leadT1ad

শতবর্ষে ঋত্বিক ঘটক

ঋত্বিক ঘটক শিখিয়েছেন কীভাবে ‘কনফিউশনের জঙ্গল’-এ পথ খুঁজে নিতে হয়

আজ বরেণ্য চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের শততম জন্মবার্ষিকী। এই বিশেষ দিনে আমরা শুধু তাঁর শিল্পের বিশালতা নয়, তাঁর অস্থির জীবন, সংবেদনশীল সম্পর্ক এবং সমসাময়িকদের চোখে দেখা তাঁর বিদ্রোহী মনকেও নতুন করে পড়ার চেষ্টা করতে পারি।

রাফসান আহমেদ
রাফসান আহমেদ

ছবি: স্ট্রিম গ্রাফিক

২০২৫ সালের ৪ নভেম্বর। ঋত্বিক কুমার ঘটকের শততম জন্মবার্ষিকী। তিনি বিশ্ব চলচ্চিত্রের মানচিত্রে এক জ্বলন্ত ব্যতিক্রম, আপসহীনতার প্রতীক এবং বাঙালির ইতিহাসের এক রক্তাক্ত দলিল ‘রেকর্ডিস্ট’। এই বিশেষ দিনে আমরা শুধু তাঁর শিল্পের বিশালতা নয়, তাঁর অস্থির জীবন, সংবেদনশীল সম্পর্ক এবং সমসাময়িকদের চোখে দেখা তাঁর বিদ্রোহী মনকেও নতুন করে পড়ার চেষ্টা করতে পারি।

ঋত্বিক ছিলেন বিরল প্রতিভা। জীবনের ক্ষত, মানুষের অপমান আর দেশভাগের যন্ত্রণাকে তিনি ক্যামেরার ফ্রেমে ধারণ করে তা এক ‘এপিক কোয়ালিটি’ তে পরিণত করেছিলেন। ১০০ বছর পেরিয়েছে। কেউ কেউ তাঁকে স্মারকে বাঁধতে চায়। কিন্তু আগুনকে কি আটকে রাখা যায়? ঋত্বিক রেকর্ড করে গেছেন পৃথিবীর অসুখ।

শিল্পের বীজভূমি: ভাই-বোনের সম্পর্ক ও সংবেদনশীলতার উৎস

ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রের ‘মহৎ নিষ্ঠুরতা’ বুঝতে হলে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের গভীরে ঢুকতে হয়। তাঁর বোন প্রতীতি দত্তের (প্রতীতি দেবী) স্মৃতিচারণগুলি প্রমাণ করে, ঋত্বিকের শিল্পীসত্তার ভিত্তি ছিল অপার ভালোবাসা আর সংবেদনশীলতা।

অভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায়ের দেওয়া সতর্কবার্তা ‘আপনি নিজেই নিজেকে শেষ করবেন’ ঋত্বিকের জীবনের ট্র্যাজেডির সারসংক্ষেপ। ঋত্বিক নিজেই স্বীকার করেছিলেন, ‘আমি কম্প্রোমাইজ করব না, তাই মদ খেয়ে জীবন শেষ করছি।’ এই 'কম্প্রোমাইজ না করা'ই তাঁকে একাকী করে তুলেছিল।

আট বছর বয়সে বোন প্রতীতির ডিপথেরিয়া হলে মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে ঋত্বিক তাঁকে দেখতে যেতেন। নিজেও অসুস্থ হলে উল্টো খুশি হয়ে বোনের পাশে শুয়ে পড়েন। বোনকে বলেছিলেন, ‘তোকে ছাড়া একদম ভালো লাগছিল নারে। অসুখ হয়ে ভালোই হলো।’

এই কথাগুলো শিশু প্রতীতির কাছে চরম নির্ভরতা আর একাত্মতার প্রকাশ ছিল। এই সেই ঋত্বিক, যিনি পরে নিজের ছবিতে মানুষের নিঃসঙ্গতা দূর করতে চেয়েছিলেন। ইনজেকশনকে ভয় পাওয়া সেই ঋত্বিক দাঁতে দাঁত চেপে বড় বড় সিরাম ইনজেকশন নিতেন, শুধু বোনের পাশে থাকার জন্য। এই আত্মত্যাগই তাঁর পরবর্তী জীবনের ‘কম্প্রোমাইজ না করার’ অঙ্গীকারের প্রথম পাঠ।

নয় বছর বয়সে বোন টাইফয়েডে অসুস্থ হলে তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল আরও গভীর। প্রতীতির অসুখের সময় তিনি ঘরের সব জিনিসপত্র পাগলের মতো ভেঙে ফেলেছিলেন। আর খেলনা ও বই বুকে চেপে খেলাঘরে বসে বসে শুধু কাঁদতেন। এই আচরণগুলিই ছিল তাঁর শিল্পের সেই গভীর ‘ব্যাথা, বেদনা, যন্ত্রনার সবচেয়ে ভয়ংকর সুন্দর মিজে সিন’ আয়োজনের প্রাথমিক মহড়া।

ঋত্বিক ঘটক। সংগৃহীত ছবি
ঋত্বিক ঘটক। সংগৃহীত ছবি

এই ব্যক্তিগত যন্ত্রণার নিরিখেই প্রতীতি দেবীর সেই বেদনাবিধুর মন্তব্যটি আসে, ‘সারা জীবন ও শুধু কেঁদেই গেল, কিছুই পেল না!’ ঋত্বিকের এই ব্যক্তিগত কান্না, বস্তুত লাখ লাখ বাস্তুহারা মানুষের কান্নার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। যা তাঁর শিল্পকে 'ক্লান্তিহীনভাবে রিপিটেটিভ' দুঃখের মহাকাব্যে পরিণত করেছিল।

রাজনীতির বারুদ: দেশভাগ ও মানুষের অপমান

ঋত্বিক ঘটকের শিল্পকে তাঁর রাজনৈতিক চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন করা অসম্ভব। তিনি বলেছিলেন, ‘মানুষ, তোমাকে ভালবাসি।’ কিন্তু এই ভালোবাসা ছিল শর্তসাপেক্ষ, যা মুলত মানুষের মর্যাদা রক্ষা করা। তাঁর শিল্পের মূল লক্ষ্য ছিল ‘মানুষের অপমানকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে।’ এই আপ্তবাক্যই তাঁর চলচ্চিত্রের প্রতিটি ফ্রেমে বারুদের মতো জ্বলেছে।

ক. ছিন্নমূলের মহাকাব্য

ঋত্বিকের জীবনবোধ ও শিল্পে দেশভাগের ক্ষত ছিল সবচেয়ে গভীর। তিনি শুধু দেশভাগ নিয়ে 'ছবি বানাননি', তিনি নিজেই ছিলেন দেশভাগ। সেই ক্ষত কখনও শুকায়নি। তিনি ছিলেন সেই ছাপোষা মধ্যবিত্তের হারিয়ে যাওয়া নাগরিকতার বোধে দীক্ষিত, যিনি শিকড় উপরে ফেলার দুঃখ কে সিনেমায় এস্থেটিকতা দিয়েছেন। ‘মেঘে ঢাকা তারা’, 'কোমল গান্ধার', এবং 'সুবর্ণরেখা' ত্রয়ী কেবল চলচ্চিত্রের উদাহরণ নয়, এগুলো তাঁর উদ্বাস্তু জীবনের রাজনৈতিক ভাষা, যা তৎকালীন সমাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল।

ঋত্বিকের সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘শুয়োরের দল। বাংলার আবার এপার-ওপার কি রে!’ প্রমাণ করে যে তিনি আঞ্চলিকতা বা সীমানার ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের যন্ত্রণাকে বিশ্বজনীন করতে চেয়েছিলেন। তাঁর চলচ্চিত্র কোনো সস্তা ফ্যান্টাসি ছিল না; তা ছিল 'রুটলেস লোয়ার মিডল ক্লাসের আইডেন্টিটি' এবং সময়কে ধারণ করার নিঃসংকোচ প্রয়াস।

ঋত্বিক ঘটকের শিল্পকে তাঁর রাজনৈতিক চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন করা অসম্ভব। তিনি বলেছিলেন, ‘মানুষ, তোমাকে ভালবাসি।’ কিন্তু এই ভালোবাসা ছিল শর্তসাপেক্ষ, যা মুলত মানুষের মর্যাদা রক্ষা করা। তাঁর শিল্পের মূল লক্ষ্য ছিল ‘মানুষের অপমানকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে।’ এই আপ্তবাক্যই তাঁর চলচ্চিত্রের প্রতিটি ফ্রেমে বারুদের মতো জ্বলেছে।

খ. ফর্ম ও বক্তব্যের যুগ

ঋত্বিক ফর্মের দিক থেকেও ছিলেন বিপ্লবী। তিনি মনে করতেন, ‘ছবিতে গল্পের যুগ শেষ হয়ে গেছে, এখন এসেছে বক্তব্যের যুগ।’ তাঁর চলচ্চিত্রের মূল উদ্দেশ্য ছিল মন জাগানো, মন যোগানো নয়। তিনি দর্শককে আঘাত করতেন তাঁর ‘নিষ্ঠুরতার চাবুক’ দিয়ে, তা হোক ‘কলকাতা শহরে রোজ অনেক মেয়ে নতুন করে বেশ্যা হয়’ দৃশ্যে বা অপমানিত মানুষের চোখের জলে। গ্রেট আর্টিস্ট হিসেবে তিনি ছিলেন মারাত্মক নিষ্ঠুর। কারণ, এই নিষ্ঠুরতাই ছিল তাঁর কাছে মানুষকে সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করানোর একমাত্র উপায়।

কনফেশন ও সংঘাত: 'মাতাল, ভাঙা বুদ্ধিজীবী'

ঋত্বিক ঘটকের ব্যক্তিগত জীবন ছিল তাঁর শিল্পের মতোই অস্থির ও সংঘাতময়। তাঁর মদ্যপান ছিল বাজার আর আপসের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ।

ক. আপসহীনতার মূল্য

অভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায়ের দেওয়া সতর্কবার্তা ‘আপনি নিজেই নিজেকে শেষ করবেন’ ঋত্বিকের জীবনের ট্র্যাজেডির সারসংক্ষেপ। ঋত্বিক নিজেই স্বীকার করেছিলেন, ‘আমি কম্প্রোমাইজ করব না, তাই মদ খেয়ে জীবন শেষ করছি।’ এই 'কম্প্রোমাইজ না করা'ই তাঁকে একাকী করে তুলেছিল।

ঋত্বিক ঘটক। সংগৃহীত ছবি
ঋত্বিক ঘটক। সংগৃহীত ছবি

তিনি নিজেকে বলতেন ‘আমি এক মাতাল। ভাঙা বুদ্ধিজীবী, ব্রোকেন ইন্টেলেকচুয়াল।’ কিন্তু তাঁর এই ‘ভাঙ্গা’ হওয়া ছিল সত্যনিষ্ঠার প্রতীক। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, ‘আমি কনফিউজড, হয়তো আমরা সবাই কনফিউজড, আটারলি কনফিউজড। আমরা সবাই দিশেহারা হয়ে হাতড়ে হাতড়ে বেরাচ্ছি।’ এই বিভ্রান্তিই তাঁকে আরও বেশি মানবিক করে তুলেছিল। কারণ, তিনি মানুষের বিভ্রান্তিকে নিজের মধ্যে অনুভব করতে পারতেন।

খ. 'যুক্তি-তক্কো-গপ্পো': চূড়ান্ত পরিণতি

ঋত্বিকের শেষ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র 'যুক্তি-তক্কো-গপ্পো' ছিল তাঁর এই অস্থির জীবনের চূড়ান্ত পরিণতি। এটি ছিল তাঁর দায়িত্ববোধের চূড়ান্ত পরিণতি। ছবিটি যখন তৈরি হয়, তখন তিনি শুধুমাত্র একজন পরিচালক ছিলেন না। নবারুণ ভট্টাচার্যের ভাষায় তিনি ছিলেন ফুটপাতে থাকা 'লুম্পেনদের' একজন, একজন 'পরিপূর্ণ উদ্বাস্তু'। এই ছবিতে তিনি তাঁর সময়, সমাজ ও বিশ্বরাজনীতির সারসংক্ষেপ তুলে ধরেছিলেন।

নবারুণ ভট্টাচার্য ও তাঁর বাবা বিজন ভট্টাচার্য বিশ্বাস করতেন, ঋত্বিককে খুন করা হয়েছে। এই 'খুন' এক অর্থে বাজারের 'প্রফিট আর্ট'-এর কাছে শিল্পের পরাজয়, যেখানে ঋত্বিকের মতো ‘অচল মাস্তান’ নিঃসঙ্গ লড়াই করেছেন।

ঋত্বিক বনাম সত্যজিৎ: দুই মহীরুহের সন্ধি

ঋত্বিক ঘটকের সমালোচনা করতে গেলে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তাঁর তুলনা অনিবার্য। ঋত্বিক নিজেই সত্যজিৎকে ‘চুলের আগা থেকে নখের ডগা পর্যন্ত কমপ্লিট আর্টিস্ট’ বলতেন, কিন্তু সেই সঙ্গে যোগ করতেন, ‘তবে একটু দরজি টাইপ আরকি। খুব মেপে মেপে কাটে।’

এই মূল্যায়নটি গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। সত্যজিৎ ছিলেন শান্ত, পরিমিত ও ক্লাসিক্যাল। অন্যদিকে ঋত্বিক ছিলেন আবেগপ্রবণ, বোহেমিয়ান এবং স্বতঃস্ফূর্ত। তাঁর ফ্রেম ছিল বারুদে ভর্তি। ঋত্বিকের শিল্প ছিল এক্সপ্রেসিভ মাইথোলজির টোনে কথা বলা, যা সমাজের উপর 'বিদ্যুৎ চাবুকে' আঘাত হানত।

ঋত্বিক: আমাদের স্কুল ও চিরন্তন জরুরত

আজকের এই কর্পোরেট-নির্ভর এবং ঝকঝকে আর্বান সিনেমার যুগে, ঋত্বিক ঘটক অতীত নন, তিনি এক জরুরত। গীতিকার কাওসার আহমেদ চৌধুরী তাঁকে মাস্টার হিসেবে মানেন। তিনি বলেছিলেন, ‘কেউ যদি বলে কে তোর মাস্টার? আমি বলি ঋত্বিক আমার স্কুল।’ এই স্কুলে আমরা শিখি, কীভাবে শব্দ, ক্যামেরা ও গল্পের মাধ্যমে জীবনকে অনুভব করতে হয়, কীভাবে 'কনফিউশনের জঙ্গল'-এ পথ খুঁজে নিতে হয়।

নবারুণের সূত্র ধরে আমরা জানি, ‘ফিল্ম একটা স্টেটমেন্ট হতে পারে, ফিল্ম একটা দার্শনিক তাৎপর্য বহন করতে পারে, ফিল্ম একটা ট্রিটিজ হতে পারে, ফিল্ম একটা দাস ক্যাপিটাল হতে পারে...’। ঋত্বিকই ছিলেন সেই বিরল পরিচালক, যিনি এই উচ্চতায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।

শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর প্রয়াণে যে কথা লিখেছিলেন, তা আজও সত্য:

‘তুমি গেছো, স্পর্ধা গেছে, বিনয় এসেছে / পোড়া পাথরের মতো পড়ে আছো বাংলাদেশে, / পাশে ঋত্বিক, তোমার জন্যে তুচ্ছ কবি আর্তনাদ করে।’

তিনি দর্শককে আঘাত করতেন তাঁর ‘নিষ্ঠুরতার চাবুক’ দিয়ে, তা হোক ‘কলকাতা শহরে রোজ অনেক মেয়ে নতুন করে বেশ্যা হয়’ দৃশ্যে বা অপমানিত মানুষের চোখের জলে। গ্রেট আর্টিস্ট হিসেবে তিনি ছিলেন মারাত্মক নিষ্ঠুর। কারণ, এই নিষ্ঠুরতাই ছিল তাঁর কাছে মানুষকে সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করানোর একমাত্র উপায়।

ঋত্বিক ঘটক সিনেমার মাস্তান। তিনি আমাদের হাতে তাঁর অটোগ্রাফ তুলে দিয়ে গেছেন, যা হারাবার নয়। তাঁর চূড়ান্ত কনফেশন ছিল, ‘আমি একেবারেই পাগল। সিনেমা না বানিয়ে থাকতে পারি না।’ এই পাগলামি, এই স্পর্ধা, এই ভালোবাসা—সবকিছু নিয়ে তিনি আমাদের চেতনায় এক অমর শিখা।

শতবর্ষে তাঁর প্রতি আমাদের শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধাঞ্জলি একটাই, ‘ভাবো, ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো।’ কারণ, এই ভাবনাতেই লুকিয়ে আছে মানুষের অপমানকে নিশ্চিহ্ন করার শক্তি।

লেখক: নৃবিজ্ঞানী, দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গবেষক, চলচ্চিত্রকার

Ad 300x250

সম্পর্কিত