.png)
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট, সংস্কার, গণভোটের দাবি এবং আগামী নির্বাচনসহ জামায়াতে ইসলামীর সার্বিক মূল্যায়ন ও রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে ঢাকা স্ট্রিমের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন দলটির সিনিয়র নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা স্ট্রিমের সম্পাদক ইফতেখার মাহমুদ। আজ প্রকাশিত হলো শেষ পর্ব।

স্ট্রিম ডেস্ক

ইফতেখার মাহমুদ: আপনাদের রাজনীতিকে সাম্প্রতিক সময়ে ‘তুর্কি মডেল’ বা ‘মুসলিম ব্রাদারহুড মডেল’-এর সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। একইসঙ্গে আপনাদের নেতৃবৃন্দের বিদেশ সফর এবং বিভিন্ন দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগও বেড়েছে। এ প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠছে, তুরস্কের সঙ্গে আপনাদের সম্পর্ক কি রাজনৈতিক আদর্শগত, নাকি সাধারণ বন্ধুত্বপূর্ণ?
মুজিবুর রহমান: দেখুন, আমাদের মডেল একটিই। আর তা হলো হযরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মডেল। আমরা তাঁর দেখানো পথেই নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে চাই। তিনি যেভাবে সংগঠন গড়েছেন, লোক তৈরি করেছেন এবং মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, আমরা সেই আদর্শই অনুসরণ করি। মদিনা সনদের ৪৭টি ধারার আদলেই আমাদের আন্দোলন পরিচালিত হয়, যা কোরআন এবং সুন্নাহর ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। কোনো দেশের মডেল আমরা অনুসরণ করি না এবং ভবিষ্যতেও করব না। তবে এটা ঠিক যে, আমাদের এই চলার পথে যারা কোরআন-সুন্নাহর আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনার চেষ্টা করছে, তাদের সঙ্গে আমাদের কাজের মিল খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। যেমন, তুরস্ক ইসলামের পথে চলার চেষ্টা করছে, মালয়েশিয়াও কিছুটা চেষ্টা করেছে। মিশর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুরসি সরকারকে তো সরিয়ে দেওয়া হলো।
ইফতেখার মাহমুদ: অনেকে এমন আশঙ্কাও করেন যে, আপনারা ক্ষমতায় গেলে আপনাদের পরিণতিও কি মিশরের মোহাম্মদ মুরসির মতো হতে পারে?
মুজিবুর রহমান: জীবন-মৃত্যু এবং ক্ষমতায় থাকা বা না থাকার মালিক একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘হে আল্লাহ! তুমিই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান কর এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নাও এবং যাকে ইচ্ছা সম্মান দান কর আর যাকে ইচ্ছা অপমানে পতিত কর।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ২৬)। সুতরাং, ক্ষমতা আল্লাহরই ফয়সালা। মৃত্যুর ব্যাপারেও আল্লাহ বলেছেন, তাঁর অনুমতি ছাড়া কারও মৃত্যু হতে পারে না। মুরসির মৃত্যু লেখা ছিল, তাই তিনি মারা গেছেন। আমাদের নেতৃবৃন্দের হায়াত যতদিন আল্লাহ লিখেছিলেন, ততদিনই তাঁরা ছিলেন। আল্লাহ আমাদের হায়াত রাখলে আমরা থাকব, আর যদি চলে যাওয়ার ফয়সালা থাকে, তবে চলে যাব। পৃথিবীতে কেউ চিরদিন থাকতে আসেনি।
ইফতেখার মাহমুদ: বলা হয়ে থাকে, ‘জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনে সুদূর চীনে যাও’। কিন্তু চীন একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র এবং ধর্মীয় আদর্শের দিক থেকে আপনাদের সঙ্গে তাদের অমিলই বেশি। এই প্রেক্ষাপটে আপনাদের সঙ্গে চীনের সাম্প্রতিক সুসম্পর্কের কারণ কী?
মুজিবুর রহমান: প্রথমে হাদিসটির বিষয়ে বলি। ‘জ্ঞান অর্জন করতে সুদূর চীনেও যদি যেতে হয়, যাও’—এই হাদিসটির দুটি ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে। কিছু হাদিসবিশারদ এটিকে ‘জইফ’ বা দুর্বল বলে মনে করেন। আবার অনেকে বলেন, তৎকালীন সময়ে আরব থেকে চীনের ভৌগোলিক দূরত্ব অনেক বেশি ছিল। তাই জ্ঞানার্জনের জন্য যত দূরেই যেতে হোক না কেন, যাওয়া উচিত—এই বিষয়টি বোঝানোর জন্য এটিকে প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে চীনের আদর্শকে অনুসরণ করতে বলা হয়নি।
ইফতেখার মাহমুদ: কিন্তু রাজনৈতিক মহলে আলোচনা হচ্ছে যে, চীন আপনাদের সমর্থন দিচ্ছে। আপনাদের নেতৃবৃন্দ চীন সফর করেছেন, দূতাবাসের সঙ্গেও একাধিক বৈঠক হয়েছে। এই বিষয়গুলোকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
মুজিবুর রহমান: আমার মনে হয়, বিষয়টিকে ঠিক সেভাবে মূল্যায়ন করা উচিত নয়। এখন তো প্রায় সব দেশই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। এতদিন হয়তো তারা আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করেনি। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর আমাদের কার্যক্রম দেখে তারা বুঝতে পেরেছে যে, জামাত-শিবির একটি ফ্যাক্টর। তারা প্রমাণ পেয়েছে যে, আমরা একটি শক্তি। আমরা নিজেদের খুব বড় শক্তি মনে না করলেও আমাদের রোকন, কর্মী ও সমর্থক রয়েছে এবং আলহামদুলিল্লাহ, দিন দিন সমর্থক বাড়ছে। আমি এর পেছনে দুটি কারণ দেখি। প্রথমত, আমাদের নেতাকর্মীদের আত্মত্যাগ। দ্বিতীয়ত, আমরা কখনো চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির মতো অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। আমাদের এই ইতিবাচক দিকগুলো সাধারণ মানুষ পছন্দ করছে। আপনি টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত যেকোনো গ্রামে যান, দেখবেন মানুষ এবার জামায়াতকে বা দাঁড়িপাল্লাকে ভোট দিয়ে দেখতে চায়। কারণ তারা অন্য দলগুলোকে দেখেছে এবং ভালো কিছু পায়নি। এটা আমাদের খুব প্রচারের কারণে নয়, বরং জনগণই পরিবর্তন চাইছে।
ইফতেখার মাহমুদ: আপনারা ইসলামের মূলনীতিকে ভিত্তি করে রাজনীতি করেন। কিন্তু সম্প্রতি আপনাদের হিন্দু ধর্মাবলম্বী সমর্থকদের নিয়ে কর্মসূচি করতে দেখা গেছে। আবার চীনের সঙ্গেও সম্পর্কন্নোয়নের চেষ্টা চলছে। এসব কি ভারত বা চীনের মতো শক্তিগুলোকে খুশি করার কোনো ভূ-রাজনৈতিক কৌশল, নাকি আপনাদের আদর্শিক অবস্থান?
মুজিবুর রহমান: ভূ-রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন শক্তিধর দেশ নিজেদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। তারা মূল্যায়ন করে যে, কার সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে তাদের লাভ হবে। এটা তাদের নিজস্ব মূল্যায়ন, আমাদের নয়। আমরা আমাদের কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের কাজ দেখে যদি কেউ কথা বলতে চায়, তাতে আমাদের আপত্তি নেই। আমাদের চীনেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, অন্য দেশেও গিয়েছি এবং ভবিষ্যতেও যাব। যেমন এখন আমাদের একটি ব্যবসায়ী গ্রুপ চীনে আছে, যদিও সেখানে কোনো কেন্দ্রীয় নেতা নেই। তুরস্কের প্রতিনিধিরা এসে দেখা করে গেছেন। আমি যুক্তরাষ্ট্রের একজন ডেপুটি স্পিকারের সঙ্গেও বৈঠক করেছি। সেখানে আমাদের একটি প্রতিনিধিদল ছিল। আমরা তাদের কাছে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ সহজ করা এবং আমাদের সম্পর্কে তাদের ভুল ধারণা ভাঙানোর আহ্বান জানিয়েছি। অতীতে আমাদের ‘জঙ্গি’ ট্যাগ দেওয়া হয়েছিল, যা খুবই দুঃখজনক। আমরা বলেছি, আমাদের সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেতে হলে আমাদের সঙ্গে মিশতে হবে এবং আমাদের কাজ দেখতে হবে।
ইফতেখার মাহমুদ: হিন্দু সমর্থকদের নিয়ে আপনাদের কার্যক্রম এবং নারী নেতৃত্বকে সামনে নিয়ে আসার বিষয়টি কি ভোটের কৌশল, নাকি আদর্শিক অবস্থান?
মুজিবুর রহমান: সম্প্রতি আমাদের দলীয় নেতা গোলাম পরওয়ার খুলনা-সাতক্ষীরা অঞ্চলে, যেখানে হিন্দু জনগোষ্ঠীর বসবাস বেশি, সেখানে জামায়াতের ‘হিন্দু বিভাগ’ আয়োজিত একটি সম্মেলনে বক্তব্য রেখেছেন। আমিও আমার এলাকায় এ ধরনের প্রায় দশটি সভা করেছি, যেখানে গড়ে ২০০-৪০০ মানুষ উপস্থিত ছিলেন। তাদের প্রতি আমাদের আবেদন খুব স্পষ্ট। প্রথমত, বাংলাদেশকে যদি সত্যিকারের দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে গড়তে হয়, তবে ভালো মানুষদের ক্ষমতায় আসতে হবে—যারা চোর নয়, যাদের অতীত স্বচ্ছ এবং যারা মানুষের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করে। এমন লোক নেতৃত্বে এলে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাই শান্তিতে থাকবে। দ্বিতীয়ত, আমরা এমন একটি সমাজ গড়তে চাই, যা সুদ, ঘুষ, চুরি এবং অন্য সব সামাজিক অন্যায় থেকে মুক্ত থাকবে। যদি আল্লাহর দয়ায় এবং জনগণের সমর্থনে আমরা ক্ষমতায় যেতে পারি, তবে দুর্নীতিকে সমূলে উৎপাটন করা হবে। দুর্নীতিবাজ যেই হোক, তাকে শাস্তি পেতে হবে, যেমনটি ইসলামের ইতিহাসে হয়েছে। আমরা শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিকতাকে প্রাধান্য দিতে চাই, যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অন্যায়কে মন থেকে ঘৃণা করতে শেখে।
ইফতেখার মাহমুদ: সেক্ষেত্রে আপনারা কি শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোটকেই লক্ষ্যবস্তু করছেন? দেশে তো বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং আদিবাসীসহ অন্যান্য ধর্ম ও জনগোষ্ঠীর মানুষও রয়েছেন।
মুজিবুর রহমান: আমরা সবার জন্য একই নীতিতে বিশ্বাসী। ইসলামী রাষ্ট্র কখনো অন্য ধর্মকে উচ্ছেদ করে না, বরং সব ধর্মাবলম্বী মিলেমিশে বসবাস করে। রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, সেখানে কি ইহুদি, খ্রিস্টান বা মুশরিক ছিল না? অবশ্যই ছিল। তাদের সহযোগিতাতেই সেই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েছে। তাহলে আমরাই বা তাদের সহযোগিতা নিতে পারব না কেন? আমরা তাদের এটাই বলছি যে, আপনারা যদি দাঁড়িপাল্লায় ভোট দিয়ে আমাদের বিজয়ী করেন এবং আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা সরকার গঠন করতে পারি, তাহলে আপনাদের দুর্ভোগগুলো কমানোর চেষ্টা করব। যেমন, চুরি বন্ধ হলে কি শুধু মুসলমানের বাড়ি সুরক্ষিত থাকবে, হিন্দুর বাড়ি থাকবে না? ঘুষ কি শুধু আমাদের দিতে হবে না, আপনাদেরও দিতে হবে না? একটি সুন্দর ও সুখী জীবনযাপনের সুযোগ যদি সবাই পায়, তাহলে আপনারা কেন জামায়াতে ইসলামীকে সমর্থন করবেন না? আপনারা হয়তো দেখেছেন, তারা দাঁড়িপাল্লার পক্ষে মিছিলও করেছে।
আমি একটি উদাহরণ দিই। আমার এলাকা গোদাগাড়ীর একটি ইউনিয়নে প্রায় ৫০০ সাঁওতালসহ আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাস। সেখানে একটি বড় পুকুর থাকা সত্ত্বেও তাদের গোসল করতে বা পানি নিতে দেওয়া হতো না, যা তাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টের ছিল। আমি সেখানে গিয়ে তাদের বললাম, ভোট আপনারা আপনাদের ইচ্ছামতোই দেবেন, কিন্তু আপনাদের এই কষ্ট দূর করার জন্য আমি চেষ্টা করব। এরপর আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে আবেদন করি এবং বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গেও কথা বলি। তারা জানান, পূর্ববর্তী সরকারের সময়ে পুকুরটি লিজ দেওয়ায় এই সমস্যা তৈরি হয়েছে। আমি এটিকে উন্মুক্ত করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করি, এবং আশা করা যায়, সমস্যাটির সমাধান হবে। এরপর তারাই আমাকে বলেছে যে, এই কাজটা হলে আপনি এখানকার ৪০০ ভোটই পাবেন। ভোট দেওয়া বা না দেওয়া তাদের ইচ্ছা এবং আল্লাহর ফয়সালা, কিন্তু তাদের সমস্যাটি আমাদের কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছে।
ইফতেখার মাহমুদ: নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে বিএনপির সঙ্গে আপনাদের আলোচনার বর্তমান অবস্থা কী? আপনারা তো একসময় মিত্র ছিলেন, একসঙ্গে সরকারও পরিচালনা করেছেন, কিন্তু এখন একটি বিবদমান অবস্থানে আছেন বলে মনে হচ্ছে। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
মুজিবুর রহমান: রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই—এরকম একটি কথা চালু আছে। কিছুদিন আগে ‘নয়া দিগন্ত’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে মির্জা ফখরুল সাহেব, সালাউদ্দিন ভাই, ড. মঈন খানসহ আমরা এবং আমাদের দলের গোলাম পরওয়ার সাহেবও উপস্থিত ছিলাম। কেক কাটার সময় সৌজন্যতার খাতিরে তিনি আমাকে মিষ্টি খাইয়ে দিলে আমারও দায়িত্ব হয় তাকে খাওয়ানো। এটি একটি আনুষ্ঠানিকতা। কিন্তু এটা ঠিক যে, তাদের সঙ্গে আগে যেভাবে আলাপ-আলোচনা হতো, এখন কিছুটা কমে গেছে। মাঝখানে ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতায় থাকায় আমাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ততটা প্রকাশ পায়নি। এখন সেই সরকার না থাকায় দ্বন্দ্বটি সামনে এসেছে। যদিও দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, যেমন—মসজিদে শিবিরের কোরআন শিক্ষার কার্যক্রমে বাধা দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। আমরা এগুলোকে বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা হিসেবেই দেখি এবং মনে করি, এমনটা হওয়া উচিত নয়। আমরা তাদের জানিয়েছি, আমাদের দ্বারা কোনো সমস্যা হলে যেন আমাদের জানানো হয়।
ইফতেখার মাহমুদ: না, আমি দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার কথা বলছি না। বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক পরিকল্পনার জায়গা থেকে আপনাদের অবস্থান কী?
মুজিবুর রহমান: আমার মনে হয়, এই মুহূর্তে ঐক্য কিছুটা কঠিন। কারণ তারা (বিএনপি) আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) ব্যবস্থাটি কার্যত চায়নি। পরে যদিও তারা রাজি হয়েছে, কিন্তু সেই রাজি হওয়া বা না হওয়া প্রায় সমান হয়ে গেছে। অন্যদিকে, আমরা পিআর ব্যবস্থার পক্ষে শক্ত অবস্থানে আছি। আপনারা দেখেছেন, সাত-আটটি ইসলামি দল নিয়ে আমাদের একটি জোট রয়েছে এবং আমরা একসঙ্গেই আন্দোলন করছি ও কর্মসূচি দিচ্ছি। এখন যেহেতু উনারা একটি ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছেন, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যদি সরকার বা প্রধান উপদেষ্টা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কোনো সমঝোতায় আসতে পারেন, তাহলে ভিন্ন কথা।
ইফতেখার মাহমুদ: একসঙ্গে হওয়ার আশা দেখেন?
মুজিবুর রহমান: মানুষ তো আশাতেই বেঁচে থাকে। আমরা আশা করি, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান হবে। এতে দেশের মঙ্গল হবে। সংঘাতের দিকে গেলে দেশের ভবিষ্যৎ ভালো হবে না। একটি মহল তো অপেক্ষায়ই আছে কোনো সুযোগের সদ্ব্যবহার করার জন্য। আমরা চাই, দেশ যেন কোনো বৃহত্তর ঝুঁকির মুখে না পড়ে এবং আলোচনার মাধ্যমেই একটি সমাধান আসুক।
ইফতেখার মাহমুদ: শোনা যাচ্ছে, হেফাজতের একটি অংশ আপনাদের সঙ্গে এবং অন্য একটি অংশ বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধছে। এমসিপির ক্ষেত্রেও একই কথা বলা হচ্ছে। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
মুজিবুর রহমান: আমি দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি যে, আমাদের দেশের রাজনীতি কেবল জাতীয় স্বার্থে পরিচালিত হয় না। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের উচিত মানুষের কল্যাণকে বড় করে দেখা। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, কিছু সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে ইসলামের নামে পরিচালিত দলও ফ্যাসিস্ট সরকারের সঙ্গে হাত মেলায়, যা হওয়া উচিত ছিল না। আমি কারও নাম উল্লেখ না করে বলছি, যদি ব্যক্তিগত স্বার্থে—যেমন এমপি হওয়ার লোভে বা আর্থিক সুবিধার জন্য—কেউ কোনো জোটে যোগ দেয়, তবে সেই রাজনীতি ব্যক্তিস্বার্থের, বৃহত্তর স্বার্থের নয়।
তবে আমি মনে করি না যে সবাই এমনটা করছে। অতীতে এমন উদাহরণ দেখা গেলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আমরা আশা করব, সবাই দেশের বৃহত্তর কল্যাণে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে এবং জনগণ একটি সুন্দর নির্বাচন পাবে। আচ্ছা, আপনিই বলুন, গণভোট আর সাধারণ নির্বাচন কি প্রায় একই জিনিস নয়? উভয় ক্ষেত্রেই জনমতকে সম্মান করতে হয়। তাহলে গণভোটকে ভয় পাওয়ার কারণ কী? যারা ভয় পায়, তাদের নিয়ে তো প্রশ্ন উঠবেই যে, তারা জনগণের মতামত চায় না। তবে আমরা কাউকে আঘাত করে কথা বলতে চাই না। ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে, ‘মন্দের জবাব উত্তম দিয়ে দাও’। আমরা সেই নীতিতেই চলছি।
সাংবিধানিক সংস্কার কমিশনে আমরা ৪১টি ধারা জমা দিয়েছিলাম। সেখানে এই বিষয়ে মিল হয়েছিল যে, তারা উচ্চকক্ষে পিআর ব্যবস্থা মেনে নেবে। আমরা উভয় কক্ষেই চেয়েছিলাম। যেহেতু এক জায়গায় মতের অমিল হয়েছে, তাই আমরা গণভোট চাইছি, যাতে জনগণ কী চায় তা দেখা যায়।
ইফতেখার মাহমুদ: অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশা করি ভবিষ্যতেও আমরা আপনার সঙ্গে কথা বলব।
মুজিবুর রহমান: বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকেও ঢাকা স্ট্রিমকে এবং দর্শক-শ্রোতা যারা কথা শুনেছেন, আমি সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।

ইফতেখার মাহমুদ: আপনাদের রাজনীতিকে সাম্প্রতিক সময়ে ‘তুর্কি মডেল’ বা ‘মুসলিম ব্রাদারহুড মডেল’-এর সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। একইসঙ্গে আপনাদের নেতৃবৃন্দের বিদেশ সফর এবং বিভিন্ন দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগও বেড়েছে। এ প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠছে, তুরস্কের সঙ্গে আপনাদের সম্পর্ক কি রাজনৈতিক আদর্শগত, নাকি সাধারণ বন্ধুত্বপূর্ণ?
মুজিবুর রহমান: দেখুন, আমাদের মডেল একটিই। আর তা হলো হযরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মডেল। আমরা তাঁর দেখানো পথেই নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে চাই। তিনি যেভাবে সংগঠন গড়েছেন, লোক তৈরি করেছেন এবং মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, আমরা সেই আদর্শই অনুসরণ করি। মদিনা সনদের ৪৭টি ধারার আদলেই আমাদের আন্দোলন পরিচালিত হয়, যা কোরআন এবং সুন্নাহর ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। কোনো দেশের মডেল আমরা অনুসরণ করি না এবং ভবিষ্যতেও করব না। তবে এটা ঠিক যে, আমাদের এই চলার পথে যারা কোরআন-সুন্নাহর আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনার চেষ্টা করছে, তাদের সঙ্গে আমাদের কাজের মিল খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। যেমন, তুরস্ক ইসলামের পথে চলার চেষ্টা করছে, মালয়েশিয়াও কিছুটা চেষ্টা করেছে। মিশর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুরসি সরকারকে তো সরিয়ে দেওয়া হলো।
ইফতেখার মাহমুদ: অনেকে এমন আশঙ্কাও করেন যে, আপনারা ক্ষমতায় গেলে আপনাদের পরিণতিও কি মিশরের মোহাম্মদ মুরসির মতো হতে পারে?
মুজিবুর রহমান: জীবন-মৃত্যু এবং ক্ষমতায় থাকা বা না থাকার মালিক একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘হে আল্লাহ! তুমিই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান কর এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নাও এবং যাকে ইচ্ছা সম্মান দান কর আর যাকে ইচ্ছা অপমানে পতিত কর।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ২৬)। সুতরাং, ক্ষমতা আল্লাহরই ফয়সালা। মৃত্যুর ব্যাপারেও আল্লাহ বলেছেন, তাঁর অনুমতি ছাড়া কারও মৃত্যু হতে পারে না। মুরসির মৃত্যু লেখা ছিল, তাই তিনি মারা গেছেন। আমাদের নেতৃবৃন্দের হায়াত যতদিন আল্লাহ লিখেছিলেন, ততদিনই তাঁরা ছিলেন। আল্লাহ আমাদের হায়াত রাখলে আমরা থাকব, আর যদি চলে যাওয়ার ফয়সালা থাকে, তবে চলে যাব। পৃথিবীতে কেউ চিরদিন থাকতে আসেনি।
ইফতেখার মাহমুদ: বলা হয়ে থাকে, ‘জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনে সুদূর চীনে যাও’। কিন্তু চীন একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র এবং ধর্মীয় আদর্শের দিক থেকে আপনাদের সঙ্গে তাদের অমিলই বেশি। এই প্রেক্ষাপটে আপনাদের সঙ্গে চীনের সাম্প্রতিক সুসম্পর্কের কারণ কী?
মুজিবুর রহমান: প্রথমে হাদিসটির বিষয়ে বলি। ‘জ্ঞান অর্জন করতে সুদূর চীনেও যদি যেতে হয়, যাও’—এই হাদিসটির দুটি ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে। কিছু হাদিসবিশারদ এটিকে ‘জইফ’ বা দুর্বল বলে মনে করেন। আবার অনেকে বলেন, তৎকালীন সময়ে আরব থেকে চীনের ভৌগোলিক দূরত্ব অনেক বেশি ছিল। তাই জ্ঞানার্জনের জন্য যত দূরেই যেতে হোক না কেন, যাওয়া উচিত—এই বিষয়টি বোঝানোর জন্য এটিকে প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে চীনের আদর্শকে অনুসরণ করতে বলা হয়নি।
ইফতেখার মাহমুদ: কিন্তু রাজনৈতিক মহলে আলোচনা হচ্ছে যে, চীন আপনাদের সমর্থন দিচ্ছে। আপনাদের নেতৃবৃন্দ চীন সফর করেছেন, দূতাবাসের সঙ্গেও একাধিক বৈঠক হয়েছে। এই বিষয়গুলোকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
মুজিবুর রহমান: আমার মনে হয়, বিষয়টিকে ঠিক সেভাবে মূল্যায়ন করা উচিত নয়। এখন তো প্রায় সব দেশই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। এতদিন হয়তো তারা আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করেনি। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর আমাদের কার্যক্রম দেখে তারা বুঝতে পেরেছে যে, জামাত-শিবির একটি ফ্যাক্টর। তারা প্রমাণ পেয়েছে যে, আমরা একটি শক্তি। আমরা নিজেদের খুব বড় শক্তি মনে না করলেও আমাদের রোকন, কর্মী ও সমর্থক রয়েছে এবং আলহামদুলিল্লাহ, দিন দিন সমর্থক বাড়ছে। আমি এর পেছনে দুটি কারণ দেখি। প্রথমত, আমাদের নেতাকর্মীদের আত্মত্যাগ। দ্বিতীয়ত, আমরা কখনো চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির মতো অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। আমাদের এই ইতিবাচক দিকগুলো সাধারণ মানুষ পছন্দ করছে। আপনি টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত যেকোনো গ্রামে যান, দেখবেন মানুষ এবার জামায়াতকে বা দাঁড়িপাল্লাকে ভোট দিয়ে দেখতে চায়। কারণ তারা অন্য দলগুলোকে দেখেছে এবং ভালো কিছু পায়নি। এটা আমাদের খুব প্রচারের কারণে নয়, বরং জনগণই পরিবর্তন চাইছে।
ইফতেখার মাহমুদ: আপনারা ইসলামের মূলনীতিকে ভিত্তি করে রাজনীতি করেন। কিন্তু সম্প্রতি আপনাদের হিন্দু ধর্মাবলম্বী সমর্থকদের নিয়ে কর্মসূচি করতে দেখা গেছে। আবার চীনের সঙ্গেও সম্পর্কন্নোয়নের চেষ্টা চলছে। এসব কি ভারত বা চীনের মতো শক্তিগুলোকে খুশি করার কোনো ভূ-রাজনৈতিক কৌশল, নাকি আপনাদের আদর্শিক অবস্থান?
মুজিবুর রহমান: ভূ-রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন শক্তিধর দেশ নিজেদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। তারা মূল্যায়ন করে যে, কার সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে তাদের লাভ হবে। এটা তাদের নিজস্ব মূল্যায়ন, আমাদের নয়। আমরা আমাদের কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের কাজ দেখে যদি কেউ কথা বলতে চায়, তাতে আমাদের আপত্তি নেই। আমাদের চীনেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, অন্য দেশেও গিয়েছি এবং ভবিষ্যতেও যাব। যেমন এখন আমাদের একটি ব্যবসায়ী গ্রুপ চীনে আছে, যদিও সেখানে কোনো কেন্দ্রীয় নেতা নেই। তুরস্কের প্রতিনিধিরা এসে দেখা করে গেছেন। আমি যুক্তরাষ্ট্রের একজন ডেপুটি স্পিকারের সঙ্গেও বৈঠক করেছি। সেখানে আমাদের একটি প্রতিনিধিদল ছিল। আমরা তাদের কাছে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ সহজ করা এবং আমাদের সম্পর্কে তাদের ভুল ধারণা ভাঙানোর আহ্বান জানিয়েছি। অতীতে আমাদের ‘জঙ্গি’ ট্যাগ দেওয়া হয়েছিল, যা খুবই দুঃখজনক। আমরা বলেছি, আমাদের সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেতে হলে আমাদের সঙ্গে মিশতে হবে এবং আমাদের কাজ দেখতে হবে।
ইফতেখার মাহমুদ: হিন্দু সমর্থকদের নিয়ে আপনাদের কার্যক্রম এবং নারী নেতৃত্বকে সামনে নিয়ে আসার বিষয়টি কি ভোটের কৌশল, নাকি আদর্শিক অবস্থান?
মুজিবুর রহমান: সম্প্রতি আমাদের দলীয় নেতা গোলাম পরওয়ার খুলনা-সাতক্ষীরা অঞ্চলে, যেখানে হিন্দু জনগোষ্ঠীর বসবাস বেশি, সেখানে জামায়াতের ‘হিন্দু বিভাগ’ আয়োজিত একটি সম্মেলনে বক্তব্য রেখেছেন। আমিও আমার এলাকায় এ ধরনের প্রায় দশটি সভা করেছি, যেখানে গড়ে ২০০-৪০০ মানুষ উপস্থিত ছিলেন। তাদের প্রতি আমাদের আবেদন খুব স্পষ্ট। প্রথমত, বাংলাদেশকে যদি সত্যিকারের দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে গড়তে হয়, তবে ভালো মানুষদের ক্ষমতায় আসতে হবে—যারা চোর নয়, যাদের অতীত স্বচ্ছ এবং যারা মানুষের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করে। এমন লোক নেতৃত্বে এলে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাই শান্তিতে থাকবে। দ্বিতীয়ত, আমরা এমন একটি সমাজ গড়তে চাই, যা সুদ, ঘুষ, চুরি এবং অন্য সব সামাজিক অন্যায় থেকে মুক্ত থাকবে। যদি আল্লাহর দয়ায় এবং জনগণের সমর্থনে আমরা ক্ষমতায় যেতে পারি, তবে দুর্নীতিকে সমূলে উৎপাটন করা হবে। দুর্নীতিবাজ যেই হোক, তাকে শাস্তি পেতে হবে, যেমনটি ইসলামের ইতিহাসে হয়েছে। আমরা শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিকতাকে প্রাধান্য দিতে চাই, যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অন্যায়কে মন থেকে ঘৃণা করতে শেখে।
ইফতেখার মাহমুদ: সেক্ষেত্রে আপনারা কি শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোটকেই লক্ষ্যবস্তু করছেন? দেশে তো বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং আদিবাসীসহ অন্যান্য ধর্ম ও জনগোষ্ঠীর মানুষও রয়েছেন।
মুজিবুর রহমান: আমরা সবার জন্য একই নীতিতে বিশ্বাসী। ইসলামী রাষ্ট্র কখনো অন্য ধর্মকে উচ্ছেদ করে না, বরং সব ধর্মাবলম্বী মিলেমিশে বসবাস করে। রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, সেখানে কি ইহুদি, খ্রিস্টান বা মুশরিক ছিল না? অবশ্যই ছিল। তাদের সহযোগিতাতেই সেই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েছে। তাহলে আমরাই বা তাদের সহযোগিতা নিতে পারব না কেন? আমরা তাদের এটাই বলছি যে, আপনারা যদি দাঁড়িপাল্লায় ভোট দিয়ে আমাদের বিজয়ী করেন এবং আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা সরকার গঠন করতে পারি, তাহলে আপনাদের দুর্ভোগগুলো কমানোর চেষ্টা করব। যেমন, চুরি বন্ধ হলে কি শুধু মুসলমানের বাড়ি সুরক্ষিত থাকবে, হিন্দুর বাড়ি থাকবে না? ঘুষ কি শুধু আমাদের দিতে হবে না, আপনাদেরও দিতে হবে না? একটি সুন্দর ও সুখী জীবনযাপনের সুযোগ যদি সবাই পায়, তাহলে আপনারা কেন জামায়াতে ইসলামীকে সমর্থন করবেন না? আপনারা হয়তো দেখেছেন, তারা দাঁড়িপাল্লার পক্ষে মিছিলও করেছে।
আমি একটি উদাহরণ দিই। আমার এলাকা গোদাগাড়ীর একটি ইউনিয়নে প্রায় ৫০০ সাঁওতালসহ আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাস। সেখানে একটি বড় পুকুর থাকা সত্ত্বেও তাদের গোসল করতে বা পানি নিতে দেওয়া হতো না, যা তাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টের ছিল। আমি সেখানে গিয়ে তাদের বললাম, ভোট আপনারা আপনাদের ইচ্ছামতোই দেবেন, কিন্তু আপনাদের এই কষ্ট দূর করার জন্য আমি চেষ্টা করব। এরপর আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে আবেদন করি এবং বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গেও কথা বলি। তারা জানান, পূর্ববর্তী সরকারের সময়ে পুকুরটি লিজ দেওয়ায় এই সমস্যা তৈরি হয়েছে। আমি এটিকে উন্মুক্ত করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করি, এবং আশা করা যায়, সমস্যাটির সমাধান হবে। এরপর তারাই আমাকে বলেছে যে, এই কাজটা হলে আপনি এখানকার ৪০০ ভোটই পাবেন। ভোট দেওয়া বা না দেওয়া তাদের ইচ্ছা এবং আল্লাহর ফয়সালা, কিন্তু তাদের সমস্যাটি আমাদের কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছে।
ইফতেখার মাহমুদ: নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে বিএনপির সঙ্গে আপনাদের আলোচনার বর্তমান অবস্থা কী? আপনারা তো একসময় মিত্র ছিলেন, একসঙ্গে সরকারও পরিচালনা করেছেন, কিন্তু এখন একটি বিবদমান অবস্থানে আছেন বলে মনে হচ্ছে। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
মুজিবুর রহমান: রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই—এরকম একটি কথা চালু আছে। কিছুদিন আগে ‘নয়া দিগন্ত’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে মির্জা ফখরুল সাহেব, সালাউদ্দিন ভাই, ড. মঈন খানসহ আমরা এবং আমাদের দলের গোলাম পরওয়ার সাহেবও উপস্থিত ছিলাম। কেক কাটার সময় সৌজন্যতার খাতিরে তিনি আমাকে মিষ্টি খাইয়ে দিলে আমারও দায়িত্ব হয় তাকে খাওয়ানো। এটি একটি আনুষ্ঠানিকতা। কিন্তু এটা ঠিক যে, তাদের সঙ্গে আগে যেভাবে আলাপ-আলোচনা হতো, এখন কিছুটা কমে গেছে। মাঝখানে ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতায় থাকায় আমাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ততটা প্রকাশ পায়নি। এখন সেই সরকার না থাকায় দ্বন্দ্বটি সামনে এসেছে। যদিও দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, যেমন—মসজিদে শিবিরের কোরআন শিক্ষার কার্যক্রমে বাধা দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। আমরা এগুলোকে বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা হিসেবেই দেখি এবং মনে করি, এমনটা হওয়া উচিত নয়। আমরা তাদের জানিয়েছি, আমাদের দ্বারা কোনো সমস্যা হলে যেন আমাদের জানানো হয়।
ইফতেখার মাহমুদ: না, আমি দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার কথা বলছি না। বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক পরিকল্পনার জায়গা থেকে আপনাদের অবস্থান কী?
মুজিবুর রহমান: আমার মনে হয়, এই মুহূর্তে ঐক্য কিছুটা কঠিন। কারণ তারা (বিএনপি) আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) ব্যবস্থাটি কার্যত চায়নি। পরে যদিও তারা রাজি হয়েছে, কিন্তু সেই রাজি হওয়া বা না হওয়া প্রায় সমান হয়ে গেছে। অন্যদিকে, আমরা পিআর ব্যবস্থার পক্ষে শক্ত অবস্থানে আছি। আপনারা দেখেছেন, সাত-আটটি ইসলামি দল নিয়ে আমাদের একটি জোট রয়েছে এবং আমরা একসঙ্গেই আন্দোলন করছি ও কর্মসূচি দিচ্ছি। এখন যেহেতু উনারা একটি ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছেন, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যদি সরকার বা প্রধান উপদেষ্টা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কোনো সমঝোতায় আসতে পারেন, তাহলে ভিন্ন কথা।
ইফতেখার মাহমুদ: একসঙ্গে হওয়ার আশা দেখেন?
মুজিবুর রহমান: মানুষ তো আশাতেই বেঁচে থাকে। আমরা আশা করি, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান হবে। এতে দেশের মঙ্গল হবে। সংঘাতের দিকে গেলে দেশের ভবিষ্যৎ ভালো হবে না। একটি মহল তো অপেক্ষায়ই আছে কোনো সুযোগের সদ্ব্যবহার করার জন্য। আমরা চাই, দেশ যেন কোনো বৃহত্তর ঝুঁকির মুখে না পড়ে এবং আলোচনার মাধ্যমেই একটি সমাধান আসুক।
ইফতেখার মাহমুদ: শোনা যাচ্ছে, হেফাজতের একটি অংশ আপনাদের সঙ্গে এবং অন্য একটি অংশ বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধছে। এমসিপির ক্ষেত্রেও একই কথা বলা হচ্ছে। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
মুজিবুর রহমান: আমি দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি যে, আমাদের দেশের রাজনীতি কেবল জাতীয় স্বার্থে পরিচালিত হয় না। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের উচিত মানুষের কল্যাণকে বড় করে দেখা। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, কিছু সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে ইসলামের নামে পরিচালিত দলও ফ্যাসিস্ট সরকারের সঙ্গে হাত মেলায়, যা হওয়া উচিত ছিল না। আমি কারও নাম উল্লেখ না করে বলছি, যদি ব্যক্তিগত স্বার্থে—যেমন এমপি হওয়ার লোভে বা আর্থিক সুবিধার জন্য—কেউ কোনো জোটে যোগ দেয়, তবে সেই রাজনীতি ব্যক্তিস্বার্থের, বৃহত্তর স্বার্থের নয়।
তবে আমি মনে করি না যে সবাই এমনটা করছে। অতীতে এমন উদাহরণ দেখা গেলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আমরা আশা করব, সবাই দেশের বৃহত্তর কল্যাণে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে এবং জনগণ একটি সুন্দর নির্বাচন পাবে। আচ্ছা, আপনিই বলুন, গণভোট আর সাধারণ নির্বাচন কি প্রায় একই জিনিস নয়? উভয় ক্ষেত্রেই জনমতকে সম্মান করতে হয়। তাহলে গণভোটকে ভয় পাওয়ার কারণ কী? যারা ভয় পায়, তাদের নিয়ে তো প্রশ্ন উঠবেই যে, তারা জনগণের মতামত চায় না। তবে আমরা কাউকে আঘাত করে কথা বলতে চাই না। ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে, ‘মন্দের জবাব উত্তম দিয়ে দাও’। আমরা সেই নীতিতেই চলছি।
সাংবিধানিক সংস্কার কমিশনে আমরা ৪১টি ধারা জমা দিয়েছিলাম। সেখানে এই বিষয়ে মিল হয়েছিল যে, তারা উচ্চকক্ষে পিআর ব্যবস্থা মেনে নেবে। আমরা উভয় কক্ষেই চেয়েছিলাম। যেহেতু এক জায়গায় মতের অমিল হয়েছে, তাই আমরা গণভোট চাইছি, যাতে জনগণ কী চায় তা দেখা যায়।
ইফতেখার মাহমুদ: অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশা করি ভবিষ্যতেও আমরা আপনার সঙ্গে কথা বলব।
মুজিবুর রহমান: বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকেও ঢাকা স্ট্রিমকে এবং দর্শক-শ্রোতা যারা কথা শুনেছেন, আমি সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
.png)

সম্প্রতি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল বলেন, গত সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় সরকার পরিবর্তন বা পতনের মূল কারণ ছিল ‘অদক্ষ ও দুর্বল শাসনব্যবস্থা’। গত শুক্রবার ভারতে পালিত ‘জাতীয় একতা দিবস’ উপলক্ষে আয়োজিত সরদার প্যাটেল স্মারক বক্তৃতায় দোভাল এ কথা বলেন।
৮ ঘণ্টা আগে
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট, সংস্কার, গণভোটের দাবি এবং আগামী নির্বাচনসহ জামায়াতে ইসলামীর সার্বিক মূল্যায়ন ও রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে ঢাকা স্ট্রিমের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন দলটির সিনিয়র নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান।
১ দিন আগে
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে একটি নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে, যার মূলে রয়েছে রাষ্ট্র কাঠামোর আমূল সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা। এই সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন ৮৪ দফা সুপারিশ পেশ করেছে।
১ দিন আগে
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ একটি নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। এই পরিবর্তনের মূলে রয়েছে রাষ্ট্র কাঠামোর আমূল সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাত ধরে সেই সংস্কার প্রক্রিয়ার যাত্রা শুরু হয়েছে।
১ দিন আগে