leadT1ad

নিউ ইয়র্কে জেন জি প্রজন্মের প্রথম ফার্স্ট লেডি, রাজনীতিতে নতুন যুগের সূচক

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

নিউইয়র্কের নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানির স্ত্রী রামা দুয়াজিকে তরুণ নেতৃত্ব ও ন্যায়ভিত্তিক রাজনীতির নতুন যুগের সূচক বলে মনে করা হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানির স্ত্রী রামা সাওয়াফ দুয়াজি ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ফার্স্ট লেডির পদে অধিষ্ঠিত হবেন। ২৮ বছর বয়সী এই সিরিয়ান-আমেরিকান শিল্পী, ইলাস্ট্রেটর ও সিরামিক নির্মাতা ১৯৯৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জেনারেশন জেড বা জেন জি প্রজন্মের এক নতুন, সচেতন ও সক্রিয় মুখপাত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন।

স্বামীর নির্বাচনী প্রচারে তিনি নীরব অথচ প্রভাবশালী ভূমিকা রাখেন। তাঁর শিল্পকর্মে আরব পরিচয়, নারী অধিকার ও ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতির বিষয়গুলো ফুটে ওঠে। এ কারণে গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। দুয়াজি তাঁর স্বামীর ডিজিটাল ভাবমূর্তি গঠনে ভূমিকা রাখলেও নিজের শিল্পী পরিচয় অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। তার ফার্স্ট লেডি হওয়াকে নিউ ইয়র্কে তরুণ নেতৃত্ব ও ন্যায়ভিত্তিক রাজনীতির নতুন যুগের সূচক বলে মনে করা হচ্ছে।

সিরিয়ান শিকড় থেকে নিউ ইয়র্কের শিল্পজীবন

রামা দুয়াজির জীবন জেন জি প্রজন্মের বহুসাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতিচ্ছবি। ১৯৯৭ সালের ৩০ জুন টেক্সাসের হিউস্টনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা দামেস্ক থেকে আসা একজন সফটওয়্যার ডেভেলপার এবং মা একজন চিকিৎসক। নয় বছর বয়সে পরিবারসহ তিনি দুবাইয়ে চলে যান। স্কুলজীবনে আঁকাআঁকির মাধ্যমে তিনি নিজের সৃষ্টিশীল আগ্রহকে লালন করতে থাকেন।

তিনি ভার্জিনিয়া কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটির স্কুল অব দ্য আর্টস থেকে যোগাযোগ শিল্পে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পড়াশোনা শুরু করেন দোহা (কাতার) ক্যাম্পাসে এবং শেষ করেন রিচমন্ড, ভার্জিনিয়ায়, ২০১৯ সালে। পরবর্তীতে বৈরুত, প্যারিস ও নিউ ইয়র্কের ক্যাটস্কিল পর্বতমালায় তিনি বিভিন্ন শিল্প-রেসিডেন্সিতে অংশ নেন।

২০২১ সালে তিনি নিউ ইয়র্কে চলে আসেন এবং স্কুল অব ভিজুয়াল আর্টস থেকে ইলাস্ট্রেশন বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন ২০২৪ সালে। তাঁর থিসিসে একত্রে খাবার ভাগাভাগির মতো সামাজিক কর্মকাণ্ডের প্রতীকী অর্থ তুলে ধরা হয়।

দুয়াজি তাঁর স্বামীর ডিজিটাল ভাবমূর্তি গঠনে ভূমিকা রাখলেও নিজের শিল্পী পরিচয় অক্ষুণ্ণ রেখেছেন।
দুয়াজি তাঁর স্বামীর ডিজিটাল ভাবমূর্তি গঠনে ভূমিকা রাখলেও নিজের শিল্পী পরিচয় অক্ষুণ্ণ রেখেছেন।

বর্তমানে তিনি ব্রুকলিনে বসবাস করেন। তাঁর কাজের ক্ষেত্র অ্যানিমেশন, ইলাস্ট্রেশন ও সিরামিক শিল্পজগৎ জুড়ে বিস্তৃত। নীল-সাদা হাতে আঁকা প্লেট, অ্যানিমেটেড প্রতিকৃতি এবং আরব সংস্কৃতি, নারীত্ব ও রাজনৈতিক প্রতিবাদের চিত্র তাঁর শিল্পে প্রাধান্য পায়।

দ্য নিউ ইয়র্কার, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, বিবিসি, অ্যাপল, স্পটিফাই, ভাইস এবং টেট মডার্নে তাঁর কাজ প্রকাশিত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি গাজা যুদ্ধ, ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ সংঘাত ও সুদানের গৃহযুদ্ধ নিয়ে কাজ করেছেন।

২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে ইয়ুং ম্যাগাজিনকে তিনি বলেন, ‘আমি তাঁদের জন্য কাজ করি, যারা আমার মতো বিষয় নিয়ে ভাবে। আমার কাজের চারপাশে যে আলোচনা তৈরি হয়, সেটি নিজে থেকেই একটি কমিউনিটিতে পরিণত হয়।’

ইনস্টাগ্রামে তাঁর অনুসারী সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৩৫ হাজার। ব্যক্তিগত জীবন ও সামাজিক আন্দোলনের বার্তা তিনি একই সঙ্গে শেয়ার করেন, যা তরুণ প্রজন্মের কাছে তাঁকে অনুপ্রেরণার প্রতীক করেছে।

ভালোবাসা ও রাজনৈতিক অংশীদারিত্ব

রামা দুয়াজি ২০২১ সালে ডেটিং অ্যাপ হিঞ্জে জোহরান কওমে মামদানির সঙ্গে পরিচিত হন। মামদানি তখন ৩০ বছর বয়সী ও নিউ ইয়র্ক রাজ্যের অ্যাসেম্বলি সদস্য। তাঁদের সম্পর্ক শুরু হয় অভিন্ন প্রগতিশীল মূল্যবোধের ভিত্তিতে।

২০২৪ সালের অক্টোবরে তাঁরা বাগদান সম্পন্ন করেন এবং ডিসেম্বর মাসে দুবাইয়ে ব্যক্তিগত নিকাহ অনুষ্ঠান করেন। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিউ ইয়র্ক সিটি হলে নাগরিক বিয়ে অনুষ্ঠান হয়। এরপর জুলাই মাসে উগান্ডায় সাংস্কৃতিকভাবে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়।

দম্পতি বর্তমানে কুইন্সের অ্যাস্টোরিয়ায় বসবাস করেন। তাঁরা ব্যক্তিগত জীবন অনেকটাই গোপন রেখেছেন। নির্বাচন প্রচারে দুয়াজিকে লক্ষ্য করে আক্রমণের সময় মামদানি প্রকাশ্যে বলেন, ‘রামা শুধু আমার স্ত্রী নন, তিনি এক অসাধারণ শিল্পী। আমার রাজনৈতিক মতের সমালোচনা করা যায়, কিন্তু আমার পরিবারকে নয়।’

নির্বাচনের রাতের ভাষণে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে ও জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তাঁর চেয়ে উপযুক্ত সঙ্গী আমি কল্পনা করতে পারি না।’ দুয়াজি সেই দিনের আগে ইনস্টাগ্রামে একসঙ্গে তোলা ছবির সঙ্গে লিখেছিলেন, ‘এর চেয়ে বেশি গর্বিত হতে পারি না।’

রামা দুয়াজি হয়ে উঠতে পারেন জেন জি-দের আইকন।
রামা দুয়াজি হয়ে উঠতে পারেন জেন জি-দের আইকন।

২০২৫ সালের মেয়র নির্বাচনে ভূমিকা: নীরব কিন্তু প্রভাবশালী শক্তি

রামা দুয়াজি আলোচনার কেন্দ্রে থাকতে চাননি। তিনি কোনো টেলিভিশন সাক্ষাৎকার বা যৌথ প্রচারণায় অংশ নেননি। তবুও নির্বাচনের পেছনের অন্যতম চালিকা শক্তি ছিলেন তিনি। বিশ্লেষকদের মতে, জোহরান মামদানির প্রচারণার ভিজ্যুয়াল রূপায়ণ—লোগো, রঙের ব্যবহার (হলুদ, কমলা, নীল) ও টাইপোগ্রাফি—সবই তাঁর সৃজনশীল ভাবনা থেকে এসেছে। সামাজিক মাধ্যমে এই চেহারা তরুণ ও বহুসাংস্কৃতিক ভোটারদের কাছে দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। এর ফলেই কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ ভোটার উপস্থিতি (৬৫ শতাংশ) ঘটে এবং মামদানির (৫০ শতাংশের বেশি ভোট) জয় নিশ্চিত করে।

বিজয় ঘোষণার মঞ্চে দুয়াজির উপস্থিতি ছিল অনন্য। তিনি পরেছিলেন সিরিয়ান ঐতিহ্য ও আধুনিক মিনিমালিস্ট ডিজাইনের মিশ্রণে তৈরি পোশাক। মেরি ক্লেয়ার এই পোশাককে ‘ক্ষমতার পোশাকের নতুন সংজ্ঞা’ বলে আখ্যা দেয়। অনেকে তাঁকে ‘মামদানির জয়ের অন্তর্নিহিত শক্তি’ বলে উল্লেখ করে। তাঁর ২ লাখ ৩৫ হাজার ইনস্টাগ্রাম অনুসারীদের মাধ্যমে তিনি অভিবাসী-অধ্যুষিত এলাকায় ভোটারদের সক্রিয় করতে সক্ষম হন।

জনসাধারণ ও গণমাধ্যমের প্রতিক্রিয়া: এক জেন জি আইকনের উত্থান

নির্বাচনের পর থেকেই দুয়াজিকে ঘিরে তৈরি হয়েছে প্রবল গণমাধ্যম আগ্রহ। ফোর্বস, গ্ল্যামার ইউকে, দ্য ইনডিপেনডেন্ট, এপি নিউজ, সিএনএন, টাইম ও দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস তাঁকে নিউ ইয়র্ক সিটির ‘প্রথম জেন জেড ফার্স্ট লেডি’ হিসেবে অভিহিত করেছে। বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যম তাঁর শিল্পীসত্তাকেই কেন্দ্রে রেখেছে, প্রচলিত প্রোটোকলভিত্তিক ভূমিকাকে নয়।

নিউজ উইক তাঁর ইনস্টাগ্রাম বিশ্লেষণ করে জানায়, ফিলিস্তিন, সিরামিক কর্মশালা ও দাম্পত্য জীবনের পোস্টগুলো তাঁকে ‘সহজ, চিন্তাশীল ও বাস্তবধর্মী’ এক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তুলে ধরেছে।

রামা দুয়াজির জীবন জেন জি প্রজন্মের বহুসাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতিচ্ছবি।
রামা দুয়াজির জীবন জেন জি প্রজন্মের বহুসাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতিচ্ছবি।

টিকটক ও এক্স-এ #GenZFirstLady হ্যাশট্যাগে তিনি ভাইরাল, যেখানে তাঁকে বলা হচ্ছে ‘গ্রেসি ম্যানশনের কুল আন্টি’। তাঁর সিরামিক শিল্পের নকশাও নেটজুড়ে আলোচনার বিষয় হয়েছে।

তবে সমালোচকরা মনে করেন, তাঁর কর্মীসুলভ শিল্পকর্ম ফার্স্ট লেডির প্রথাগত আনুষ্ঠানিক ভূমিকার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। অপরদিকে সমর্থকরা বলেন, তাঁর ডায়াসপোরা অভিজ্ঞতা নিউ ইয়র্কের সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে এবং শহরের আর্ট ও শরণার্থী সহায়তা কর্মসূচিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

নতুন দিগন্তে

ফার্স্ট লেডি হিসেবে রামা দুয়াজি এমন এক মঞ্চ পাচ্ছেন, যা ঐতিহ্যগতভাবে সমাজসেবামূলক কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। তাঁর পরিকল্পনার মধ্যে থাকতে পারে—শিল্পী রেসিডেন্সি প্রোগ্রাম, মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং তরুণ শিল্পীদের মেন্টরশিপ। নিজস্ব আন্তর্জাতিক সংযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি নিউ ইয়র্কে এক নতুন সাংস্কৃতিক পরিসর গড়ে তুলতে পারেন।

মামদানির প্রশাসনের বিপুল বাজেট তাঁকে শিল্প ও মানবিক সহায়তামূলক কর্মসূচিতে ভূমিকা রাখার সুযোগ দেবে। তিনি ফিলিস্তিন সংহতি, শিল্পে বিনিয়োগ এবং শরণার্থী সহায়তার মতো বিষয়গুলোতে নীতিগত স্তরে প্রভাব ফেলতে পারেন।

তবে যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ফেডারেল তহবিল নিয়ে রাজনৈতিক চাপ তৈরি হতে পারে, বিশেষত মামদানিকে ‘র‍্যাডিকাল’ আখ্যা দেওয়া হলে। তবুও, মাত্র ২৮ বছর বয়সে রামা দুয়াজি জেন জেড প্রজন্মের সৃজনশীলতা ও ন্যায়বোধের প্রতীক হয়ে উঠেছেন।

ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন এলি-র ভাষায়, ‘তিনি শুধু স্বামীর পাশে দাঁড়াননি—তিনি ভবিষ্যত আঁকছেন।’

অভিষেকের আগমুহূর্তে, তাঁর উপস্থিতি নিউ ইয়র্ক সিটির সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনকে পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত