leadT1ad

মিসির আলি কি ভূতে বিশ্বাস করতেন

প্রকাশ : ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ২১: ২৩
স্ট্রিম গ্রাফিক

‘আপনি কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন লজিকই হচ্ছে পৃথিবীর শেষ কথা! লজিকের বাইরে কিছু নেই?’ ‘অনীশ’ উপন্যাসে ‘বুড়ি’ চরিত্রটি মিসির আলিকে প্রশ্ন করার পরে তিনি উত্তরে বলেন, ‘পারব’। আবার মিসির আলির সামনে যদি কোনো ভূত এসে উপস্থিতও হয়, তখনও ভূত বিশ্বাস করবেন না তিনি। কারণ তখন তাঁর মনে হবে, এটি হ্যালোসিনেশন।

যুক্তি ও রহস্যের মাঝে নিখুঁত ভারসাম্য বাংলা সাহিত্যে খুব কম লেখকই রক্ষা করতে পেরেছেন। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদে এই কাজটি খুব ভালোমতই করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন তাঁর পাঠক ও বিশ্লেষকেরা। তাঁর সুবিশাল সাহিত্য জগতে যদি সবচেয়ে জটিল, আকর্ষণীয় ও কিছুটা স্ববিরোধী চরিত্রের নাম নিতে হয়, তবে নিঃসন্দেহে মিসির আলির নামটিই সবার আগে আসবে। একদিকে মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক, বাস্তববাদী চিন্তক, যুক্তির অনুশীলক; অন্যদিকে অজানার প্রতি কৌতূহলী, রহস্যের আকর্ষণে জর্জরিত এক একাকী মানুষ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাবনরমাল সাইকোলজি (অস্বাভাবিক মনবিদ্যা) এই খণ্ডকালীন অধ্যাপক পাঠকদের কাছে বিশুদ্ধ যুক্তির প্রতিচ্ছবি। ভূত-প্রেত, জিন-পরী বা যেকোনো অতিপ্রাকৃত ঘটনাকে যিনি ব্যাখ্যা করেন মনোবিজ্ঞানের জটিল তত্ত্ব আর বিজ্ঞানের সরল সূত্র দিয়ে। তাঁর কাছে অশরীরী আত্মার অস্তিত্ব নেই, যা আছে তা হলো মানুষের মনের বিকার, হ্যালুসিনেশন আর পরিবেশের তৈরি করা বিভ্রম।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, যুক্তির এই লৌহবর্মে আবৃত মিসির আলি কি আজীবন তাঁর বিশ্বাসে অটল থাকতে পেরেছিলেন? মিসির আলি সিরিজের পাতা ওল্টালে, প্রশ্নের উত্তরে 'হ্যাঁ' বা 'না'-এর মতো সহজ নয়। বরং বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের এক ধূসর জগতে তাঁর বসবাস। যেখানে যুক্তি প্রায়শই পথ হারায় আর জেগে ওঠে এক গভীর সংশয়।

‘মিসির আলি কি ভূতে বিশ্বাস করতেন না?’ এমন প্রশ্নের উত্তরও সহজ নয়। খোদ লেখক নিজেই ইচ্ছে করে চরিত্রটি ধোঁয়াশার মধ্যে রেখেছেন।

হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস দেবী। সংগৃহীত ছবি
হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস দেবী। সংগৃহীত ছবি

মিসির আলির দর্শন

কোনো বাড়িতে ভূতের উপদ্রব শুরু হলে সবাই যখন ওঝা খোঁজে, মিসির আলি সম্ভবত খুঁজবেন একজন ভালো ইলেক্ট্রিশিয়ান আর একজন গ্যাস মিস্ত্রিকে। কারণ তাঁর মতে বেশিরভাগ ভৌতিক ঘটনার পেছনে থাকে ত্রুটিপূর্ণ ওয়্যারিং আর কার্বন মনোক্সাইড লিক!

মিসির আলি চরিত্রটির মূল ভিত্তিই হলো যুক্তি। হুমায়ূন আহমেদের মতে, ‘মিসির আলি এমন একজন মানুষ, যিনি দেখার চেষ্টা করেন চোখ বন্ধ করে। যে পৃথিবীতে চোখ খুলেই কেউ দেখে না, সেখানে চোখ বন্ধ করে দেখার এক আশ্চর্য ফলবতী চেষ্টা।’ এই চোখ বন্ধ করে দেখাটাই হলো তাঁর যুক্তিনির্ভর বিশ্লেষণ। প্রতিটি রহস্যময় ঘটনাকে ব্যবচ্ছেদ করেন একজন মনোবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে। তাঁর কাছে ভয় হলো অ্যাড্রেনালিন হরমোনের নিঃসরণ। অস্বাভাবিক আচরণ হলো সিজোফ্রেনিয়া বা মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারের মতো মানসিক রোগের লক্ষণ।

‘দেবী’ উপন্যাসে রানুর অলৌকিক ক্ষমতার পেছনে তিনি খুঁজে পান মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার। ‘আমিই মিসির আলি’ উপন্যাসে বিশেষ পাহাড়ি মধু খেয়ে দুঃস্বপ্ন দেখার ঘটনাকে তিনি ব্যাখ্যা করেন রাসায়নিক প্রভাব হিসেবে। কোনো রহস্যের সমাধান করতে না পারলে, মিসির আলি সেটিকে সরাসরি ‘অলৌকিক’ বলে স্বীকার করেন না। বরং নিজের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়ে সেটিকে তুলে রাখেন তাঁর বিখ্যাত ‘আনসলভড’ ডায়রিতে। এই ডায়রিটিই প্রমাণ করে, তিনি অজ্ঞতাকে মেনে নিতে রাজি, কিন্তু অবৈজ্ঞানিক বিশ্বাসকে নয়।

যুক্তির দেয়ালে ফাটল

সব বল কি আর গ্যালারিতে পাঠানো যায়? মাঝে মাঝে ইয়র্কারে বোল্ডও তো হতে হয়। মিসির আলির যুক্তির জগতেও তেমন কিছু বাউন্সার এসেছে।

মিসির আলির এই ইস্পাতকঠিন যুক্তির জগৎ বহুবার কেঁপে উঠেছে ব্যাখ্যাতীত সব ঘটনায়। এমন অনেক মুহূর্ত তাঁর জীবনে এসেছে, যখন মনোবিজ্ঞানের কোনো তত্ত্বই ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে যথেষ্ট ছিল না। এই অমীমাংসিত অধ্যায়গুলোই মিসির আলির ভূত-বিশ্বাস নিয়ে বিতর্কের জন্ম দেয়। তিনি নিজে ভূত বা অশরীরীতে বিশ্বাস না করলেও, প্রকৃতির কিছু রহস্যময়তার সামনে দাঁড়িয়ে নির্বাক হয়েছেন।

পাঠক হিসেবে আমরা দেখি, এই ‘হ্যালুসিনেশন’-এর প্রভাব কতটা বাস্তব। দেবীর স্পর্শে তাঁর যন্ত্রণা কমে আসা, তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা—এগুলো কোনোভাবেই মিসির আলির যুক্তির জগতে খাপ খায় না।

‘বাঘবন্দি মিসির আলি’ উপন্যাসে যখন আমরা মিসির আলিকে বলতে শুনি, ‘জগতের বড় বড় রহস্যের সমাধান বেশির ভাগ থাকে অমীমাংসিত। প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে। রহস্যের মীমাংসা তেমন পছন্দ করে না।’ তখন হয়তো আমাদের মনেও সন্দেহ জাগে, যুক্তিবাদী এই মানুষটার মধ্যেও হয়তো কিছুটা ধোঁয়াশা আছে, ধন্ধ আছে।

এই রহস্যময়তার সবচেয়ে শক্তিশালী উদাহরণ সম্ভবত ‘নিশীথিনী’ উপন্যাস। মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত ফিরোজের লোহার রডের আঘাতে মিসির আলি যখন জীবন-মৃত্যুর সুতোর ওপর ঝুলছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে এক অলৌকিক সত্তার আবির্ভাব ঘটে। এক দেবীমূর্তি, যাঁর শরীর থেকে ভেসে আসছে চাঁপা ফুলের সুবাস, যাঁর পায়ে নূপুরের শব্দ। সেই দেবীমূর্তি কেবল মিসির আলির জীবনই রক্ষা করেন না, বরং নীলুর সঙ্গে তাঁর ভবিষ্যৎ পরিণতির কথাও বলেন।

মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর মিসির আলি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেন ঘটনাটিকে যুক্তির ছাঁচে ফেলতে। নিজেকে বোঝান, ‘এসব আমার কল্পনা। উইশফুল থিংকিং। দেবী আবার কী?’

সত্যি বলতে, লোহার রড দিয়ে মাথায় আঘাত খাওয়ার পর চাঁপা ফুলের গন্ধওয়ালা কোনো দেবী যদি বাঁচাতে আসেন, তবে সেটাকে ‘উইশফুল থিংকিং’ না বলে স্রেফ ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে মেনে নিলেই বোধহয় ভালো হতো। কিন্তু তিনি মিসির আলি, ধন্যবাদ জানানোর আগেও ঘটনার মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা খুঁজবেন! এইতো স্বাভাবিক।

অন্যদিকে পাঠক হিসেবে আমরা দেখি, এই ‘হ্যালুসিনেশন’-এর প্রভাব কতটা বাস্তব। দেবীর স্পর্শে তাঁর যন্ত্রণা কমে আসা, তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা—এগুলো কোনোভাবেই মিসির আলির যুক্তির জগতে খাপ খায় না।

একইভাবে ‘মিসির আলি আনসলভ্‌’ গল্পগ্রন্থে উঠে আসা বিভিন্ন ঘটনা বারবার মিসির আলিকে তাঁর যুক্তির সীমানায় এনে দাঁড় করিয়েছে। তিনি এসব ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজে ফেরেন, কিন্তু অনেকবারই ব্যর্থ হন। এই ব্যর্থতাকে মেনে নিয়ে প্রকৃতির বিশালতার কাছে নিজের অসহায়ত্বের কথাও স্বীকার করেন অকপটে।

বিশ্বাস ও সংশয়ের দোটানায় এক মানবীয় চরিত্র

শেষ পর্যন্ত তাহলে মিসির আলিকে আমরা কোন কাতারে ফেলব? ভূতে বিশ্বাসী না অবিশ্বাসী?

এর সরাসরি উত্তর হলো, মিসির আলি প্রচলিত অর্থে ভূতে বিশ্বাস করতেন না। তিনি আত্মা, প্রেত বা কোনো ধরনের অশরীরী সত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করতেন না। একনিষ্ঠ যুক্তিবাদী এবং বিজ্ঞানমনস্ক এক চরিত্র। কিন্তু একই সঙ্গে লেখক হুমায়ূন আহমেদের মুনশিয়ানায় মিসির আলি রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে এতটাই পাঠকের কাছাকাছি চলে এসেছেন যে, তাঁর ব্যর্থতা বা ব্যাখ্যা করতে না পারা ঘটনাগুলো আমাদের কাছে অতিপ্রাকৃত বিশ্বাস আকারেই হাজির হয়।

মিসির আলি ভূতে বিশ্বাস না করলেও, ‘অমীমাংসিত রহস্যে’ বিশ্বাস করতেন। তিনি জানতেন, বিজ্ঞান এখনও সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি, তবে একদিন অবশ্যই পারবে। তাই তো দেবীর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে মিসির আলি বলেন, ‘আজ জানি না, কিন্তু একদিন জানব। আমি না জানলেও আমার পরবর্তী বংশধর জানবে।’

তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? মিসির আলি ভূতে বিশ্বাস করতেন কি না, এই প্রশ্নটি আসলে একটা ফাঁদ। তিনি বিশ্বাস করতেন না, কিন্তু পুরোপুরি অবিশ্বাস করার মতো প্রমাণও তাঁর হাতে ছিল না। মিসির আলি একদিকে যেমন যুক্তিকেও আঁকড়ে ধরেছিলেন, অন্যদিকে প্রকৃতির বিশাল রহস্যের সামনে দাঁড়িয়ে বিস্মিতও হয়েছেন। ‘অন্যভুবন’ গল্পে তিন্নি যেভাবে মিসির আলির স্মৃতির একটি নির্দিষ্ট অংশ মুছে দিয়েছিলেন, আমরাও সেভাবে মিসির আলি চরিত্রের অতিপ্রাকৃতের সামনে আত্মসমর্পণ ভুলে গিয়ে তাঁর ক্ষুরধার যুক্তি দিয়ে সমস্যার সমাধানেই মনোযোগ দিতে চাই। মিসির আলি আমাদের জন্য হয়ে ওঠেন বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক চিরন্তন জিজ্ঞাসার নাম।

Ad 300x250

সম্পর্কিত