leadT1ad

তাকাইচি কেন জাপানের ‘লৌহমানবী’

ইয়ান বুরুমা
ইয়ান বুরুমা

প্রকাশ : ০৮ নভেম্বর ২০২৫, ১০: ৪৫
জাপানের প্রধানমন্ত্রী তাকাইচি সানায়ে। স্ট্রিম গ্রাফিক

জাপানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী তাকাইচি সানায়ে সম্পর্কে ধারণা করা হচ্ছে, তিনি পুরুষ নেতাদের চেয়েও কঠোর হতে পারেন। অভিবাসন ও প্রতিরক্ষা নীতিতে তার কড়া অবস্থানের কারণে এমন ধারণা প্রকট হচ্ছে। বলা হচ্ছে, তিনি হয়তো নারীদের জন্য সমতার নতুন সুযোগ তৈরি করবেন না। টোকিওতে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, জাপানের একজন নারী প্রধানমন্ত্রী পেতে এত সময় লাগল কেন? প্রশ্নটি কঠিন হলেও যুক্তিযুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রেও এখন পর্যন্ত কোনো নারী প্রেসিডেন্ট নেই, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বেও কখনো কোনো নারী আসেননি। এমনকি লিঙ্গ-সমতার ইস্যুতে উদারতার প্রতীক নেদারল্যান্ডসেও কখনো নারী প্রধানমন্ত্রী আসেননি।

এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসে কয়েকটি দেশে নারী রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান ছিলেন। কিন্তু তাদের প্রায় বেশিরভাগই কোনো খ্যাতনামা পুরুষ নেতার উত্তরাধিকার। যেমন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন জওহরলাল নেহরুর কন্যা। আর দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট পার্ক গিউন-হে ছিলেন সামরিক শাসক পার্ক চুং-হির মেয়ে। তবুও জাপানের লিঙ্গ বৈষম্যের চিত্র স্পষ্ট। ২০২৪ সালের গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্টে ১৪৬টি দেশের মধ্যে জাপানের অবস্থান ছিল ১১৮তম। তুলনায় দক্ষিণ কোরিয়া ছিল ৯৪তম এবং চীন ১০৬তম। জাপানে উচ্চশিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ পুরুষদের প্রায় সমান, কিন্তু নেতৃত্বের অবস্থানে তাদের উপস্থিতি ২০ শতাংশেরও কম। শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নারী শিক্ষার্থীর হার মাত্র ২০ শতাংশ।

এই প্রেক্ষাপটে তাকাইচি সানায়ের প্রধানমন্ত্রী হওয়া নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক অগ্রগতি। তবে প্রশ্ন রয়ে যায়, এটি কি জাপানি সমাজে নারীর অবস্থান বদলের সূচনা, নাকি কেবল একক অর্জন?

সামাজিক বিষয়ে তাকাইচির রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি আশাব্যঞ্জক নয়। তিনি বিবাহিত নারীদের নিজস্ব পারিবারিক নাম রাখার বিরোধিতা করেন এবং সমলিঙ্গের বিবাহেরও বিরোধী। অভিবাসীদের বিষয়ে তার মন্তব্যেও রয়েছে বৈষম্যের সুর, যদিও জাপানের অর্থনীতি এখন তাদের ওপরই নির্ভরশীল।

লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতৃত্বের প্রচারণায় তিনি দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদীদের খুশি করতে বিদেশি পর্যটকদের আচরণ নিয়ে নানা গুজব ছড়িয়েছিলেন। ক্ষমতায় এসে তিনি ১৯ সদস্যের মন্ত্রিসভায় মাত্র দুজন নারীকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন—যা আগের কিছু সরকারের চেয়েও কম।

তবু তাকাইচির রাজনৈতিক উত্থান প্রশংসনীয়। পুরুষ-প্রধান রক্ষণশীল দলে নেতৃত্ব দেওয়া সহজ কাজ নয়। আরও একটি দিক থেকে তিনি আলাদা—জাপানের অধিকাংশ শীর্ষ রাজনীতিকের মতো তিনি কোনো রাজনৈতিক পরিবার থেকে আসেননি। তিনি বড় হয়েছেন এক রক্ষণশীল গ্রামীণ পরিবারে, যেখানে তার মা বিশ্বাস করতেন মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু তাকাইচি নিজের শিক্ষার অধিকার আদায় করে নেন।

জাপানের প্রধানমন্ত্রী তাকাইচি সানায়ে। সংগৃহীত ছবি
জাপানের প্রধানমন্ত্রী তাকাইচি সানায়ে। সংগৃহীত ছবি

তাকাইচি ব্রিটেনের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারকে আদর্শ মানেন। থ্যাচারের মতো তিনিও নিজেকে ‘আয়রন লেডি’ হিসেবে উপস্থাপন করেন—পুরুষদের চেয়েও দৃঢ় ও কঠোর। তবে সেই কঠোরতার সঙ্গে তিনি নারীত্বের উপস্থিতিও বজায় রাখেন—সবসময় হাসিমুখে থাকেন এবং ব্যক্তিগতভাবে রক মিউজিক ও মোটরসাইকেলের ভক্ত।

সম্ভবত রক্ষণশীল দলগুলোর রাজনীতিতে নারীদের এগিয়ে যেতে হলে পুরুষ প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে বেশি দৃঢ় অবস্থান নিতে হয়। জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল হয়তো নীতিগতভাবে খুব কঠোর ছিলেন না, কিন্তু রাজনৈতিক কৌশলে পুরুষ প্রতিদ্বন্দ্বীদের ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। ক্ষমতায় এসে তিনি একধরনের মমতাপূর্ণ নেতৃত্ব প্রদর্শন করেন, যা জার্মান জনগণের আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠে।

তাকাইচি সানায়ের নেতৃত্বের ধরন মার্গারেট থ্যাচারের মতো নয়। তিনি অভিবাসন ও প্রতিরক্ষা বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেন। তাঁর রাজনৈতিক গুরু প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের মতোই, তাকাইচি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের যুদ্ধাপরাধ নিয়ে আলোচনায় আগ্রহী নন। তিনি ইয়াসুকুনি মন্দিরে উৎসর্গ পাঠাতেও কোনো সমস্যা দেখেন না—যেখানে যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত ব্যক্তিরাও সম্মানিত।

তিনি প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির ২ শতাংশে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছেন, যা আগামী মার্চের মধ্যেই বাস্তবায়ন করতে চান। এছাড়া, জাপানের শান্তিবাদী সংবিধান সংশোধনের প্রতিও তার আগ্রহ প্রবল। এই পদক্ষেপগুলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সন্তুষ্ট করেছে। ট্রাম্প প্রথম সাক্ষাতেই তাকাইচির প্রতি আগ্রহ দেখান এবং তাকে ‘একজন বিজয়ী’ বলে অভিহিত করেন। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের মধ্যে হঠাৎই ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে।’ তবে তাকাইচির এই দৃঢ় ও আগ্রাসী অবস্থান চীনের উদ্বেগ বাড়িয়েছে; তারা এখনো পর্যন্ত তার বিজয়ে আনুষ্ঠানিক অভিনন্দন জানায়নি।

থ্যাচারের মতোই তাকাইচি দলীয় উদারপন্থী নেতাদের দুর্বল বলে মনে করেন। তিনি প্রায়ই নিজের কিছু সহকর্মী, বিশেষ করে পূর্বসূরি ইশিবা শিগেরুকে—অক্ষম ও অদক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করেন। এই কৌশল তাকে একজন কার্যকর ও প্রভাবশালী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। এমনকি তিনি সংবিধান সংশোধন ও সেনাবাহিনীর ভূমিকা বাড়ানোর ক্ষেত্রে আবেকেও ছাড়িয়ে যেতে পারেন।

তবে অভিবাসন নীতিতে তাকাইচি আবের থেকে ভিন্ন। আবের সময়ে শিল্প, কৃষি ও নির্মাণ খাতে শ্রমিক সংকট দূর করতে ভিসা নীতিতে শিথিলতা আনা হয়েছিল। পাশাপাশি, রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য পর্যটন খাতও উৎসাহিত করা হয়। তাকাইচি এর বিপরীতে অভিবাসন বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। তবে এতে ডানপন্থী অভিবাসী বিদ্বেষী দলগুলোর প্রভাব কমে গেলে, তিনি হয়তো শান্তভাবে আবের নীতি কিছুটা অব্যাহত রাখতে পারবেন।

নারীদের অগ্রগতিতে তাকাইচির আগ্রহ খুব একটা দেখা যায় না। তবু তার নিজস্ব অর্জনই হয়তো জাপানি নারীদের জন্য সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা হয়ে উঠবে। যেমন ২০০৮ সালে বারাক ওবামা মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে আফ্রিকান-আমেরিকান সম্প্রদায় উচ্ছ্বাসে মেতে উঠেছিল, ‘আমার ছেলেও একদিন প্রেসিডেন্ট হতে পারবে!’, এই বিশ্বাসে। এখন জাপানের মায়েরা হয়তো একইভাবে ভাবতে পারেন—‘আমার মেয়েও একদিন প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে।’ সেটাই তাকাইচির সবচেয়ে বড় অবদান হতে পারে।

তাকাইচি সানায়ের ক্ষেত্রে সময়ই বলে দেবে—তিনি কি সত্যিই পরিবর্তনের প্রতীক হবেন, নাকি কেবল জাপানের দীর্ঘ পুরুষ-প্রধান রাজনীতির আরেকটি অধ্যায় হবেন।

(প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে প্রকাশিত ইয়ান বুরুমার লেখা থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ)

Ad 300x250

সম্পর্কিত