leadT1ad

মালি দখলের পথে আল-কায়েদাপন্থী সংগঠন জেএনআইএম

বিশ্বের প্রথম পূর্ণাঙ্গ আল-কায়েদা নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র হতে পারে মালি

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২৫, ১৪: ০০
জেএনআইএম শুধু বিদ্রোহী গোষ্ঠী নয়, বরং একধরনের ‘অস্থায়ী রাষ্ট্র’ হিসেবে কাজ করছে। ছবি: সংগৃহীত।

পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালি দখলের পথে রয়েছে আল-কায়েদার শাখা জামাআত নুসরাত আল-ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন (জেএনআইএম)। তারা ধীরে ধীরে মালির রাজধানী বামাকোর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। শহরটির পতন হলে দেশটি কঠোর শরিয়াহ আইনের অধীনে একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র হওয়ার দিকে এগিয়ে যাবে।

জেএনআইএম সেখানে অর্থনৈতিক ও সামরিক কৌশলে নিয়ন্ত্রণ বিস্তার করে। দুই মাসের জ্বালানি অবরোধ ও সমন্বিত হামলার মাধ্যমে তারা রাজধানী বামাকোকে প্রায় অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। দেশটির সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, আর সামরিক জান্তার দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মধ্য, পশ্চিম ও উত্তর মালির বিশাল এলাকা এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে।

জেএনআইএম শুধু বিদ্রোহী গোষ্ঠী নয়, বরং একধরনের ‘অস্থায়ী রাষ্ট্র’ হিসেবে কাজ করছে। তারা স্থানীয় ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে প্রশাসন, কর আদায় ও বিচার কার্য পরিচালনা করছে। এই পরিস্থিতি মালিকে আধুনিক ইতিহাসে প্রথম পূর্ণাঙ্গ আল-কায়েদা নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রে পরিণত করার আশঙ্কা তৈরি করেছে।

তুয়ারেগ বিদ্রোহ থেকে জিহাদি উত্থান

২০১২ সালের জানুয়ারিতে উত্তর মালিতে তুয়ারেগ জাতিগোষ্ঠীর বিদ্রোহ থেকেই এ সংকটের সূচনা। লিবিয়ার গাদ্দাফি সরকারের পতনের পর সেখানে অস্ত্রের স্রোত পৌঁছে যায়। এই সুযোগে আল-কায়েদা ইন দ্য ইসলামিক মাঘরেব (একিউআইএম) ও তাদের মিত্ররা টিমবুকটু ও গাও দখল করে। ২০১৩ সালে ফ্রান্সের সামরিক অভিযান ‘অপারেশন সারভাল’ অস্থায়ীভাবে জিহাদিদের পিছু হটায়, তবে দারিদ্র্য, জাতিগত বৈষম্য, দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা রয়ে যায়।

২০১৭ সালের মার্চে একিউআইএমের শাখা, আনসার আল-দিন, আল-মুরাবিতুন ও মাসিনা মুক্তি ফ্রন্ট একত্র হয়ে জেএনআইএম গঠন করে। শীর্ষ নেতা ইয়াদ আগ ঘালির নেতৃত্বে তারা আল-কায়েদার প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে। তারা আইএসের মতো বর্বরতা না দেখিয়ে স্থানীয় জনগণের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের কৌশল নেয়। ফূলানি ও তুয়ারেগ সম্প্রদায়ের মধ্যে বিচার ব্যবস্থা, নিরাপত্তা ও বাণিজ্যে কর আরোপের মাধ্যমে তারা প্রভাবশালী হয়ে ওঠে।

২০২০ সালের পর কর্নেল আসিমি গোইতা নেতৃত্বাধীন সামরিক জান্তা দুটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে। তারা নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়। ফরাসি বাহিনী (২০২২), জাতিসংঘ মিশন মিনুসমা (২০২৩) ও ইকোওয়াস (২০২৫)–—সবকিছুর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে মালি আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে হয়ে পড়ে। এতে জেএনআইএম দ্রুত পুনরুজ্জীবিত হয়। শুধু গত এক বছরে পশ্চিম ও দক্ষিণ মালিতে তাদের হামলায় ৪৫০ জনের বেশি নিহত হয়েছে।

বর্তমান অবস্থা: বামাকোর অবরোধ

২০২৫ সালের জুলাইয়ে জেএনআইএম সাতটি বড় হামলা চালিয়ে নতুন ধাপে যুদ্ধ শুরু করে। তারা এখন বামাকো থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে কার্যক্রম চালাচ্ছে। কায়েস ও নিয়োরো দ্য সাহেল সীমান্ত শহরগুলো অবরোধ করে সেনেগাল, আইভরি কোস্ট, গিনি ও মৌরিতানিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি বন্ধ করেছে। এই পথগুলোই ছিল মালির ৯৫ শতাংশ জ্বালানির উৎস।

গত ১৪ সেপ্টেম্বর এক হামলায় তারা সেনা পাহারাদার কনভয়ে থাকা ৪০টিরও বেশি ট্যাঙ্কার জ্বালিয়ে দেয় ও বহু মানুষ অপহরণ করে।

নভেম্বর নাগাদ দুই মাসের অবরোধে বামাকো অচল হয়ে পড়ে। ৪০ লাখ মানুষের শহরে রাতভর জ্বালানির লাইনে অপেক্ষা চলছে। স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, ব্যবসায়িক কার্যক্রম স্থবির, খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়েছে এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ ভেঙে পড়েছে। জেএনআইএম সামরিক ও অর্থনৈতিক কৌশল একত্রে ব্যবহার করছে—ড্রোন হামলা, বিস্ফোরণ, অপহরণ ও স্বর্ণখনি থেকে চাঁদা আদায়ের মাধ্যমে তারা অর্থ জোগাড় করছে।

দক্ষিণ মালির ৬০ শতাংশ জনগণ এখন জেএনআইএম নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বাস করছে। সেখানে জাকাত কর, সংগীত ও মদের নিষেধাজ্ঞা, নারীদের পোশাকবিধি এবং স্থানীয় আদালত স্থাপন করে শরিয়াভিত্তিক আইন ও শাসনব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। আগস্টে ফারাবুগুর পতনের পর সেখানকার বাসিন্দারা বাধ্য হয়ে মাসিনা ফ্রন্টের নিয়ম মেনে চলছে।

এ পর্যন্ত ২ লাখ ৪৫ হাজারের বেশি মানুষ মৌরিতানিয়া ও সেনেগালে পালিয়ে গেছে। ২০১২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এই সংঘাতে ১৭ হাজার ৭০০ জনেরও বেশি নিহত হয়েছে, যার দুই-তৃতীয়াংশ মারা যায় ২০২০ সালের পর।

মালি এখন এক গভীর মানবিক ও রাজনৈতিক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। যদি পরিস্থিতি দ্রুত না বদলায়, তবে দেশটি শিগগিরই আল-কায়েদা নিয়ন্ত্রিত প্রথম রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে।

জ্বালানি সংকটের কারণে মালির বামাকোতে একটি পেট্রোল পাম্পে লোকজন জড়ো হচ্ছে। ছবি: রয়টার্স।
জ্বালানি সংকটের কারণে মালির বামাকোতে একটি পেট্রোল পাম্পে লোকজন জড়ো হচ্ছে। ছবি: রয়টার্স।

মূল পক্ষ ও কৌশল

জেএনআইএম জোট: ইয়াদ আগ ঘালির নেতৃত্বে গঠিত এই জোটে একিউআইএম, ফুলানি-কেন্দ্রিক এফএলএম এবং অন্যান্য গোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত। সদস্যসংখ্যা আনুমানিক দুই থেকে তিন হাজার। অর্থ সংগ্রহ হয় মুক্তিপণ, খনি কর ও বাণিজ্য থেকে চাঁদা আদায়ের মাধ্যমে। তাদের কৌশল সরাসরি দখল নয়, বরং ‘অবরোধ ও ঘেরাও’ নীতি। তারা সামরিক জান্তার জীবনরেখাগুলো আঘাত করে বিকল্প প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলছে।

এফএলএম উপগোষ্ঠী: জেএনআইএমের দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলের প্রধান বাহিনী এটি। মোপ্তি থেকে সীমান্ত পর্যন্ত তাদের প্রভাব বিস্তৃত হয়েছে। অপ্রচলিত এলাকায় সহিংসতা দ্বিগুণ বেড়েছে।

সামরিক জান্তা বাহিনী: ১৫ থেকে ২০ হাজার সেনা সদস্য নিয়ে তারা লড়ছে। রুশ আফ্রিকা কর্পসের প্রায় ১ হাজার ৫০০ যোদ্ধা আছে। তুরস্ক ড্রোন সহযোগিতা দিচ্ছে। চেকপোস্ট ও হেলিকপ্টার হামলা সাময়িক সাফল্য আনলেও জেএনআইএমের গতিশীল কৌশলের সামনে তা টেকে না। আগস্টে কয়েকজন জেনারেল গ্রেপ্তারের ঘটনায় জান্তার অভ্যন্তরীণ বিভাজন স্পষ্ট হয়েছে।

বিশ্লেষক দানিয়েল গারোফালো বলেন, জেএনআইএমের ‘বহুমাত্রিক কৌশল’ তাদের শত শত কিলোমিটার দূরে একযোগে অভিযান চালাতে সক্ষম করছে। এতে তারা দরিদ্র জনগণের চোখে ‘ভালো সরকার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে।

জেএনআইএমের অগ্রগতির কারণ

১. জান্তার একঘরে অবস্থা ও দমননীতি: ২০২৫ সালের মে মাসে রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত, গণমাধ্যম স্থগিত, ও গোইতার পাঁচ বছরের স্বঘোষিত মেয়াদ জান্তার বৈধতা দুর্বল করেছে। মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত দুই বছরে বেসামরিক হতাহতের ৭৭ শতাংশের জন্য জান্তা ও রুশ বাহিনী দায়ী। এতে জনগণের ক্ষোভ জেএনআইএমের পক্ষে কাজ করছে।

জান্তা বুরকিনা ফাসো এবং নাইজারের সাথে সামরিক সহায়তার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে কিন্তু এর প্রভাব এখনও দেখা বাকি। ইকোওয়াসের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার পর, মালি তার সামরিক সম্পদের উপর নির্ভর করতেও অক্ষম।

২. ব্যর্থ জোটনীতি: ফরাসি বাহিনী বহিষ্কারের পর রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা গোয়েন্দা তথ্যের ঘাটতি তৈরি করেছে। ২০২৪ সালের এক হামলায় ৫০ রুশ যোদ্ধার মৃত্যু তাদের দুর্বলতা প্রকাশ করে।

৩. অর্থনৈতিক দুর্বলতা: স্থলবেষ্টিত মালি আমদানির ওপর নির্ভরশীল। ফলে অবরোধে অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে। স্বর্ণ ও তুলা রপ্তানি দেশটির রাজস্বের ৮০ শতাংশ, যা এখন জেএনআইএমের প্রধান লক্ষ্য।

৪. আঞ্চলিক পরিস্থিতি: জেএনআইএম ও আইএসজিএস-এর মধ্যে অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতি তাদের বিস্তার সহজ করেছে। শরণার্থী স্রোত প্রতিবেশী দেশগুলোকে চাপে ফেলছে।

৫. বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তন: পশ্চিমা দেশগুলোর সরে যাওয়া—বিশেষত ইউরোপীয় ইউনিয়নের টাসকুবা মিশন বন্ধ হওয়া (২০২২)—একটি শূন্যতা তৈরি করেছে। জেএনআইএম এই সুযোগে জাতিগত বিভাজন কাজে লাগাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

চলতি মাসে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে পশ্চিম আফ্রিকা ও সাহেল অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হবে। সিয়েরা লিওনের প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস মাদা বায়ো এতে সভাপতিত্ব করবেন। জেএনআইএমের নতুন সক্ষমতা—ড্রোন ও সমন্বিত হামলা—বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে।

জুলাইয়ের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেএনআইএম দক্ষিণ দিকে টোগো, বেনিন ও নাইজেরিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

নভেম্বরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি ও ইতালি তাদের নাগরিকদের দ্রুত দেশ ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে। ইকোওয়াস সতর্ক করেছে, যদি মালির পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসে, তাহলে সাহেল জোট (এইইএস) ভেঙে পড়তে পারে।

বিশ্লেষক এডমুন্ড ফিটন-ব্রাউন মন্তব্য করেন, ফরাসি, জাতিসংঘ ও ইকোওয়াসের বহিষ্কার জেএনআইএমকে ‘নরম পদ্ধতিতে শাসন পরিবর্তনের’ সুযোগ দিয়েছে। কূটনীতিকরা এখন স্থানীয় নেতাদের—যেমন মোপ্তির ইমামদের—মাধ্যমে আলোচনার পথ খুঁজছেন।

পরিণতি ও ঝুঁকি

এসি‌এলইডি বিশ্লেষক হেনি নসাইবিয়ার মতে, বামাকোর পতন ‘কবে হবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।’ এতে আল-কায়েদা প্রথম সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে। তাতে তালেবানশাসিত আফগানিস্তানের মতো শরিয়া আইন, নারীদের চলাচলে বিধিনিষেধ ও প্রকাশ্য মৃত্যুদণ্ড চালু হতে পারে।

এটি প্রতিবেশী বুরকিনা ফাসো ও নাইজারেও অস্থিরতা ছড়াবে। উপকূলীয় দেশগুলো, যেমন আইভরি কোস্টে, ইতিমধ্যেই হামলা ২০ শতাংশ বেড়েছে।

বিশ্বপর্যায়ে, সাহেল অঞ্চলের এ সংকট ইউরোপে অভিবাসন ও সন্ত্রাসবাদ বাড়াতে পারে। লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে।

‘কন্ট্রোল রিস্কস’ মূল্যায়ন বলছে, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মালির জান্তা সরকার হয় অভ্যুত্থান, নয়তো সংকটে ভেঙে পড়তে পারে। জেএনআইএমের শাসন মডেল ‘সহিংসতার বদলে প্রশাসন’, যা বিদ্রোহ ও রাষ্ট্রগঠনের সীমানা ঘোলাটে করে দিচ্ছে।

মালির সংকট একটি বড় সতর্কবার্তা। জিহাদি গোষ্ঠীগুলো দুর্বল রাষ্ট্র কাঠামো ও অর্থনৈতিক সংকটকে ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করছে।

তথ্যসূত্র: বিবিসি, সিএনএন, দ্য গার্ডিয়ান

Ad 300x250

সম্পর্কিত