‘উইন্টার ইজ কামিং’—এক সময় এটা ছিল শুধু একটি সংলাপ। এখন তা যেন হয়ে উঠেছে লেখক জর্জ আর. আর. মার্টিনের লেখালেখির গতি নিয়ে এক রকম রসিকতার ইঙ্গিত। প্রায় পনেরো বছর পেরিয়ে গেছে, তবু আলোর মুখ দেখেনি তাঁর বহুল প্রতীক্ষিত উপন্যাস ‘দ্য উইন্ডস অব উইন্টার’। আজও মার্টিন ভক্তদের প্রশ্ন একটাই, ‘উইন্টার’ কি সত্যিই আসবে?
‘দ্য উইন্ডস অব উইন্টার’ হচ্ছে ‘সং অব আইস অ্যান্ড ফায়ার’ সিরিজের ষষ্ঠ খণ্ড। এই সিরিজের ওপর ভিত্তি করেই এইচবিও তৈরি করেছিল ‘গেম অব থ্রোনস’ টেলিভিশন সিরিজ, যা ২০১১ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে সম্প্রচারিত হয়েছে।
জর্জ মার্টিনের বইয়ের কোলাজ২০১০ সালের জুনে মার্টিন জানিয়েছিলেন, তাঁর নতুন বই ‘দ্য উইন্ডস অব উইন্টার’-এর চারটি অধ্যায় লেখা শেষ। এর মধ্যে আরিয়ান মার্টেল, আরিয়া স্টার্ক এবং সানসা স্টার্কের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা কাহিনীগুলো সেখানে অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরের মাসে, অর্থাৎ জুলাইয়ে তিনি আরও জানান, প্রায় একশ’র বেশি পৃষ্ঠার বেশি লেখা শেষ।
এরপর ২০১১ সালের এপ্রিলের এক সাক্ষাৎকারে মার্টিন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছিলেন, তিনি আশা করছেন তিন বছরের মধ্যেই বইটি শেষ করতে পারবেন। তখন সেই বছরের জুলাইয়ে প্রকাশিত হয় এই সিরিজের পঞ্চম খণ্ড ‘আ ড্যান্স উইথ ড্রাগনস’। যা এখন পর্যন্ত এই সিরিজের সর্বশেষ প্রকাশিত বই।
তখন ভক্তরা ভেবেছিল, পরের বইটি শিগগিরই আসবে। কিন্তু গল্পটা তখনই বদলে যেতে শুরু করে। শুরু হলো প্রতীক্ষা। ২০১২ সালে তিনি বললেন, চার শ পৃষ্ঠা লেখা হয়ে গেছে। বইটি প্রকাশের লক্ষ্য ২০১৪। কিন্তু ২০১৫–১৬ সালের দিকে এসে তাঁর আশা ডুবে যায় ‘গেম অব থ্রোনস’ টিভি সিরিজে। বইটি টিভি সিরিজের ছয় নম্বর মৌসুমের আগে শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও ব্যর্থ হন। এরপর ২০১৬ সালের শুরুতে নিজের ব্লগে লিখলেন, ‘আমি কিছুই লিখতে পারছি না ‘‘উইন্ডস’’ ছাড়া।’
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই শীতও যেন স্থায়ী হয়ে গেল। ২০১৮ সালে যখন জর্জ আর. আর. মার্টিন ‘ফায়ার অ্যান্ড ব্লাড’ বের করলেন, ভক্তরা তখন বুঝল মার্টিন আপাতত ড্রাগনের রাজবংশেই ব্যস্ত। নতুন বই নয়, এসেছে পুরোনো ইতিহাস। টারগারিয়েন রাজবংশের ইতিহাসভিত্তিক এই বই পরে ‘হাউজ অব দ্য ড্রাগন’ সিরিজের ভিত্তি হয়ে ওঠে।
২০১৯ সালে এক সাক্ষাৎকারে রসিকতা করে মার্টিন বলেছিলেন, ‘২০২০ সালের জুলাইয়ের মধ্যে শেষ না করলে আমাকে ভক্তরা হয়তো বন্দী করবে।’ কিন্তু ২০২০ এল, গেল, আর ‘উইন্ডস’ রয়ে গেল দিগন্তের ওপারে।
এরপর ২০২২ সালের অক্টোবরে মার্টিন আবার জানালেন, বইটির তিন-চতুর্থাংশ সম্পন্ন। প্রায় ১২০০ পৃষ্ঠা লেখা হয়ে গেছে। এক বছর পরের নভেম্বরে তিনি স্বীকার করলেন, সেখানেই তিনি আটকে আছেন। লেখা এগোয়, কিন্তু শেষ আর হয় না। যেন গল্পের চরিত্ররাই তাঁকে বন্দী করে রেখেছে তাদেরই জগতে।
‘গেম অব থ্রোনস’ টেলিভিশন সিরিজের পোস্টার২০২৪ সালের জুলাইয়ে অধৈর্য পাঠকদের উদ্দেশে মার্টিন বলেছিলেন, ‘শেষ হলে নিজেই ঘোষণা করব, তার আগে নয়।’ সেই ডিসেম্বরেই আরেকটি সাক্ষাৎকারে তিনি আবার জানালেন, বইটি প্রকাশে ১৩ বছর দেরি হয়ে গেল। আর যারা বলেন, এই বই হয়তো কোনোদিনই আসবে না, হয়তো তাঁরাই সঠিক।
২০২৫ সালের এপ্রিলে তিনি একটি বায়োটেক প্রকল্পে অংশ নেন। আর সেখানে সমালোচনার মুখে বলে ফেলেন, ‘এই বইটাই এখন আমার জীবনের অভিশাপ।’ এর কয়েক মাস পর জুলাইয়ে তিনি দাবি করেন, বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা এখন প্রায় ১৫০০ হয়ে গেছে। সিরিজের সবচেয়ে বড় খণ্ড হবে এটি। এখানেই শেষ নয়! মাস তিনেক পর অক্টোবরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি হেসে বললেন, ‘কোনো কম্পিউটার ‘‘উইন্ডস অব উইন্টার’’ লিখে শেষ করতে পারবে না।’
এমন মন্তব্যের পর অনেকে বলতে লাগলেন, মার্টিন হয়তো কল্পনার জগতের এক শীতের গল্প লিখতে গিয়ে নিজেই সময়ের তুষারে আটকে গেছেন।
‘দ্য উইন্ডস অব উইন্টার’-এর পর মার্টিনের পরিকল্পনা আছে ‘আ ড্রিম অব স্প্রিং’ সিরিজের সপ্তম ও শেষ খণ্ড বের করার। কিন্তু এই মুহূর্তে এই স্বপ্ন যেন মরীচিকা মাত্র। হয়তো একদিন আমরা সত্যিই পড়ব ‘দ্য উইন্ডস অব উইন্টার’। অথবা হয়তো এটি থেকে যাবে আধুনিক সাহিত্য ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত ‘অলিখিত বই’ হিসেবে।
জর্জ মার্টিন একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘লেখা হচ্ছে যুদ্ধের মতো। তোমরা পরিকল্পনা করবে, যুদ্ধ করবে, জিতবে। অথবা মাঝে মাঝে তোমাকে শুধু লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।’ এখনও তিনি সেই যুদ্ধক্ষেত্রেই আছেন। আর পাঠকেরা অপেক্ষা করছে সেই এক বাক্যের অপেক্ষায়,
‘উইন্টার হ্যাজ ফাইনালি কাম’।