রাজধানীর ধানমন্ডি লেক ও এর আশপাশে গত কয়েকদিনের ব্যবধানে পরপর চারটি বিড়ালের খোঁজ পাওয়া গেছে; যেগুলোর একটিরও চোখ নেই। এটি নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয় বলেই মনে করছেন প্রাণিগুলোকে উদ্ধার ও পরিচর্যার দায়িত্ব নেওয়া ব্যক্তিরা। তাদের ধারণা, এর পেছনে হয়তো কোনো ‘সাইকোপ্যাথ’ ব্যক্তির হাত আছে; যে হয়তো বিড়ালের কষ্টে আনন্দ পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাণির প্রতি এমন নির্দয়তা থেকেই বড় অপরাধের প্রবণতা তৈরি হতে পারে। এদিকে ঘটনাটি তদন্তে নেমেছে পুলিশ। সংস্থাটি জানিয়েছে, অপরাধীকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে।
ধানমন্ডির ১২/এ রোডের মসজিদুদ তাকওয়ার পাশের লেক এলাকা থেকে প্রথম আহত এক বিড়ালের খোঁজ পাওয়া যায় গত ৩০ অক্টোবর। পরদিন একই এলাকা থেকে আরও দুটি বিড়ালের খোঁজ মেলে। এই তিনটি বিড়ালের একটিরও চোখ ছিল না। সবশেষ গত রোববার (২ নভেম্বর) লেকের পার্শ্ববর্তী শুক্রাবাদ এলাকায় এমন আরেকটি বিড়াল পাওয়া যায়।
এই ঘটনায় চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চোখহীন বিড়ালের ছবি ছড়িয়ে পড়লে অনেকে ক্ষোভ, ঘৃণা ও শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
যেভাবে উদ্ধার হলো বিড়ালগুলো
বেসরকারি ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী যয়নব রহমান চৌধুরী গত ৩০ অক্টোবর সন্ধ্যায় ধানমন্ডি লেকের ধারে হাঁটছিলেন। হঠাৎ একটি বিড়াল চোখে পড়ে তাঁর। লেকের প্রাণীদের প্রতি আগে থেকেই ভালোবাসা থাকায় কাছে গিয়ে আদর করতে যান তিনি। গিয়ে দেখেন, বিড়ালটির চোখ নেই।
ধানমন্ডি লেকে বিড়াল উদ্ধারকারী যয়নব রহমান চৌধুরী। স্ট্রিম ছবিযয়নব স্ট্রিমকে বলেন, ‘আমি প্রায়ই লেকে হাঁটতে যাই। বিড়াল, কুকুর দেখলে আদর করি। সেদিন গাছের পাশে একটা বিড়াল বসে ছিল। কাছে গিয়ে দেখি, চোখে ইনজুরির মতো কিছু একটা। পরে ভালো করে দেখে বুঝি, ওর চোখই নেই। ভয় পেলেও ডাকে সাড়া দিচ্ছিল ও।’
তিনি জানান, তখন পাশে থাকা এক ব্যক্তি বলেন, ওই এলাকায় আগের দুদিনেও এমন দুইটি বিড়াল দেখা গেছে—একটি সাদা, আরেকটি কালো-কমলা রঙের। তাদের চোখও উপড়ে ফেলা হয়েছিল। এমন কথা শুনে আমি ভয় পেয়ে যাই। বন্ধুদের কল দিই। পরে এক আপুকে পাই, যিনি বিড়ালটি নিতে ও চিকিৎসার খরচ দিতে রাজি হন। আমরা বন্ধুরা মিলে বিড়ালটাকে ধানমন্ডি সাত নম্বরের এক ক্লিনিকে নিয়ে যাই। কিন্তু কালো বিড়ালটাকে তখন আমরা খুঁজে পাইনি।’
বিড়ালগুলো এখন কোথায় আছে
চোখ উপড়ে ফেলা তিনটি বিড়ালের খোঁজ পেয়েছে স্ট্রিম। আরেকটি বিড়ালের তথ্য পাওয়া যায়নি। বর্তমানে এই তিনটি বিড়ালের দেখাশোনা করেছেন ইলিন জাহান ও রাকিব হোসেন। রাজধানীর দয়াগঞ্জ এলাকায় থাকেন এই দম্পতি। তাঁদের বাসায় গিয়ে দেখা গেল, তিনটি বিড়ালকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়ে রেখেছেন নিজেদের শোবার ঘরে। একটি বিড়াল গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেও বাকি দুটো বিড়াল খেলছে, খাচ্ছে। মানুষের গন্ধ বা আওয়াজ পেলে শরীরে ঘেঁষে আদর চাইছে।
ইলিন জাহান বলেন, ‘আমি আট বছর ধরে বিড়াল রেসকিউ করি। আমাদের মোবাইল নম্বর বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে আছে। সেখান থেকে এক আপু কল দেন, তারপর আমরা বিড়ালটা রেসকিউ করি। চিকিৎসার খরচ চলে ফস্টার ও ক্রাউডফান্ডিংয়ের টাকায়।’
‘এক্সিডেন্ট না, ইচ্ছাকৃতভাবে করা’
বর্তমানে ইলিন জাহানের কাছে ৫০টির বেশি বিড়াল আছে। দীর্ঘদিন বিড়াল লালন-পালন করে তাদের বিষয়ে অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন তিনি। ইলিন বলেন, ‘চোখ উপড়ে ফেলার ঘটনায় প্রথমে গুরুত্ব দেইনি। সাধারণত কোথাও আঘাত পেলে বিড়ালদের চোখে অনেক সময় এমন সমস্যা হয়। কিন্তু পরের দিন একইধরনের আরও একটি ঘটনা সামনে আসে, একই এলাকায়। আরেকজন আপু ফোন দিলেন। সেই বিড়ালটারও চোখ উপড়ানো বলে জানতে পারি। তখন আমাদের কাছে বিষয়টি কনসার্নিং মনে হয়েছে।’
ইলিন আরও বলেন, ‘আমার তত্ত্বাবধানে থাকা বিড়ালগুলোর অনেকগুলোরই চোখে অপারেশন করা, সেলাই করা। কিন্তু যেসব বিড়াল অ্যাবিউজড হয়, ওগুলোর চোখ সেলাই করা যায় না। খোঁচা-খুঁচির কারণে চোখগুলো বাজে অবস্থায় থাকে।’
বিড়ালগুলোর পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাগজ। স্ট্রিম ছবিইলিনের স্বামী রাকিব হোসেন স্ট্রিমকে বলেন, ‘আমরা বিড়ালগুলোকে ডাক্তার দেখিয়েছি। বিভিন্ন টেস্ট করানোর পরে ডাক্তাররা বলেছেন, এটা আসলে কোনো এক্সিডেন্ট বা হেলথ ইস্যু না। কোনো মানুষের মাধ্যমে এই কাজটা করা হয়ে থাকতে পারে। এরকম কেস আমরা এর আগেও দেখেছি।'
এমন ঘটনা কেন ঘটে, যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার বা কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডার থেকে মানুষ এমন ঘটনা ঘটাতে পারে বলেন মনে করেন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক আহমেদ হেলাল।
স্ট্রিমকে তিনি বলেন, ‘সাইকোপ্যাথ শব্দটা কমন টার্ম। মানসিক স্বাস্থ্যের জায়গাটাতে এই শব্দ ব্যবহার না করে আমরা দুটো শব্দ ব্যবহার করি। একটা হচ্ছে পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার, আরেকটা হচ্ছে কনডাক্ট ডিসঅর্ডার। কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে যদি কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডার থাকে, তখন তারা পশু-পাখিদের প্রতি নির্দয় হয় এবং আঘাত করে। এতে তাঁরা হয়তো আঘাত করে এক ধরনের গ্র্যাটিফিকেশন বা তৃপ্তি পায়। যেটা তার মনটাকে ভালো রাখে, শান্ত রাখে, অস্থিরতা কমায়, অ্যাংজাইটি কমায়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের শিক্ষক রেজাউল করিম সোহাগের মতে বিষয়টি ‘চিন্তা এবং উদ্বেগের’। তিনি মনে করেন, একই এলাকায় পরপর এসব ঘটনা নির্দিষ্ট কোনো চক্র বা ব্যক্তি ঘটিয়ে থাকতে পারেন।
রেজাউল করিম স্ট্রিমকে বলেন, ‘এই ঘটনাকে কয়েকভাবে দেখা যায়। বিড়ালকে অনেকে কুসংস্কারবশত মন্দ ভাগ্য বা ব্ল্যাক ম্যাজিকের অংশের প্রতীক হিসেবে দেখেন, সেখান থেকে এমন ঘটনা ঘটতে পারে।’
উদ্ধার হওয়া একটি বিড়াল। স্ট্রিম ছবিরেজাউল করিম সোহাগ আরও বলেন, ‘ফ্রাস্টেশন অথবা রিভেঞ্জের জায়গা থেকেও এমন ঘটনা অনেকে ঘটাতে পারেন। মানুষের ওপর তৈরি হওয়া ক্ষোভ, নিরীহ প্রাণীর ওপর বাস্তবায়ন করতে দেখা যায় অনেককে, যা ডিসপ্লেসড অ্যাগ্রেশন হিসেবে বিবেচিত।
তাঁর মতে, এমন অপরাধে যুক্ত ব্যক্তিরা পরবর্তী সময়ে জড়িয়ে পড়তে পারেন বড় অপরাধে। রেজাউল করিম স্ট্রিমকে বলেন, এসব ঘটনা এখনই আইনের আওতায় না আনা হলে পরবর্তী সময়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
আইন কী বলে
বাংলাদেশে প্রাণিকল্যাণ নিশ্চিত করতে ‘প্রাণিকল্যাণ আইন, ২০১৯’ আছে। এই আইনে প্রাণীর প্রতি নির্দয় আচরণ বা সহায়তার অপরাধে দুই বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু এই আইনের তেমন একটা ব্যবহার দেখা যায় না। এমনকি এই আইনে দায়ের হওয়া মামলাও খুব একটা নেই। তবে ধানমন্ডিতে এবারের নৃশংস ঘটনায় এরই মধ্যে অভিযোগ দায়ের হয়েছে।
ঘটনার তদন্ত চেয়ে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে জানিয়ে ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ক্যশৈন্যু মারমা স্ট্রিমকে বলেন, ‘অভিযোগকারীদের আশ্বস্ত করেছি, আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব। বিড়াল বা যে কোনো পশুর চোখ উপড়ে ফেলা একটা দণ্ডনীয় অপরাধ। কাজেই এটা আমরা বের করার চেষ্টা করছি। বিশেষত লেক-কেন্দ্রিক যেসব জায়গায় সিসি ক্যামেরাগুলো আছে, সেগুলো আমরা অ্যানালাইসিস করছি, খুঁজছি। অপরাধীকে পেলে অবশ্যই তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসব।’
উদ্ধার হওয়া বিড়াল। স্ট্রিম ছবিশুধু শাস্তি নয়, প্রয়োজন সচেতনতাও
বিড়ালের চোখ উপড়ে ফেলার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি জনসচেতনতার কথাও বলেছেন উদ্ধারকারী ও বিশেষজ্ঞরা। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আহমদ হেলাল বলেন, ‘এটা মাথায় রাখতে হবে, যারা পশু-পাখির ওপর নির্দয় আচরণ করছে, তারা নিজেরাও কোনো এক সময় অ্যাবিউজের মুখোমুখি হয়ে থাকতে পারে।’
বিড়াল উদ্ধারের সময় যয়নবের সঙ্গে ছিল তাঁর বন্ধু অধরা মাধুরী। তিনি স্ট্রিমকে বলেন, ‘ধানমন্ডি থানা ঘটনাটাকে ইনভেস্টিগেট করবে, এটা শুনে আমি খুবই খুশি হইছি। সাহসও পাচ্ছি, সামনে কিছু হইলে আমরা তাঁদের কাছে যেতে পারবো। উনারা সাহায্য করবেন।’
মাধুরী আরও বলেন, ‘আইনি দিক ছাড়াও আমাদের অ্যাওয়ারনেস তৈরির কাজ করতে হবে। যেন আশপাশের মানুষ খেয়াল রাখেন, অ্যানিমেলগুলো কেমন আছে। উপকার না করলেও যেন অন্তত ক্ষতি না করে। অলরেডি এমন কিছু করার জন্য আমরা উদ্যোগ নেওয়ার চিন্তা করছি।’
যয়নব রহমান চৌধুরী বলেন, ‘এমন ঘটনা শুধু একজন মানুষের নিষ্ঠুরতার বিষয় নয়। এটি আমাদের সমাজের বিচ্ছিন্নতা এবং অসুস্থতার প্রতিফলন। আমরা নিজের, একে অপরের এবং চারপাশের জীবজগতের সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলেছি।’
‘এই সমস্যা মোকাবিলায় সামাজিক উদ্যোগ প্রয়োজন। শুধু শাস্তি দিয়ে এর সমাধান হবে না। যারা এধরনের কাজ করেন, তাঁরা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, একাকিত্বে ভুগে থাকতে পারেন। তাদের দূরে ঠেলে দিয়ে বা শুধু শাস্তির ব্যবস্থা করে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করা যাবে না।’