leadT1ad

বিশেষ সাক্ষাৎকার

৫০টির মতো দল নিয়ে আমাদের মৌলিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে: আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হলে বিএনপি কীভাবে যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে একটি 'জাতীয় ঐক্যের সরকার' গঠন করতে চায়, কীভাবে এক কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং কৌশলগত স্বকীয়তা বজায় রেখে বৈদেশিক নীতি পরিচালনা করতে চায় ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ঢাকা স্ট্রিমের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা স্ট্রিমের সম্পাদক ইফতেখার মাহমুদ

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। ছবি: আশরাফুল আলম

ইফতেখার মাহমুদ: আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি কিছু আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। যে আসনগুলো এখনো খালি আছে, ধারণা করা হচ্ছে সেগুলো আপনাদের রাজনৈতিক মিত্রদের জন্য রাখা হয়েছে। নির্বাচনকেন্দ্রিক এই জোটে কারা থাকছে বা আপনাদের সম্ভাব্য মিত্র কারা হতে যাচ্ছে?

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: আমাদের সঙ্গে তো অনেকেই আছেন। যুগপৎ আন্দোলনেই প্রায় ৪২টি দল ছিল। এর বাইরে আরও পাঁচ-সাতটি বামপন্থী দলসহ প্রায় ৫০টি দল আমাদের ভাবনার সঙ্গে একাত্ম, বিশেষ করে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে। এই ৫০টি দল গণতন্ত্রের জন্য এবং আগামী দিনের বাংলাদেশ গড়ার ভাবনায় আমাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ।

আমাদের ঐক্যের মৌলিক ভিত্তিগুলো হলো—একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, জনগণের ম্যান্ডেটের মাধ্যমে সরকার গঠন, মানবাধিকারের সঠিক প্রয়োগ এবং একটি জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের ধারণা। আমরা মনে করি, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায়নি, বরং পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে তা ভাগ-বাটোয়ারা করা হয়েছে। আগামী দিনে আমরা নীতি প্রণয়ন ও এর সুফলভোগের ক্ষেত্রে জনগণের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে চাই। আমাদের ৩১ দফার মধ্যে এই ভাবনাগুলোর প্রতিফলন ঘটেছে এবং আমি বিশ্বাস করি, দেশের বহু রাজনৈতিক দল এই চিন্তার জায়গায় একমত হয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। ছবি: আশরাফুল আলম
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। ছবি: আশরাফুল আলম

নির্বাচনের ক্ষেত্রে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সব দল হয়তো অংশ নেবে না, কারণ সবার সেভাবে নির্বাচনী আসন নেই। তবে যারা নির্বাচন করবে না, তারাও আমাদের সঙ্গে থাকবে এবং কাজ করবে। আমরা যদি সরকার গঠন করতে পারি, তারপরও এই ঐক্য ধরে রাখতে চাই। যেহেতু আমরা সবাই মিলে ৩১ দফা প্রণয়ন করেছি, তাই এর বাস্তবায়নেও আমরা একসঙ্গে কাজ করতে চাই। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সবার সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সরকার পরিচালনার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

ইফতেখার মাহমুদ: ৫ আগস্টের আগে আপনাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে কারা ছিল, তা আমরা জানি। কিন্তু এরপর অনেক নতুন রাজনৈতিক ধারা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে ইসলামিক দলগুলোর সঙ্গে আপনাদের নির্বাচনী মিত্রতা বা ঐক্যের বিষয়টি যদি নির্দিষ্টভাবে বলতেন। কাদের সঙ্গে আলোচনা চলছে বা কাদেরকে আপনারা নির্বাচনী মিত্র হিসেবে ভাবছেন?

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: বিষয়টি নির্দিষ্ট কোনো দলের সঙ্গে সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের এই ভাবনার সঙ্গে যারা একমত, তাদের সবার জন্যই অংশগ্রহণের সুযোগ আমরা খোলা রাখতে চাই।

নির্বাচন মানে জয়-পরাজয়ের বিষয় এবং আমরা জেতার জন্যই নির্বাচন করছি। জিতে সরকার গঠন করে আমরা আগামী দিনের বাংলাদেশ গড়ার রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে চাই। সুতরাং, জয়ের সম্ভাবনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। সেই লক্ষ্যে, আমাদের মিত্রদের মধ্যে যাদের নিজ নিজ আসনে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, আমরা সবাই মিলে সেই সুযোগটিই কাজে লাগাতে চাই।

অন্যদিকে, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যাদের অবদান আছে, কিন্তু নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার সুযোগ নেই, তাদের মূল্যায়নের কথাও আমরা ভেবেছি। আমরা সরকার গঠন করতে পারলে ‘উচ্চকক্ষ’ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা আছে। আন্দোলনে অবদান রাখা যোগ্য ব্যক্তিরা, যারা সাংসদ হতে পারবেন না, তাদের সেখানে সদস্য হওয়ার সুযোগ থাকবে।

সততা ও পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে দেশের জন্য যিনি যেখানে অবদান রাখতে পারবেন, তাকেই সেই দায়িত্ব দেওয়া হবে। এখানে ভাগাভাগির কোনো বিষয় নেই যে, ভাগাভাগি করতে গিয়ে আমরা যোগ্য ও অযোগ্যর পার্থক্য ভুলে যাব। তাই কতজন নির্বাচন করবে বা কতটি আসন রাখা হয়েছে, এগুলো অবাস্তব প্রশ্ন। আসন জেতার বিষয়, রাখার নয়। সরকার পরিচালনাও একই রকম। আপনি কি যোগ্যতার সঙ্গে দেশ চালাবেন, নাকি ভাগাভাগি করতে গিয়ে সরকারকে অযোগ্য করে তুলবেন? সুতরাং, সরকারের ভেতরে বা বাইরে যার যেখানে যোগ্যতা আছে, সেভাবেই বিষয়টি দেখলে দেশ ও জাতির মঙ্গল হবে। দিনশেষে দেশের মানুষ যে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছে, আমাদের প্রতিটি সিদ্ধান্তে সেই আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন থাকতে হবে।

ইফতেখার মাহমুদ: অর্থাৎ, যারা আপনাদের রাজনৈতিক মিত্র?

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: হ্যাঁ। উচ্চকক্ষে তাদের যাওয়ার সুযোগ থাকবে। এছাড়া, বিএনপি সরকার পরিচালনার সুযোগ পেলে যোগ্যতা অনুযায়ী বিভিন্ন দায়িত্বে থেকেও দেশের জন্য অবদান রাখার সুযোগ থাকবে। তারেক রহমান একটি ‘জাতীয় ঐক্যের সরকার’ গঠনের কথা বলেছেন, এবং আমার মনে হয়, এই বিষয়টি তিনি মাথায় রেখেই বলেছেন। সবাই তো সাংসদ হবেন না; কেউ সাংসদ হবেন, কেউ উচ্চকক্ষে যাবেন, আবার কেউ যোগ্যতার ভিত্তিতে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে অবদান রাখবেন। আমরা এই সুযোগটি উন্মুক্ত রেখেছি। যারা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ত্যাগ স্বীকার করেছেন এবং যাদের যোগ্যতা রয়েছে, তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে।

ইফতেখার মাহমুদ: জামায়াতে ইসলামীও আন্দোলনে তাদের বড় অবদানের কথা বলছে। সম্প্রতি তাদের এক শীর্ষ নেতা আমাদের সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, সরকার ও প্রশাসনে তাদের সম্পৃক্ততা বাড়ছে। একসময় তারা আপনাদের মিত্র ছিল। এবারের পরিস্থিতি কী এবং তাদের সঙ্গে আলোচনা কেমন চলছে?

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: আমি আগেই বলেছি, আমাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যারা ছিল এবং এর বাইরেও যারা আমাদের ভাবনার সঙ্গে একাত্ম, তাদের সবাইকে নিয়েই আমাদের পথচলা। আমরা কোনো নির্দিষ্ট দলকে বাইরে রাখতে চাই না। তারেক রহমান ‘জাতীয় ঐক্যের সরকার’ গঠনের কথা বলেছেন। সুতরাং, কোনো একটি নির্দিষ্ট দলকে নিয়ে আমাদের আলাদা কোনো নীতি থাকতে পারে না। আমরা আমাদের সার্বিক নীতি নিয়ে চলছি। আমাদের এই গণতান্ত্রিক ধারায় যারা আসতে চান এবং যারা এরই মধ্যে এসেছেন—প্রায় ৫০টির মতো দল—তাদের নিয়ে আমাদের একটি মৌলিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। তাই কোনো নির্দিষ্ট দলের জন্য আমাদের আলাদা কোনো কর্মসূচি নেই।

ইফতেখার মাহমুদ: রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সংসদে আসন ও মন্ত্রিত্বের মতো বিষয়গুলো মিত্রতা তৈরিতে নির্ণায়ক ভূমিকা রাখে। আপনাদের জোটে প্রায় ৫০টি দল থাকলেও মনোনয়ন বঞ্চিত আসনের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। সেক্ষেত্রে আপনি যে ‘জাতীয় সরকারের’ ধারণা ব্যাখ্যা করলেন, যেখানে উচ্চকক্ষ বা সরকার পরিচালনায় অন্যান্য ভূমিকার কথা বলা হয়েছে, সেই বিষয়টি যদি আরেকটু বিস্তারিত বলতেন।

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: দেখুন, বিষয়টি যোগ্যতাভিত্তিক। আমাদের বুঝতে হবে, দেশ পরিচালনা করতে হলে সঠিক জায়গায় যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে হবে। শেখ হাসিনার শাসনামলে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে, যার মূল কারণ ছিল অতিমাত্রায় রাজনীতিকরণ। প্রতিষ্ঠান রাজনীতিকরণের মাধ্যমে ধ্বংস করলে দেশের কোনো ভবিষ্যৎ থাকে না। একটি সরকার দেশ পরিচালনা করে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে। সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্রহণযোগ্যতা, পেশাদারত্ব, স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা যদি রক্ষা করা না যায়, তবে আবারও শেখ হাসিনার মতো শাসনব্যবস্থা ফিরে আসবে। আমরা সেই পথে হাঁটতে পারি না।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। ছবি: আশরাফুল আলম
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। ছবি: আশরাফুল আলম

এজন্য যোগ্যতা, সততা ও পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে দেশের জন্য যিনি যেখানে অবদান রাখতে পারবেন, তাকেই সেই দায়িত্ব দেওয়া হবে। এখানে ভাগাভাগির কোনো বিষয় নেই যে, ভাগাভাগি করতে গিয়ে আমরা যোগ্য ও অযোগ্যর পার্থক্য ভুলে যাব। তাই কতজন নির্বাচন করবে বা কতটি আসন রাখা হয়েছে, এগুলো অবাস্তব প্রশ্ন। আসন জেতার বিষয়, রাখার নয়। সরকার পরিচালনাও একই রকম। আপনি কি যোগ্যতার সঙ্গে দেশ চালাবেন, নাকি ভাগাভাগি করতে গিয়ে সরকারকে অযোগ্য করে তুলবেন? সুতরাং, সরকারের ভেতরে বা বাইরে যার যেখানে যোগ্যতা আছে, সেভাবেই বিষয়টি দেখলে দেশ ও জাতির মঙ্গল হবে। দিনশেষে দেশের মানুষ যে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছে, আমাদের প্রতিটি সিদ্ধান্তে সেই আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন থাকতে হবে।

ইফতেখার মাহমুদ: নির্বাচনী প্রচারের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলোতে একটি গতানুগতিক ধারা লক্ষ্য করা যায়। যেহেতু এটি একটি অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতি এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নির্বাচন হতে যাচ্ছে, এক্ষেত্রে বিএনপির প্রচারে কি কোনো নতুনত্ব বা ভিন্নতা দেখা যাবে? আপনারা কী ভাবছেন?

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: সরাসরি জনগণের কাছে যাওয়া এবং ভোটারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া তো অপরিহার্য। মনোনীত প্রার্থীদের এটি অবশ্যই করতে হবে। এর বাইরে গণমাধ্যমের একটি বড় জগৎ রয়েছে—প্রিন্ট, টেলিভিশন, রেডিও এবং সবচেয়ে বড় পরিসরে সোশ্যাল মিডিয়া। সব মিলিয়ে যোগাযোগের প্রক্রিয়াটি এখন ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। আমরা এই সব মাধ্যমকে মাথায় রেখেই কাজ করছি এবং এটিকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছি, যা শুধু নির্বাচনের জন্য নয়, বরং দলের ভবিষ্যতের জন্যেও।

এই প্রক্রিয়ায় আমরা পেশাদারত্ব, অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা এবং মেধাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। অ্যানালিটিক্স, গণসংযোগ এবং মুখপাত্র হিসেবে কারা কাজ করবেন, তা আলাদা করে দায়িত্ব বণ্টন করা হয়েছে। এখন সঠিক সময়ে সঠিক বার্তা জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া, একটি সুস্পষ্ট ন্যারেটিভ তৈরি করা এবং মানসম্মত কনটেন্ট নির্মাণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগে রাজনৈতিক দলগুলো হয়তো এভাবে ভাবেনি, কিন্তু এখন জনগণের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনে এই বিষয়গুলোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হচ্ছে।

আমরা নতুন মডেলের অর্থনীতি নিয়ে ভাবছি। যেমন, প্রতিটি নাগরিকের জন্য আমরা বিনামূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করব। এর মাধ্যমে একটি পরিবারের মাসে পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকা সাশ্রয় হবে, যা পরোক্ষে তাদের পকেটে টাকা দেওয়ার সামিল। পাশাপাশি, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হলে বড় ধরনের রোগের ঝুঁকি ও চিকিৎসার বিপুল খরচ থেকেও মানুষ মুক্তি পাবে। শিক্ষা ক্ষেত্রেও বেগম খালেদা জিয়ার শুরু করা ‘খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা’ কর্মসূচির মতো যুগোপযোগী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

ইফতেখার মাহমুদ: ফ্যাসিবাদবিরোধী দীর্ঘ লড়াইয়ে যারা অবদান রেখেছেন কিন্তু মনোনয়ন পেলেন না, তাদের জন্য আপনাদের ভাবনা কী?

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: তাদের জন্য অবশ্যই আমাদের ভাবনা আছে। গত ১৫-১৬ বছর ধরে যারা ত্যাগ স্বীকার করেছেন, পরিবার-পরিজন, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি হারিয়েছেন, জেল-জুলুম ও মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছেন, তাদের অবদান আমরা ভুলতে পারি না। বিএনপিতে এমন ভুক্তভোগীর সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখের বেশি।

এই ত্যাগী ব্যক্তিদের তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী মূল্যায়ন করতেই হবে। এরা দেশপ্রেমিক। রাষ্ট্র পরিচালনার ভেতরে এবং বাইরে, উভয় ক্ষেত্রেই তাদের যথাযথ মূল্যায়নের বিষয়টি আমাদের কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে। রাষ্ট্রের মাধ্যমে যতটুকু করা সম্ভব, তা করা হবে। যা সম্ভব হবে না, তা রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের বাইরে থেকেও তাদের মূল্যায়ন করার চেষ্টা করা হবে।

ইফতেখার মাহমুদ: প্রতি নির্বাচনেই ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’র বিষয়টি দেখা যায়। এবারও বিভিন্ন জেলায় মনোনয়ন নিয়ে বিক্ষোভ চলছে। তাদের প্রতি আপনাদের বার্তা কী?

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: মনোনয়ন না পেয়ে প্রার্থীরা নিজেরা সব সময় এমনটা করেন তা নয়। অনেক সময় তাদের সমর্থকরা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন এবং তাৎক্ষণিক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। এটি একটি সাময়িক বিষয়। পরবর্তীতে তারা উপলব্ধি করতে পারেন যে, দলের শৃঙ্খলার বাইরে গিয়ে কাজটি করা সঠিক হয়নি। শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, তারাই অনুতপ্ত হয়ে দলের মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন। আর যেসব ত্যাগী নেতাকে আমরা মনোনয়ন দিতে পারিনি, আমি আগেই বলেছি, আগামী দিনে তাদের মূল্যায়নের বিষয়টি আমাদের পরিকল্পনায় রয়েছে।

ইফতেখার মাহমুদ: আপনারা বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে পূর্বের বিএনপি সরকারের তুলনায় নতুন সরকারের নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে কি, বিশেষ করে অর্থনৈতিক নীতিমালায়?

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: হ্যাঁ, অনেক বড় পরিবর্তন আসবে। আমরা অর্থনৈতিক মডেলটি সম্পূর্ণ নতুনভাবে সাজাচ্ছি। বাংলাদেশে উন্নয়নের সুফল সাধারণ মানুষের কাছে খুব বেশি পৌঁছায় না; একটি পৃষ্ঠপোষক গোষ্ঠীই এর সিংহভাগ ভোগ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো, এই সুফল সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া।

এজন্য আমরা নতুন মডেলের অর্থনীতি নিয়ে ভাবছি। যেমন, প্রতিটি নাগরিকের জন্য আমরা বিনামূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করব। এর মাধ্যমে একটি পরিবারের মাসে পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকা সাশ্রয় হবে, যা পরোক্ষে তাদের পকেটে টাকা দেওয়ার সামিল। পাশাপাশি, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হলে বড় ধরনের রোগের ঝুঁকি ও চিকিৎসার বিপুল খরচ থেকেও মানুষ মুক্তি পাবে। শিক্ষা ক্ষেত্রেও বেগম খালেদা জিয়ার শুরু করা ‘খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা’ কর্মসূচির মতো যুগোপযোগী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কৃষকদের জন্য ‘ফার্মারস কার্ড’ এবং নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ‘ফ্যামিলি কার্ড’ চালু করে নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হবে।

ইফতেখার মাহমুদ: আপনি তৃণমূলের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার কথা বলছেন। এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের জন্য আপনাদের নির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা আছে কি?

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: একদমই। আমাদের গ্রাম-গঞ্জের কামার, কুমার, তাঁতি এবং অন্যান্য কুটির শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা বংশপরম্পরায় কাজ করলেও তাদের জীবনযাত্রার মানে তেমন কোনো পরিবর্তন আসে না। এর কারণ হলো—তারা সহজে ঋণ পায় না, কাঁচামাল সংগ্রহে সহায়তা পায় না এবং আধুনিক ডিজাইন, ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিংয়ের কোনো সুযোগ পায় না।

আমরা এই কারিগরদের জন্য ঋণের সুবিধা, উন্নত ডিজাইন ও ব্র্যান্ডিংয়ে সহায়তা এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মে তাদের পণ্য বাজারজাত করার সুযোগ তৈরি করব। ডেলিভারি বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা। তাই সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাত ও এনজিওগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে আমরা এই সেবাগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দেব। আমাদের লক্ষ্য হলো, এই মানুষগুলো যেন ঘরে বসেই আলিবাবা, অ্যামাজন বা ইবে-র মতো প্ল্যাটফর্মে তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারে।

আমাদের বৈদেশিক নীতি কয়েকটি মৌলিক স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হবে: পারস্পরিক সম্মান, পারস্পরিক স্বার্থ, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা এবং কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন। আমাদের নীতি কোনো দেশকেন্দ্রিক হবে না, বরং এটি হবে বহুপাক্ষিক। যেখানে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ রক্ষা হবে, আমরা সেভাবেই সিদ্ধান্ত নেব।

ইফতেখার মাহমুদ: কর্মসংস্থান এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আপনারা ১৮ মাসে এক কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যা অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী। এই বিশাল লক্ষ্যমাত্রা কীভাবে পূরণ করবেন?

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: আমরা জানি এটি একটি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা। কিন্তু দেশকে সংকট থেকে বের করে আনতে হলে আমাদের এমন সাহসী পদক্ষেপই নিতে হবে। আমরা কয়েকটি খাতকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছি:

তথ্যপ্রযুক্তি: পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মতো আমরাও কল সেন্টার, ডেটা সেন্টার ও চ্যাট সেন্টারের মতো খাতগুলোতে লক্ষ লক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারি। প্রায় দুই লাখ তরুণ-তরুণী ফ্রিল্যান্সিংয়ে জড়িত, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির অভাবে এগোতে পারছে না। আমরা ‘পেপ্যাল’-এর মতো আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সিস্টেম চালু করে তাদের জন্য ব্যবসার পথ সুগম করব।

ক্রিয়েটিভ ইকোনমি: আমরা খেলাধুলাকে একটি ‘স্পোর্টস ইকোনমি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাই। প্রতিটি এলাকায় ক্রীড়া কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হলে একদিকে যেমন ক্রীড়াবিদ তৈরি হবে, অন্যদিকে টিকিট বিক্রি, ব্যবস্থাপনা ও সংশ্লিষ্ট খাতগুলোতে বহু মানুষের কর্মসংস্থান হবে এবং সরকারের রাজস্ব বাড়বে। একইভাবে, থিয়েটার, সঙ্গীত (যেমন: লালনগীতি, পল্লিগীতি) এবং ব্যান্ড সংগীতকে বাণিজ্যিক রূপ দিয়ে আমরা একটি শক্তিশালী ‘ক্রিয়েটিভ ইকোনমি’ গড়ে তুলব। এর মাধ্যমে দেশের একটি ‘সফট পাওয়ার’-ও তৈরি হবে, যা বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে।

বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ: ব্যবসা করার পরিবেশ সহজ করতে আমরা দেশকে ‘ওভার-রেগুলেশন’ বা অতিরিক্ত নিয়ম কানুনের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করব। দুর্নীতি কমাতে সরকারি দপ্তরের সঙ্গে মানুষের সরাসরি সংস্পর্শ কমিয়ে এনে অনলাইন সেবা, যেমন—ঘরে বসে কোম্পানির রেজিস্ট্রেশন বা পাসপোর্ট প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হবে। বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি ‘ফিল গুড ফ্যাক্টর’ তৈরি করতে হবে, যেখানে তারা স্বাচ্ছন্দ্যে ও নিশ্চিন্তে বিনিয়োগ করতে পারবেন।

ইফতেখার মাহমুদ: বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে আপনাদের চিন্তাভাবনায় কি কোনো পরিবর্তন আসছে? বিশেষ করে পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে আপনাদের কৌশল কী হবে?

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: আমাদের বৈদেশিক নীতি কয়েকটি মৌলিক স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হবে: পারস্পরিক সম্মান, পারস্পরিক স্বার্থ, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা এবং কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন। আমাদের নীতি কোনো দেশকেন্দ্রিক হবে না, বরং এটি হবে বহুপাক্ষিক। যেখানে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ রক্ষা হবে, আমরা সেভাবেই সিদ্ধান্ত নেব।

যেকোনো বিদেশি বিনিয়োগ গ্রহণের ক্ষেত্রে আমরা কয়েকটি বিষয় নিশ্চিত করব: প্রকল্পের সঠিক মূল্যায়ন, বিনিয়োগ থেকে যথাযথ রিটার্ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং পরিবেশের সুরক্ষা। বর্তমানে কূটনীতি মূলত বাণিজ্যিক ও লেনদেনভিত্তিক। তাই আমাদেরকেও নিজেদের নীতিমালা সম্পর্কে স্বচ্ছ ও স্পষ্ট ধারণা রাখতে হবে।

ইফতেখার মাহমুদ: আপনাকে ধন্যবাদ।

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: ধন্যবাদ আপনাকে ও ঢাকা স্ট্রিমের পাঠকদেরও।

Ad 300x250

সম্পর্কিত