leadT1ad

‘অদক্ষ শাসনে বাংলাদেশ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় সরকার পরিবর্তন’, অজিত দোভাল কী ইঙ্গিত দিলেন

দোভালের এই বক্তব্য ভারতীয় কূটনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত। এর আগে চীন ও পাকিস্তানের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে কৌশলগত প্রভাব বজায় রাখার জন্য নয়াদিল্লি এই পতিত সরকারগুলোকে সমর্থন করে আসছিলো।

প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২৫, ১১: ৫৬
ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। ছবি: সংগৃহীত।

সম্প্রতি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল বলেন, গত সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় সরকার পরিবর্তন বা পতনের মূল কারণ ছিল ‘অদক্ষ ও দুর্বল শাসনব্যবস্থা’। গত শুক্রবার ভারতে পালিত ‘জাতীয় একতা দিবস’ উপলক্ষে আয়োজিত সরদার প্যাটেল স্মারক বক্তৃতায় দোভাল এ কথা বলেন।

দোভাল ইতিহাস ও বর্তমান সময়ের উদাহরণ টেনে বলেন, ‘মহান সাম্রাজ্য, রাজতন্ত্র, অলিগার্কি, অভিজাত শাসনব্যবস্থা বা গণতন্ত্র—সব কিছুর উত্থান ও পতনের ইতিহাস আসলে তাদের শাসনব্যবস্থার ইতিহাস। ’তাঁর ভাষায়, ‘বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপালসহ সাম্প্রতিক সময়ে সরকার পরিবর্তনের ঘটনাগুলো আসলে দুর্বল শাসনের ফল।’

সরকারগুলোর ব্যর্থতার মূল কারণ হিসেবে দোভাল স্বৈরাচার, অবিচার ও বৈষম্যকে চিহ্নিত করেন। তিনি বলেন, ‘যে স্বৈরাচারী শাসন দমননীতি চালায়, বৈষম্যমূলক আইন প্রয়োগ করে, ন্যায়বিচার দিতে ব্যর্থ হয়, জনগণকে প্রান্তিক করে এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন করে—তা শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের পতন ঘটায়।’

দোভাল আরও বলেন, ‘যখন জবাবদিহিতা থাকে না, মানুষ জানে না তারা কেন কী করছে—তখনই অবক্ষয়ের সূচনা হয়।’ দোভালের কথায়, ‘রাষ্ট্রগঠনের প্রক্রিয়ায় সুশাসনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং জাতিকে তার লক্ষ্য ও আকাঙ্ক্ষা পূরণে সহায়তা করে।’

তিনি ভারতেও সর্বত্র শাসন ব্যবস্থার উন্নতির জন্য পরিবর্তনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, নীতি ও পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে যা জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবে। এর মধ্যে আইন প্রণালীর পুনঃমূল্যায়নের কথাও উল্লেখ করেন।

তাঁর এই মন্তব্য এলো এমন সময়ে যখন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নিতে আহ্বান জানান। অন্যদিকে, চীনের ‘স্ট্রিং অব পার্লস’ কৌশল নিয়ে ভারতও উদ্বিগ্ন। চীন ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ঋণনির্ভর অবকাঠামো প্রকল্প ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করছে।

দোভালের এই বক্তব্য ভারতীয় কূটনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত। এর আগে চীন ও পাকিস্তানের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে কৌশলগত প্রভাব বজায় রাখার জন্য নয়াদিল্লি এই পতিত সরকারগুলোকে সমর্থন করে আসছিলো।

দোভাল দুর্বল শাসনব্যবস্থাকে দায়ী করে পরোক্ষভাবে এই দেশগুলোর পতিত বা অস্থির সরকারগুলোর সমালোচনা করেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি হয়তো ইঙ্গিত দেন যে ভারত স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় নতুন সরকারকে সহায়তা দিতে প্রস্তুত।

ভারতের ‘প্রো-ইন্ডিয়া রেজিম’ কৌশল

ক্ষমতাসীন বিজেপি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ভারতের প্রতিবেশী নীতির মূল স্লোগান ছিল ‘প্রতিবেশী প্রথম।’ কিন্তু বাস্তবে প্রায়ই তার মানে দাঁড়িয়েছে বন্ধুত্বপূর্ণ নেতাদের সমর্থন দেওয়া, যদিও তাদের দেশের ভেতরে নানা ত্রুটি ছিল।

বাংলাদেশে ২০০৯ সাল থেকে ভারত দৃঢ়ভাবে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে এসেছে। এমনকি ২০২৪ সালের নির্বাচনেও নয়াদিল্লি সমর্থন দেয়, যদিও তখন বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন ও অগণতান্ত্রিক আচরণের অভিযোগ ছিল। হাসিনার সরকারকে ভারত দেখেছে ইসলামপন্থী উত্থান ও চীনা প্রভাবের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধক হিসেবে।

নেপালে, ২০০৮ সালের পর থেকে ১৩ জন প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তনের মধ্যে ভারত প্রায়ই প্রো-ইন্ডিয়া রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখে, যেমন কেপি শর্মা ওলি। অথচ সেখানে দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক স্থবিরতা চলছিল।

শ্রীলঙ্কায়ও ২০২২ সালের সঙ্কটের পর ভারত অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট রানিল বিক্রমাসিংহেকে সমর্থন দেয় এবং চীনা ঋণের প্রভাব মোকাবিলায় ৪ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা দেয়।

এই কৌশল কিছু স্বল্পমেয়াদি সাফল্য আনলেও পরবর্তীতে ক্ষোভ সৃষ্টি করে। ভারতের প্রকাশ্য পক্ষপাত—যেমন হাসিনার মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় উপেক্ষা—প্রতিবেশীদের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব বাড়িয়েছে এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে উৎসাহিত করেছে।

২০২৪ সালে হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়া বাংলাদেশে ‘ভারতের হস্তক্ষেপের’ অভিযোগ তৈরি করে এবং মুহাম্মদ ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ককে জটিল করে তোলে।

দোভালের এই মন্তব্য প্রথমবারের মতো একজন উচ্চপদস্থ ভারতীয় কর্মকর্তার পতিত সরকারগুলোর ওপর দায় চাপানোর প্রকাশ্য ইঙ্গিত। এটি একটি রূপরেখা পরিবর্তনের সংকেত দেয়—অবাধ সমর্থন থেকে সরে এসে শাসনের মান এবং জবাবদিহিতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া।

দোভাল দুর্বল শাসনব্যবস্থাকে দায়ী করে পরোক্ষভাবে এই দেশগুলোর পতিত বা অস্থির সরকারগুলোর সমালোচনা করেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি হয়তো ইঙ্গিত দেন যে ভারত স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় নতুন সরকারকে সহায়তা দিতে প্রস্তুত।

বিশ্লেষক সি রাজা মোহন যেমন পরামর্শ দিয়েছেন, ভারতকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বদলে পারস্পরিক সম্মান ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার ভিত্তিতে নতুন কূটনৈতিক পথ বেছে নিতে হবে।

দোভালের বার্তার অন্তর্নিহিত অর্থ

দুর্বল শাসনব্যবস্থা নিয়ে দোভালের এই সমালোচনা শুধুই অতীতের পর্যালোচনা নয়; এটি ভারতের আঞ্চলিক প্রভাবের কমতে থাকার প্রেক্ষিতে এক বহুমাত্রিক বার্তা। বর্তমানে বাংলাদেশ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় চীনই ভারতের চেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। এটি ভারতের ‘কাঠামোগত প্রভাব কমার’ ইঙ্গিত দেয়। দোভালের বক্তব্যে তিনটি মূল উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়—

১. নতুন বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া:

ভারতপন্থী সরকারগুলোর পতনের পর ভারত এখন আরও নমনীয় অবস্থান নিচ্ছে। হাসিনার পর ভারতের সঙ্গে ইউনুস সরকারের সম্পর্ক শীতল হলেও নয়াদিল্লি বাস্তবধর্মী সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে।

শ্রীলঙ্কায় ২০২৪ সালের নির্বাচনে অনুরা কুমারা দিসানায়েকের জয়ে ভারত অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি দিয়ে চীনা প্রভাব প্রতিহত করেছে।

বিশ্লেষক দেবকান্ত পাল সতর্ক করেন, যদি ভারত বিকল্প সহায়তা না দেয়, তবে চীন সহজেই প্রভাব বাড়াবে। তাই দোভালের বার্তা মূলত সংস্কৃতি, প্রতিষ্ঠান ও সহযোগিতার মাধ্যমে ভারতের সফট পাওয়ারের শক্তি পুনরুজ্জীবনের আহ্বান।

২. অস্থিতিশীল প্রতিবেশীদের জন্য সতর্কবার্তা:

ভারত বাইরের হস্তক্ষেপ নয়, বরং ‘দুর্বল শাসনব্যবস্থা’-কেই দোষারোপ করে এক প্রকারে ঢাকা, কলম্বো ও কাঠমান্ডুর নেতাদের সংস্কারের আহ্বান জানাচ্ছেন। দোভাল জোর দেন জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠান গঠনের ওপর।

৩. ভারতের শাসন মডেলের প্রচার:

দোভাল দক্ষিণ এশিয়ার ব্যর্থ শাসনগুলোর সঙ্গে ভারতের অগ্রগতির তুলনা টানেন। মোদির নেতৃত্বে ভারত প্রযুক্তিনির্ভর ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের পথে এগিয়েছে—যেমন ডিজিটাল সেবা ও স্বচ্ছতা কর্মসূচি।

এর মাধ্যমে ভারত ‘সুশাসনের মডেল’ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করছে এবং বিমসটেক-এর মতো সংস্থার মাধ্যমে তা ভাগাভাগি করতে চাইছে।

বিশ্লেষক সি রাজা মোহন যেমন পরামর্শ দিয়েছেন, ভারতকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বদলে পারস্পরিক সম্মান ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার ভিত্তিতে নতুন কূটনৈতিক পথ বেছে নিতে হবে।

দোভালের বক্তব্য ভারতের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের হস্তক্ষেপের অভিযোগ কমাতে সাহায্য করবে এবং সংস্কার হলে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে নতুন সূচনা হতে পারে। কিন্তু যদি এই বার্তা উপদেশমূলক মনে হয়, তবে উল্টো প্রতিক্রিয়াও হতে পারে।

ভারসাম্যপূর্ণ মূল্যায়ন

সরদার প্যাটেল স্মারক বক্তৃতায় অজিত দোভালের বক্তব্য ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে এক সূক্ষ্ম পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। বিশেষ করে বাংলাদেশ, নেপাল এবং শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব সুস্পষ্ট। এটি যদিও আনুষ্ঠানিক নীতি ঘোষণা নয়, তবুও তিনি যখন এই দেশগুলোর সাম্প্রতিক সরকার পতনের জন্য ‘দুর্বল শাসনব্যবস্থাকে’ দায়ী করেন, তখন তা ভারতের পুরোনো নীতি থেকে এক সরে আসার ইঙ্গিত দেয়।

এর আগে ভারত সাধারণত প্রো-ইন্ডিয়া নেতাদের নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে এসেছে, তাদের অভ্যন্তরীণ ত্রুটি উপেক্ষা করে। কিন্তু দোভালের বক্তব্যে নতুন দিকনির্দেশনা দেখা যায়—এখন ভারতের লক্ষ্য জবাবদিহিতা, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা; স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক জোট নয়।

এ থেকে বোঝা যায় যে নয়াদিল্লি এখন আঞ্চলিক অস্থিরতায় ক্লান্ত এবং চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলায় নতুন কৌশল খুঁজছে।

ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে দোভালের মন্তব্য সচরাচর পরিকল্পনাবহির্ভূত নয়; সেগুলো প্রায়ই নীতিগত দিক নির্দেশ করে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ভারত এখন দক্ষিণ এশিয়ায় ‘শাসনভিত্তিক’ নীতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে—যেখানে প্রভাব বিস্তারের বদলে সংস্কার ও সুশাসন প্রচারে গুরুত্ব পাবে।

দেশীয়ভাবে তাঁর বক্তব্য আশ্বাস দেয় যে ভারতের নিজস্ব সংস্কার তাকে এ ধরনের সংকট থেকে রক্ষা করছে, আর আন্তর্জাতিকভাবে এটি সহযোগিতার আহ্বান জানায়—সুশাসন থাকলে গণঅভ্যুত্থানের ভয় নেই। তবে ভারতের ভেতরে সংস্কার না এলে এই বার্তা ভণ্ডামি হিসেবে ধরা পড়তে পারে।

দোভালের বক্তব্য ভারতের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের হস্তক্ষেপের অভিযোগ কমাতে সাহায্য করবে এবং সংস্কার হলে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে নতুন সূচনা হতে পারে। কিন্তু যদি এই বার্তা উপদেশমূলক মনে হয়, তবে উল্টো প্রতিক্রিয়াও হতে পারে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত