leadT1ad

মামদানির জয়ের পর ইতিহাসগড়া আরেক মুসলিম নেতা যে বার্তা দিলেন

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

পশ্চিমা বিশ্বের প্রথম মুসলিম রাষ্ট্রনেতা হামজা ইউসুফ। ছবি: সংগৃহীত।

ব্রিটেন থেকে ৮ ঘণ্টার ফ্লাইট শেষে বুধবার ওয়াশিংটন ডিসিতে পৌঁছান হামজা ইউসুফ। তিনি পশ্চিমা বিশ্বের প্রথম মুসলিম রাষ্ট্রনেতা। ওয়াশিংটনে মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যদের তিনি শুভেচ্ছা জানান, ‘জোহরান মুবারাক’ বলে। এটি ছিল ঈদের শুভেচ্ছার আদলে নিউইয়র্কের নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানির নাম যুক্ত করে বলা একটি রসিক মন্তব্য। উপস্থিত সবাই তার এই মন্তব্যে উচ্ছ্বসিত হয়ে করতালিতে সাড়া দেন।

তবে ইউসুফের যুক্তরাষ্ট্র সফর শুধুই মামদানির জয়ের আনন্দ ভাগাভাগি করার জন্য নয়। তিনি এসেছেন অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে, পরামর্শ দিতে এবং সম্পর্ক গড়তে। তিনি বলেন, ‘আপনারা পশ্চিমের অতিথি নন, আপনারাই পশ্চিমকে গড়ে তুলছেন।’ মামদানির ঐতিহাসিক বিজয়ের পরদিনই এই বার্তা দেন তিনি।

ইউসুফ সতর্ক করে বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য, হুমকি ও আনুগত্য যাচাইয়ের চাপ সত্ত্বেও মুসলিম আমেরিকানদের পিছু হটলে চলবে না। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী শহরের নতুন মুসলিম মেয়রকে এখন আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। নিজের অভিজ্ঞতার কথা টেনে তিনি বলেন, ‘আমি যখন স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার ছিলাম, তখন মৃত্যুর হুমকি এতটাই বাস্তব ছিল যে পরিবারসহ অতিরিক্ত নিরাপত্তা নিতে হয়েছিল।’

তার মতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ায় এ ধরনের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়েছে। তাই মুসলিমদের মধ্যে ‘সহযোগী নেটওয়ার্ক’ ও ‘পিয়ার মেন্টর’ কার্যক্রম গড়ে তোলা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যেই তিনি যুক্তরাষ্ট্র সফরে নেমেছেন—ওয়াশিংটন ডিসি থেকে শুরু করে শিকাগো, ফিনিক্স ও লস অ্যাঞ্জেলেস পর্যন্ত।

দুই দশকের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নিয়ে ইউসুফ এখন তরুণ মুসলিম প্রজন্মকে নেতৃত্বে আগ্রহী করে তুলতে চান। তিনি বলেন, ‘আমাদের অভিজ্ঞতা ও সংগ্রামের দাগ আছে, তাই যারা রাজনীতিতে আসতে চায়, তাদের পথনির্দেশনা দিতে পারি।’

আন্তঃআটলান্টিক সংযোগ গড়ে তোলা

হামজা ইউসুফ ২০২৩ সালের মার্চ থেকে ২০২৪ সালের মে পর্যন্ত স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার ও স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির (এসএনপি) নেতা ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বকালেই শুরু হয় গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা, যার বিরুদ্ধে তিনি সরব ছিলেন।

২০২৩ সালের ১০ অক্টোবর, হামাসের হামলার তিন দিন পর তিনি জানান, গাজায় অবস্থানরত তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ির জন্য তিনি দুশ্চিন্তায় আছেন। তাঁর স্ত্রী নাদিয়া এল-নাকলা ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত। প্রায় এক মাস পর তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ি গাজা থেকে স্কটল্যান্ডে ফিরে আসেন।

ইউসুফ জানান, তাঁরা এখন গভীর মানসিক আঘাতে ভুগছেন, আর পরিবারের মূল উদ্বেগ এখন গাজায় থাকা নাদিয়ার আত্মীয়া স্যালি ও তার সন্তানদের নিরাপত্তা।

২০২৩ সালের অক্টোবরের মধ্যভাগে এসএনপি ছিল যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো প্রথম দিকের রাজনৈতিক দলগুলোর একটি। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউসুফ যুক্তরাজ্য সরকারকে ইসরায়েলে অস্ত্র বিক্রি বন্ধের আহ্বান জানান, কারণ এতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন ঘটতে পারে।

২০২৪ সালের মে মাসে সম্ভাব্য অনাস্থা প্রস্তাবের আগে তিনি পদত্যাগ করেন। তবে তিনি এখনো গ্লাসগো-পোলক আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফিলিস্তিনের পক্ষে তার অবস্থান তুলে ধরছেন।

মার্চ মাসে হামজা ইউসুফ রাজনীতি পুরোপুরি ছেড়ে দিতে চান। এরপর তিনি মনোযোগ দিতে চান এমন প্রতিষ্ঠান গঠনে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মুসলিম নেতৃত্বকে বিনিয়োগ, শক্তিশালী ও সুরক্ষিত করবে।

তিনি বলেন, ‘আমরা এমন মানুষদের কথা বলছি, যারা রাজনীতিতে আসতে চান শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের কল্যাণের জন্য নয়, বরং পুরো সমাজের উন্নতির জন্য।’

ইউসুফ আরও বলেন, ‘আমাদের দায়িত্ব হলো এক আন্তঃআটলান্টিক জোট গড়ে তোলা, যা ইসলামভীতি ও মুসলমানবিরোধী ঘৃণার বিরুদ্ধে কাজ করবে।’

তিনি যুক্তি দেন, ‘যারা ইসলামভীতি ছড়াচ্ছে, তারা সীমান্ত পেরিয়ে তথ্য, বার্তা ও অর্থায়ন ভাগাভাগি করছে। যুক্তরাজ্যের ডানপন্থী উগ্রবাদী টমি রবিনসনের বক্তব্যে আমরা দেখি, তিনি ঠিক সেই কথাগুলোই বলছেন যা যুক্তরাষ্ট্রের উগ্র ডানপন্থীরা বলে। এমনকি তিনি ইলন মাস্কের মতো ব্যক্তির কাছ থেকে সাম্প্রতিক আইনি লড়াইয়ে অর্থসহায়তাও পেয়েছেন।’

হামজার ওপর ইলন মাস্কের আক্রমণ

প্রায় দেড় বছর আগে ইউসুফ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপের আহ্বান জানান। এরপর তিনি টেসলা প্রধান ইলন মাস্কের সমালোচনা করেন, কারণ মাস্ক যুক্তরাজ্যে জাতিগত দাঙ্গা নিয়ে মিথ্যা ও উস্কানিমূলক মন্তব্য করেছিলেন।

এর জবাবে মাস্ক তাঁকে ‘বর্ণবাদী’ ও ‘নিকৃষ্ট লোক’ বলে আক্রমণ করেন। এমনকি মাস্ক ইউসুফকে ‘সাদা মানুষকে ঘৃণা করে এমন অতিবর্ণবাদী’ বলেও মন্তব্য করেন। মাস্ক আরও বলেন, ‘আমি ওই লোকটাকে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি—চলো, মামলা করো।’

২০২৪ সালের আগস্টে মিডল ইস্ট আই-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউসুফ বলেন, সহিংস দাঙ্গার সেই সপ্তাহ তাঁকে গভীর অনিশ্চয়তায় ফেলেছিল। তিনি ভাবছিলেন, তাঁর পরিবার আদৌ যুক্তরাজ্যে নিরাপদ কি না।

তিনি বলেন, ‘প্রতিটি মুসলিম যার সঙ্গে আমি কথা বলেছি, সবাই এখন ভাবছে—এই দেশ কি তাদের জন্য নিরাপদ?’

ইউসুফ আরও বলেন, ‘আমার আর কোনো দেশ নেই স্কটল্যান্ড ছাড়া। আমি এখানে জন্মেছি, বড় হয়েছি, সারাজীবন এখানে থেকেছি। আমি যতটা স্কটিশ হওয়া সম্ভব, ঠিক ততটাই স্কটিশ। কিন্তু পরিবারের নিরাপত্তাই এখন আমার প্রথম চিন্তা।’

‘যদি সবাই চলে যায়, তবে লড়বে কে?’

সাম্প্রতিক ইসলামভীতি ও মুসলিমবিরোধী আক্রমণের বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে ইউসুফ বলেন, ‘যা যুক্তরাষ্ট্রে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাজ্যেও আমি ঠিক সেটাই দেখছি। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই কেউ না কেউ এসে বলে, তারা দোহা বা দুবাইয়ে চাকরি খুঁজছে।’

তবে তিনি যোগ করেন, ‘কিন্তু যদি আমরা সবাই চলে যাই, তাহলে এখানে লড়বে কে? আপনি যদি আপনার ক্ষেত্রের নেতা হন—আইন, গণমাধ্যম, সরকারি বা বেসরকারি খাতে—তবে আপনাকে টিকে থাকতে হবে, লড়তে হবে। জোহরান মামদানির বিজয় প্রমাণ করেছে, আমরা জিততে পারি।’

ইউসুফ বলেন, এটি কেবল মুসলমানদের বিষয় নয়, বরং গণতন্ত্র রক্ষার বিষয়। ‘আমরা যদি এখনই এই ঘৃণার মোকাবিলা না করি, এর ফল হবে ভয়াবহ। ১৯২০ ও ৩০-এর দশকে ইউরোপে যখন ইহুদিবিদ্বেষ অবারিতভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, তার ভয়াবহ পরিণতি আমরা দেখেছি। একই ভুল মুসলমানদের ক্ষেত্রেও হতে দেওয়া যাবে না।’

সূত্র: মিডল ইস্ট আই

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত