.png)
সাক্ষাৎকারে এম এ সাত্তার মণ্ডল
প্রায় ৫৪ বছরের যাত্রাপথে বাংলাদেশের কৃষি বড় ধরনের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। প্রতিনিয়ত আমাদের চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমছে এবং শিল্পায়ন বাড়ছে। ফলে আগামী দশকের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এখন থেকেই পরিকল্পনা নেওয়া দরকার। গতানুগতিক ভূমি সংস্কারে নয়, বরং আধুনিক প্রযুক্তি ও বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে খামারের ‘ব্যবস্থাপনাগত একত্রীকরণ’ মডেলে যেতে হবে, যেখানে মালিকানা বদলাবে না কিন্তু উৎপাদন বাড়বে। কৃষির রূপান্তরের আমাদের সকলের একযোগে কাজ করা এখন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।

স্ট্রিম ডেস্ক

এম এ সাত্তার মণ্ডল; একুশে পদকপ্রাপ্ত কৃষি অর্থনীতিবিদ। তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) থেকে কৃষি অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থানসহ বিএসসি (সম্মান) ও এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। লন্ডন থেকে পিএইচডি ও অক্সফোর্ডে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা সম্পন্ন করে পাঁচ দশক বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষি অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা ও গবেষণা করছেন এবং বিভাগীয় প্রধান, অনুষদীয় ডিন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। তিনি বাকৃবি-র প্রথম ইমেরিটাস অধ্যাপক। তিনি পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এর প্রফেসরিয়াল ফেলো হিসেবে গবেষণা অব্যাহত রেখেছেন। বাংলাদেশের কৃষির বর্তমান অবস্থা, সংকট, সম্ভাবনা এবং ভবিষ্যৎ রূপকল্প নিয়ে ঢাকা স্ট্রিমের সঙ্গে কথা বলেছেন।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: দেশের কৃষি অর্থনীতি কখনোই পুরোপুরি স্থবির ছিল না। এর প্রবৃদ্ধি কখনো কম, কখনো বেশি—এই ধারা সবসময়ই চলমান ছিল। এটি একটি চলমান রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্যেই আছে। তবে রূপান্তরের গতি কখনো কখনো কিছুটা ধীর হয়। এই মুহূর্তে প্রযুক্তির ব্যবহার, গবেষণা এবং বিশেষ করে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের গতি কিছুটা শ্লথ মনে হচ্ছে। এ কারণে আমাদের পুরো বাজার ব্যবস্থাটি গভীরভাবে বিশ্লেষণের একটি ব্যাপার রয়েছে। তবে সার্বিকভাবে আমি মনে করি, কৃষির রূপান্তর প্রক্রিয়া ঠিক পথেই চলছে।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: বিষয়টা একটু বুঝিয়ে বলি। ৭০ বা ৮০-এর দশকে খামারের আয়তন যত বড় হতো, একক প্রতি উৎপাদনশীলতা তত কম হত। কারণ তখন সনাতন প্রযুক্তিতে বেশি পরিমাণ জমি ব্যবস্থাপনা করা কঠিন ছিল। অন্যদিকে, ক্ষুদ্র চাষিরা পারিবারিক শ্রম দিয়ে নিবিড় চাষের মাধ্যমে বেশি ফসল ফলাত। এখন চিত্রটা পুরোপুরি উল্টে গেছে। বাংলাদেশে এখন পৌনে দুই কোটি কৃষক পরিবারের প্রায় দেড় কোটিই ক্ষুদ্র। উত্তরাধিকার আইনের কারণে বড় ও মাঝারি খামারগুলো ভেঙে যাচ্ছে এবং ক্ষুদ্র কৃষকের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এই ক্ষুদ্র কৃষকদের অনেকেই আবার "পার্ট-টাইম" বা খণ্ডকালীন কৃষক। তারা নিজেদের অল্প জমি আবাদের পাশাপাশি অন্যের জমি বর্গা বা বন্ধকি নিয়ে চাষ করছেন। ফলে, তাদের ফলন বারানোর সাধ থাকলেও নগদ অর্থ ও সময় মত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে না পারায় ফলন তেমনটা বাড়ছেনা। অপরদিকে, যারা বেশি জমি একত্রে চাষ করছে খামারের কার্যকর আয়তন বাড়িয়ে তাদের ফলন স্বাভাবিক ভাবেই বেশি হওয়ার কথা। কাজেই কৃষির কাঠামোগত রূপান্তরটি হতে হবে খামারের গড় আয়তন বর্ধনমুখী।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: আমি এই ক্ষুদ্র ক্ষণ্ডকালীন কৃষকদের "নব্য কৃষক" বলছি। অতীতে যারা ক্ষেতমজুর ছিলেন, তারাই এখন নতুন প্রযুক্তির সহায়তায় কৃষক হয়ে উঠছেন। ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলারের মতো যন্ত্র আসায় কায়িক শ্রমের চাহিদা কমেছে, যা তাদের জন্য সুযোগ তৈরি করেছে। তারা এখন উচ্চমূল্যের ফসল—যেমন শাকসবজি ও ফল চাষে ঝুঁকছে। তবে তাদের মূল সমস্যা হলো জমিগুলো একাধিক খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত থাকা, যা সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনাকে কঠিন করে তোলে।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: ঠিক তাই। খামারের ক্ষুদ্র আয়তন ও কৃষিজমির খণ্ড-বিখণ্ড হওয়া আমাদের সবচেয়ে বড় কাঠামোগত দুর্বলতা। এর সমাধান গতানুগতিক ভূমি সংস্কারে নেই। সমাধান লুকিয়ে আছে ‘ব্যবস্থাপনাগত একত্রীকরণে’। যেমন, একজন শ্যালো টিউবওয়েল মালিক নিজের ছোট জমি ছাড়াও আশপাশের ১০-১৫ বিঘা জমিতে সেচ সেবা দিয়ে একটি ‘কমান্ড এরিয়া’ তৈরি করছেন। এখানে জমির মালিকানা বদলাচ্ছে না, কিন্তু উৎপাদনের প্রয়োজনে জমিগুলো একটি ব্যবস্থাপনার আওতায় আসছে। পাওয়ার টিলার, কম্বাইন হারভেস্টার—সব ক্ষেত্রেই এই মডেল কাজ করছে। এই বাজারভিত্তিক মডেল, যেখানে জমি লিজ বা বন্ধকির মাধ্যমে খামারের কার্যকর আয়তন বৃদ্ধি করা যায়, সেটিকেই আমাদের নীতিগতভাবে সমর্থন দিতে হবে।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: কৃষকের আয় বাড়ছে না, এই কথাটি যেমন ঠিক, তেমনি কোনো কোনো পণ্যে যে আয় বাড়ছে, সেটাও ঠিক। এখানেই আধুনিক ও বাণিজ্যিক কৃষির সুবিধা-অসুবিধাগুলো বোঝার ব্যাপার রয়েছে। আমাদের কৃষি এখন আর শুধু খোরপোশের পর্যায়ে নেই; কৃষক এখন বাজারের জন্য এবং লাভের জন্যই উৎপাদন করে। কিছু কিছু পণ্য যেমন পাট, যা খাদ্য তালিকার বাইরের একটি বৃহৎ কৃষি পণ্য, সেগুলোর বাজার গত চার বছরে তেমন সম্প্রসারণ হয়নি। ফলে কৃষকরা লাভবান হননি। কিন্তু অন্যদিকে তৈলবীজ (তিল, কালিজিরা) বা পেঁয়াজের মতো ফসলে কৃষকরা লাভবান হয়েছেন, যদিও পেঁয়াজের বাজারে দামের ওঠানামা বেশ লক্ষণীয়।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: এই সমস্যাটি নতুন নয়, অর্থনীতিতে একে ‘কবওয়েব থিওরেম’ বলা হয়। কৃষক গত বছরের দাম দেখে পরের বছরের উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেন। এর সমাধান হলো উন্নত ‘ফোরকাস্টিং সিস্টেম’ বা পূর্বাভাস ব্যবস্থা। আবহাওয়া, আন্তর্জাতিক বাজার এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা সম্পর্কে সঠিক তথ্য কৃষকের কাছে পৌঁছানো গেলে তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। আমাদের দেশে এই তথ্যব্যবস্থা এখনো ততটা শক্তিশালী নয়।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: ধানের বিষয়টি বেশ জটিল। চালের দাম মোটামুটি বাড়তির দিকে থাকলেও কৃষকের লাভ নিশ্চিত হচ্ছে না, কারণ উৎপাদন খরচ বেড়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি দ্রুতগতিতে। এর প্রধান কারণগুলো হলো:
১. শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি: ভরা মৌসুমে কৃষি শ্রমিকের সংকট এবং চড়া মজুরি একটি বড় বিষয়।
২. উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি: রাসায়নিক সার, কীটনাশক এবং সেচকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির ভাড়া—সবকিছুর দাম বেড়েছে।
৩. নগদ অর্থের সংকট: এখন কৃষির প্রায় সব উপকরণই বাজার থেকে নগদ অর্থে কিনতে হয়। কিন্তু কৃষকদের হাতে সবসময় প্রয়োজনীয় নগদ অর্থ থাকে না এবং কৃষিঋণও পর্যাপ্ত নয়।
এই ত্রিমুখী সংকটের কারণে চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে কৃষকের হাতে লাভ থাকছে না।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: আমি এদের মধ্যস্বত্বভোগী না বলে "মার্কেটিং এজেন্ট" বা বাজার ব্যবস্থাপনার অংশ বলতে চাই। ধান থেকে চাল তৈরির প্রক্রিয়ায় চালকল মালিকদের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে এবং বাজারের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভরা মৌসুমে তারাই বেপারিদের মাধ্যমে ধানের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে তারাই ধানকে চালে রূপান্তর করে বাজারে ছাড়েন। বেপারিরাও কৃষক, তাই ধানের দামের ওঠানামায় তাদেরও লাভক্ষতির ব্যাপার আছে। ক্ষুদ্র ও বিচ্ছিন্ন কৃষকদের পক্ষে এই বাজার ব্যবস্থায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলা কঠিন। এ কারণে বাজারের সংকটকে কৃষকের লাভ না হওয়ার একটি বড় কারণ।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: আমি ‘মধ্যস্বত্বভোগী’ শব্দটি ব্যবহার করতে চাই না, কারণ এটি একটি নেতিবাচক ধারণা দেয়। আমি তাদের বলি ‘মার্কেটিং এজেন্ট’ বা বিপণন প্রতিনিধি। বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশের কৃষি ব্যবস্থা ক্ষুদ্র ও খণ্ডিত হওয়ায় এই এজেন্টরা বাজারের একটি প্রয়োজনীয় অংশ। যখন একজন কৃষক মাত্র ৫ বা ১০ কেজি পণ্য উৎপাদন করেন, তখন তার পক্ষে সরাসরি ভোক্তার কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। এই এজেন্টরাই সেই সংযোগটি স্থাপন করে। মজার বিষয় হলো, এদের অনেকেই নিজেরাও কৃষক, যারা বাড়তি আয়ের জন্য এই কাজ করেন।
সমস্যাটা এজেন্টদের অস্তিত্বে নয়, বরং তাদের সংখ্যার আধিক্যে। এর মূল সমাধান হলো খামারের উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ানো, যাকে ইংরেজিতে বলে ‘ইকোনমিকস অফ স্কেল’। যখন খামারের আকার বড় হবে এবং উৎপাদনের পরিমাণ বাড়বে, তখন অনেক এজেন্টের প্রয়োজন হবে না এবং কৃষকের দর-কষাকষির ক্ষমতাও বাড়বে।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: ভারসাম্য আনা বেশ কঠিন, কারণ আমাদের উৎপাদক ও ভোক্তার অবস্থান ভিন্ন। দেশের ১৪ কোটি মানুষ গ্রামাঞ্চলে, যারা একাধারে উৎপাদক ও ভোক্তা। তাদের মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্য থাকলেও মূল সংকট তৈরি হয় শহরের ৪ কোটি ভোক্তার জন্য। যখনই সরবরাহ ব্যবস্থায় সামান্য বিঘ্ন ঘটে, তখনই শহুরে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। মোদ্দা কথা, খামারের গড় আয়তন বৃদ্ধি পেলে তাদের মোট উৎপাদনের পরিমাণ বাড়বে, কৃষকের সংখ্যা কমবে এবং সেই সংগে তাদের বাজারে দর কষাকষির সক্ষমতাও বাড়বে।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: না, আমি মনে করি বাণিজ্যিক কৃষি কোনো ঝুঁকি নয়, বরং এটি একটি সময়ের চাহিদা এবং প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া, যার মধ্যে ঝুঁকি মোকাবেলা করার কৌশলগুলো নিহিত থাকার কথা। খোরপোশ কৃষি থেকে বেরিয়ে এসে লাভজনক কৃষিতে উত্তরণ সবার জন্যই জরুরি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বীজ বা প্রযুক্তি দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, কিন্তু তারা মূলত স্থানীয় বেসরকারি কোম্পানির মাধ্যমেই কাজ করে। তারা প্রযুক্তি ও পুঁজি নিয়ে আসছে, যার ফলে আমরা সারা বছর ধরে উচ্চমূল্যের শাকসবজি পাচ্ছি। হাইব্রিড জাতের কারণে উৎপাদন বাড়ছে। এটা বাস্তবতা।
ক্ষুদ্র কৃষকরাও এর থেকে লাভবান হচ্ছেন। তারাই এখন সবজি চাষে সবচেয়ে এগিয়ে, কারণ এটি শ্রমনিবিড় এবং তাদের পারিবারিক শ্রম এখানে কাজে লাগছে। আমাদের শুধু খেয়াল রাখতে হবে যে এই বাণিজ্যিক কৃষিতে উৎপাদিত পণ্য যেন নিরাপদ হয়। কীটনাশক বা অন্যান্য উপকরণের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করাটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: কৃষিকে লাভজনক করতে হলে প্রযুক্তির কোনো বিকল্প নেই। আমরা এখন সনাতন কৃষি বা সবুজ বিপ্লবের পর্যায় পেরিয়ে ‘ডিজিটাল কৃষি’র যুগে প্রবেশ করছি। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো ড্রোন। একদিকে যখন শ্রমিকের সংকট, অন্যদিকে তখন মাটির গুণাগুণ বিচার করে সঠিক পরিমাণে সার ও কীটনাশক প্রয়োগের জন্য ড্রোনের মতো প্রযুক্তি অপরিহার্য। ধরুন, কোনো ভুট্টা ক্ষেতে ‘আর্মি ফলওয়ার্ম’ পোকার আক্রমণ হলো। দুই-তিন ঘণ্টার মধ্যে স্প্রে না করলে পুরো ফসল নষ্ট হয়ে যাবে। একজন ক্ষুদ্র কৃষকের পক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে সেই ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন। কিন্তু একটি ড্রোন সার্ভিস থাকলে তা সহজেই সম্ভব। একইভাবে ‘ক্রপ রোবোটিক্স’ এখন আর স্বপ্ন নয়। একটি সাধারণ মোটরবাইকের দামেই এই প্রযুক্তি পাওয়া সম্ভব। একজন তরুণ উদ্যোক্তা একটি রোবট কিনে পুরো গ্রামে সেবা দিতে পারেন। কৃষককে এই প্রযুক্তিগুলোর মালিক হতে হবে না, তাকে শুধু সেবাটি কেনার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে, ঠিক যেমনটি ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলারের ক্ষেত্রে হয়েছে। আর এই প্রযুক্তিগুলোর সফল প্রয়োগের জন্যই আমাদের কৃষি শিক্ষা ও গবেষণায় বিনিয়োগ আরও বাড়াতে হবে।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: আমি এটিকে অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে দেখি। এই শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তারাই আমাদের কৃষির ভবিষ্যৎ। তারা উচ্চমূল্যের কৃষিতে, যেমন—আম, পেয়ারা, কলার বাগান বা হাস্মুরগি, দুধ ও মাছের খামারে বিনিয়োগ করছে। তবে তাদের একটি বড় অংশ এখনো ধান বা প্রধান খাদ্যশস্য উৎপাদনে আসছে না, কারণ সেখানে ঝুঁকি এবং বিনিয়োগের ধরন ভিন্ন। যদি খামারের আয়তন ‘ব্যবস্থাপনাগত একত্রীকরণের’ মাধ্যমে বাড়ানো যায়, তবে এই তরুণরা হাই-টেক প্রযুক্তি নিয়ে ধান উৎপাদনেও আসবে বলে আমার বিশ্বাস। ইতিমধ্যে ধান গমের বীজ উৎপাদনে শিক্ষিত তরুন উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসছেন। তখন আমাদের ‘ইল্ড গ্যাপ’ বা ফলনের পার্থক্য কমে আসবে এবং খাদ্য নিরাপত্তা আরও শক্তিশালী হবে।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: প্রথমত, আমাদের যেকোনো মূল্যে ফলন বৃদ্ধি করতে হবে। আমাদের কৃষি জমিতে শিল্পায়ন বা নগরায়ন হবেই, এটা আটকানো কঠিন। তাই কম জমিতে বেশি ফসল ফলানোই একমাত্র পথ।
দ্বিতীয়ত, খামারের ব্যবহারিক আয়তন বাড়ানো। আমি যে ‘অপারেশনাল কনসোলিডেশন’ বা ব্যবস্থাপনাগত একত্রীকরণের কথা বললাম, সেটিকে প্রাতিষ্ঠানিক ও নীতিগত সমর্থন দিয়ে এগিয়ে নিতে হবে।
তৃতীয়ত, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। যদিও এটি সরাসরি কৃষির বিষয় নয়, কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধিই খাদ্য ও জমির ওপর মূল চাপ সৃষ্টি করে। এই বিষয়ে আমাদের আবারও মনোযোগ দিতে হবে।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: কৃষিতে নারীদের মজুরি বৈষম্য অবশ্যই আছে। তবে এর কারণ আইনি কাঠামোর চেয়েও বেশি সামাজিক। গ্রামীণ সংস্কৃতিতে নারীদের শ্রমকে এখনো পুরুষের সমান মর্যাদা দেওয়া হয় না। তবে আমি মনে করি, শিক্ষা এবং সচেতনতা বাড়ার সাথে সাথে এই অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। এখন নারীরা নিড়ানি দেওয়া থেকে শুরু করে ফসলের পরাগায়নের মতো জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোও করছেন, যা পুরুষরা ভাল পারেন না। তাদের এই অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা জরুরি। আমার ধারণা, আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যে এই বৈষম্য অনেকটাই কমে আসবে।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: আমার মতে, মূল দর্শন হওয়া উচিত উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি। কারণ আমাদের সবকিছুর মূলে রয়েছে বিপুল জনসংখ্যা এবং সীমিত জমি। এই উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর অপরিহার্য অনুষঙ্গ বা মাধ্যম হলো প্রযুক্তি। আর এই দুটি যখন একসঙ্গে কাজ করবে, তখন কৃষকের জীবনমান উন্নত হবে এবং সেটাই হবে টেকসই জীবন। সুতরাং, একটি আরেকটির পরিপূরক। তবে আমাদের যাত্রা করতে হবে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে।
স্ট্রিম: আপনাকে ধন্যবাদ।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: ধন্যবাদ ঢাকা স্ট্রিম ও বাংলা স্ট্রিমের পাঠকদেরও।
শ্রুতিলিখন: মুজাহিদুল ইসলাম

এম এ সাত্তার মণ্ডল; একুশে পদকপ্রাপ্ত কৃষি অর্থনীতিবিদ। তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) থেকে কৃষি অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থানসহ বিএসসি (সম্মান) ও এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। লন্ডন থেকে পিএইচডি ও অক্সফোর্ডে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা সম্পন্ন করে পাঁচ দশক বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষি অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা ও গবেষণা করছেন এবং বিভাগীয় প্রধান, অনুষদীয় ডিন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। তিনি বাকৃবি-র প্রথম ইমেরিটাস অধ্যাপক। তিনি পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এর প্রফেসরিয়াল ফেলো হিসেবে গবেষণা অব্যাহত রেখেছেন। বাংলাদেশের কৃষির বর্তমান অবস্থা, সংকট, সম্ভাবনা এবং ভবিষ্যৎ রূপকল্প নিয়ে ঢাকা স্ট্রিমের সঙ্গে কথা বলেছেন।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: দেশের কৃষি অর্থনীতি কখনোই পুরোপুরি স্থবির ছিল না। এর প্রবৃদ্ধি কখনো কম, কখনো বেশি—এই ধারা সবসময়ই চলমান ছিল। এটি একটি চলমান রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্যেই আছে। তবে রূপান্তরের গতি কখনো কখনো কিছুটা ধীর হয়। এই মুহূর্তে প্রযুক্তির ব্যবহার, গবেষণা এবং বিশেষ করে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের গতি কিছুটা শ্লথ মনে হচ্ছে। এ কারণে আমাদের পুরো বাজার ব্যবস্থাটি গভীরভাবে বিশ্লেষণের একটি ব্যাপার রয়েছে। তবে সার্বিকভাবে আমি মনে করি, কৃষির রূপান্তর প্রক্রিয়া ঠিক পথেই চলছে।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: বিষয়টা একটু বুঝিয়ে বলি। ৭০ বা ৮০-এর দশকে খামারের আয়তন যত বড় হতো, একক প্রতি উৎপাদনশীলতা তত কম হত। কারণ তখন সনাতন প্রযুক্তিতে বেশি পরিমাণ জমি ব্যবস্থাপনা করা কঠিন ছিল। অন্যদিকে, ক্ষুদ্র চাষিরা পারিবারিক শ্রম দিয়ে নিবিড় চাষের মাধ্যমে বেশি ফসল ফলাত। এখন চিত্রটা পুরোপুরি উল্টে গেছে। বাংলাদেশে এখন পৌনে দুই কোটি কৃষক পরিবারের প্রায় দেড় কোটিই ক্ষুদ্র। উত্তরাধিকার আইনের কারণে বড় ও মাঝারি খামারগুলো ভেঙে যাচ্ছে এবং ক্ষুদ্র কৃষকের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এই ক্ষুদ্র কৃষকদের অনেকেই আবার "পার্ট-টাইম" বা খণ্ডকালীন কৃষক। তারা নিজেদের অল্প জমি আবাদের পাশাপাশি অন্যের জমি বর্গা বা বন্ধকি নিয়ে চাষ করছেন। ফলে, তাদের ফলন বারানোর সাধ থাকলেও নগদ অর্থ ও সময় মত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে না পারায় ফলন তেমনটা বাড়ছেনা। অপরদিকে, যারা বেশি জমি একত্রে চাষ করছে খামারের কার্যকর আয়তন বাড়িয়ে তাদের ফলন স্বাভাবিক ভাবেই বেশি হওয়ার কথা। কাজেই কৃষির কাঠামোগত রূপান্তরটি হতে হবে খামারের গড় আয়তন বর্ধনমুখী।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: আমি এই ক্ষুদ্র ক্ষণ্ডকালীন কৃষকদের "নব্য কৃষক" বলছি। অতীতে যারা ক্ষেতমজুর ছিলেন, তারাই এখন নতুন প্রযুক্তির সহায়তায় কৃষক হয়ে উঠছেন। ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলারের মতো যন্ত্র আসায় কায়িক শ্রমের চাহিদা কমেছে, যা তাদের জন্য সুযোগ তৈরি করেছে। তারা এখন উচ্চমূল্যের ফসল—যেমন শাকসবজি ও ফল চাষে ঝুঁকছে। তবে তাদের মূল সমস্যা হলো জমিগুলো একাধিক খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত থাকা, যা সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনাকে কঠিন করে তোলে।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: ঠিক তাই। খামারের ক্ষুদ্র আয়তন ও কৃষিজমির খণ্ড-বিখণ্ড হওয়া আমাদের সবচেয়ে বড় কাঠামোগত দুর্বলতা। এর সমাধান গতানুগতিক ভূমি সংস্কারে নেই। সমাধান লুকিয়ে আছে ‘ব্যবস্থাপনাগত একত্রীকরণে’। যেমন, একজন শ্যালো টিউবওয়েল মালিক নিজের ছোট জমি ছাড়াও আশপাশের ১০-১৫ বিঘা জমিতে সেচ সেবা দিয়ে একটি ‘কমান্ড এরিয়া’ তৈরি করছেন। এখানে জমির মালিকানা বদলাচ্ছে না, কিন্তু উৎপাদনের প্রয়োজনে জমিগুলো একটি ব্যবস্থাপনার আওতায় আসছে। পাওয়ার টিলার, কম্বাইন হারভেস্টার—সব ক্ষেত্রেই এই মডেল কাজ করছে। এই বাজারভিত্তিক মডেল, যেখানে জমি লিজ বা বন্ধকির মাধ্যমে খামারের কার্যকর আয়তন বৃদ্ধি করা যায়, সেটিকেই আমাদের নীতিগতভাবে সমর্থন দিতে হবে।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: কৃষকের আয় বাড়ছে না, এই কথাটি যেমন ঠিক, তেমনি কোনো কোনো পণ্যে যে আয় বাড়ছে, সেটাও ঠিক। এখানেই আধুনিক ও বাণিজ্যিক কৃষির সুবিধা-অসুবিধাগুলো বোঝার ব্যাপার রয়েছে। আমাদের কৃষি এখন আর শুধু খোরপোশের পর্যায়ে নেই; কৃষক এখন বাজারের জন্য এবং লাভের জন্যই উৎপাদন করে। কিছু কিছু পণ্য যেমন পাট, যা খাদ্য তালিকার বাইরের একটি বৃহৎ কৃষি পণ্য, সেগুলোর বাজার গত চার বছরে তেমন সম্প্রসারণ হয়নি। ফলে কৃষকরা লাভবান হননি। কিন্তু অন্যদিকে তৈলবীজ (তিল, কালিজিরা) বা পেঁয়াজের মতো ফসলে কৃষকরা লাভবান হয়েছেন, যদিও পেঁয়াজের বাজারে দামের ওঠানামা বেশ লক্ষণীয়।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: এই সমস্যাটি নতুন নয়, অর্থনীতিতে একে ‘কবওয়েব থিওরেম’ বলা হয়। কৃষক গত বছরের দাম দেখে পরের বছরের উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেন। এর সমাধান হলো উন্নত ‘ফোরকাস্টিং সিস্টেম’ বা পূর্বাভাস ব্যবস্থা। আবহাওয়া, আন্তর্জাতিক বাজার এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা সম্পর্কে সঠিক তথ্য কৃষকের কাছে পৌঁছানো গেলে তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। আমাদের দেশে এই তথ্যব্যবস্থা এখনো ততটা শক্তিশালী নয়।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: ধানের বিষয়টি বেশ জটিল। চালের দাম মোটামুটি বাড়তির দিকে থাকলেও কৃষকের লাভ নিশ্চিত হচ্ছে না, কারণ উৎপাদন খরচ বেড়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি দ্রুতগতিতে। এর প্রধান কারণগুলো হলো:
১. শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি: ভরা মৌসুমে কৃষি শ্রমিকের সংকট এবং চড়া মজুরি একটি বড় বিষয়।
২. উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি: রাসায়নিক সার, কীটনাশক এবং সেচকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির ভাড়া—সবকিছুর দাম বেড়েছে।
৩. নগদ অর্থের সংকট: এখন কৃষির প্রায় সব উপকরণই বাজার থেকে নগদ অর্থে কিনতে হয়। কিন্তু কৃষকদের হাতে সবসময় প্রয়োজনীয় নগদ অর্থ থাকে না এবং কৃষিঋণও পর্যাপ্ত নয়।
এই ত্রিমুখী সংকটের কারণে চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে কৃষকের হাতে লাভ থাকছে না।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: আমি এদের মধ্যস্বত্বভোগী না বলে "মার্কেটিং এজেন্ট" বা বাজার ব্যবস্থাপনার অংশ বলতে চাই। ধান থেকে চাল তৈরির প্রক্রিয়ায় চালকল মালিকদের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে এবং বাজারের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভরা মৌসুমে তারাই বেপারিদের মাধ্যমে ধানের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে তারাই ধানকে চালে রূপান্তর করে বাজারে ছাড়েন। বেপারিরাও কৃষক, তাই ধানের দামের ওঠানামায় তাদেরও লাভক্ষতির ব্যাপার আছে। ক্ষুদ্র ও বিচ্ছিন্ন কৃষকদের পক্ষে এই বাজার ব্যবস্থায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলা কঠিন। এ কারণে বাজারের সংকটকে কৃষকের লাভ না হওয়ার একটি বড় কারণ।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: আমি ‘মধ্যস্বত্বভোগী’ শব্দটি ব্যবহার করতে চাই না, কারণ এটি একটি নেতিবাচক ধারণা দেয়। আমি তাদের বলি ‘মার্কেটিং এজেন্ট’ বা বিপণন প্রতিনিধি। বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশের কৃষি ব্যবস্থা ক্ষুদ্র ও খণ্ডিত হওয়ায় এই এজেন্টরা বাজারের একটি প্রয়োজনীয় অংশ। যখন একজন কৃষক মাত্র ৫ বা ১০ কেজি পণ্য উৎপাদন করেন, তখন তার পক্ষে সরাসরি ভোক্তার কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। এই এজেন্টরাই সেই সংযোগটি স্থাপন করে। মজার বিষয় হলো, এদের অনেকেই নিজেরাও কৃষক, যারা বাড়তি আয়ের জন্য এই কাজ করেন।
সমস্যাটা এজেন্টদের অস্তিত্বে নয়, বরং তাদের সংখ্যার আধিক্যে। এর মূল সমাধান হলো খামারের উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ানো, যাকে ইংরেজিতে বলে ‘ইকোনমিকস অফ স্কেল’। যখন খামারের আকার বড় হবে এবং উৎপাদনের পরিমাণ বাড়বে, তখন অনেক এজেন্টের প্রয়োজন হবে না এবং কৃষকের দর-কষাকষির ক্ষমতাও বাড়বে।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: ভারসাম্য আনা বেশ কঠিন, কারণ আমাদের উৎপাদক ও ভোক্তার অবস্থান ভিন্ন। দেশের ১৪ কোটি মানুষ গ্রামাঞ্চলে, যারা একাধারে উৎপাদক ও ভোক্তা। তাদের মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্য থাকলেও মূল সংকট তৈরি হয় শহরের ৪ কোটি ভোক্তার জন্য। যখনই সরবরাহ ব্যবস্থায় সামান্য বিঘ্ন ঘটে, তখনই শহুরে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। মোদ্দা কথা, খামারের গড় আয়তন বৃদ্ধি পেলে তাদের মোট উৎপাদনের পরিমাণ বাড়বে, কৃষকের সংখ্যা কমবে এবং সেই সংগে তাদের বাজারে দর কষাকষির সক্ষমতাও বাড়বে।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: না, আমি মনে করি বাণিজ্যিক কৃষি কোনো ঝুঁকি নয়, বরং এটি একটি সময়ের চাহিদা এবং প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া, যার মধ্যে ঝুঁকি মোকাবেলা করার কৌশলগুলো নিহিত থাকার কথা। খোরপোশ কৃষি থেকে বেরিয়ে এসে লাভজনক কৃষিতে উত্তরণ সবার জন্যই জরুরি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বীজ বা প্রযুক্তি দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, কিন্তু তারা মূলত স্থানীয় বেসরকারি কোম্পানির মাধ্যমেই কাজ করে। তারা প্রযুক্তি ও পুঁজি নিয়ে আসছে, যার ফলে আমরা সারা বছর ধরে উচ্চমূল্যের শাকসবজি পাচ্ছি। হাইব্রিড জাতের কারণে উৎপাদন বাড়ছে। এটা বাস্তবতা।
ক্ষুদ্র কৃষকরাও এর থেকে লাভবান হচ্ছেন। তারাই এখন সবজি চাষে সবচেয়ে এগিয়ে, কারণ এটি শ্রমনিবিড় এবং তাদের পারিবারিক শ্রম এখানে কাজে লাগছে। আমাদের শুধু খেয়াল রাখতে হবে যে এই বাণিজ্যিক কৃষিতে উৎপাদিত পণ্য যেন নিরাপদ হয়। কীটনাশক বা অন্যান্য উপকরণের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করাটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: কৃষিকে লাভজনক করতে হলে প্রযুক্তির কোনো বিকল্প নেই। আমরা এখন সনাতন কৃষি বা সবুজ বিপ্লবের পর্যায় পেরিয়ে ‘ডিজিটাল কৃষি’র যুগে প্রবেশ করছি। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো ড্রোন। একদিকে যখন শ্রমিকের সংকট, অন্যদিকে তখন মাটির গুণাগুণ বিচার করে সঠিক পরিমাণে সার ও কীটনাশক প্রয়োগের জন্য ড্রোনের মতো প্রযুক্তি অপরিহার্য। ধরুন, কোনো ভুট্টা ক্ষেতে ‘আর্মি ফলওয়ার্ম’ পোকার আক্রমণ হলো। দুই-তিন ঘণ্টার মধ্যে স্প্রে না করলে পুরো ফসল নষ্ট হয়ে যাবে। একজন ক্ষুদ্র কৃষকের পক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে সেই ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন। কিন্তু একটি ড্রোন সার্ভিস থাকলে তা সহজেই সম্ভব। একইভাবে ‘ক্রপ রোবোটিক্স’ এখন আর স্বপ্ন নয়। একটি সাধারণ মোটরবাইকের দামেই এই প্রযুক্তি পাওয়া সম্ভব। একজন তরুণ উদ্যোক্তা একটি রোবট কিনে পুরো গ্রামে সেবা দিতে পারেন। কৃষককে এই প্রযুক্তিগুলোর মালিক হতে হবে না, তাকে শুধু সেবাটি কেনার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে, ঠিক যেমনটি ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলারের ক্ষেত্রে হয়েছে। আর এই প্রযুক্তিগুলোর সফল প্রয়োগের জন্যই আমাদের কৃষি শিক্ষা ও গবেষণায় বিনিয়োগ আরও বাড়াতে হবে।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: আমি এটিকে অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে দেখি। এই শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তারাই আমাদের কৃষির ভবিষ্যৎ। তারা উচ্চমূল্যের কৃষিতে, যেমন—আম, পেয়ারা, কলার বাগান বা হাস্মুরগি, দুধ ও মাছের খামারে বিনিয়োগ করছে। তবে তাদের একটি বড় অংশ এখনো ধান বা প্রধান খাদ্যশস্য উৎপাদনে আসছে না, কারণ সেখানে ঝুঁকি এবং বিনিয়োগের ধরন ভিন্ন। যদি খামারের আয়তন ‘ব্যবস্থাপনাগত একত্রীকরণের’ মাধ্যমে বাড়ানো যায়, তবে এই তরুণরা হাই-টেক প্রযুক্তি নিয়ে ধান উৎপাদনেও আসবে বলে আমার বিশ্বাস। ইতিমধ্যে ধান গমের বীজ উৎপাদনে শিক্ষিত তরুন উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসছেন। তখন আমাদের ‘ইল্ড গ্যাপ’ বা ফলনের পার্থক্য কমে আসবে এবং খাদ্য নিরাপত্তা আরও শক্তিশালী হবে।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: প্রথমত, আমাদের যেকোনো মূল্যে ফলন বৃদ্ধি করতে হবে। আমাদের কৃষি জমিতে শিল্পায়ন বা নগরায়ন হবেই, এটা আটকানো কঠিন। তাই কম জমিতে বেশি ফসল ফলানোই একমাত্র পথ।
দ্বিতীয়ত, খামারের ব্যবহারিক আয়তন বাড়ানো। আমি যে ‘অপারেশনাল কনসোলিডেশন’ বা ব্যবস্থাপনাগত একত্রীকরণের কথা বললাম, সেটিকে প্রাতিষ্ঠানিক ও নীতিগত সমর্থন দিয়ে এগিয়ে নিতে হবে।
তৃতীয়ত, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। যদিও এটি সরাসরি কৃষির বিষয় নয়, কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধিই খাদ্য ও জমির ওপর মূল চাপ সৃষ্টি করে। এই বিষয়ে আমাদের আবারও মনোযোগ দিতে হবে।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: কৃষিতে নারীদের মজুরি বৈষম্য অবশ্যই আছে। তবে এর কারণ আইনি কাঠামোর চেয়েও বেশি সামাজিক। গ্রামীণ সংস্কৃতিতে নারীদের শ্রমকে এখনো পুরুষের সমান মর্যাদা দেওয়া হয় না। তবে আমি মনে করি, শিক্ষা এবং সচেতনতা বাড়ার সাথে সাথে এই অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। এখন নারীরা নিড়ানি দেওয়া থেকে শুরু করে ফসলের পরাগায়নের মতো জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোও করছেন, যা পুরুষরা ভাল পারেন না। তাদের এই অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা জরুরি। আমার ধারণা, আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যে এই বৈষম্য অনেকটাই কমে আসবে।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: আমার মতে, মূল দর্শন হওয়া উচিত উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি। কারণ আমাদের সবকিছুর মূলে রয়েছে বিপুল জনসংখ্যা এবং সীমিত জমি। এই উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর অপরিহার্য অনুষঙ্গ বা মাধ্যম হলো প্রযুক্তি। আর এই দুটি যখন একসঙ্গে কাজ করবে, তখন কৃষকের জীবনমান উন্নত হবে এবং সেটাই হবে টেকসই জীবন। সুতরাং, একটি আরেকটির পরিপূরক। তবে আমাদের যাত্রা করতে হবে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে।
স্ট্রিম: আপনাকে ধন্যবাদ।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: ধন্যবাদ ঢাকা স্ট্রিম ও বাংলা স্ট্রিমের পাঠকদেরও।
শ্রুতিলিখন: মুজাহিদুল ইসলাম
.png)

ঐক্যমত্য কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের চুড়ান্ত সুপারিশমালা হস্তান্তর করেছে। তবে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ কিছু মতামত ও প্রস্তাবনা পাশ কাটিয়ে যাওয়ায় এই সনদ এখন বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু।
২২ মিনিট আগে
‘যদি দ্রুত যেতে চাও, একা হাঁটো। আর যদি জীবন উপভোগ করতে চাও, অনেকের সাথে হাঁটো।’— হাঁটা নিয়ে এক আলোচনায় এমন দর্শনের কথা বলেছিলেন ইফতেখার মাহমুদ। তিনি যেন সেই একা হাঁটা মানুষের দলে। জীবন থেকে তাঁর দ্রুত প্রস্থান সেই দর্শনেরই প্রতিফলন করে। কোনো শিকলে বাঁধা পড়েননি তিনি, বরং শিকলকেই মুক্তি দিয়েছেন নিজের
১ ঘণ্টা আগে
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা একটি বহুধা বিভক্ত ও বৈষম্যমূলক কাঠামোতে পরিণত হয়েছে। নীতিগত পঙ্গুত্ব, শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন এবং শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে নীতিনির্ধারকদের সংযোগহীনতা এর মূল কারণ, যা একটি জ্ঞানহীন প্রজন্ম ও সামাজিক বিভাজন তৈরি করছে।
১ দিন আগে
আগস্ট-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি ক্রান্তিকাল পার করছে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে কিছুটা স্বস্তি ফিরলেও সার্বিক কর্মচাঞ্চল্যে গতি ফেরানো এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা, সংকট উত্তরণের পথ এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে ঢাকা স্ট্রিম-এর সঙ্গে কথা বলেছেন অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন
২ দিন আগে