leadT1ad

শতবর্ষে ঋত্বিক ঘটক

‘ওই পারে আমার দেশ’, ঋত্বিক ঘটকের সিনেমায় দেশভাগের দলিল

আজ চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের শততম জন্মবার্ষিকী। তাঁর লেন্সে দেশভাগের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ছাপিয়ে দাগ কেটেছিল এর গভীর মানবিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব। দেশভাগের ফলে তিনি নিজেই পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে অভিবাসী হয়েছিলেন।

রাতুল আল আহমেদ
রাতুল আল আহমেদ

ছবি: স্ট্রিম গ্রাফিক

মানব ইতিহাসের দিকে যদি তাকাই, দেখতে পাব জাতিরাষ্ট্রের ধারণাটি নিতান্তই নতুন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপের উপনিবেশগুলো একে একে স্বাধীন হতে শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণে বিশ্ব ইতিহাসের বহু দেশ ভাঙাগড়ার ভেতর দিয়ে গেছে। তেমনি ১৯৪৭ সালে ভাগ হয়েছে ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রদেশ। সিরিল র‍্যাডক্লিফের পেন্সিলের দাগ কেবল এই ভূখণ্ডকে ভাগ করেনি; বরং মানুষের জীবন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক, বংশপরম্পরাকে ক্ষতবিক্ষত করেছে।

ঋত্বিক ঘটক এই ট্র্যাজেডিকে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে নতুন আঙিকে তুলে ধরেছিলেন। তাঁর লেন্সে দেশভাগের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ছাপিয়ে দাগ কেটেছিল এর গভীর মানবিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব। এর একটি কারণ হতে পারে তাঁর নিজের রিফিউজি পরিচয়। দেশভাগের ফলে তিনি নিজেই পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে অভিবাসী হয়েছিলেন।

এই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, উদ্বাস্তু হওয়ার যন্ত্রণার স্মৃতি এবং বাঙালি জাতিসত্তার বিচ্ছিন্নতার উপলব্ধি ঋত্বিকের চলচ্চিত্রচিন্তাকে আলাদা করে তোলে। ফলে ঋত্বিকের চলচ্চিত্রে দেশভাগের প্রতিফলন শুধু ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নয়, বরং তা চরিত্র, গল্প ও দৃশ্যপটের মাধ্যমে দর্শকের মনে প্রবাহিত হয়।

'মেঘে ঢাকা তারা' সিনেমার একটি দৃশ্য। ইউটিউব থেকে নেওয়া ছবি
'মেঘে ঢাকা তারা' সিনেমার একটি দৃশ্য। ইউটিউব থেকে নেওয়া ছবি

আজ থেকে শতবর্ষ পূর্বে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন ঋত্বিক ঘটক। আদিনিবাস উত্তরবঙ্গের রাজশাহীতে, পদ্মার পাড়ে। পশ্চিমবঙ্গে যাওয়ার পর তিনি শুধু একটি নতুন শহরেই মানিয়ে নেননি, বরং নতুন জীবনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর সংগ্রামও করেছিলেন। এই অভিজ্ঞতা তাঁকে ‘রিফিউজি আর্টিস্ট’-এ পরিণত করে। ফলে তাঁর চলচ্চিত্রচিন্তায় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক বাস্তবতা একাকার হয়ে ওঠে। ঘটনাক্রমে, তিনি দেশভাগকে কেবল ইতিহাস হিসেবে নেননি; বরং তা মানসিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষতির চিহ্ন হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

অর্থাৎ, ঋত্বিক ঘটকের কাছে সিনেমা শুধুমাত্র গল্প বলার মাধ্যম ছিল না। তিনি চলচ্চিত্রকে দেখিয়েছেন ইতিহাসের সচেতন দলিল হিসেবে, যা দর্শককে মানবিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার দিকে তাকাতে বাধ্য করে। তাঁর চলচ্চিত্রে দেশভাগের প্রভাব স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান, যেখানে রিফিউজি কলোনি, গৃহহীন পরিবার, অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এসবই তাঁর ছবির কেন্দ্রীয় উপজীব্য।

সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেনও দেশভাগকে চলচ্চিত্রে এনেছেন, তবে তাঁদের সিনেমা রাজনৈতিক ও মানসিক বিশ্লেষণে ঋত্বিকের মতো গভীর নয়। সত্যজিৎ ও মৃণালের কলকাতা ট্রিলজিতে দেশভাগ সেখানে পার্শ্বচরিত্রমাত্র। সেখানে ঋত্বিকের চলচ্চিত্রের স্বতন্ত্রতা হলো দেশভাগকে সামাজিক, মানসিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে উপস্থাপন করা।

ঋত্বিকের ‘পার্টিশন ট্রিলজি’

ঋত্বিক ঘটকের পার্টিশন ট্রিলজি—‘মেঘে ঢাকা তারা’ (১৯৬০), ‘কোমলগান্ধার’ (১৯৬১) এবং ‘সুবর্ণরেখা’ (১৯৬২)—দেশভাগের অব্যাহত প্রভাব, উদ্বাস্তু জীবনের বাস্তবতা ও সাংস্কৃতিক ক্ষয়কে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বর্ণনা করেছে।

পরপর তিনটি বাণিজ্যিকভাবে অসফল চলচ্চিত্রের পর ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছিল ঋত্বিকের প্রথম ব্যবসাসফল ছবি। দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গে থিতু হওয়া এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত শরণার্থী পরিবারের সংগ্রামের গল্প তিনি এখানে তুলে ধরেছেন। নীতা ও তার পরিবার পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে এসে নতুন জীবন শুরু করার চেষ্টা করে, কিন্তু সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা তাঁদের পথ ক্রমাগত কঠিন করে তোলে। চলচ্চিত্রে দেখা যায়, পরিবারের সদস্যরা নিজেদের সম্মান ও স্বপ্ন হারিয়ে দিতেও বাধ্য হন।

ঋত্বিক বলতে চেয়েছেন, দেশের বিভাজন কেবল ভূগোল নয়, এটি মানুষের জীবন ও মনস্তত্ত্বের ওপরও স্থায়ী প্রভাব ফেলে। নীতার বিখ্যাত সংলাপ, ‘দাদা, আমি বাঁচতে চাই’ আর তার আত্মত্যাগ, ঋত্বিকের চোখে পার্টিশনেরই প্রতীক।

ট্রিলজির পরবর্তী দ্বিতীয় ছবি ‘কোমলগান্ধার’-এ ঋত্বিক দেশভাগের প্রভাবকে নাট্যদলের মাধ্যমে উপস্থাপন করেন। এটি ছিল তাঁর নিজের সবচেয়ে প্রিয় চলচ্চিত্র। এখানে নাটক ও সংগীতের প্রতীকায়নের মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার মানুষের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। ভৃগু ও অনুসূয়ার সম্পর্ক, নাট্যদলের টানাপোড়েন এবং পুনর্মিলনের আকাঙ্ক্ষা, সবই দেশভাগের ছায়া বহন করে।

ঋত্বিক ঘটক। সংগৃহীত ছবি
ঋত্বিক ঘটক। সংগৃহীত ছবি

অনসূয়াকে ভৃগু যখন ট্রেনলাইনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে দূরের দিগন্ত দেখিয়ে বলে, ‘ওই পারে আমার দেশ’। তখন সামনে বয়ে যাওয়া নদী যেন জীবনের প্রতীক হয়ে ওঠে। ট্রেনের যান্ত্রিকতা, লাইনের প্রান্ত, দোহাই আলির আর্তনাদ—সব মিলিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার অনিবার্য বিচ্ছেদকে তুলে ধরে। যে রেললাইন ছিল এক সময়ের ‘যোগচিহ্ন’, কালের নিয়মে তা-ই হয়ে ওঠে ‘বিয়োগচিহ্ন’। এই সিনেমায় ঋত্বিক প্রতীকের ভেতর দিয়ে হয়তো নিজের আকাঙ্ক্ষাই প্রকাশ করেছেন—দুই বাংলার পুনর্মিলন।

এরপর আসে ট্রিলজির শেষ চলচ্চিত্র ‘সুবর্ণরেখা’। এখানে আমরা দেখি দেশভাগের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব এবং মানবিক ও সামাজিক অবক্ষয়। উদ্বাস্তু পরিবার, কাজের অভাব, আশ্রয়হীন জীবন, সামাজিক বিপর্যয়, সবই এখানে উপস্থিত। ফলে সিনেমার চরিত্ররা কেবল ব্যক্তিগত কষ্টের প্রতিচ্ছবি নয়; বরং তারা যেন সমগ্র বাঙালির বিভক্ত চেতনার দার্শনিক প্রতিফলন।

‘সুবর্ণরেখা’-তে পূর্ববঙ্গ থেকে ভারতের রিফিউজি কলোনিতে ঠাঁই পাওয়া বাগদী বউ ভারতে এসেও নিরাপত্তা পায় না; উপায়ন্তর না দেখে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য হওয়া সীতার অপমান সেই সময়ের সামাজিক ও নৈতিক সংকটের দীর্ঘমেয়াদি চিহ্ন হয়ে ওঠে। মৈনাক বিশ্বাসের গবেষণায় দেখানো হয়েছে, সীতার পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য হওয়ার ঘটনাটি দেশভাগ-পরবর্তী সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের গভীর প্রতীক।

নাগরিক ও অন্যান্য চলচ্চিত্রে উদ্বাস্তু জীবন

ঋত্বিকের প্রথম নির্মিত চলচ্চিত্র ‘নাগরিক’ (১৯৫২, মুক্তি ১৯৭৭) উদ্বাস্তুদের জীবন এবং বাঙালি সমাজের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষতির প্রতিফলন। ভায়োলিনবাদকের চরিত্রের মাধ্যমে দেখা যায়, কীভাবে দেশের হারানো সুর মানুষের মানসিক অবস্থাকে প্রভাবিত করে। চলচ্চিত্রে উদ্বাস্তু জীবনের গল্প, উচ্ছেদ, উৎখাত এবং সামাজিক অবক্ষয়—এসবই ঋত্বিকের রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণের জটিল সমন্বয় হিসেবে প্রকাশ পায়।

ঋত্বিক বলতে চেয়েছেন, দেশের বিভাজন কেবল ভূগোল নয়, এটি মানুষের জীবন ও মনস্তত্ত্বের ওপরও স্থায়ী প্রভাব ফেলে। নীতার বিখ্যাত সংলাপ, ‘দাদা, আমি বাঁচতে চাই’ আর তার আত্মত্যাগ, ঋত্বিকের চোখে পার্টিশনেরই প্রতীক।

ঋত্বিক তাঁর সিনেমায় পার্টিশনকে কখনো কেবল দাঙ্গা বা সংঘাতের দৃশ্য হিসেবে দেখাননি। তিনি দেখিয়েছেন উদ্বাস্তু জীবনের অভিজ্ঞতা, নতুন শহরে নামান্তরিত জীবন, রিফিউজি কলোনির বাস্তবতা—এগুলোই দেশভাগের প্রকৃত প্রভাব। বলিউডের পার্টিশন চলচ্চিত্রে যেমন রক্তরঞ্জিত ট্রেন বা দাঙ্গার দৃশ্য দেখা যায়, ঋত্বিকের সিনেমা তা নয়। বরং তাঁর চলচ্চিত্র মানসিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষতির দলিল।

‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’

ঋত্বিকের শেষ দিকের চলচ্চিত্র ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’-এ তিনি নিজেই অভিনয় করেছেন এবং নিজের অভিজ্ঞতাকে সরাসরি ফুটিয়ে তুলেছেন। এখানে শাঁওলী মিত্র অভিনীত বঙ্গবালা চরিত্রের মাধ্যমে পূর্ববাংলার আত্মাকে প্রতীকীভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেনও দেশভাগকে চলচ্চিত্রে এনেছেন, তবে তাঁদের সিনেমা রাজনৈতিক ও মানসিক বিশ্লেষণে ঋত্বিকের মতো গভীর নয়। সত্যজিৎ ও মৃণালের কলকাতা ট্রিলজিতে দেশভাগ সেখানে পার্শ্বচরিত্রমাত্র। সেখানে ঋত্বিকের চলচ্চিত্রের স্বতন্ত্রতা হলো দেশভাগকে সামাজিক, মানসিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে উপস্থাপন করা।

ঋত্বিক ঘটকের সিনেমার ভাষাও ছিল অনন্য। তিনি মেলোড্রামা, গান, নাটক, শব্দ ও সংগীতকে রাজনৈতিক ও সামাজিক অভিব্যক্তির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমলগান্ধার’ ও ‘সুবর্ণরেখা’ ট্রিলজিতে ক্যামেরার ব্যবহার, ফ্রেমিং, শব্দ ও সংগীত চরিত্রের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও দেশভাগের যন্ত্রণা দর্শকের কাছে গভীরভাবে পৌঁছে দেয়।

Ad 300x250

সম্পর্কিত