অর্থনৈতিক লাভ ও নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য এমন কোনো কাজ নেই যা যুক্তরাষ্ট্র করে না। অতীতে সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব থেকে নতুন ভূমি জয় অথবা পরোক্ষ আধিপত্য বিস্তারই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। এখন তাতে যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক আধিপত্য। একুশ শতকের শতাব্দীর প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার আধিপত্যের নতুন ক্ষেত্রের সন্ধান করছে মহাকাশে।
মহাকাশ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কেবল বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ক্ষেত্র নয়। তাদের জন্য মহাকাশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব ও জাতীয় নিরাপত্তার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই ধারণার মূলে রয়েছে রাজনৈতিক আধিপত্যের চিন্তাভাবনা ও যুগান্তকারী প্রযুক্তিগত অগ্রগতি।
মহাকাশকে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করার পেছনে বেশ কিছু সুস্পষ্ট কারণ আছে। চলুন, কারণগুলো অনুসন্ধান করা যাক—
মহাকাশ গবেষণায় ঐতিহাসিক নেতৃত্ব
দীর্ঘদিন ধরেই মহাকাশ গবেষণা ও প্রযুক্তিতে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে ‘অ্যাপোলো মিশন’, ‘আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (আইএসএস) নির্মাণ’ ও মঙ্গল গ্রহের অনুসন্ধান পর্যন্ত মহাকাশ-ভিত্তিক বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাম। ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (নাসা) মতো সংস্থাগুলো শুধু বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহেই থেমে থাকেনি, বরং প্রযুক্তির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে মহাকাশের বাণিজ্যিকীকরণ ও সামরিক ব্যবহারের পথ খুলে দিয়েছে।
বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা
মহাকাশ বর্তমানে এক বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনার ক্ষেত্র। স্যাটেলাইট পরিষেবা, মহাকাশ পর্যটন, খনিজ উত্তোলন ও মহাকাশ-ভিত্তিক উৎপাদন—এই প্রতিটি ক্ষেত্রই ট্রিলিয়ন ডলারের শিল্পে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। স্পেস ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালেই বৈশ্বিক মহাকাশ অর্থনীতির আকার ৫০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে তা ১ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এই অর্থনৈতিক লাভের উল্লেখযোগ্য অংশ আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি খাত থেকে। স্পেসএক্স, ব্লু অরিজিন, নর্থরপ গ্রুমম্যান ও লকহিড মার্টিনের মতো সংস্থাগুলো নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছে এবং মহাকাশে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
স্পেস-এক্স স্যাটেলাইট। সংগৃহীত ছবিমহাকাশ অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চালিকা শক্তি হলো স্যাটেলাইট পরিষেবা। যোগাযোগ, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, জিপিএস নেভিগেশন, পৃথিবী পর্যবেক্ষণ ও দূরসংবেদন (রিমোট সেন্সিং)—এই সমস্ত ক্ষেত্রেই স্যাটেলাইটের ব্যবহার অপরিহার্য।
স্যাটেলাইট পরিষেবা প্রদানে স্পেসএক্স সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম। তাদের দেশীয় ‘স্টারলিংক’ বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ গ্রাহককে উচ্চ-গতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সরবরাহ করছে, বিশেষ করে দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে। স্টারলিংক শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে সেবা প্রদানে থেমে নেই, বরং জাহাজ, বিমান ও সামরিক বাহিনীকেও নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট পরিষেবা দিচ্ছে। এর ফলে, আফ্রিকার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে চলমান জাহাজ পর্যন্ত, সর্বত্রই ডিজিটাল যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছে।
অ্যামাজন কুইপার ও ওয়ানওয়েবের মতো সংস্থাগুলোও এই স্যাটেলাইট ইন্টারনেট বাজারে প্রবেশ করায় প্রতিযোগিতা বাড়ছে। ফলে গুণগত মান ও সাশ্রয়ী মূল্যে পরিষেবার সুযোগের পাশাপাশি তৈরি হয়েছে বিশাল আর্থিক লাভের ক্ষেত্র।
মহাকাশ পর্যটন একসময় কেবল কল্পবিজ্ঞানের অংশ হলেও এখন বাস্তবতার অনেক কাছাকাছি। ‘ভার্জিন গ্যালাকটিক’, ‘ব্লু অরিজিন’ ও ‘স্পেসএক্স’-এর মতো সংস্থাগুলো সাধারণ মানুষকে মহাকাশের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করছে।
প্রথম চন্দ্র অবতরণ মিশনের চন্দ্র মডিউল পাইলট, নাসার মহাকাশচারী অ্যাডউইন ই. অলড্রিন জুনিয়র, অ্যাপোলো ১১ মিশনের সময় মার্কিন পতাকার পাশে ছবির জন্য পোজ দিচ্ছেন। ছবি: নাসাযদিও বর্তমানে এই মহাকাশ ভ্রমণ অত্যধিক ব্যয়বহুল বিলাসিতা, তবে এই খাত ভবিষ্যতে আরও সাশ্রয়ী হয়ে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে। ভার্জিন গ্যালাকটিক ইতিমধ্যেই উপ-কক্ষপথীয় ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করেছে এবং ব্লু অরিজিনও তার নিউ শেপার্ড রকেটের মাধ্যমে পর্যটকদের মহাকাশে পাঠানোর পরীক্ষামূলক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। এই ধরনের পর্যটন শুধু মানুষের মহাকাশ ভ্রমণের স্বপ্ন পূরণ করছে না, বরং নতুন প্রকৌশল, নিরাপত্তা প্রোটোকল ও গ্রাউন্ড অবকাঠামো উন্নয়নেও বিনিয়োগ আকর্ষণ করছে।
মহাকাশের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী ও যুগান্তকারী অর্থনৈতিক সম্ভাবনাগুলোর একটি হলো গ্রহাণু এবং চাঁদে খনিজ উত্তোলন। বিজ্ঞানীদের ধারণা, মহাকাশে প্রচুর পরিমাণে প্ল্যাটিনাম, বিরল ধাতু (রেয়ার আর্থ মেটালস) বিদ্যমান।
ডিপ স্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ ও প্ল্যানেটারি রিসোর্সেস এই ধারণার ভিত্তিতে কাজ শুরু করেছিল। যদিও পরবর্তী সময়ে তারা তাদের কার্যক্রম পরিবর্তন করেছে বা বন্ধ করে দিয়েছে। তবে রিলেটিভিটি স্পেস সংস্থার এক প্রতিবেদন মতে, ভবিষ্যতে এই ধরনের কার্যক্রম বাণিজ্যিক ও প্রযুক্তিগতভাবে আরও কার্যকর হয়ে উঠলে এটি পৃথিবীর সম্পদের ওপর চাপ কমাতে এবং নতুন শিল্প তৈরি করতে সাহায্য করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সামরিক কৌশল ও জাতীয় নিরাপত্তা
বর্তমান সময়ে সামরিক কৌশল ও জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও মহাকাশ একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে স্যাটেলাইট যোগাযোগ, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, নেভিগেশন ও ক্ষেপণাস্ত্র সতর্কীকরণ ব্যবস্থার ভূমিকা অনস্বীকার্য। মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ মহাকাশকে ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, প্রতিযোগিতামূলক ও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র’ হিসেবে বিবেচনা করে।
২০১৯ সালে ইউএস স্পেস ফোর্স প্রতিষ্ঠা এই দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন। এর উদ্দেশ্য হলো মহাকাশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আধিপত্য বজায় রাখা এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো, যেমন চীন ও রাশিয়ার, ক্রমবর্ধমান মহাকাশ সক্ষমতার মোকাবিলা করা। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো মাইকেল ই ও হ্যানলনের মতে, ‘মহাকাশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি অপরিহার্য। ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতাকে সমর্থন করতে এর কোনো বিকল্প নেই।’
নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ইইউ-এর সঙ্গে মতবিরোধ
সম্প্রতি মহাকাশ নিয়ন্ত্রণের ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মধ্যে যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে, তা মহাকাশকে আমেরিকার নতুন দিগন্ত হিসেবে আরও স্পষ্ট করে তোলে। ইইউ একটি সমন্বিত মহাকাশ আইন প্রস্তাব করেছে, যার লক্ষ্য হলো স্যাটেলাইট পরিষেবা, কক্ষপথের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও মহাকাশের স্থায়িত্ব নিয়ন্ত্রণ করা। এক্ষেত্রে তাঁরা ইইউ-এর বাইরের দেশগুলোকেও এই আইনের আওতায় আনার প্রস্তাব করেছে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই প্রস্তাবকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি হলো, মহাকাশ স্বাধীনতা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্র, এখানে আমলাতন্ত্র বা অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগ নেই। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর দাবি করে, ইইউ-এর প্রস্তাব খণ্ডিত বৈশ্বিক বাজার তৈরি করবে ও উদ্ভাবনকে বাধাগ্রস্ত করবে। এই মতবিরোধ স্পষ্ট করে যে, মহাকাশের নেতৃত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র মহাকাশ অনুসন্ধান, বাণিজ্যিকীকরণ বা সামরিকীকরণের ক্ষমতা কাউকে দিতেই রাজি নয়।
চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের প্রতিক্রিয়া
মহাকাশ প্রযুক্তি ও মহাকাশ অর্থনীতিতে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘মহাকাশ’কে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে ভাবতে বাধ্য হয়েছে। তিয়ানগং মহাকাশ স্টেশন তৈরি করা ও দ্রুত মহাকাশে সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে চীন। এই প্রেক্ষাপটে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মহাকাশে তার প্রযুক্তিগত ও সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর। মহাকাশ নীতি বিশেষজ্ঞ, রন সিগেলের মতে, ‘চীন ও রাশিয়ার মতো প্রতিদ্বন্দ্বীদের উত্থানের মুখে মহাকাশে কৌশলগত শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখা এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।’
মহাকাশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কেবল স্বপ্নের ক্ষেত্র নয়, বরং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জাতীয় নিরাপত্তা এবং ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্যের এক অপরিহার্য উপাদান। কৌশলগত নেতৃত্ব বজায় রাখা, বাণিজ্যিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা ও নতুন দিগন্ত উন্মোচন করার মাধ্যমে আমেরিকা মহাকাশকে তার পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে গ্রহণ করেছে। এই যাত্রায় উদ্ভাবন ও স্বাধীনতার প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবিচল বিশ্বাসই দেশটিকে মহাকাশের নেতৃত্ব দিতে সাহায্য করবে বলে মনে করছেন স্বাধীন বিশেষজ্ঞরা।
তথ্যসূত্র: এশিয়া টাইমস, সিএনএন, নাসা এবং ওডিসি স্পেস রিসার্চ।