বিএনপির সঙ্গে বৃহত্তর জোটে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল আছে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ। আরপিও সংশোধনের গেজেট প্রকাশের পরে জোট নিয়ে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে সংশয় তৈরি হয়েছে। তবে জমিয়তের একাধিক শীর্ষ নেতা স্ট্রিমকে জানিয়েছেন, বিএনপির সঙ্গে জোট করার নীতিগত সিদ্ধান্তে তাঁরা অটল রয়েছেন।
বিএনপির সঙ্গে বেশ পুরনো সম্পর্ক জমিয়তের। সর্বশেষ দলটি ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি জোট থেকে চারটি আসনে ছাড় পেয়েছিল। পরবর্তীতে ২০২১ সালে মোদিবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে জমিয়তের নেতারা বেশ চাপে পড়েন। আওয়ামী লীগ সরকার দলটির অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাকে গ্রেপ্তার করে।
এরপর ঘোষণা দিয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে যায় দলটি। জোট ছাড়ার পর নেতাদের একে একে জামিন হয়। মামলা মোকাদ্দমা ও সরকারের প্রচণ্ড চাপের কারণে জমিয়ত জোটত্যাগ করেছে বলে ওই সময় জানিয়েছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। চব্বিশের ছাত্র আন্দোলনের পরে দেওবন্দিধারার দলগুলোকে নিয়ে স্বতন্ত্র জোটের আলোচনায় শামিল হয় জমিয়ত। কিন্তু দেওবন্দিধারার অন্যদলগুলোর সঙ্গে জামায়াতের ঘনিষ্ঠতা বাড়লে জমিয়ত আবারও বিএনপির বলয়ে যোগ দেয়।
গত সোমবার (৩ নভেম্বর) কিছু আসন ফাঁকা রেখে দলীয় প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ফাঁকা রাখা আসনগুলোতে যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গীদের সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হবে বলেও জানান তিনি।
তবে ওই দিন রাতেই আরপিও সংশোধনের গেজেট প্রকাশ হওয়ার পরে বিএনপির সঙ্গে জমিয়ত জোট করবে কিনা তা নিয়ে কর্মীদের মাঝে সংশয় তৈরি হয়। নির্বাচন সংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) অধ্যাদেশের গেজেট জারি হওয়ায় জোটবদ্ধ হয়ে এক দলের প্রতীকে অন্য দলের প্রার্থীর নির্বাচনের সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
এর পরে গতকাল মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) দলীয় প্রার্থীদের নিয়ে একটি বৈঠক করে জমিয়তের নির্বাচন উপকমিটি। বৈঠকের একাধিক সূত্র স্ট্রিমকে জানিয়েছে, ধানের শীষ প্রতীক না পেলে বিএনপির সঙ্গে জোট করে জমিয়ত খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না বলে জমিয়তের অধিকাংশ মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থী মতামত দিয়েছেন। এ কারণে তাঁরা দলের শীর্ষ নেতাদের কাছে এককভাবে নির্বাচনে যাওয়ার দাবি জানিয়েছেন। এতে সাংগঠনিকভাবে দলটি পরবর্তী নির্বাচনে ভালো করতে পারবে বলে মনে করেন তাঁরা।
তবে যেসব আসনে বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা হতে পারে সেসব আসনের প্রার্থীরা জোটগত নির্বাচনের পক্ষেই মতামত দিয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, বিএনপির সঙ্গে জোটে গেলে দলটির সাংগঠনিক শক্তি কাজে লাগিয়ে সহজে জয় পাওয়া সম্ভব। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে ক্ষমতা থেকে দূরে থাকায় এবং নির্যাতনের শিকার হওয়ায় আগামী নির্বাচনে কিছু নেতার সংসদে যাওয়া জরুরি বলে তাঁদের মত।
ওই বৈঠকে উপস্থিত থাকা দুজন শীর্ষ নেতা ও সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী স্ট্রিমকে জানিয়েছেন, বিএনপির সঙ্গে জোটে যাওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েই কাজ করছেন তাঁরা। মঙ্গলবারের বৈঠকে সব প্রার্থী স্পষ্টভাবে বলেছেন, দলের কেন্দ্রীয় খাস কমিটি ও নীতি নির্ধারণী ফোরামের যে কোনো সিদ্ধান্ত তাঁরা মেনে নেবেন। ফলে জোটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত এলে কারও আপত্তি থাকবে না।
৬ আসন নিয়ে গুঞ্জন
অতীতে বিএনপির জোট থেকে চার আসনে ছাড় পাওয়া জমিয়ত এবার ছয় আসন পেতে পারে এমন গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। দেওবন্দি ধারার দলটির আলোচিত ওই ৬ আসন ফাঁকা রেখে সম্প্রতি দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। জমিয়তের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, ওই ছয় আসনে বিএনপি জোটের সমর্থন পেতে যাচ্ছে তারা।
গত সোমবার (৩ নভেম্বর) বিএনপির পক্ষ থেকে ২৩৭ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। পরের দিন মঙ্গলবার ১ জনের মনোনয়ন স্থগিত করে দলটি। এই হিসেবে এখনো মনোনয়নের অপেক্ষায় রয়েছে ৬৪টি আসন। এর মধ্যে ছয়টি আসনে জমিয়তের হেভিওয়েট প্রার্থী রয়েছে।
জমিয়তের একজন যুগ্ম মহাসচিব স্ট্রিমকে জানিয়েছেন, দলটির দুটি অংশ মিলিয়ে মোট ছয়টি আসনে বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে সিলেটে দুটি আসন।
দলীয় সূত্র জানিয়েছে, জমিয়ত সভাপতি মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক সিলেট-৫ (জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট), মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী নীলফামারী-১ (ডোমার-ডিমলা), সহসভাপতি মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীব ব্রাহ্মণবাড়িয়া–২ (সরাইল-আশুগঞ্জ), যুগ্ম মহাসচিব মুফতি মনির হোসেন কাসেমী নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা), রশিদ বিন ওয়াক্কাস যশোর-৫ (মণিরামপুর) এবং অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলী সিলেট-৪ (জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ)—এই ছয় আসনে বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা হচ্ছে।
এই আসনগুলোর কোনোটিতেই বিএনপি কোনো প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেনি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া–২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) আসনে এতদিন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। তবে মির্জা ফখরুলের ঘোষিত মনোনয়ন তালিকায় তাঁর নাম নেই। এই আসনে নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে আসছেন জমিয়তের সহসভাপতি মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীব।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় স্ট্রিমকে তিনি বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে জোটের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে আমাদের। তবে আমরা অনেকগুলো আসন নিয়েই আলোচনা করছি। বিএনপির সঙ্গে অন্যান্য দলও জোট করছে। আমাদের কোন আসনগুলো দেওয়া হবে তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি।’ তবে চূড়ান্ত না হলেও খুব দ্রুতই বিএনপির সমর্থন পাওয়া জোটের প্রার্থীদের নাম জানা যাবে বলেও জানান তিনি।
যশোর-৫ (মণিরামপুর) আসনেও কোনো প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেনি বিএনপি। এই আসনে জমিয়তের আরেক অংশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা রশীদ বিন ওয়াক্কাস নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। জমিয়তের এই অংশটি নিবন্ধিত নয়। একারণে ধানের শীষ প্রতীকেই তাঁর নির্বাচনের সম্ভাবনা রয়েছে। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁর পিতা মুফতি ওয়াক্কাস বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় ঐক্যজোট থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এই আসন থেকে মুফতি ওয়াক্কাস ১৯৮৬, ১৯৮৮ ও ২০০১ সালে তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। প্রথম মেয়াদে পানি সম্পদ এবং দ্বিতীয় মেয়াদে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০২১ সালে মুফতি ওয়াক্কাস মারা গেছেন। এসব কারণে এই আসনটিতে তাঁর ছেলে রশীদ বিন ওয়াক্কাসের নির্বাচিত হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখছে জমিয়ত।
সিলেট-৪ নিয়ে অনিশ্চিয়তা
সিলেট-৪ আসনে জমিয়তের মনোনীত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলী আগেও দুইবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। ১৯৯৬ সালের উপ-নির্বাচনে এবং ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে এই আসনে জমিয়তের প্রার্থী হয়ে খেজুর গাছ প্রতীকেই নির্বাচন করেন তিনি। এই আসনে জমিয়ত তাঁকে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বি মনে করে। কিন্তু বিএনপি এই আসনটি এখনও জমিয়তের জন্য ছেড়ে দেয়নি।
জমিয়তের যুগ্ম মহাসচিব মুফতি মনির হোসাইন কাসেমী স্ট্রিমকে জানিয়েছেন, মোহাম্মদ আলীর আসনটি পেতে তাঁরা জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।