leadT1ad

অন্যদেশে সরকার পরিবর্তনে আর হস্তক্ষেপ নয়, এটা কি যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতার লক্ষণ

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক (ডিএনআই) তুলসি গ্যাবার্ড ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র আর পৃথীবির কোনো দেশের সরকার পরিবর্তনের হস্তক্ষেপ করবে না। কারণ তাঁর মতে, অতীতের এই পররাষ্ট্রনীতিই বিশ্বজুড়ে অস্থিতিশীলতা ও সন্ত্রাসবাদের জন্ম দিয়েছে। আর বন্ধুর চেয়ে বেশি শত্রু তৈরি করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। এই ঘোষণার পর বিতর্ক উঠেছে এটা কি যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতার ইঙ্গিত, নাকি এটি পরিপক্ব কৌশলগত সংযমের প্রতিফলন?

প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২৫, ১০: ২২
তুলসি গ্যাবার্ড বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের পররাষ্ট্রনীতি, যা ‘অন্যদেশে সরকার পরিবর্তন’ ও ‘রাষ্ট্রগঠন’-নির্ভর ছিল তার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটেছে। স্ট্রিম গ্রাফিক।

বাহরাইনের মানামায় আয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (আইআইএসএস)-এর ‘মানামা ডায়ালগ’-এ যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক (ডিএনআই) তুলসি গ্যাবার্ড এক গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের পররাষ্ট্রনীতি, যা ‘অন্যদেশে সরকার পরিবর্তন’ ও ‘রাষ্ট্রগঠন’-নির্ভর ছিল তার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটেছে।

গ্যাবার্ডের এই বক্তব্য এমন এক সময় (৩১ অক্টোবর ২০২৫) আসে, যখন মধ্যপ্রাচ্যে গাজা যুদ্ধবিরতি ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে এবং ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, এই নীতি পরিবর্তন কোনো কৌশলগত বিচ্যুতি নয়, বরং গত কয়েক দশকের হস্তক্ষেপমূলক নীতির বিপরীতে এক সচেতন সিদ্ধান্ত।

তাঁর মতে, যুক্তরাষ্ট্রের অতীতের পররাষ্ট্রনীতিই বরং অস্থিতিশীলতা ও সন্ত্রাসবাদের জন্ম দিয়েছে। এই অবস্থান ট্রাম্প প্রশাসনের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিকে আরও স্পষ্ট করে, যা অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব, নির্বাচিত প্রতিরোধ এবং বিদেশে অকারণ যুদ্ধে জড়ানো থেকে বিরত থাকার ওপর জোর দেয়।

পটভূমি: স্নায়ুযুদ্ধ থেকে ৯/১১-পরবর্তী অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ইতিহাসে বিদেশি সরকারে হস্তক্ষেপের দীর্ঘ ধারা রয়েছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা বা হুমকি মোকাবিলার অজুহাতে এ ধরনের অভিযান পরিচালিত হয়েছে বহুবার। এর শুরু স্নায়ু যুদ্ধের সময় থেকে—যেমন ১৯৫৩ সালে ইরানে সিআইএ নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থান, কিংবা ১৯৭৩ সালে চিলির সামরিক অভ্যুত্থানে সহায়তা।

৯/১১ সন্ত্রাসী হামলার পর এই নীতি আরও তীব্র হয়। আফগানিস্তান (২০০১) ও ইরাক (২০০৩) দখল, পরে লিবিয়া (২০১১) ও সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ—সবই কথিত ‘বিশ্বজুড়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগঠন’ নীতির অংশ ছিল। এতে স্বৈরশাসকদের সরকার উৎখাত করে পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়—সংবিধান, নির্বাচন ও উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে।

এই নীতির সমর্থকরা দাবি করতেন, এতে স্থিতিশীলতা আসবে এবং সন্ত্রাস দমন হবে। কিন্তু সমালোচকরা বলেছিলেন, এসব অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল অর্থনৈতিক ও মানবিক ক্ষতি হয়েছে। ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের কস্ট অব ওয়ার প্রকল্পের হিসাব অনুযায়ী ৯/১১-পরবর্তী যুদ্ধে ব্যয় হয়েছে ৮ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি এবং প্রাণহানি ঘটেছে প্রায় ৯ লাখ মানুষের। এসব যুদ্ধের পরবর্তী শূন্যস্থান থেকেই উত্থান ঘটে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) মতো গোষ্ঠীর। ২০১০-এর দশকের মাঝামাঝি নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রে এই ‘অন্তহীন যুদ্ধ’-র বিরুদ্ধে জনঅসন্তোষ দেখা দেয়।

ট্রাম্পের নীতি অনুযায়ী, অন্তহীন যুদ্ধ দেশের সম্পদ নিঃশেষ করে দেয়, যা অবকাঠামো উন্নয়ন বা সীমান্ত সুরক্ষার মতো অভ্যন্তরীণ চাহিদায় ব্যয় করা যেত। গ্যাবার্ড বলেন, আগের নীতি ছিল ‘জনগণের করের অর্থের অপচয়।’

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদ: সংযমী নীতির সূচনা

২০১৭-২০২১ মেয়াদে ট্রাম্প সরাসরি এই নীতির বিরোধিতা করেন। তিনি একে ‘রাষ্ট্রগঠন ও শাসন পরিবর্তনের ব্যর্থ নীতি’ হিসেবে অভিহিত করেন এবং বলেন, ইরাক, লিবিয়া, মিসর ও সিরিয়ায় এসব নীতি কেবল বিশৃঙ্খলাই বাড়িয়েছে।

তার শাসনামলে কোনো নতুন বড় যুদ্ধ শুরু হয়নি। আফগানিস্তান ও ইরাক থেকে ধীরে ধীরে সেনা প্রত্যাহার করা হয়, যা ২০২১ সালের পূর্ণ প্রত্যাহারের ভিত্তি তৈরি করে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র মনোযোগ দেয় সীমিত সামরিক অভিযান ও আঞ্চলিক কূটনৈতিক উদ্যোগে—যেমন ইসরায়েল ও আরব দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা আব্রাহাম অ্যাকর্ডস চুক্তি। এতে মার্কিন সেনা মোতায়েন ছাড়াই মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা বাড়ানোর চেষ্টা হয়।

দ্বিতীয় মেয়াদে চূড়ান্ত রূপ: হস্তক্ষেপ নয়, কূটনৈতিক চাপ

২০২৫ সালের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু হওয়ার পর ট্রাম্প প্রশাসন এই নীতি আরও স্পষ্টভাবে অনুসরণ করে। গাজায় যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্র এবার সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ নয়, কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের পথ বেছে নেয়।

একই সঙ্গে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় সীমিত লক্ষ্যভিত্তিক হামলা অনুমোদন করা হয়—তবে লক্ষ্য ছিল প্রতিরোধ, সরকার ও শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন নয়।

তুলসি গ্যাবার্ডের মানামা বক্তব্যে এই পরিবর্তনকে ‘আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়, যা কেবল কথার পর্যায়ে নয়—বরং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।

এই নীতিগত পরিবর্তনের মূল কারণ

গ্যাবার্ড এই নীতিগত পরিবর্তনকে যুক্তরাষ্ট্রের অতীত ব্যর্থতা থেকে পাওয়া শিক্ষা হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি তিনটি প্রধান কারণ তুলে ধরেছেন—

১. প্রতিকূল ফল ও নিরাপত্তা ঝুঁকি বৃদ্ধি:

গ্যাবার্ড বলেন, অতীতে বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপ ‘বন্ধুর চেয়ে শত্রু বেশি সৃষ্টি করেছে।’ এতে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বেড়েছে এবং উগ্রপন্থীদের শক্তি বেড়েছে। তাঁর ভাষায়, ‘এর ফলাফল—অগণিত প্রাণহানি, কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় এবং অনেক ক্ষেত্রে আরও বড় নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি।’

তিনি মনে করেন, ‘ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থানের’ পেছনে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি দায়ী। গবেষণা ও গোপন নথি অনুযায়ী, মার্কিন হামলায় ইরাক ও লিবিয়ায় অস্থিতিশীলতার কারণেই আইএসসহ অন্যান্য গোষ্ঠী শক্তিশালী হয়।

তবে গ্লোবাল টাইমসের চীনা বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘোষণা মূলত রিপাবলিকান দলের রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে, ডেমোক্র্যাটদের সমালোচনার জন্য দেওয়া হয়েছে। তারা যুক্তি দেন, ট্রাম্প প্রশাসন খরচ কমানোর দিকেই বেশি মনোযোগ দিচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মার্কিন হস্তক্ষেপ বন্ধ হয়নি। উদাহরণ হিসেবে তারা ভেনিজুয়েলায় চলমান গোপন মার্কিন তৎপরতার কথা উল্লেখ করেন।

২. অর্থনীতি ও অভ্যন্তরীণ অগ্রাধিকার (‘আমেরিকা ফার্স্ট নীতি’):

ট্রাম্পের নীতি অনুযায়ী, অন্তহীন যুদ্ধ দেশের সম্পদ নিঃশেষ করে দেয়, যা অবকাঠামো উন্নয়ন বা সীমান্ত সুরক্ষার মতো অভ্যন্তরীণ চাহিদায় ব্যয় করা যেত। গ্যাবার্ড বলেন, আগের নীতি ছিল ‘জনগণের করের অর্থের অপচয়।’

ট্রাম্পও সমালোচনা করেছেন সেই ‘রাষ্ট্রগঠনকারীদের’, যারা ‘যে দেশগুলোকে গড়তে গিয়েছিল, সেগুলোকে আরও ধ্বংস করেছে।’ তাঁর মতে, ‘কাবুল বা বাগদাদে ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেও কিছুই গড়া যায়নি।’

এ কারণে ট্রাম্প প্রশাসন এখন ‘অরাজকতা নয়, বাণিজ্য’-কে অগ্রাধিকার দিচ্ছে—বিশেষ করে উপসাগরীয় অঞ্চলে বাণিজ্য ও জ্বালানি অংশীদারত্বের মাধ্যমে।

৩. বাস্তববাদী কৌশল ও আঞ্চলিক স্বনির্ভরতা:

এখন যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশের ওপর নিজেদের ইচ্ছা মতো সরকার আরোপের চেষ্টা না করে স্থানীয় নেতৃত্বকে শক্তিশালী করতে চায়। গ্যাবার্ড আগের পদ্ধতিকে বলেছেন ‘একই ছাঁচের নীতি’—যেখানে ‘অজানা সংঘাতে জড়িয়ে অন্যের সরকারব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া’ হতো।

এটি ট্রাম্পের ২০১৭ সালের রিয়াদ ভাষণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে তিনি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে আহ্বান করেছিলেন ‘নিজেদের অঞ্চল থেকে সন্ত্রাসীদের বিতাড়ন করতে।’ এটি বিদেশি হস্তক্ষেপ কমানোর এক ‘নাটকীয় পরিবর্তন।’

সারাংশে, এই নীতিগত পরিবর্তনটি কেবল ট্রাম্পের নয়—বরং যুক্তরাষ্ট্রে দুই দলেই হস্তক্ষেপবিরোধী মনোভাবের প্রতিফলন। ওবামার লিবিয়া নীতিতে দ্বিধা এবং বাইডেনের আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার তার প্রমাণ। তবে ট্রাম্পের আমলে বিষয়টি পরিণত হয় এক বাস্তববাদী হিসাব-নিকাশে—যেখানে গণতন্ত্র রপ্তানির চেয়ে প্রতিরোধ ও স্বার্থরক্ষা অগ্রাধিকার পায়।

বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকদের মতামত

সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং হুভার ইনস্টিটিউশনের গবেষক জেমস জেফ্রির মতে, ট্রাম্পের নীতি ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ নয়, বরং বাস্তব সমস্যা সমাধানের কৌশল।’ তিনি বলেন, এই নীতির তিনটি ভিত্তি হলো— ১. অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মার্কিন হস্তক্ষেপ প্রত্যাখ্যান, ২. স্থিতিশীলতা রক্ষায় স্থানীয় অংশীদারদের ওপর নির্ভরতা, ৩. এবং পারস্পরিক অর্থনৈতিক স্বার্থে বাণিজ্যকে অগ্রাধিকার।

জেফ্রির মতে, এতে যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয় থাকবে, তবে বড় যুদ্ধ বা বিপুল ব্যয়ের ঝুঁকি ছাড়াই। তিনি বলেন, এটি উপসাগরে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হতে পারে।

তবে গ্লোবাল টাইমসের চীনা বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘোষণা মূলত রিপাবলিকান দলের রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে, ডেমোক্র্যাটদের সমালোচনার জন্য দেওয়া হয়েছে।

তবে বাস্তবে ভেনিজুয়েলা বা ইরান ইস্যুর মতো উদাহরণ দেখায়, সংযম ও গোপন হস্তক্ষেপের সীমারেখা এখনও অস্পষ্ট। গ্যাবার্ডের বক্তব্য হয়তো নতুন এক যুগের ইঙ্গিত দেয়, কিন্তু বাস্তবায়নের ফলই নির্ধারণ করবে—এটি সত্যিই মার্কিন হস্তক্ষেপবাদের অবসান, নাকি কেবল তার নতুন রূপ।

তারা যুক্তি দেন, ট্রাম্প প্রশাসন খরচ কমানোর দিকেই বেশি মনোযোগ দিচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মার্কিন হস্তক্ষেপ বন্ধ হয়নি। উদাহরণ হিসেবে তারা ভেনিজুয়েলায় চলমান গোপন মার্কিন তৎপরতার কথা উল্লেখ করেন।

কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স-এর প্রেসিডেন্ট রিচার্ড হাস বহুবার সতর্ক করেছেন যে ‘চিরস্থায়ী যুদ্ধের’ বিরোধিতা করলেও ট্রাম্পের নীতিতে বাস্তব পরিবর্তন সামান্য। তাঁর মতে, রেজিম পরিবর্তনের হুমকি ছাড়া কূটনীতি ‘লেনদেনভিত্তিক ও দিকহীন’ হয়ে পড়ছে, যা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কমিয়ে দেয়।

দ্য আটলান্টিকের বিশ্লেষক অ্যান অ্যাপলবাম মন্তব্য করেছেন, ট্রাম্প বিদেশে ‘রেজিম চেঞ্জ’ বন্ধ করলেও, দেশে নিজেই প্রশাসনিক কাঠামো বদলে এক ধরনের ‘অভ্যন্তরীণ রেজিম চেঞ্জ’ ঘটাচ্ছেন। তাঁর মতে, এটি যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্য বিপজ্জনক, কারণ ট্রাম্প বিদেশে যেটি সমালোচনা করেন, দেশে সেটিই বাস্তবায়ন করছেন। নিজ দেশকে তিনি কর্তৃত্ববাদের দিকে যাচ্ছেন।

মোটের ওপর বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বজুড়ে ‘রেজিম চেঞ্জ নীতি’র সমাপ্তি ট্রাম্প প্রশাসনের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়—যা অর্থনৈতিক সহযোগিতা, আঞ্চলিক অংশীদারত্ব ও সীমিত শক্তি ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে। তবে বাস্তবে ভেনিজুয়েলা বা ইরান ইস্যুর মতো উদাহরণ দেখায়, সংযম ও গোপন হস্তক্ষেপের সীমারেখা এখনও অস্পষ্ট। গ্যাবার্ডের বক্তব্য হয়তো নতুন এক যুগের ইঙ্গিত দেয়, কিন্তু বাস্তবায়নের ফলই নির্ধারণ করবে—এটি সত্যিই মার্কিন হস্তক্ষেপবাদের অবসান, নাকি কেবল তার নতুন রূপ।

এটা কি যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতার লক্ষণ

তুলসি গ্যাবার্ডের ঘোষণা পররাষ্ট্রনীতির মহলে এক পুরোনো বিতর্ককে আবারও উসকে দিয়েছে—অতীতের মতো প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ থেকে সরে আসা কি যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতার ইঙ্গিত, নাকি এটি পরিপক্ব কৌশলগত সংযমের প্রতিফলন?

সমালোচকরা—বিশেষত নব্যরক্ষণশীল ও উদার আন্তর্জাতিকতাবাদী বিশ্লেষকরা—মনে করেন, রেজিম পরিবর্তনের নীতি ত্যাগ করা মানে চীন, রাশিয়া ও ইরানের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়া। এতে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং শত্রুপক্ষ আরও সাহসী হয়ে ওঠে।

তাদের মতে, শত্রু রাষ্ট্রগুলো যদি বুঝে যায় যে যুক্তরাষ্ট্র আর আগের মতো সরকার পরিবর্তনে হস্তক্ষেপ করবে না, তবে তারা আরও আগ্রাসী হতে পারে। সেন্টার ফর আমেরিকান প্রগ্রেস মন্তব্য করেছে, ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি ‘আমেরিকাকে দুর্বল করেছে।’ মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি কমে যাওয়ায় পুতিন ও শি জিনপিংয়ের মতো নেতারা আরও সাহসী হয়েছেন।

একইভাবে দ্য গার্ডিয়ানের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কমে যাওয়ায় একধরনের ‘কৌশলগত শূন্যতা’ তৈরি হয়েছে, যা ইউক্রেন ও দক্ষিণ চীন সাগরের মতো অঞ্চলে ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

আসলে এই পরিবর্তন শুধুই ট্রাম্পের উদ্যোগ নয়। এটি ইরাক ও আফগানিস্তান পরবর্তী এক যৌথ মার্কিন বাস্তবতার প্রতিফলন। ওবামার লিবিয়া অভিযান ছিল দ্বিধাগ্রস্ত, বাইডেনের আফগানিস্তান প্রত্যাহার ছিল বিশৃঙ্খল—কিন্তু দুটোই জাতি গঠনের ক্লান্তি প্রকাশ করে। পিউ রিসার্চ–এর ২০২৫ সালের জরিপে দেখা যায়, ৬০–৭০ শতাংশ আমেরিকান নতুন স্থলযুদ্ধের বিপক্ষে।

অনেক মিত্র দেশ এই নীতিকে আমেরিকার পশ্চাদপসরণ হিসেবে দেখছে। ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস জানিয়েছে, ট্রাম্প ন্যাটো মিত্রদের ‘দুর্বল ও নির্ভরশীল’ বলে সমালোচনা করেন। রেজিম পরিবর্তন বন্ধ করলে ঐ দেশগুলো নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়বে। এতে যৌথ জোট যেমন আইএসবিরোধী মিত্রতা দুর্বল হতে পারে।

অন্যদিকে সমর্থকরা—বিশেষত বাস্তববাদী নীতিনির্ধারক ও ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠরা—বলছেন, প্রকৃত শক্তি হলো অপ্রয়োজনীয় সংঘাতে না জড়িয়ে নিজের ক্ষতি এড়ানো। ইরাক ও আফগানিস্তানের মতো ব্যর্থ অভিযানে ট্রিলিয়ন ডলার ও অগণিত প্রাণহানি হয়েছে; সেই নীতির অবসান যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন শক্তি সঞ্চয়ে সহায়তা করছে।

সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের সংযম ইউরোপকে আরও দায়িত্বশীল করছে, যা একটি ভারসাম্যপূর্ণ বহুমেরুর বিশ্বব্যবস্থা গঠনে সহায়ক।

আটলান্টিক কাউন্সিল এই ধারা’কে ‘একটি নীতিগত বিপ্লব’ বলে বর্ণনা করেছে—যেখানে অংশীদারদের প্রতি কঠোর প্রত্যাশা দেখানো হচ্ছে, কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি ও সম্পদ সংরক্ষণে সহায়তা করছে।

অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ডগলাস ম্যাকগ্রেগরও যুক্তি দিয়েছেন, সংযমই প্রকৃত শক্তি। তাঁর মতে, অতীতের অতিরিক্ত সামরিক সম্পৃক্ততা শত্রুদের শক্তি নিয়ে ভুল মূল্যায়ন করেছিল। এখন নির্বাচিতভাবে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ‘নীরব কিন্তু কার্যকর শক্তি’ প্রদর্শন করছে।

আসলে এই পরিবর্তন শুধুই ট্রাম্পের উদ্যোগ নয়। এটি ইরাক ও আফগানিস্তান পরবর্তী এক যৌথ মার্কিন বাস্তবতার প্রতিফলন। ওবামার লিবিয়া অভিযান ছিল দ্বিধাগ্রস্ত, বাইডেনের আফগানিস্তান প্রত্যাহার ছিল বিশৃঙ্খল—কিন্তু দুটোই জাতি গঠনের ক্লান্তি প্রকাশ করে। পিউ রিসার্চ–এর ২০২৫ সালের জরিপে দেখা যায়, ৬০–৭০ শতাংশ আমেরিকান নতুন স্থলযুদ্ধের বিপক্ষে।

সবশেষে, এটি দুর্বলতা না শক্তি—তা নির্ভর করে মূল্যায়নের ভিত্তির ওপর। যদি আধিপত্য দিয়ে মাপা হয়, হ্যাঁ—যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি কমছে। কিন্তু যদি স্থায়িত্ব ও অভিযোজনক্ষমতা দিয়ে বিচার করা হয়, এটি এক সাহসী পুনর্গঠন। ভেনেজুয়েলায় সীমিত চাপের মতো পদক্ষেপ প্রমাণ করবে, এই নীতি প্রকৃতপক্ষে মার্কিন হস্তক্ষেপবাদের সমাপ্তি কিনা, নাকি কেবল নতুনভাবে সাজানো এক পুরোনো কৌশল।

তথ্যসূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউইয়র্ক টাইমস, সিএনএন, পলিটিকো, দ্য গার্ডিয়ান, কার্নেগি এনডাওমেন্ট ওড ওআরজি, মিলিটারি ডটকম, আরব সেন্টার ডিসি ডট ওআরজি, ইরান ইন্টারন্যাশনাল, আটলান্টিক কাউন্সিল, সিএসআইএস ডট ওআরজি

Ad 300x250

সম্পর্কিত