যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ৩০ অক্টোবর মার্কিন যুদ্ধ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন ‘অবিলম্বে’ পুনরায় পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু করতে। এর মাধ্যমে তিনি ১৯৯২ সালে শুরু হওয়া ৩৩ বছরের স্বেচ্ছা-নিষেধাজ্ঞার অবসান ঘটান। দক্ষিণ কোরিয়ায় তার সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক শুরু হওয়ার কয়েক মিনিট আগে ট্রাম্প এই আদেশ দেন।
তাইওয়ান ও বাণিজ্য যুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-চীন উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে নেওয়া এই পদক্ষেপ নতুন এক অস্ত্র প্রতিযোগিতার আশঙ্কা জাগিয়েছে। ট্রাম্প দাবি করেন, রাশিয়া ও চীন নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার আধুনিক করছে, অথচ যুক্তরাষ্ট্র নিষ্ক্রিয়। হোয়াইট হাউসের ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, ‘আমরাও অন্যদের সমানভাবে পরীক্ষা করব। এখন আবার শক্তিশালী হওয়ার সময়।’
ট্রাম্পের সমর্থকরা বলছেন যুক্তরাষ্ট্র মূলত ‘অবিস্ফোরক পরীক্ষা’—যেমন কম্পিউটার সিমুলেশন ও সীমিত প্রতিক্রিয়ার পরীক্ষা চালাবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে এটি পূর্ণাঙ্গ বিস্ফোরণ পরীক্ষার পথও খুলে দিতে পারে। এতে দশকের পর দশক ধরে গড়ে ওঠা অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে।
পারমাণবিক পরীক্ষার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো প্রদেশের আলামোগোর্ডোতে ২১ কিলোটনের একটি পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার মধ্য দিয়ে বিশ্বে পারমাণবিক যুগের সূচনা হয়। একই বছরের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে দুটি পারমাণবিক বোমা হামলা করে। এর ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে এবং জাপান আত্মসমর্পণ করে।
এরপর শুরু হয় বৈশ্বিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার যুগ। চার বছর পর ১৯৪৯ সালের আগস্টে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের প্রথম পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোকে হতবাক করে দেয়।
১৯৪৫ থেকে ১৯৯৬ সালের ‘সার্বিক পারমাণবিক পরীক্ষা-নিষিদ্ধ চুক্তি’ (সিটিবিটি) স্বাক্ষরের সময় পর্যন্ত প্রায় ২ হাজারের বেশি পারমাণবিক পরীক্ষা পরিচালিত হয়। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র চালায় ১ হাজার ৩২টি এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন চালায় ৭১৫টি পরীক্ষা। এ ছাড়া ব্রিটেন ৪৫টি, ফ্রান্স ২১০টি এবং চীন ৪৫টি পরীক্ষা চালায়।
সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯২ সালে, চীন ও ফ্রান্স ১৯৯৬ সালে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৯০ সালে পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্ত্রভাণ্ডারের উত্তরাধিকারী রাশিয়া এখনো কোনো পূর্ণাঙ্গ পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়নি। তবে সম্প্রতি দেশটি পারমাণবিক মহড়া পরিচালনা করেছে এবং একটি পারমাণবিক ওয়ারহেড পরীক্ষা করেছে।
সিটিবিটি স্বাক্ষরের পরও পারমাণবিক পরীক্ষা হয়েছে। ১৯৯৮ সালে ভারত ও পাকিস্তান প্রত্যেকে দুটি করে পরীক্ষা চালায়। দেশ দুটি মোট ৬টি করে পরীক্ষা চালায়।
১৯৯৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বে অন্তত ২ হাজার ৫৬টি পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটে, যার মাধ্যমে আটটি দেশের ২ হাজার ৪৭৬টি অস্ত্র পরীক্ষা করা হয়। ইসরায়েল বাদে সব দেশ প্রকাশ্যে পরীক্ষা চালিয়েছে।
পরবর্তীতে উত্তর কোরিয়া নবম দেশ হিসেবে যোগ দেয়। উত্তর কোরিয়া এখন পর্যন্ত মোট ছয়টি পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছে। এই পরীক্ষাগুলো হয় ২০০৬, ২০০৯, ২০১৩ এবং ২০১৬ সালে (দুবার)। ২০১৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সর্বশেষ পরীক্ষাটি চালায় উত্তর কোরিয়া।
সম্প্রতি মার্কিন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার একটি প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক পরীক্ষা কেন্দ্র পুনঃপ্রস্তুত করেছে এবং যেকোনো সময় সপ্তম পারমাণবিক পরীক্ষা চালাতে পারে।
সব পারমাণবিক পরীক্ষাগুলোর মধ্যে ৫২০টি ছিল বায়ুমণ্ডলীয় বিস্ফোরণ, যা ১৯৬৩ সালের আংশিক নিষেধাজ্ঞা চুক্তির পর নিষিদ্ধ হয়। বাকিগুলো করা হয় ভূগর্ভে, যাতে বিকিরণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। শুধু যুক্তরাষ্ট্রই অর্ধেকেরও বেশি বায়ুমণ্ডলীয় পরীক্ষা করেছে—১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে বছরে ৫০টিরও বেশি করে।
কেন পারমাণবিক পরীক্ষা বন্ধ হয়েছিল
পারমাণবিক পরীক্ষা বন্ধ হওয়ার ঘটনা হঠাৎ ঘটেনি; এটি ছিল নৈতিক ক্ষোভ, রাজনৈতিক বাস্তবতা ও জনমতের চাপের ফল। প্রাথমিক পরীক্ষাগুলো প্রকৃতি ও মানুষের জীবনে ভয়াবহ ক্ষতি এনেছিল। ১৯৫৪ সালের বিকিনি অ্যাটলের ‘ব্রাভো’ পরীক্ষায় বিকিরণে আক্রান্ত হয়েছিলেন মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের ২৩৬ জন মানুষ এবং একটি জাপানি মাছ ধরার নৌকার নাবিকেরা। এতে বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়। ১৯৮০-র দশকে নেভাদা ও সেমিপালাতিনস্ক এলাকার ক্যান্সার আক্রান্ত জনসংখ্যা আরও প্রতিবাদের জন্ম দেয়।
পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত প্রভাব: পাঁচ শতাধিক বায়ুমণ্ডলীয় বিস্ফোরণে বিকিরণজনিত আয়োডিন, স্ট্রনশিয়াম ও সিজিয়াম ছড়িয়ে পড়ে, যা থাইরয়েড ক্যান্সার ও জন্মগত ত্রুটির কারণ হয়। ভূগর্ভস্থ পরীক্ষাগুলোও নিরাপদ ছিল না; ফ্রান্সের মোরুরোয়া অঞ্চলে ১৯৯০-র দশকে ভূমিকম্প ঘটেছিল পারমাণবিক পরীক্ষার কারণে।
অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের মাইলফলক: ১৯৬৩ সালের আংশিক নিষিদ্ধ চুক্তি খোলা আকাশে পারমাণবিক পরীক্ষা বন্ধ করে। ১৯৯৬ সালের সিটিবিটি সব ধরনের পরীক্ষা স্থায়ীভাবে বন্ধের আহ্বান জানায়। যুক্তরাষ্ট্র এতে স্বাক্ষর করলেও এখনো অনুসমর্থন করেনি।
যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগ: ১৯৯২ সালে স্নায়ু যুদ্ধ-পরবর্তী বাজেট সংকট ও কংগ্রেসের চাপে প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ ৯ মাসের জন্য পরীক্ষা স্থগিত করেন। প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন তা অনির্দিষ্টকালের জন্য বাড়ান, পরীক্ষার পরিবর্তে কম্পিউটার সিমুলেশন ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন।
এটি ছিল রাশিয়া ও চীনকে চুক্তিতে যুক্ত করার জন্য চাপ প্রয়োগের কৌশল। যুক্তরাষ্ট্র এরপর পারমাণবিক অস্ত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করে স্টকপাইল স্টুয়ার্ডশিপ প্রোগ্রাম চালু করে, যেখানে লেজার-নির্ভর প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
২০২৫ সালে পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশসমূহ
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) ২০২৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, ৯টি দেশের কাছে প্রায় ১২ হাজার ১০০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড আছে। ১৯৮৬ সালে এই সংখ্যা ছিল প্রায় ৭০ হাজার।
রাশিয়ার কাছে ৪ হাজার ৩০৯টি, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ৩ হাজার ৭০০টি, চীনের কাছে ৬০০টি, ফ্রান্সের কাছে ২৯০টি, যুক্তরাজ্যের কাছে ২২৫টি, ভারতের কাছে ১৮০টি, পাকিস্তানের কাছে ১৭০টি, ইসরায়েলের কাছে ৯০টি এবং উত্তর কোরিয়ার কাছে প্রায় ৫০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড।
এই অস্ত্রভাণ্ডারে হিরোশিমা ধ্বংসের মতো ১ লাখের বেশি বিস্ফোরণ ঘটানোর ক্ষমতা রয়েছে—যা মানবসভ্যতা ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট।
এখন কেন পরীক্ষা পুনরায় শুরু?
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্দেশে যুক্তরাষ্ট্র আবারও পারমাণবিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ট্রাম্পের দাবি, রাশিয়া ও চীন নতুন প্রজন্মের অস্ত্র তৈরি করছে, তাই যুক্তরাষ্ট্রকেও নিজের সক্ষমতা যাচাই করতে হবে। ট্রাম্প আরও দাবি করেন, রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া ও পাকিস্তানের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো গোপনে এমন পরীক্ষা চালাচ্ছে। তাই তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ট্রাম্পের নির্দেশ বাস্তবায়িত হলে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৩৩ বছর পর আবার পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা চালাবে। এতে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে এবং অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ নীতি নিয়ে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে। সমালোচকরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত পারমাণবিক উত্তেজনা আরও বাড়াবে।
তবে সমর্থকদের যুক্তি হলো এই পরীক্ষা হবে সীমাবদ্ধ। কারণ সিমুলেশনে পূর্ণাঙ্গ বিস্ফোরণের প্রভাব পড়ে না। তাদের মতে, উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার সাম্প্রতিক পরীক্ষাগুলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমাচ্ছে। আর তা ছাড়া ক্ষুদ্র ও কৌশলগত অস্ত্রের কার্যকারিতা যাচাই প্রয়োজন। নেভাদা পরীক্ষাকেন্দ্র প্রস্তুত করতে ৫০ কোটি ডলার ও দুই বছর সময় লাগবে।
কিন্তু বিরোধীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সাবেক জ্বালানি মন্ত্রী আর্নেস্ট মোনিজ একে ‘অপ্রয়োজনীয় ও বিপজ্জনক’ বলেছেন। তারা সতর্ক করেছেন— এটি আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ভেঙে দিতে পারে। ভারত-পাকিস্তান বা ইরানের নতুন পরীক্ষা উৎসাহিত করতে পারে।
কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়াও দেখা দিতে পারে—জাপানসহ মিত্র দেশগুলো বিকিরণ ঝুঁকি নিয়ে উদ্বিগ্ন।
ট্রাম্প বলেন, ‘শক্তির মাধ্যমে শান্তি।’ তবে এনপিআর-এর বিশ্লেষক কেলসি স্নেল মন্তব্য করেন, ‘এমন পরীক্ষা যুক্তরাষ্ট্রকে নিরাপদ নয়, বরং আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে।’
এই পদক্ষেপ কেবল প্রযুক্তিগত নয়; এটি বিশ্বশক্তির প্রতিযোগিতায় এক নতুন চ্যালেঞ্জ। ২০২৫ সালে এক পিউ রিসার্চ জরিপে দেখা গেছে, ৮০ শতাংশ আমেরিকান এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেন।
ফলে এই পুনরারম্ভ বিশ্ব নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ প্রতিরোধনীতি—দুই ক্ষেত্রেই গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
চীন পাঁচ বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক ভান্ডারের সমকক্ষ হতে পারে—এমন দাবি ট্রাম্প কেন করছেন তা স্পষ্ট নয়। তবে এটা সত্য যে, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া ধীরে ধীরে তাদের পারমাণবিক অস্ত্রের পরিমাণ কমাচ্ছে, অন্যদিকে চীন তার ভান্ডার বাড়িয়ে চলেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক পরীক্ষা পুনরায় শুরু করার সিদ্ধান্তে নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, এই পদক্ষেপ বিশ্বকে একটি নতুন স্নায়ুযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
তাদের মতে, এর ফলে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের কয়েক দশকের প্রচেষ্টা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং প্রধান শক্তিগুলোর মধ্যে নতুন করে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এই পদক্ষেপগুলো শুধুমাত্র প্রধান শক্তিগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং ভারত, পাকিস্তান এবং উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলোকেও নতুন করে পারমাণবিক পরীক্ষা চালাতে উৎসাহিত করতে পারে। ফলে বিশ্বজুড়ে স্থিতিশীলতা আরও বিপন্ন হবে। এতে দেশগুলোর মধ্যে সৃষ্ট অবিশ্বাস ও উত্তেজনা বিশ্বকে একটি নতুন ও অনিশ্চিত স্নায়ুযুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
তথ্যসূত্র: ডেক্কান হেরাল্ড, রয়টার্স, আল-জাজিরা, নিউইয়র্ক টাইমস, এনবিসি নিউজ, এবিসি নিউজ, এপি