leadT1ad

শতবর্ষে ঋত্বিক ঘটক

অচেতন ঋত্বিক, সচেতন সেলুলয়েড

আজ বরেণ্য চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের শততম জন্মবার্ষিকী।

মাসুদ পারভেজ
মাসুদ পারভেজ

ছবি: স্ট্রিম গ্রাফিক

বাংলা চলচ্চিত্র জগতে ঋত্বিককুমার ঘটক একটা নাম বটে! তাঁকে যারা পছন্দ করেন কিংবা অপছন্দ করেন উভয় দলই স্বীকার করে নেবেন, ঋত্বিক এক বিশিষ্ট নাম। তো ঋত্বিক কী এমন সিনেমা বানিয়েছেন যে, তাঁকে শতবর্ষে স্মরণ করতে হয়! কিংবা ঋত্বিক কী এমন করেছিলেন যে, তাঁকে অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের হাতে মার খেতে হয়! কিংবা তাঁকে মারার পর সৌমিত্র কেন সেটার ফলাও প্রচার করেন? যাই হোক, এসব বিষয় বাদ দিয়ে বরং ঋত্বিক ঘটকের খোঁজ করা যাক।

বাংলাভাষী মানুষের জন্য ১৯৪৭ সাল একটি স্মরণীয় বছর। দেশভাগ কিংবা বাংলা ভাগের ফলে যে নতুন জাতীয়তাবাদী পরিচয়ের নির্মিতি ঘটে তা জনসাধারণের জন্য একটা নিজস্ব ভূমি তৈরি করে ঠিকই কিন্তু একই সঙ্গে তা বেদনাদায়ক ইতিহাসেরও জন্ম দেয়। ফলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত থেকে যদি বাংলা ভাগ একরকম ইমপ্যাক্ট তৈরি করে তবে সামজিক বা ব্যক্তিক দিক থেকে এর ইমপ্যাক্ট আরেক রকম। কেউ খুব সহজে এই দেশভাগ মেনে নিতে পেরেছে আবার কেউ জীবনভর একটা ট্রমার মধ্যে থেকেছে। ঋত্বিক ঘটক হলেন পরের ঘরানার, বাংলা ভাগ যাদের মনের চেতন ও অচেতন উভয় অবস্থায় প্রভাব ফেলে। চলচ্চিত্রকার ঋত্বিকের ক্ষেত্রে এই প্রভাব কেমন ছিল এবার তার খোঁজ করা যাক।

নীতা = ভারতীয় নারীর সহিষ্ণুতার প্রতীক

গীতা= ভারতীয় নারীর অনুভূতির প্রতীক

মা= ভারতীয় নারীর হিংস্রতার প্রতীক

ঋত্বিক ঘটক আটটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় সবগুলো চলচ্চিত্র মুক্তি পায়নি। সেক্ষেত্রে তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘নাগরিক’ ১৯৫২ সালে নির্মিত হলেও মুক্তি পায় তাঁর মৃত্যুর পর। এই ঘটনা যেকোনো সৃষ্টিশীল ব্যক্তির জন্য বেদনাদায়ক। দুর্ভাগ্যের মাপকাঠিতে ঋত্বিক যেন আরেক বাঙালি চলচ্চিত্রকার হীরালাল সেনের উত্তরসূরি হলেন -- যা জীবনভর তাকে তাড়িত করেছে। সে কথায় পরে আসছি।

‘নাগরিক’ নির্মাণের ঠিক তিন বছর পর সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ (১৯৫৫) মুক্তি পায়। ভারতীয় চলচ্চিত্রের জগতে যা ইতিহাস হয়ে আছে। তখন কেমন লেগেছিল ঋত্বিকের? সত্যজিৎ রায়ের মতে, ‘ঋত্বিক সে ছবি (পথের পাঁচালী) দেখেছে এবং দেখে তার খুবই বেশিরকম ভালো লেগেছিল। সে কথা সে প্রাণ খুলে আমার কাছে বলে। কিন্তু আমার কাছে যে জিনিসটি সব চাইতে ভালো লেগেছিল সেটা সে যেভাবে ছবিটাকে বিশ্লেষণ করেছিল -- তার কয়েকটা দৃশ্য -- সেটা থেকে আমার মনে হয়েছিল, ঋত্বিক যদি ছবি করে তাহলে সে খুব ভালোই ছবি করবে।’

এটা হলো ঋত্বিক ও সত্যজিতের প্রথম দিকের ঘটনা। কিন্তু বাঙালি বোদ্ধা মাত্রই ঋত্বিক ও সত্যজিৎ নামক দুইটি প্রতিদ্বন্দ্বী ঘরানা হিসেবে হাজির হয়। যাই হোক, ঋত্বিকের প্রথম চলচ্চিত্র ‘নাগরিক’ মুক্তি না পেলেও তিনি দ্বিতীয় চলচ্চিত্র হিসেবে ‘অযান্ত্রিক’ (১৯৫৮) নির্মাণ করেন। এটি তাঁর প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র হিসেবে অভিহিত হয়। কথাসাহিত্যিক সুবোধ ঘোষের ‘অযান্ত্রিক’ ছোটোগল্প অবলম্বনে ঋত্বিক এই চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।

জানা যায়, প্রায় ছয়-সাতবার এর চিত্রনাট্য তিনি লেখেন আর নিজেই ছিঁড়ে ফেলেন। তখন প্রশ্ন জাগে, ঋত্বিক ‘অযান্ত্রিক’-এ কী করতে চেয়েছেন বা কী করেছেন? দেশভাগের প্রায় দশবছর পর নির্মিত চলচ্চিত্রে ঋত্বিক যন্ত্রণাকেই ফোকাল পয়েন্ট বানালেন। তবে কি ঋত্বিকের অচেতন/নির্জ্ঞান ও চেতন/সজ্ঞান মনে সর্বদা দেশভাগের যন্ত্রণাক্লিষ্ট ক্ষত বহমান? যার ফলে তাঁর চলচ্চিত্রগুলো সব বেদনাচ্ছন্ন! এই যে, ড্রাইভার বিমল আর তার বিগতযৌবন জিপগাড়ি জগদ্দল এই দুইয়ের বন্ধন নিয়েই ‘অযান্ত্রিক’। এই ঘটনা ভারতীয় চলচ্চিত্রে তাঁর আগে কেউ করেনি। ফলে একটি প্রাণসত্তা ও একটি জড়বস্তুর মধ্যে যে মানবীয় সম্পর্ক সেলুলয়েডে ধারণ করলেন, এর মূল মেসেজটা আসলে কী? লক্ষ করা যাক :

জগদ্দল (জিপগাড়ি) = গতিবেগ

বিমল (মানব) = আবেগ।

চলচ্চিত্রে গতিবেগ ও আবেগের মধ্যে পারস্পরিক একটি সম্পর্ক তৈরি করা হলো এর মধ্যে নতুনত্ব কোথায়? বিষয়টি সাধারণভাবে দেখলে বলা যায়, প্রত্যেকেই তার উপার্জনের উপায় বস্তুসামগ্রীকে সমীহ করে, যত্ন করে -- তো বিমলও তাই করেছে। সেক্ষেত্রে সময়টাকে বিবেচনা করা দরকার।

ঋত্বিক ঘটক। সংগৃহীত ছবি
ঋত্বিক ঘটক। সংগৃহীত ছবি

একদিকে ঋত্বিকের মধ্যে মানুষের প্রিমিটিভ অস্তিত্বকে ধারণ করার আকাঙ্ক্ষা যেমন ভর করেছিল, পাশাপাশি দেশভাগ পরবর্তী হতাশা, দারিদ্র্য, ব্যক্তিবিচ্ছিন্নতা এসবের প্রভাব মানুষকে নীতিহীন কর্ম ও কালোবাজারিতে যেভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল তার দায়বোধও তাঁর মধ্যে ছিল। এরকম সময়ে বিমলের জিপগাড়িটি শুধু একটি জড়বস্তু বা যন্ত্র নয় তা তার সঙ্গী হয়ে ওঠে -- যার ওপর সে ভরসা করতে পারে।

এই ভরসা করতে পারা ও না-পারার বিষয়টিরই অভাব প্রকট হয়েছিল দেশভাগের রাজনীতিতে। ঋত্বিক কি তবে মানুষের ওপর আস্থার যে সংকট তা একটি যন্ত্রের ওপর প্রতিস্থাপন করে দেখালেন? পুঁজিবাদী প্রবণতার যে-বৈশিষ্ট্য ফুরিয়ে গেলেই ছুঁড়ে ফেলে দেয়া, তা থেকে ঋত্বিক এখানে ব্যতিক্রম হলেন। ফ্রানৎস কাফকার ‘মেটামরফসিস’ গল্পে গ্রেগর সামসা গুবরে পোকায় রূপান্তরিত হওয়ার পর যেভাবে অপাঙক্তেয় হয়ে ওঠে ঋত্বিক জগদ্দলের ক্ষেত্রে তেমনটি দেখাননি। বরং জিপগাড়ি জগদ্দল আর বিমলের মধ্যে চিরকালীন যে বিচ্ছেদ ঘটে গেল তা ঋত্বিকের চেতন ও অচেতন মন মেনে নেয়নি, ফলে পরিত্যক্ত জগদ্দলের যে হর্ন শিশুটি বাজায় তা যেন নতুন যাত্রা শুরুর ইঙ্গিত দিয়েছে।

আর তাই এই হর্নের শব্দে অশ্রুসিক্ত বিমলের মুখে হাসির রেখা দেখা যায়। তাহলে কি ঋত্বিক বলতে চেয়েছেন, জগদ্দলের সঙ্গে বিমলের বিচ্ছেদ মানে দেশভাগের করুণ পরিণতি। তো এমন করুণ পরিণতির চলচ্চিত্র দর্শক দেখতে চাইবে কেন? কারণ তাদের মনে তো তখন দেশভাগের দগদগে ক্ষত বিদ্যমান। ঋত্বিকের অচেতন মন এই ক্ষতটাকে মেনে নেয়নি ফলে তাঁর সচেতন মন সর্বদা তাতে প্রলেপ দিয়েছে সেলুলয়েডে। ঋত্বিক বলেন, আমার সবচেয়ে যেটা জরুরি বলে বোধ হয়েছে সেটা এই বিভক্ত বাংলার জরাজীর্ণ চেহারাটিকে লোকচক্ষে উপস্থিত করা, বাঙালিকে নিজেদের অস্তিত্ব, নিজেদের অতীত ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সচেতন করে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা।’ এটি ঋত্বিকের বিভক্ত বাংলার বাস্তবতাকে ধারণ করার বয়ান। যা তাঁর পরবর্তী চলচ্চিত্রেও দেখা যায়।

একদিকে ঋত্বিকের মধ্যে মানুষের প্রিমিটিভ অস্তিত্বকে ধারণ করার আকাক্সক্ষা যেমন ভর করেছিল, পাশাপাশি দেশভাগ পরবর্তী হতাশা, দারিদ্র্য, ব্যক্তিবিচ্ছিন্নতা এসবের প্রভাব মানুষকে নীতিহীন কর্ম ও কালোবাজারিতে যেভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল তার দায়বোধও তাঁর মধ্যে ছিল। এরকম সময়ে বিমলের জিপগাড়িটি শুধু একটি জড়বস্তু বা যন্ত্র নয় তা তার সঙ্গী হয়ে ওঠে -- যার ওপর সে ভরসা করতে পারে।

শিবরাম চক্রবর্তীর গল্প থেকে নির্মিত শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ (১৯৫৯) এর ব্যতিক্রম নয়। শহুরে জীবনের চাকচিক্য আদতে যে শূন্যতা ও রুক্ষতায় ভরা তা একটি বালকের দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে। ফলে বাড়িপালানো সেই বালক কাঞ্চন বলে, ‘এ শহরে এত দুঃখ কেন?’ এই প্রশ্নের জবাব কে দেবে? ঋত্বিক বরং এক মুটের মুখে ডায়লগ তুলে দিলেন, ‘এ লড়ায়ের জায়গা, কলকাতা শহর, দয়ামায় কুছু নেই, ... যা ঘরে চলে যা।’ এই লড়াই তো উদ্বাস্তু হয়ে বেঁচে থাকার লড়াই আবার যে লড়াইয়ে মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে অর্থাৎ দেশভাগের আগে কলিকাতার দাঙ্গার ইঙ্গিতও বটে। তো ঋত্বিক বাংলার এই দ্বন্দ্ব ও বিভাজন মানতে পারেননি। ফলে তাঁর ইঙ্গিত ‘মেঘে ঢাকা তারা’ (১৯৬০)-তেও পাওয়া গেল।

‘মেঘে ঢাকা তারা’কে তিনি তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কর্ম হিসেবে উল্লেখ করেছেন এভাবে : ‘আমি মনে করি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কর্ম এই ‘মেঘে ঢাকা তারা’। সেটা অন্যলোকেরা শুনে খুব আপত্তি করবেন। আমার কিছুই বলার নেই। আমার মত আমার কাছে, অন্যের মত অন্যের কাছে।’ তবে কী আছে ‘মেঘে ঢাকা তারা’য়? বাংলা ও বাঙালির আত্মপরিচয় অন্বেষণের তাগিদ, যা তাঁর পরবর্তী চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও ডিসকোর্স হিসেবে জারি থেকেছে। ‘মেঘে ঢাকা তারা’য় তিনি মূলত নারী শক্তিকে উন্মোচিত করেছেন। এই নারীর আত্মপরিচয় হলো ভারতীয়। চলচ্চিত্রে নীতা চরিত্রটির মধ্যে পুরাণের গৌরীকে ধারণ করার চিত্র লক্ষ করা যায়। সে ত্যাগের মাধ্যমে নিজেকে উৎসর্গ করার মানসিকতা পোষণ করে। নীতা, গীতা আর তাদের মা এই তিনটি নারী চরিত্রকে বিশেষভাবে খেয়াল করা দরকার :

নীতা = ভারতীয় নারীর সহিষ্ণুতার প্রতীক

গীতা= ভারতীয় নারীর অনুভূতির প্রতীক

মা= ভারতীয় নারীর হিংস্রতার প্রতীক

এই চরিত্রগুলোর ভেতর দিয়ে ঋত্বিক মূলত ভারতীয় বাঙালি নারীর আত্মপরিচয়কে তুলে ধরতে চেয়েছেন। তাঁর বাঙালিয়ানার অনুসন্ধান ও চলচ্চিত্রায়ন এ প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায় বলেন, ‘ঋত্বিক মনে প্রাণে বাঙালি পরিচালক ছিল, বাঙালি শিল্পী ছিল -- আমার থেকেও অনেক বেশী বাঙালি।’ তা করতে গিয়ে ঋত্বিক বাঙালির মিথ, পুরাণ, ইতিহাস, সমাজ, রাজনীতির নিগূঢ় প্রেক্ষাপটকে উপজীব্য করেছেন। ফলে তার চলচ্চিত্র কিংবা তথ্যচিত্রে ওঁরাও যেমন আসে তেমনি আসে তাদের সংগীত। তাঁর চলচ্চিত্রে ক্ষয়ে যাওয়া সমাজের নির্মোহ বাস্তবতা শুধু উঠে আসেনি এর পেছনের কারণটাকেও তিনি প্রশ্ন করেছেন। তখন দেখা দরকার তাঁর এই প্রশ্ন সমালানোর হিম্মত কি এই সমাজের দর্শক শ্রোতার আছে? শকুন্তলার যে ন্যারেটিভ ধরে তিনি ‘কোমলগান্ধার’ (১৯৬১) নির্মাণ করছেন তা তো মিলনের সুর।

'মেঘে ঢাকা তারা' সিনেমার একটি দৃশ্য। ইউটিউব থেকে নেওয়া ছবি
'মেঘে ঢাকা তারা' সিনেমার একটি দৃশ্য। ইউটিউব থেকে নেওয়া ছবি

ঋত্বিকের মতে, ‘কোমলগান্ধার।’ শকুন্তলা বাংলাদেশে পরিণত হয় আমার কাছে। রবিঠাকুরের সেই আশ্চর্যসুন্দর প্রবন্ধটি শকুন্তলা ও মিরাণ্ডার অপূর্ব তুলনা যেখানে রয়েছে, সেটি আমাকে প্রভাবিত করে। চারপাশের যে দ্বিধা, যে ভাঙন আমি জানি তার মূল হচ্ছে ভাঙা বাংলা। পূর্ব বাংলার লোক বলে এ কথা মনে করি না। গোটা বাংলার ঐতিহ্যটি আয়ত্ত করার চেষ্টা করি বলেই একথা জানি যে, দুই বাংলা মিলন অবশ্যম্ভাবী। তার রাজনৈতিক তাৎপর্য আমার হিসাব করার কথা নয়, কিন্তু সাংস্কৃতিক মূল্য আমার কাছে অবধারিত।

‘কোমলগান্ধার’ নিয়ে ঋত্বিকের এই বয়ান উপলব্ধি করার অবস্থা বাঙালি দর্শকের ছিল না। কিংবা বলা যায়, ‘কোমলগান্ধার’ চলচ্চিত্রে ঋত্বিক ছিলেন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রগামী। ফলে দর্শক তাঁর এই নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্র গ্রহণ করেনি। তারপরও ঋত্বিক থেমে থাকেননি। তিনি নির্মাণ করেন ‘সুবর্ণরেখা’ (১৯৬২) -- যা বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত হয়ে মুক্তি পায় ১৯৬৫ সালে।

একদিকে ‘কোমলগান্ধারে’র দুঃসহ অভিজ্ঞতা, আরেকদিকে মানসিক অবসাদ -- এসবের ভেতরেই চলে ‘সুবর্ণরেখা’র নির্মাণ। মূলত উদ্বাস্তু সমস্যা এই চলচ্চিত্রের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু এই উদ্বাস্তু কেবল দেশভাগের পরিপ্রেক্ষিতকে ধারণ করেছে, তা নয় বরং একই সঙ্গে মানুষের জীবনের প্রতি যে আকাঙ্ক্ষা, অর্থাৎ মমত্ববোধ ও ভালোবাসার পরিচয়কে তুলে ধরা হয়েছে। ‘সুবর্ণরেখা’য় দেশভাগের শিকার মানুষগুলোর একদিকে ব্যক্তির দ্বন্দ্ব, আরেকদিকে সমষ্টির দ্বন্দ্বের যে চিত্র তা মূলত আইডেনটিটির সংকট থেকে সৃষ্ট। উদ্বাস্তু বা বাস্তুহারা বা ‘রিফিউজি’ তকমা দিয়ে এই মানুষগুলোকে যে পরিচিতি প্রদান করা হয়েছে এটার সমাধান কি আদৌ আছে?

সমাধান করার লক্ষ্যে যে দেশভাগ করা হয় তাতে জাতীয়তাবাদী একটি পরিচয় ব্যক্তি পায় বটে, কিন্তু তার অর্থনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক সংকট কি সমাধান হয়? এমন প্রশ্নের সম্মুখে ঋত্বিক বারবার আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন আর সমাজ চেতনা, কাল চেতনা, মিথ, পুরাণ, ব্যক্তি, গোষ্ঠী, লোকাচার ইত্যাদির সম্মিলনে ‘সুবর্ণরেখা’কে দান করেছেন ‘আদিম পুরাকল্পীয় ইমেজ’। কিন্তু এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণের পর মুক্তি পেতে সময় লেগেছিল তিন বছর। এরপর ঋত্বিক নির্মাণ করলেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ (১৯৭৩)।

ঋত্বিক ঘটক আটটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় সবগুলো চলচ্চিত্র মুক্তি পায়নি। সেক্ষেত্রে তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘নাগরিক’ ১৯৫২ সালে নির্মিত হলেও মুক্তি পায় তাঁর মৃত্যুর পর। এই ঘটনা যেকোনো সৃষ্টিশীল ব্যক্তির জন্য বেদনাদায়ক।

অদ্বৈত মল্লবর্মণের উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে এই চলচ্চিত্র। ততদিনে ঋত্বিকের পূর্ববঙ্গ ‘বাংলাদেশ’ নামক একটি স্বাধীন ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। হয়তোবা ঋত্বিকের অচেতন মনে দুই বাংলার মিলনমেলার যে আকাঙ্ক্ষা অনবরত কড়া নাড়ত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ দিয়ে তার সচেতন মন সেটাকে তুলে ধরে। জানা যায়, ‘তিতাসকে কেন্দ্র করে এপিকধর্মী কিছু করার ভাবনা পাকাপাকিভাবে তাঁর মাথায় ঢোকে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে এসে।’

‘তিতাস’ একটি চরিত্র, একটি আইডেনটিটি। কার? ঋত্বিকের পূর্ববাংলার। আবার যে জনজীবনকে ঋত্বিক তার আগের চলচ্চিত্রসমূহে ধারণ করেছেন বা করতে চেয়েছেন তিতাসে সেই কৈবর্ত, মালোদের জীবনগাথা ও সংস্কৃতির নাগাল তিনি পেয়েছেন। ফলে ঋত্বিকের অচেতন ও চেতন মনে আত্মপরিচেয়র যে সংকট বিদ্যমান ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ দিয়ে তিনি তা ঘোচাতে চেয়েছেন। এই চলচ্চিত্র বিষয়ে ঋত্বিক বলেন, ‘...তিতাসটা ছিল আমার পক্ষে আইডিয়াল। কারণ তিতাস ছিল একটা ‘‘সাবজেক্ট’’ যে সাবজেক্ট মোটামুটিটা নেই তা, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেকার বাংলা। তার উপর তো পটভূমিকা। এর সাবজেক্টটা হচ্ছে এমন যা বাংলাদেশের সর্বত্র ঘোরার সুযোগ দেয় -- গ্রাম বাংলাকে বোঝার সুযোগ দেয়। গাঁয়ে গিয়ে চিত্রধারণ করাটা বড় কথা নয়। চিত্রধারণ করার ফাঁকে ফাঁকে মানুষের সাথে মেশা, নাড়ীর স্পন্দনটাকে বোঝার চেষ্টা করা। কাজেই ইতিহাসটা একটা অজুহাত এদিক থেকে। এবং ওই অবস্থায় তিতাস ধরে করলে হয় কী সেই -- মাকে পুজো করা হয়। তা এতগুলি কারণেই এই তিতাস পরে হতে পারত না। এখনো তিতাস আমার একটা ‘‘স্টাডি’’ আর আমার একটা ‘‘ওয়ারশিপ’’ হিসাবে দেখা যেতে পারে। এই নদী, এই মাটি, এই মানুষ, এদের মধ্যে যাবার একটা ব্যাপার আছে, আবার আছে এর সঙ্গে নিজেকে ‘‘রি-এস্টাবলিশ’’ করা।

ছবি: স্ট্রিম গ্রাফিক
ছবি: স্ট্রিম গ্রাফিক

ঋত্বিকের এই বয়ানের পর তিতাস নিয়ে আর কি বা বলার থাকে! এই যে পঞ্চাশ বছর আগের বাংলাকে ঋত্বিক তিতাসে আশ্রয় করেছেন এটাই মূলত তাঁর হারানো আত্মপরিচয়ের প্রামাণ্য রূপ। কিন্তু ঋত্বিকের এই অচেতন মনকে সেলুলয়েডের বোদ্ধা ও দর্শকেরা উপলব্ধি করতে পারেননি বা চায়নি। ফলে তারা দেশভাগের রাজনৈতিক বয়ান ও ইতিহাস চেতনা সম্পর্কে ঋত্বিককে অজ্ঞ হিসেবে দায় দিয়েছেন। ঋত্বিক প্রসঙ্গে মহাশ্বেতা দেবী বলেন, ‘দেশের সে চেহারা স্বাধীনতার পর থেকে দেখা গেল, ইতিহাস চেতনার ফলে যে বিশ্লেষণী পরিপ্রেক্ষিত জ্ঞান জন্মায় তা ঋত্বিকের থাকলে তিনি বুঝতেন, এই নৈরাজ্য নগ্নতা ছিন্নমূলতা হঠাৎ স্বাধীনতার পরই গজিয়ে ওঠেনি। দেশের ইতিহাস যে পথে চলছিল তাতে ঠিক ঠিক ইতিহাসসম্মত পরিণতিই ঘটেছে এবং আমরা জাতিগতভাবে এর ভালো অবস্থা হবার মতো কোনো কাজ কোনো ফ্রন্টেই করিনি।’

মহাশ্বেতা দেবীর ইতিহাস বিষয়ক এই বয়ান পুরোপুরি ঔপনিবেশিক ইতিহাসকেন্দ্রিক। আর ঋত্বিকের চলচ্চিত্রে ইতিহাস বোধ হলো ‘প্রিমিটিভ’। ফলে ঋত্বিক তাঁর চলচ্চিত্রে ধারণ করতে চেয়েছেন সামূহিক নির্জ্ঞান বা কালেকটিভ আনকন্সাসনেস। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, সামূহিক নির্জ্ঞানের ক্ষেত্রে ‘সিম্বল’ ও ‘কালচারাল নলেজ’ যুক্ত থাকে, যা ব্যক্তির অভিজ্ঞতায় থাকে না ফলে তা উপলব্ধি করতে পারে না। কিন্তু বিষয়টি এই অর্থে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যে, যা ব্যক্তির পূর্বপুরুষের মধ্যে বিদ্যমান ছিল ফলে তা প্রবাহিত হয়ে ব্যক্তির মধ্যেও বর্তমান থাকে। কিন্তু ব্যক্তি সে সম্পর্কে নির্জ্ঞান থাকে। ফলে একে সামূহিক নির্জ্ঞানও বলা হয়। ঋত্বিক তাঁর চলচ্চিত্রে প্রথাগত ইতিহাস চেতনার বাইরে গিয়ে এই সামূহিক নির্জ্ঞানকে ধারণ করতে চেয়েছেন। তাই জন্মশতবর্ষে ঋত্বিক ঘটককে নিয়ে ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ চলতে পারে কিন্তু খারিজ করবে সে হিম্মত কার?

তথ্যঋণ

‘ঋত্বিক চলচ্চিত্র কথা’, বাঁধন সেনগুপ্ত, পুনশ্চ, ২০১৩, কলকাতা;

‘মৃত্যু : সাহিত্যে নির্জ্ঞানে’, মাসুদ পারভেজ. কথাপ্রকাশ, ২০২৫, ঢাকা।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

Ad 300x250

সম্পর্কিত