নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে জোহরান মামদানির বিজয় আসলে প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে এক নৈতিক জবাব। যে প্রাতিষ্ঠানিকতা আমাদের এতদিন বলে এসেছে, ক্ষমতার কাছাকাছি থাকাই পূন্য ও টাকা থাকাই যোগ্যতা, সেই প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে মামদানির বিজয় যেন এক সাক্ষাৎ চপেটাঘাত।
বড়লোকদের ডোনেশনের বন্যা, গণমাধ্যমের বাঁকা চোখ, ইসলামোফোবিয়া আর খোদ নিজ দলের কিছু অংশের বিরোধিতা উপেক্ষা করে মামদানি বিজয়ী হয়েছেন। মামদানির এই জয় স্পষ্ট সংকেত দিচ্ছে, সম্পদ আর প্রভাবের পুরোনো অংক কষে এখন আর ক্ষমতার মসনদ পাওয়া যায় না।
দীর্ঘদিন ধরে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির জাতীয় নেতারা সাধারণ মানুষের জন্য সহানুভূতির ভাষা ব্যবহার করলেও, বাস্তবে তারা বড় ব্যবসায়ী ও লবিস্টদের স্বার্থই রক্ষা করেছেন। মামদানির নির্বাচনী প্রচার প্রকাশ্যে সেই ভণ্ডামির মুখোশ খুলে দিয়েছে। মামদানি কোনো বিমূর্ত তত্ত্বকথা না কপচে সাধারণ নাগরিকের স্বার্থের মৌলিক প্রশ্নই তুলে ধরেছেন—‘এই শহরে টিকে থাকার সামর্থ্য কার আছে?’
মামদানির উত্তরও ছিল সহজ। তিনি ডাক দিয়েছেন সরকারি উদ্যোগে আবাসন, ভাড়া-সুরক্ষা আইন, সার্বজনীন শিশু পরিচর্যা এবং বিনামূল্যে সিটি বাসের। মামদানি প্রস্তাব করেছেন সুলভ মূল্যে খাবার সরবরাহ করবে এমন সরকারি মালিকানাধীন মুদি দোকানের, যা মানুষের ক্ষুধাকে পুঁজি করে মুনাফা লোটা বেসরকারি চেইন শপগুলোর একচেটিয়া আধিপত্য ভাঙবে। মামদানি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ধনীরা যাতে তাদের ন্যায্য হিস্যাটুকু দেয়, তা তিনি নিশ্চিত করবেন।
মামদানির বিশেষত্ব তাঁর নীতিতে নয়, বরং সেই নীতির ভিত্তি নিয়ে তার খোলামেলা বক্তব্যে। মামদানি স্পষ্ট করে বলেছেন, সরকারের কাজ হলো শ্রমজীবী মানুষের সেবা করা, লবিস্ট বা ধনীদের নয়। তিনি ঘোষণা করেছেন, নিউইয়র্ক তার নাগরিকদের। কোনো বিল্ডার, ব্যাংকার বা দাতাদের নয়।
মামদানির দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর একজন খোদ ডেমোক্রেটিক পার্টির। মামদানি দলীয় নমিনেশন পাওয়ায় অ্যান্ড্রু কুয়োমো নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। অ্যান্ড্রু কুয়োমো অভিজাতদের সেবা করা রাজনীতির প্রতীক। বলার অপেক্ষা রাখে না, এখনকার ভোটাররা এই অভিজাতদের ভীষণ অপছন্দ করে। ওয়াল স্ট্রিটের বড় ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের সহায়তা আর ক্ষমতার জোরে কুয়োমো নিজের কেলেঙ্কারির দাগ মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু যতই বিজ্ঞাপন, সমর্থন আর দাতার টাকা ব্যয় করা হোক না কেন, ভোটাররা বুঝে গিয়েছিল—কুয়োমো আর তার পৃষ্ঠপোষকরা আসলে সেই ডেমোক্র্যাটিক পার্টিরই প্রতীক, যারা নীতিহীনভাবে অভিজাত শ্রেণির সেবা করে যাচ্ছে।
পার্টির নমিনেশন দেওয়ার শুরুর সময়ে ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতৃত্বের আচরণ ছিল আরও লজ্জাজনক। একাধিক যৌন অসদাচরণের মুখে ২০২১ সালে নিউইয়র্কের গভর্নর থেকে পদত্যাগ করেন কুয়ামো। তবুও, নমিনেশনের সময় দলের অনেক শীর্ষ নেতা তাঁকে সমর্থন দিয়েছিলেন।
কুয়োমোকে ডেমোক্রেটিকরা যেভাবে রক্ষা করেছে, সেটা রিপাবলিকানদের ডোনাল্ড ট্রাম্পকে রক্ষার চেষ্টার থেকে আলাদা কিছু নয়। দুই ক্ষেত্রেই দেখা গেছে নৈতিকতাবিহীন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার রাজনীতি।
প্রাইমারি বিতর্কে যখন ডেমোক্র্যাট প্রার্থীরা বলছিলেন, নির্বাচিত হলে তারা প্রথমে ইসরায়েল সফরে যাবেন, মামদানি তখন বলেছিলেন, তিনি নিউ ইয়র্কের মেয়র হতে চান, কোনো পররাষ্ট্র দূত নন। তাই ইসরায়েল সফরের কোনো পরিকল্পনাও তাঁর নেই। তার এই স্পষ্ট বক্তব্যে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও মূলধারার গণমাধ্যম হতবাক হয়েছিল।
ডেমোক্রেটিক নেতৃত্ব ও অনেক সংবাদমাধ্যম মামদানির এই অবস্থানকে ‘অযোগ্যতা’ হিসেবে তুলে ধরেছে। তারা যেন বলতে চায়, ইসরায়েলকে খুশি না করলে কেউ যোগ্য নেতা হতে পারে না। কিন্তু ভোটাররা ভণ্ডামির চেয়ে সততার নীতিকেই বেছে নিয়েছে।
কুয়োমোর সমর্থকেরা মামদানিকে ‘সোশ্যালিস্ট বা সমাজতান্ত্রিক’ বলে ভয় দেখাতে চেয়েছিল। কিন্তু এই পুরোনো কৌশল আর কাজ করেনি। নিউ ইয়র্কবাসী বুঝেছে, ট্রাম্পরা যেসব কর্মকাণ্ডকে ‘কমিউনিজম’ বলে গালি দেন, সেটি আসলে জনগণের সম্পদ জনগণের কল্যাণে ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি মাত্র।
জায়নবাদের সমালোচনা ও ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞের নিন্দা জানানোয় মামদানিকে ইহুদিবিদ্বেষী বা ‘অ্যান্টিসেমিটিক’ বলে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু ভোটাররা এসব অযথা ও নৈতিক ওজন হারিয়ে ফেলা ট্যাগিংয়ে প্রভাবিত হননি।
এইসব অভিযোগ পাত্তা না দিয়ে মামদানিকে জিতিয়ে নিউ ইয়র্কের মানুষ জানিয়ে দিয়েছে, নৈতিক স্পষ্টতা ও মানবিক সহানুভূতি কোনো ‘চরমপন্থা’ নয়; বরং এগুলোই আজকের রাজনীতিতে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় গুণ। কুয়োমো ও তাঁর সহযোগীরা নৈতিক স্পষ্টতা বাদ দিয়ে প্রকাশ্য বর্ণবাদ আর ইসলামবিদ্বেষের আশ্রয় নিয়েছিল। মামদানির জয় তাই বিদ্বেষকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার রাজনীতির পরাজয়ের চিহ্ন।
ইসরায়েল ইস্যুতে এই নির্বাচনের নৈতিক বিভাজন সবচেয়ে স্পষ্ট হয়েছে। এই ইস্যুতে মামদানি যে সাহস দেখিয়েছেন, তা খুব কম আমেরিকান রাজনীতিকই দেখাতে পেরেছেন। বৈষম্যের ওপর দাঁড়ানো ইসরায়েলকে ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেছেন মামদানি। গাজায় ইসরায়েলের চালানো গণহত্যার নিন্দা জানিয়ে মামদানি বলেছেন, ন্যায়বিচার কখনো কয়েকজনের জন্য বা নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠীর জন্য হয় না। ন্যায়বিচারের অধিকার সবার।
অন্যদিকে, কুয়োমো সুযোগসন্ধানী ভঙ্গিতে বলেছেন, যদি কখনো ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গণহত্যার অভিযোগে বিচারাধীন হন, তবে তিনি তাঁকে রক্ষা করতে প্রস্তুত। কুয়ামো প্রকাশ্যে বলেছেন, তাঁর আনুগত্য ইসরায়েলের জাতিগত পরিচয়ের প্রতি, আর মামদানির অবস্থান ‘চরমপন্থী’। কিন্তু ভোটারদের কাছে ন্যায়বিচার নয়, বরং ক্ষমতার পক্ষ নেওয়া কুয়ামোই হয়ে উঠেছেন আসল চরমপন্থী।
নতুন প্রজন্ম এখন ইসরায়েল নিয়ে সেই ভয় বা ট্যাবুতে আটকে নেই। তারা গাজার নির্মম দৃশ্যগুলো নিজের চোখে দেখেছে। এসব দৃশ্য আর গণহত্যার চাক্ষুষ প্রমাণ তাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, ‘ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র গণতন্ত্র’—এই ধরনের বুলি আসলে কতটা ফাঁকা আওয়াজ। অনেকেই এখন খোলাখুলিভাবে বলছে, ইসরায়েল একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্র। ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো কিংবা এই ইস্যুতে নৈতিক সত্য বলা তাই এই প্রজন্মের কাছে কোনো অপরাধ নয়।
তারা তাই ন্যায়বিচারকেই বেছে নিয়েছে এবং মামদানির জয় সেই ন্যায়বিচারেরই প্রতিফলন।
মার্কিন সিনেটর চাক শুমার শুরুতে মামদানিকে সমর্থনই দেননি। আরেক প্রতিনিধি হাকিম জেফরিস সমর্থন দেন একেবারে ভোট শুরু হওয়ার আগের দিন। ডেমোক্রেটিকদের নেতৃত্ব এখনো দাতাশ্রেণির চিন্তাধারায় বন্দী। সেখানে ওয়াল স্ট্রিট নির্ধারণ করে অর্থনৈতিক যুক্তি, আর জায়নবাদী লবি নির্ধারণ করে কে কী বলতে পারবে। ফলে ভোটাররাই ডেমোক্রেটিকদের ছেড়ে চলে গেছে।
মামদানির এই বিজয় আসলে প্রজন্মগত বিদ্রোহের ফল। তরুণরা ‘ত্রুটিপূর্ণ হলেও এই ব্যবস্থা মানতে হবে’ এমন কথা শুনতে শুনতে ক্লান্ত। তরুণরা দেখছে শিক্ষাঋণে কীভাবে তাদের ভবিষ্যৎ বিপদের মুখে পড়ছে, অত্যাধিক ভাড়া তাদের মজুরি গিলে খাচ্ছে, আর রাজনীতিবিদেরা তাদের স্বপ্নকে ‘অভিজ্ঞতার অভাব’ বলে উড়িয়ে দিচ্ছে। তরুণরা আর প্রতীকি উদারতা বা ‘শেয়ার্ড ভ্যালু’র ফাঁকা বুলি চায় না। সত্য কথা বলে এবং সেই সত্যের পক্ষে কাজ করে এমন রাজনীতিই তারা চায়।
প্রতিষ্ঠিত মহল অবশ্য এই ফলাফলকে স্থানীয় ব্যতিক্রম বা শহুরে উগ্রপন্থার ঝোঁক হিসেবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবে। কিন্তু মামদানির এ বিজয় আসলে ডেমোক্রেটিক পার্টির বিরুদ্ধে, যে পার্টি নৈতিক বিশ্বাস বিক্রি করে তহবিল জোগাড় করে। আর জনগণের আস্থা বিকিয়ে পায় প্রভাবশালীদের দোরগোড়ায় প্রবেশাধিকার।
আমেরিকার সবচেয়ে বড় ইহুদি জনসংখ্যার শহরের জনগণ, ভণ্ডামি ও বশ্যতার রাজনীতি মেনে নেয়নি। নৈতিক স্পষ্টতাকে সবসময় টাকার ভয়ে নরম হতে হবে—এমন মিথ নিউ ইয়র্কের নাগরিকেরা ভেঙে দিয়েছে।
মামদানিকে নির্বাচিত করে নিউ ইয়র্কবাসী যেন তাদের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছে। তারা পুরো দেশকে মনে করিয়ে দিয়েছে, নীতি এখনো ক্ষমতাকে হারাতে পারে, বিবেক এখনো পুঁজির চেয়ে বেশি জোরে কথা বলতে পারে এবং যে পার্টি ওয়াল স্ট্রিটের দাস আর সত্যের ভয়ে নীরব, তারা জনগণের প্রতিনিধি হতে পারে না।
যদি এই বিজয় ডেমোক্রেটিক নেতৃত্বকে নৈতিক নিদ্রা থেকে না জাগায়, তবে এই জয়ই নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে। তারা উঠে দাঁড়াবে এবং পুরোনো নেতৃত্বকেই আমূলে বদলে দেবে।
লেখক:
জিয়াদ মোতালা, হাওয়ার্ড ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ ল-এর অধ্যাপক
(কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরায় প্রকাশিত। অনুবাদ করেছেন তুফায়েল আহমদ)