক। ইতিহাসবিদ হাইকে গোর্তেমেকারের ভাষায়, ‘হিটলার নিজেকে শিল্পী মনে করতেন, কিন্তু হতে পারেননি। স্পেয়ারের মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন সেই শিল্পীসত্তা।’
মাত্র ২৫ বছর বয়সে নাৎসি দলে যোগ দিয়েছিলেন স্পেয়ার। হিটলারের বিশ্বাস ছিল তাঁর সাম্রাজ্য চলবে হাজার বছর, আর সেই সাম্রাজ্যের স্থাপত্যও হতে হবে চিরস্থায়ী। এজন্য হিটলার তাঁর প্রিয় স্থপতি স্পেয়ারকে অনেক কাজের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এভাবে হিটলারের আশীর্বাদে স্পেয়ারের হাতে আসে সীমাহীন ক্ষমতা আর অর্থ।
কিন্তু ১৯৭০ সালে বিবিসির মাইকেল চার্লটনের সাক্ষাৎকারে স্পেয়ার বলেছিলেন, এখন তিনি হিটলারকে ইতিহাসের অন্যতম ‘অশুভ মানুষ’ মনে করেন। একইসঙ্গে আবার বলেছিলেন, ‘হিটলারেরও কিছু আকর্ষণীয় দিক ছিল। তিনি ‘‘অনেক সময়’’ একদম স্বাভাবিক মানুষের মতোই ছিলেন।’
স্পেয়ার এই প্রসঙ্গে আরও বলেছিলেন, ‘যুদ্ধের পর আমরা শুধু শুনেছি হিটলার ছিলেন উন্মাদ, সারাক্ষণ চেঁচাতেন। এতে ভবিষ্যতে বিপদ আছে, কারণ যদি কোনো নতুন হিটলার আসে আর সে যদি শান্ত প্রকৃতির হয়, তখন মানুষ ভাববে, ‘‘এ তো হিটলারের মতো না’’। কিন্তু আসলে হিটলারও মানুষ ছিল তাঁর জীবনের অনেক দিক ছিল।’
কেন স্পেয়ার বুঝতে পারেননি হিটলারের রাজত্ব এক অপরাধযন্ত্র, এই প্রশ্নে স্পিয়ারের উত্তর ছিল আরও দায়সারা। তিনি বলেছিলেন, ‘তখন আমি শুধু প্রযুক্তিবিদ ছিলাম। আমাকে এমনভাবে শিক্ষিত করা হয়েছিল যাতে আমি ভাবি না, প্রশ্ন না করি। স্কুলে আমরা শুধু পড়া মুখস্থ করতাম, রাজনীতি নিয়ে কোনো আলোচনাই হতো না। ফলে যখন হিটলারের মতো কেউ সামনে এলো, আমরা তা ভাবতেও শিখিনি।’
স্পেয়ার আরও বলেন, ‘আমরা তখন হতাশাগ্রস্থ প্রজন্ম ছিলাম। ভবিষ্যতের কোনো আশা ছিল না। তখন হিটলার এলেন, আমাদেরকে বললেন, ‘‘তোমরা পারবে, জার্মানি আবার উন্নত হবে।’’ এই আশাটাই ছিল বড় প্রলোভন।’
তবে স্পেয়ারের আত্মজীবনী অনুসারে তাঁর সতর্ক হওয়ার সুযোগ ছিল। ১৯৩৪ সালে নাৎসিরা প্রায় চার শ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করে। স্পেয়ার দেখেছিলেন অফিসে শুকনো রক্তের দাগ, সেখানে একজনকে গুলি করা হয়েছিল। নিজের বইতে এ প্রসঙ্গে স্পেয়ার লিখেছিলেন, ‘আমি তাকালাম না। সেদিনের পর ঘরটা এড়িয়ে চলেছি।’
২০ বছর কারাভোগের পর ১৯৬৬ সালে আলবার্ট স্পেয়ার বার্লিনের স্প্যান্ডাউ কারাগার থেকে বের হয়ে সংবাদমাধ্যমে একের পর এক সাক্ষাৎকার দিতে থাকেন। সংগৃহীত ছবিআত্মজীবনীতে লেখা এই ঘটনা নিয়ে স্পেয়ার বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘ওটা ছিল আমার সম্পূর্ণ নৈতিক ব্যর্থতা। আমি ওই রক্ত দেখে বিষয়টা মনে থেকে মুছে দিয়েছিলাম। ভাবলাম, কিছু হয়নি। যদি একটু ভেবেও দেখতাম, সেদিনই হিটলারকে ছেড়ে চলে যেতাম। কিন্তু যাইনি।’
স্পেয়ারের স্বপ্ন ছিল পুরো বার্লিন পুনর্গঠন করে তার নাম দেওয়া ‘জার্মানিয়া’, বিশ্বের ভবিষ্যৎ রাজধানী। বিশাল গম্বুজওয়ালা ‘গ্রেট হল’ বানাতে চেয়েছিলেন, যার উচ্চতা রোমের সেন্ট পিটার্স বাসিলিকার ১৬ গুণ।
কিন্তু তার আগেই শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, স্পেয়ারের এই স্বপ্ন ভেঙে গেল ১৯৪২ সালে তিনি হয়ে গেলেন মন্ত্রী। যুদ্ধ চালিয়ে যেতে তাঁর কারখানা, খনিতে তিনি ব্যবহার করেন দাসশ্রম। তখন তাঁর হাতে বন্দি শ্রমিকের জীবন-মরণ নির্ভর করত। সাত মিলিয়নেরও বেশি শ্রমিক জার্মান শিল্পকারখানায় কাজ করত। অনেককেই জোরপূর্বক এনেছিলেন শ্রমিক হিসেবে। এর বড় অংশই ছিল স্পেয়ারের নিয়ন্ত্রণে। অনেকেই মারা গিয়েছিল অমানবিক অবস্থায়। ইতিহাসবিদ হিউ ট্রেভর রোপার বলেন, ‘স্পেয়ার জানতেন তিনি কী করছেন। তিনি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের বন্দিদেরও কাজে লাগাতেন।’
ন্যুরেমবার্গ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে স্পেয়ার নিজের দায় এড়াতে সব দোষ চাপান তাঁর উপদেষ্টা ফ্রিটজ সাউকেলের ওপর। প্রসিকিউটর রবার্ট জ্যাকসন বলেন, ‘মিশরের ফেরাউনদের পর এরাই সবচেয়ে নিষ্ঠুর দাসপ্রভু।’ সাউকেলকে ফাঁসি দেওয়া হয় ১৯৪৬ সালের ১৬ অক্টোবর। সাউকেল ফাঁসিতে ঝুললেন, স্পেয়ার রক্ষা পেলেন।
স্পেয়ার সব সাক্ষাৎকারেই বলতেন, হিটলারের অপরাধ সম্পর্কে তিনি কিছু জানতেন না। পরে সব জানার পর গভীর অনুতাপে ভুগেছেন। কিন্তু ইতিহাসবিদদের অনুসন্ধান অন্য কথা বলে। ১৯৭১ সালে হার্ভার্ডের গবেষক এরিখ গোল্ডহাগেন খুঁজে পান, ১৯৪৩ সালে এক বৈঠকে স্পেয়ার উপস্থিত ছিলেন, যেখানে এসএস প্রধান হিমলার প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ‘ইহুদিদের নির্মূল করতে হবে।
বৈঠক প্রসঙ্গে স্পিয়ারের আত্মজীবনীকার গিটা সেরেনি আবার বিবিসিকে বলেন, ‘তিনি হয়তো সরাসরি উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু তাঁর ঘনিষ্ঠ তিন সহকর্মী ছিলেন, যারা তাঁকে অবশ্যই বলেছিল হিমলার কী বলেছিল সেদিন। সেখানে ছিলেন কি না, তা বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় স্পেয়ার এসব খবর জানতেন।
১৯৮১ সালে লন্ডনে বিবিসিকে সাক্ষাৎকার দিতে এসে স্পেয়ারের স্ট্রোক হয়। সেদিন রাতেই তিনি মারা যান ৭৬ বছর বয়সে। তখন প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর নতুন বই ‘দ্য স্লেভ স্টেট’। সেখানে জানা যায়, লন্ডনে স্পেয়ারের গোপন প্রেমিকা ছিল। তাঁর কথা স্পেয়ারের স্ত্রী-সন্তান কেউ জানত না। জীবনের শেষ পর্যন্তও তিনি বেঁচেছিলেন দ্বিমুখী জীবন নিয়ে।
আজ স্পেয়ারের বানানো কোনো স্থাপত্য টিকে নেই। হাজার বছরের জন্য বানানো সেইসব স্থাপত্য যুদ্ধশেষে মাটিতে মিশে গেছে। শুধু ন্যুরেমবার্গের তাঁর অসমাপ্ত র্যালি ভবন এখনও টিকে আছে ইতিহাসের ভয়াবহতার সাক্ষী হিসেবে।
লেখা: বিবিসি অবলম্বনে