leadT1ad

ডিসমিসল্যাবের বিশ্লেষণ

অনলাইনে ভুয়া তথ্যের দুই–তৃতীয়াংশই এখন রাজনৈতিক

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক

প্রকাশ : ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ২৩: ৫২
ডিসমিসল্যাবের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া ছবি।

আসন্ন ফেব্রুয়ারি মাসের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশে অনলাইনভিত্তিক প্লাটফর্মগুলোতে রাজনৈতিক অপপ্রচার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে যেখানে যাচাইকৃত মোট ভুয়া তথ্যের অর্ধেকেরও কম ছিল রাজনৈতিক, সেখানে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর—এই তিন মাসে সেই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশে (৬৩ শতাংশ)।

দেশের আটটি ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থার যাচাইকৃত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত জুলাই-সেপ্টেম্বরে ছড়ানো রাজনৈতিক ভুয়া তথ্যের অর্ধেকেরও বেশি (৫২ শতাংশ) ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমাবেশ, সংঘর্ষ বা নেতাদের নামে ছড়ানো বানোয়াট বক্তব্য কেন্দ্রিক। এ ছাড়া, রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে নির্যাতন, হত্যা বা দুর্নীতির অভিযোগসংক্রান্ত ভুয়া তথ্যের পরিমাণ ছিল ১৮ শতাংশ।

এই সময়ে রাজনৈতিক অপপ্রচারের কেন্দ্রে ছিল গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশ, শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচন। রাজনীতির বাইরে জুলাই মাসে মাইলস্টোন স্কুলের বিমান দুর্ঘটনা এবং সেপ্টেম্বরে খাগড়াছড়িতে আদিবাসী স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে সৃষ্ট সহিংসতা নিয়েও ব্যাপক ভুয়া তথ্য ছড়িয়েছে।

গ্রাফিক্স, ছবি বা লিখিত পোস্টের চেয়ে অপপ্রচার বেশি ছড়ানো হয় ভিডিও’র মাধ্যমে, যা মোট যাচাইকৃত ভুয়া তথ্যের ৬৬ শতাংশ।

ডিসমিসল্যাবের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া ছবি।
ডিসমিসল্যাবের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া ছবি।

নিজেদের প্রতিবেদনের পাশাপাশি বাংলাদেশের আরও সাতটি ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থার প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে এই বিশ্লেষণ করেছে তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ডিসমিসল্যাব। অন্য সংস্থাগুলো হলো রিউমার স্ক্যানার, বুমবিডি, নিউজচেকার, ফ্যাক্ট ক্রিসেন্ডো, ফ্যাক্ট ওয়াচ, এএফপি বাংলাদেশ, আজকের পত্রিকা। ডিসমিসল্যাব জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে মোট ৯৬০টি স্বতন্ত্র কেস এই প্রতিবেদনের জন্য বিশ্লেষণ করেছে।

রাজনৈতিক অপপ্রচারের চালচিত্র

সমাবেশ নিয়ে ভুয়া তথ্য

জুলাই-সেপ্টেম্বরে রাজনৈতিক অপপ্রচারের একটি বড় অংশজুড়ে ছিল বিভিন্ন সমাবেশের পুরোনো ছবি ও ভিডিওকে নতুন বলে চালিয়ে দেওয়া, অথবা এক দলের সমাবেশকে অন্য দলের বলে দাবি করা। মোট রাজনৈতিক ভুয়া তথ্যের ১৯ শতাংশই ছিল সমাবেশ-সম্পর্কিত। এর মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ পোস্টেই দাবি করা হয়, সমাবেশগুলো জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত ও বর্তমানে নিষিদ্ধঘোষিত আওয়ামী লীগ আয়োজন করেছে। এসব পোস্টের মূল উদ্দেশ্য ছিল নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের কর্মীরা এখনো সক্রিয়—এমন একটি ধারণা তৈরি করা।

গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশে সহিংসতার পর আওয়ামী লীগের ডাকা হরতাল এবং ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী ঘিরেও সমাবেশ নিয়ে ভুয়া তথ্যের ছড়াছড়ি দেখা যায়। এমনকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে তৈরি করা ঢাকা ও চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের সমাবেশের ভুয়া ভিডিও-ও অনলাইনে ছড়ানো হয়।

সংঘর্ষ ও সহিংসতা

রাজনৈতিক অপপ্রচারের আরেকটি বড় অংশ (১৮ শতাংশ) ছিল সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনা নিয়ে। সহিংস ঘটনার পুরোনো বা সম্পর্কহীন ভিডিওকে সাম্প্রতিক বলে দাবি করা হয়। এমনকি কেনিয়ার একটি বিক্ষোভের ভিডিওকে ফরিদপুরে এনসিপি নেতাদের ওপর হামলা এবং ভারতের একটি গ্রামের সভার সংঘর্ষকে বিএনপি-জামায়াতের কর্মীদের সংঘর্ষ বলে চালিয়ে দেওয়া হয়।

গোপালগঞ্জের সহিংসতার সময় তাইওয়ানের একটি ভিডিও ছড়িয়ে দাবি করা হয়, সেনাবাহিনী সেখানে ট্যাংক থেকে গুলি চালাচ্ছে।

বানোয়াট বক্তব্য ও মন্তব্য

যাচাইকৃত রাজনৈতিক ভুয়া তথ্যের ১৬ শতাংশই ছিল বিভিন্ন ব্যক্তির নামে ছড়ানো বানোয়াট মন্তব্য। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা, রাজনৈতিক নেতা বা সাধারণ নাগরিকদের নামে এসব ভুয়া মন্তব্য ছড়ানো হয়, যার অনেকগুলোতেই এআই-জেনারেটেড ভিডিও ব্যবহার করা হয়।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছিলেন অপপ্রচারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। তিনি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বা সুদভিত্তিক অর্থনীতি বিশ্বকে বদলে দিতে পারে—এমন মন্তব্য করেছেন বলে ছড়ানো হয়। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর নামেও ‘দুর্গাপূজা মদ ও গাঁজার উৎসব’—এমন একটি বানোয়াট মন্তব্য প্রচার করা হয়।

দুর্নীতি ও চরিত্রহনন

প্রায় ৮ শতাংশ রাজনৈতিক অপপ্রচারে রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ভুয়া অভিযোগ আনা হয়। বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং এনসিপি নেতা সামান্থা শারমিন, তাসনিম জারা ও নাসীরউদ্দীন পাটওয়ারীর বাড়ি থেকে টাকা উদ্ধারের মতো ভুয়া খবর ছড়ানো হয়।

ডিসমিসল্যাবের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া ছবি।
ডিসমিসল্যাবের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া ছবি।

এর বাইরেও, সম্পর্কহীন যুগলের অন্তরঙ্গ ছবি ব্যবহার করে নির্দিষ্ট রাজনীতিবিদদের চরিত্রহননের চেষ্টা করা হয়। এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ ও তাসনিম জারার চুম্বনের একটি ভুয়া ভিডিও ছড়ানো হয়, যা আসলে ছিল ভারতের একটি যুগলের।

বিদেশি হস্তক্ষেপের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব

এই সময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশি হস্তক্ষেপের বিভিন্ন ষড়যন্ত্র তত্ত্বও ছড়ানো হয়। গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের ওপর হামলার পর এক ব্যক্তির ছবি ছড়িয়ে দাবি করা হয়, তিনি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর এজেন্ট। এ ছাড়া, ভারত, ফিলিপাইন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের সরকার শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের বৈধ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে বা তাঁর হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে—এমন ভুয়া দাবিও করা হয়।

আইনশৃঙ্খলা-সম্পর্কিত অপপ্রচার বৃদ্ধি

খাগড়াছড়িতে আদিবাসী মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে সৃষ্ট সহিংসতাকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা-সম্পর্কিত ভুয়া তথ্যের পরিমাণ ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ১১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার পুরোনো ভিডিওকে খাগড়াছড়ির রাতের দৃশ্য এবং জুলাই অভ্যুত্থানের সময়ের চট্টগ্রামের ছবিকে খাগড়াছড়িতে বাঙালিদের সশস্ত্র হামলা বলে চালানো হয়।

ধর্ম ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে অপপ্রচার কমেছে

তুলনামূলকভাবে, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী (১৯ শতাংশ থেকে ১ শতাংশ) এবং ধর্ম-সম্পর্কিত (৭ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশ) ভুয়া তথ্যের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত