leadT1ad

জুলাই সনদ, গণভোট এবং হ্যাঁ-না

ঐক্যমত্য কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের চুড়ান্ত সুপারিশমালা হস্তান্তর করেছে। তবে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ কিছু মতামত ও প্রস্তাবনা পাশ কাটিয়ে যাওয়ায় এই সনদ এখন বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। এমনকি গণভোট এবং জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিয়েও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।

মো. শামসুল আলম
মো. শামসুল আলম

স্ট্রিম গ্রাফিক

যে কোনো সংকট থেকে উত্তরণের জন্য জাতীয় ঐক্যমত্যের বিকল্প নেই। আর সেই ঐক্যের বার্তা নিয়ে যখন কোনো কমিশন কাজ শুরু করে, তখন জাতির মনে আশা জাগাটাই স্বাভাবিক। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার কাছে ঐক্যমত্য কমিশনের জমা দেওয়া ৮৪-দফা সুপারিশমালা বা 'জুলাই সনদ' তেমনই একটি প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু সুপারিশগুলো জনসমক্ষে আসার পর ঐক্যের বদলে বিভেদের সুরই যেন তীব্র হয়ে উঠেছে। যা সমাধানের পথ দেখানোর পরিবর্তে দেশকে এক নতুন সংকটের দিকে ঠেলে দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি করেছে।

ঐক্যমত্য কমিশনের নাম এবং কার্যকলাপের মধ্যে এক বিরাট ফারাক শুরুতেই চোখে পড়ে। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর এই সুপারিশমালা চূড়ান্ত করার কথা থাকলেও, অন্যতম প্রধান দল অভিযোগ করেছে যে তাদের দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ মতামত ও প্রস্তাবনাগুলোকে পাশ কাটিয়ে এই সনদ তৈরি করা হয়েছে। তাদের আপত্তির বিষয়গুলোকে বাদ দিয়ে একতরফাভাবে একটি সুপারিশমালাকে 'ঐক্যমত্যের ফসল' হিসেবে উপস্থাপন করা শুধু দুঃখজনকই নয়, বরং এটি এক ধরনের প্রতারণার সামিল। যখন একটি প্রক্রিয়ার ভিত্তিই হয়ে ওঠে অবিশ্বাস, তখন তার ফলাফল কখনোই আস্থা অর্জন করতে পারে না। এই ঘটনাটি কমিশনের নিরপেক্ষতাকে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং জন্ম দিয়েছে গভীর সন্দেহের। প্রশ্ন উঠেছে, এই কমিশনের মূল উদ্দেশ্য কি সত্যিই জাতীয় সংকট নিরসন, নাকি নির্বাচনকে বিলম্বিত করার কোনো কৌশল অথবা বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করা?

এই সনদে 'গণভোট'-এর মতো একটি গণতান্ত্রিক হাতিয়ারের প্রস্তাব করা হলেও, বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি সমাধানের চেয়ে সংকটকে আরও ঘনীভূত করতে পারে। যে সুপারিশমালার ওপর প্রধান দলগুলোরই ঐক্যমত্য নেই, সেটি গণভোটে দেওয়া হলে তার ফলাফল কী হবে? গণভোটে যদি এই সুপারিশমালা প্রত্যাখ্যাত হয়, তাহলে দেশ কোন পথে হাঁটবে? তখন কি আমরা আবার শূন্য থেকে শুরু করব? একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ এবং বিপুল অর্থ ব্যয়ে আয়োজিত গণভোট ব্যর্থ হলে তা কেবল রাজনৈতিক অচলাবস্থাকেই দীর্ঘায়িত করবে। তাছাড়া, গণভোটের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে যখন দুই দিকেই কথা বলা হয়, তখন এর পেছনের উদ্দেশ্য নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। এটি কি জনগণের রায় নেওয়ার আন্তরিক প্রচেষ্টা, নাকি সময়ক্ষেপণের কৌশল—এই প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

সুপারিশমালাগুলো সাধারণ মানুষের জন্য কতটা সহজবোধ্য, সেই প্রশ্নটিও সামনে এসেছে। ৮৪টি সুপারিশের ভাষা এবং তার অন্তর্নিহিত অর্থ সাধারণ জনগণের পক্ষে বোঝা অত্যন্ত কঠিন। ফলে, একটি ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে, যেখানে স্বচ্ছতার বদলে অস্পষ্টতাই বেশি। যখন দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণকারী একটি দলিলের বিষয়বস্তু সম্পর্কেই নাগরিকরা অন্ধকারে থাকে, তখন সেটি নিয়ে অর্থবহ কোনো জনমত তৈরি হওয়া অসম্ভব।

সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলে মনে হয়, দেশ সমাধানের পথ থেকে সরে গিয়ে আবারও জটিলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ঐক্যমত্য কমিশন তার মূল ভূমিকা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে। একদিকে যখন প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বরে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কথা বলছেন, তখন এই বিতর্কিত সনদ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। সরকারের পক্ষ থেকে আক্রমণের আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছে, যা স্থিতিশীলতার বদলে অনিশ্চয়তাকেই নির্দেশ করে। অন্যদিকে, শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকার এবং ক্ষমা চাইতে অস্বীকৃতি প্রমাণ করে যে রাজনৈতিক সমঝোতার পথ এখনও বহু দূর। তার কঠোর অবস্থান এবং পুরোনো অবস্থানে ফিরে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, অতীতের তিক্ততা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি।

এই পরিস্থিতিতে ছোট দলগুলোর ভূমিকাও লক্ষণীয়। অনেক দল, যাদের গণভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, তারাও বড় বড় কথা বলছে এবং ঘন ঘন অবস্থান পরিবর্তন করছে। জামায়াতে ইসলামীর মতো দল, যারা এক সময় সনদে স্বাক্ষর করতে নারাজ ছিল, তারাই আবার স্বাক্ষর করছে। এই স্ববিরোধী অবস্থানগুলো রাজনৈতিক অঙ্গনে সুবিধাবাদ এবং নীতিহীনতার চিত্রই ফুটিয়ে তোলে।

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রধান উপদেষ্টার ভূমিকা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার যে পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, তা এখন এক কঠিন পরীক্ষার মুখে। লন্ডনে বসে তিনি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা থেকে সরে আসলে জাতির কাছে তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে। পুরো দায়ভার এখন তার কাঁধেই বর্তায়। একটি বিতর্কিত এবং অগ্রহণযোগ্য সুপারিশমালার ওপর ভিত্তি করে তিনি যদি এগিয়ে যান, তাহলে তা দেশকে এক গভীর খাদে নিক্ষেপ করতে পারে।

এই অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র পথ হলো পুনরায় আন্তরিক সংলাপে বসা। যে বিষয়গুলো নিয়ে আপত্তি উঠেছে, বিশেষ করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ প্রক্রিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে, সেগুলো নিয়ে সংসদে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। বিএনপি'র পক্ষ থেকে পিএসসি বা দুদকের মতো প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতার বিরোধিতা করা হয়নি; বরং তাদের দাবি ছিল, এই নিয়োগ প্রক্রিয়া সংসদের মাধ্যমে স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন হোক। এই দাবি অযৌক্তিক নয়।

পরিশেষে, জুলাই সনদ যে প্রত্যাশা নিয়ে এসেছিল, তা পূরণে অনেকটা ব্যর্থ। এটি এখন জাতীয় ঐক্যের প্রতীক না হয়ে, জাতীয় বিভেদের দলিলে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি। কালক্ষেপণ না করে এবং একতরফা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা না করে, সব পক্ষের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছানো অপরিহার্য। নইলে যে অন্ধকার সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য জাতি এত ত্যাগ স্বীকার করেছে, সেই অন্ধকারেই আমাদের আবার হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে।

লেখক:
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক

Ad 300x250

সম্পর্কিত