‘৯/১১ পরবর্তী আমেরিকার রূপকার’ এবং ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের স্থপতি’ হিসেবে খ্যাত যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম ভাইস প্রেসিডেন্ট রিচার্ড ডিক ব্রুস চেনি মারা গেছেন। স্থানীয় সময় সোমবার সন্ধ্যায় (৩ নভেম্বর ২০২৫) ৮৪ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। নিউমোনিয়া এবং দীর্ঘদিনের হৃদ্যন্ত্র ও রক্তনালীর রোগজনিত জটিলতায় তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সময় তাঁর পাশে ছিলেন স্ত্রী লিন ও দুই কন্যা লিজ ও মেরি।
তাঁর মৃত্যু এক যুগের অবসান ঘটিয়েছে—যে যুগ যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি, জ্বালানি প্রভাব এবং কঠোর জাতীয় নিরাপত্তা নীতির মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত হয়েছিল। চেনির মৃত্যু নিয়ে বিশ্বজুড়ে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। কেউ তাঁকে চারজন প্রেসিডেন্টের অধীনে দায়িত্ব পালনকারী নিবেদিত রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। আবার কেউ ইরাক যুদ্ধ ও বন্দি নির্যাতন নীতির জন্য কঠোর সমালোচনা করেছেন।
ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে চেনির উত্তরাধিকার একদিকে আমেরিকার দৃঢ়তা ও নেতৃত্বের প্রতীক, অন্যদিকে ক্ষমতার সীমা ও অপব্যবহারের সতর্কবার্তা।
ডিক চেনির জন্ম ১৯৪১ সালের ৩০ জানুয়ারি নেব্রাস্কার লিংকনে। তিনি ওয়াইয়োমিং-এ বেড়ে ওঠেন এবং আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলের স্বনির্ভর ও দৃঢ়চেতা চরিত্রকে ধারণ করেন। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও পড়াশোনায় ব্যর্থ হয়ে তিনি তা ত্যাগ করেন। পূর্ব উপকূলের অভিজাত সংস্কৃতির প্রতি তাঁর অনীহা ছিল প্রবল।
তাঁর রাজনৈতিক উত্থান শুরু হয় নিক্সন ও ফোর্ড প্রশাসনে। ১৯৭৫ সালে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে তিনি প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের অধীনে ইতিহাসের সবচেয়ে তরুণ হোয়াইট হাউস চিফ অব স্টাফ হন। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির পর প্রশাসন পুনর্গঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
১৯৭৮ সালে ওয়াইয়োমিং থেকে কংগ্রেস সদস্য নির্বাচিত হয়ে তিনি টানা ছয় মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি হাউস মাইনোরিটি হুইপ হন। এ সময় তিনি জ্বালানি খাতের প্রসার ও প্রতিরক্ষা নীতির কঠোর অবস্থানের জন্য পরিচিত হন।
জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ প্রশাসনে ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত প্রতিরক্ষা সচিব হিসেবে তিনি পানামা অভিযান ও ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধ পরিচালনা করেন। এই যুদ্ধে ১৪৭ জন মার্কিন সেনা নিহত হলেও ইরাকি প্রাণহানি ছিল এক লক্ষাধিক। যুদ্ধ শেষে তিনি প্রতিরক্ষা বাজেট থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার কমান।
সরকারি দায়িত্ব শেষে তিনি ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত হ্যালিবার্টন কোম্পানির প্রধান নির্বাহী ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে কোম্পানির আয় বেড়ে ১২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়, বিশেষত ফ্র্যাকিং প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে। তবে পরবর্তীতে ইরাক যুদ্ধ–সম্পর্কিত ৩৯ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের সরকারি চুক্তির কারণে তিনি সমালোচনার মুখে পড়েন।
২০০০ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী নির্বাচনের দায়িত্বে ছিলেন চেনি। শেষ পর্যন্ত নিজেই সেই পদে মনোনীত হন—যা তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে প্রভাবশালী অধ্যায় হিসেবে ইতিহাসে স্থান পায়।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশের সঙ্গে ডিক চেনি। ছবি: সংগৃহীত।যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী উপ-রাষ্ট্রপতি
ডিক চেনির উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন (২০০১–২০০৯) এই পদটিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছিল। ইতিহাসবিদদের মতে, তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী উপ-রাষ্ট্রপতি। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার সময় তিনি হোয়াইট হাউসের বাঙ্কার থেকে বিমান গুলি করে নামানোর অনুমোদন দেন। পরবর্তীতে আফগানিস্তান (২০০১) ও ইরাক (২০০৩) আক্রমণের পক্ষে জোর দেন। ইরাক যুদ্ধের যুক্তি হিসেবে যে গণবিধ্বংসী অস্ত্র ও আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্কের দাবি তোলা হয়েছিল, তা পরে ভুল প্রমাণিত হয়।
এই যুদ্ধগুলোতে শুধু ইরাকেই ৪ হাজার ৪৩১ মার্কিন সেনা নিহত হয়। ব্যয় হয় প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার। বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়ায় ৮ লাখ। ২০১৪ সালে চেনি বলেন, বন্দিদের ওপর কঠোর জিজ্ঞাসাবাদ ও গুয়ানতানামো বন্দিশিবিরের মতো পদক্ষেপ তিনি আবারও নিতেন। দেশে তিনি ২০০৫ সালের জ্বালানি আইন প্রণয়নে নেতৃত্ব দেন, যা তেল উৎপাদনে নতুন গতি আনে। একই সঙ্গে ১ দশমিক ৩৫ ট্রিলিয়ন ডলারের কর ছাড় কার্যকর করেন। তবে ইরাক সংকটের কারণে ২০০৯ সালের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা নেমে আসে ৩১ শতাংশে।
পরবর্তী সময়ে তিনি ট্রাম্পপন্থী রিপাবলিকানদের সমালোচনা করেন। ট্রাম্পকে তিনি ‘কাপুরুষ’ ও ‘প্রজাতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি’ বলে আখ্যা দেন। ২০২৪ সালে তিনি কমলা হ্যারিসকে সমর্থন করেন। জীবনী লেখক জেক বার্নস্টাইন লিখেছেন, চেনি শেষ পর্যন্ত নিজের ‘ডার্থ ভেডার’ উপাধিকে গ্রহণ করেছিলেন—অটল ও অনুতপ্তহীনভাবে।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ও জনমত
চেনির মৃত্যুর খবর প্রকাশের পর তা বিশ্বজুড়ে শিরোনাম হয়। সিএনএন, রয়টার্স ও দ্য গার্ডিয়ান তাঁকে ‘রিপাবলিকান রাজনীতির বিশাল ব্যক্তিত্ব’ ও ‘যুদ্ধবাজ নেতা’ হিসেবে বর্ণনা করে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যাল-এ লেখেন, ‘তিনি ছিলেন কঠোর, মেধাবী নেতা।’ সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ বলেন, ‘ডিক শুধু সহকর্মী নন, তিনি ছিলেন আমার ঘনিষ্ঠ ভাই।’
তাঁর মেয়ে লিজ চেনি এক্স-এ লেখেন, ‘আমার বাবা, যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম উপ-রাষ্ট্রপতি ডিক চেনি, আজ সন্ধ্যায় শান্তিতে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তাঁর মতো নিবেদিত দেশপ্রেমিক ও পিতৃপ্রতিম মানুষ আর নেই।’
তবে তাঁর মৃত্যুতে জনপ্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। সমর্থকেরা তাঁর গালফ যুদ্ধ ও জ্বালানি নীতির প্রশংসা করেন। বিরোধীরা তাঁর মৃত্যুকে ‘ইতিহাসের পরিসমাপ্তি’ হিসেবে দেখেন। কেউ কেউ লিখেন, ‘ডিক চেনির মৃত্যু মানে নব্যরক্ষণশীল যুগের অবসান।’ যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় এবং রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হয়।
আন্তর্জাতিকভাবে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর ইসরায়েল-সমর্থন স্মরণ করেন। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে অনেকেই ইরাক যুদ্ধের ক্ষোভ পুনরুজ্জীবিত করেন। দ্য জেরুজালেম পোস্ট তাঁর ২০০৩ সালের আক্রমণে ভূমিকা তুলে ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনের প্রাক্কালে চেনির মৃত্যু ঘটেছে। এতে রিপাবলিকান পার্টির পরিবর্তিত আদর্শ—তাঁর কঠোর পররাষ্ট্রনীতির যুগ থেকে ট্রাম্পের এককেন্দ্রিক নীতিতে রূপান্তর—নিয়ে নতুন আলোচনা শুরু হয়েছে। তাঁর মৃত্যু ৯/১১ পরবর্তী নব্যরক্ষণশীল যুগের পরিসমাপ্তি নির্দেশ করে। তবে নির্বাহী ক্ষমতার সম্প্রসারণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় নিয়ে বিতর্ক এখনো চলছে।
পরিবারের কাছে তিনি ছিলেন ‘মর্যাদাবান এক মহৎ মানুষ’, আর ইতিহাসের কাছে তিনি থেকে গেলেন এমন এক ব্যক্তিত্ব, যিনি আমেরিকা ও বিশ্বকে গভীরভাবে বদলে দিয়েছিলেন—সুকৌশলে, কিন্তু চিরবিতর্কিতভাবে।
তথ্যসূত্র: সিএনএন, রয়টার্স, দ্য গার্ডিয়ান, পলিটিকো, সিবিএস নিউজ, এনবিসি নিউজ