ম্যারাডোনা মারা গেছেন, এই খবর শোনার পর সেদিন যেন গোটা পৃথিবী থেমে গিয়েছিল এক মুহূর্তের জন্য। আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এইরেসে মানুষ নেমে এসেছিল রাস্তায়। কান্নায় ভেসে গিয়েছিল সরকারি প্রাসাদের সামনে রাখা তাঁর কফিন। এমন শোক আর্জেন্টিনা আর কোনোদিন দেখেনি। মানুষ কাঁদছিল, যেন নিজেরই কোনো ঘনিষ্ঠ মানুষ চলে গেছে।
কিন্তু গোটা আর্জেন্টিনা কীসের শোকে কাতর ছিল? শুধু ডিয়েগো ম্যারাডোনা চলে যাওয়ার শোকে? নাকি নিজের জীবনের সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর জন্য, যখন টেলিভিশনের পর্দায় নীল-সাদা জার্সিতে এক যুবক মাঠে জাদু দেখাতেন?
ম্যারাডোনা মানে আনন্দ। ম্যারাডোনা মানে আর্জেন্টাইনদের জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল মুহূর্তগুলো। কারণ, তাঁর খেলায় অসম্ভবকে সম্ভব হতে দেখেছিল আর্জেন্টিনাসহ গোটা দুনিয়ার মানুষ। ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ ছিল তার প্রমাণ। যখন তিনি একাই পুরো টুর্নামেন্টের গতিপথ বদলে দিয়েছিল। তখন আর্জেন্টিনা সদ্য সামরিক শাসনের দুঃসময় পেরিয়ে এসেছে। সেই সময় ম্যারাডোনা হয়ে উঠেছিলেন ঐক্যের প্রতীক। তিনি মানুষকে এক করেছিলেন, একসঙ্গে চিৎকার করার আনন্দে।
'হ্যান্ড অফ গড' যাকে বলা হয় 'গোল অফ সেঞ্চুরি' ছবি: গোল ডটকমম্যারাডোনার নৈপুণ্য দেখলে মনে হতো ফুটবলের ঈশ্বর যেন মাঠে নেমে এসেছেন। অনেকে বলতেন, বল পায়ে ম্যারাডোনা একধরনের ‘শিল্পকলা’। এক ফুটবল গবেষক বলেছিলেন, ‘ম্যারাডোনার মধ্যে যে সৃষ্টিশীল উন্মাদন ছিল, তা বেটোফেনের সিম্ফনি বা শেকসপিয়রের নাটকের সমান।’ কারণ, ফুটবলে তাঁর প্রতিটি টাচ, প্রতিটি পাস ছিল তাল ও ছন্দের অংশ।
ম্যারাডোনাকে নিয়ে সবচেয়ে প্রচলিত বিতর্ক, পেলে নাকি ম্যারাডোনা কে বড়? অনেকেই অনেক যুক্তি আর পরিসংখ্যান দেখান। পেলের তিনটা বিশ্বকাপ আছে! লিওনেল মেসি কিন্তু বলেছেন, ‘আমাদের আর্জেন্টাইনদের জন্য ডিয়েগো ম্যারাডোনাই সবচেয়ে বড় আইডল। ডিয়েগো সবকিছুর ঊর্ধ্বে।’
আর এখানে তুলনা করা মানেই ভুল করা। কারণ, ম্যারাডোনা কখনো সমান প্রতিদ্বন্দ্বিতার ময়দানে নামেননি। তিনি লড়েছিলেন একা। ১৯৮৬-র আর্জেন্টিনা দলটা মোটামুটি ভালোই ছিল, কিন্তু অসাধারণ নয়। আর তিনি সেই সাধারণ দল নিয়ে জিতেছিলেন বিশ্বকাপ।
সেই বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটি ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত। প্রথম গোল ‘হ্যান্ড অব গড’, যেটা নিয়ে আজও বিতর্ক শেষ হয়নি। এ প্রসঙ্গে ফুটবল, পলিটিক্স আর পপুলার কালচার নিয়ে কাজ করা হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিসকিন্ড বলেছিলেন, ‘ইউরোপ-আমেরিকার চোখে হ্যান্ড অব গড ‘চিটিং’ হতে পারে। কিন্তু লাতিন আমেরিকার মানুষের কাছে সেটা ছিল বুদ্ধির জয়, ঔপনিবেশিক ক্ষমতার বিরুদ্ধে চুপচাপ বিদ্রোহ।’ তারপর এসেছিল সেই ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’, যেখানে ম্যারাডোনা একে একে ছয়জনকে কাটিয়ে গোল করলেন। সেটা আসলে দশ সেকেন্ডে তৈরি হয়ে যাওয়া অমর শিল্প।
ম্যারাডোনা মানে আর্জেন্টাইনদের জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল মুহূর্তগুলো। সংগৃহীত ছবিকিন্তু ম্যারাডোনাকে বোঝার জন্য শুধু ফুটবল দেখা যথেষ্ট নয়। তাঁকে বুঝতে হয় তাঁর জন্মস্থান থেকে। বুয়েনস এইরেসের উপকণ্ঠের ভিলা ফিওরিতো নামের সেই বস্তির দিকে তাকাতে হবে। আট ভাইবোন, বাবা কারখানার শ্রমিক, মা ঘরের কাজ সামলাতেন। যখন বৃষ্টি হতো, ঘরের ভেতরও পানি পড়ত। খাবার ছিল না সবার জন্য।
বড় হয়ে ম্যারাডোনা বুঝেছিলেন, তাঁর মা সবসময় কেন বলতেন, তাঁর খিদে লাগেনি। আসলে এটা ছিল মায়ের না খাওয়ার অজুহাত, যাতে সন্তানদের ভাগে একটু বেশি খাবার জোটে। সারা জীবন তিনি এই গল্প বলেছেন। যাতে কেউ না ভুলে যায়, কোথা থেকে তিনি এসেছেন। এরপর বিলাসবহুল জীবনের মধ্যেও তিনি আজীবন নিজের শিকড়কে আঁকড়ে রেখেছিলেন।
এই কারণেই দরিদ্র মানুষেরা তাঁকে নিজেদের একজন মনে করতেন। সেটা শুধু আর্জেন্টিনা নয়, নেপলসেও। ইতালির বড় বড় ক্লাবের দাপটের ভেতর ছোট শহরের দল নাপোলিকে তিনি এনে দিয়েছিলেন প্রথম সিরি-আ শিরোপা। নেপলস আজও বলে, ‘আমাদের কাছে ঈশ্বর দুজন। একজন ওপরে, আরেকজন মাঠে।’
তবু ম্যারাডোনার জীবন শুধু আলোয় ভরা ছিল না। ছিল অন্ধকারও। মাদক, নারী, রাজনীতি—সব মিলিয়ে ম্যারাডোনার ছিল অস্থিরতা। তিনি হয়তো ভুল করেছেন, নিজেকে কোনো কোনো সময় ধ্বংসও করেছেন। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন সৎ। কখনো নিজের দোষ ঢাকেননি তিনি।
অনেকে ম্যারাডোনার এই সত্তাকে বোঝার চেষ্টা করেছেন দর্শনের আলোয়। ফ্রেডরিখ নিটশে বলেছিলেন, মানুষের ও শিল্পের ভেতরে দুটি বিপরীত দেবতা কাজ করে—অ্যাপোলো ও ডায়োনিসাস। অ্যাপোলো মানে সামাজিক শৃঙ্খলা, যুক্তি আর সংযম। ডায়োনিসাস মানে উন্মাদনা, নেশা, আবেগ, ধ্বংসের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি আর অনিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা। পেলে হয়তো অ্যাপোলোর প্রতীক। আর ম্যারাডোনা হয়তো ডায়োনিসাসের। ডায়োনিসাসের জগতে আছে শুধু আকাঙ্ক্ষা। সেই আকাঙ্ক্ষা নিজেই এক সৃষ্টিশীল ধ্বংসের শক্তি।
ম্যারাডোনাকে আমাদের ভেতরের সেই ডায়োনিসীয় সত্তার একটি রূপ হিসেবে দেখা যায়। কারণ, তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে জীবনে-সমাজে-পৃথিবীতে এই অনন্ত স্বাধীনতা ও আকাঙ্ক্ষার জন্য জায়গা তৈরি করা জরুরি। ম্যারাডোনা সেই স্বাধীনতারই প্রতীক।
তথ্যসূত্র: দ্য হাভার্ড গেজেট