.png)

মাহবুব উল্লাহ

বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন কিছু দিন রয়েছে, যা নিছক একটি তারিখ নয়, বরং এক একটি মাইলফলক। এসব দিন আমাদের জাতীয় গতিপথকে নির্ণাায়কভাবে প্রভাবিত করেছে। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি শেখ মুজিব কর্তৃক বাকশাল ঘোষণা, একই বছরের ১৫ আগস্ট তাঁর সরকারের পতন ও সামরিক অভ্যুত্থান, খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতা গ্রহণ, ১৯৯০-এ এরশাদের পতন এবং অতি সম্প্রতি ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের মহা-গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী সরকারের বিদায়—এই প্রতিটি ঘটনাই একেকটি ঐতিহাসিক বাঁক। এই তাৎপর্যপূর্ণ দিবসগুলোর মধ্যে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর এক স্বতন্ত্র মহিমায় ভাস্বর, যা ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে পরিচিত। এই দিবসের ঐতিহাসিক তাৎপর্য এবং গুরুত্ব অপরিসীম।
বিপ্লব-পূর্ববর্তী সংকট ও অনিশ্চয়তা
৭ নভেম্বরের তাৎপর্য বুঝতে হলে এর পূর্ববর্তী ঘটনাবলি অনুধাবন করা জরুরি। ১৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর জাতি এক চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে। এর মধ্যেই ৩ নভেম্বর সংঘটিত হয় একটি পাল্টা অভ্যুত্থান, যার নেতৃত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। তাঁর ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা বা ‘চেইন অব কমান্ড’ ফিরিয়ে আনা। কিন্তু এই অভ্যুত্থান দেশকে আরও গভীর সংকটে নিমজ্জিত করে। ৩ থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে কার্যত কোনো সরকার ছিল না। এই সরকারবিহীন অবস্থায় জনমনে চরম দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা ও শঙ্কা দানা বাঁধে।
এই প্রেক্ষাপটেই ৪ নভেম্বর ঢাকায় একটি মিছিল বের হয়, যার আয়োজনে ছিল তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি। আওয়ামী লীগের সমর্থনে আয়োজিত এই মিছিলের উদ্দেশ্য ছিল শেখ মুজিবের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো। সেই মিছিলে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের মা ও ভাইয়ের অংশগ্রহণ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। সাধারণ মানুষ এবং সিপাহীদের মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান মূলত আবারও বাকশালী শাসন এবং ভারতীয় আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার একটি প্রচেষ্টা। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব যখন এক চরম সংকটের মুখে, তখনই সংঘটিত হয় এক ঐতিহাসিক বিপ্লব।
সিপাহী-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান
ছয় নভেম্বর মধ্যরাতের পর ঢাকা সেনানিবাসে সিপাহীরা অভ্যুত্থান ঘটায়। তাঁদের প্রথম কাজটি ছিল তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্ত করা, যাঁকে খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের পর বন্দী করা হয়েছিল। এরপর সিপাহীরা ট্যাঙ্ক নিয়ে রাজপথে নেমে আসে। তাঁদের স্লোগানে প্রকম্পিত হয় ঢাকার রাজপথ—‘নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবার’, ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’, ‘জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ’, ‘সিপাহী-জনতার বিপ্লব জিন্দাবাদ’। হাজার হাজার সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে এসে সিপাহীদের অভিনন্দিত করে, ট্যাঙ্কের নলে ফুলের মালা পরিয়ে দেয়। পুরো জাতি যেন এক বিশাল বিপদ থেকে মুক্তির আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। এই বিপ্লবের রাতেই খালেদ মোশাররফ ও তাঁর দুই সঙ্গী নিহত হন। ৭ই নভেম্বরের এই সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জাতি তার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থেকে মুক্তি পায়।
৭ নভেম্বরের প্রত্যক্ষ ফল ছিল জিয়াউর রহমানের ক্ষমতার কেন্দ্রে পুনঃপ্রতিষ্ঠা। তিনি সেনাপ্রধানের পদে পুনর্বহাল হন এবং ডেপুটি চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে থাকলেও ক্ষমতার ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠেন জিয়াউর রহমান। এই অভ্যুত্থান প্রমাণ করেছিল যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের স্বাধীনতার স্পৃহাকে সাময়িকভাবে দমিয়ে রাখা গেলেও অনন্তকালের জন্য দাবিয়ে রাখা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে এটি ছিল একদলীয় শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের জন্য জনগণের আকুতির এক বলিষ্ঠ প্রকাশ। সার্বিকভাবে ৭ নভেম্বর ছিল আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষার এক সম্মিলিত বহিঃপ্রকাশ বা ‘The assertion of our independence and sovereignty and our assertion for democracy’।
৭ নভেম্বরের চেতনা ও ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান
এই ঘটনা যদি না ঘটত, তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপথ ভিন্ন হতে পারত। সম্ভবত, তৎকালীন ভারত সমর্থিত সরকারই ক্ষমতায় থাকত এবং বাংলাদেশ একটি অর্ধ-সার্বভৌম দেশে পরিণত হতো, যা তার জাতীয় আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হতো। এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব আমরা পরবর্তীতেও দেখেছি। যেমন, আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা প্রায় সাড়ে পনেরো বছর ভারতের সমর্থনে ফ্যাসিবাদী শাসন চালিয়েছেন। কিন্তু সেই পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে। এর মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশের জনগণ আধিপত্যবাদ এবং স্বৈরাচারকে দীর্ঘকাল মেনে নেয় না। প্রয়োজনে বুকের রক্ত ঢেলে তারা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করে। ২৪-এর অভ্যুত্থানকে এক অর্থে পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বরের চেতনারই এক নতুন সংস্করণ বলা চলে।
রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ ও গণতন্ত্রের নবযাত্রা
৭ নভেম্বরের আরেকটি বড় অবদান হলো, এটি তৎকালীন রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ করেছিল। শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সব রাজনৈতিক দল, এমনকি আওয়ামী লীগকেও নিষিদ্ধ করে একটি রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি করেছিলেন। চারটি রাষ্ট্রীয় সংবাদপত্র ছাড়া বাকি সব গণমাধ্যম বন্ধ করে দিয়ে রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল বাকস্বাধীনতা। ৭ নভেম্বরের পর সেই বদ্ধ দুয়ার খুলে যায়। বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চা শুরু হয়, রাজনৈতিক দলগুলো পুনরুজ্জীবিত হয় এবং জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠিত হয়। এভাবেই ৭ নভেম্বর রাজনৈতিক ভ্যাকুয়াম বা শূন্যতা পূরণ করে দেশে রাজনীতির নবযাত্রা শুরু করে।
এই বিপ্লবের মধ্য দিয়েই ক্ষমতার কেন্দ্রে আসা জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন ক্ষণজন্মা রাষ্ট্রনায়ক। একজন সামরিক শাসক হয়েও তিনি দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছেন, নির্বাচন দিয়েছেন এবং জনগণের ভোটাধিকার, বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে সম্মান জানিয়েছেন। ভঙ্গুর অর্থনীতিকে তিনি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর উদ্যোগ নেন। তাঁর দুটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি এবং পোশাক শিল্পের গোড়াপত্তন। তাঁর গৃহীত নীতির ফলেই আজ বাংলাদেশ রেমিট্যান্স ও পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছে। এছাড়াও, ‘খাল কাটা কর্মসূচি’ এবং কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে তিনি দেশকে খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে এগিয়ে নিয়ে যান।
বর্তমান প্রজন্মের কাছে ৭ নভেম্বরের তাৎপর্য
আজকের তরুণ প্রজন্মের কাছে ৭ই নভেম্বরের তাৎপর্য অপরিসীম। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই প্রজন্ম প্রমাণ করেছে যে, তাদের মধ্যে প্রচণ্ড দেশপ্রেম রয়েছে। যে যুবসমাজকে নিয়ে আমরা একসময় হয়তো আশা হারিয়ে ফেলেছিলাম, তারাই দেশের সার্বভৌমত্ব ও মুক্তির জন্য রুখে দাঁড়িয়েছে। যেহেতু তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের শিখা প্রজ্জ্বলিত, তাই ৭ নভেম্বরের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয়তাবাদের চেতনা তাদের কাছে খুব সহজেই গ্রহণযোগ্য। আমাদের জাতীয় দায়িত্ব হলো, এই প্রজন্মের কাছে ৭ই নভেম্বরের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা এবং তাদের চেতনায় এই বিপ্লবের তাৎপর্যকে প্রোথিত করা।
অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদ

বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন কিছু দিন রয়েছে, যা নিছক একটি তারিখ নয়, বরং এক একটি মাইলফলক। এসব দিন আমাদের জাতীয় গতিপথকে নির্ণাায়কভাবে প্রভাবিত করেছে। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি শেখ মুজিব কর্তৃক বাকশাল ঘোষণা, একই বছরের ১৫ আগস্ট তাঁর সরকারের পতন ও সামরিক অভ্যুত্থান, খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতা গ্রহণ, ১৯৯০-এ এরশাদের পতন এবং অতি সম্প্রতি ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের মহা-গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী সরকারের বিদায়—এই প্রতিটি ঘটনাই একেকটি ঐতিহাসিক বাঁক। এই তাৎপর্যপূর্ণ দিবসগুলোর মধ্যে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর এক স্বতন্ত্র মহিমায় ভাস্বর, যা ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে পরিচিত। এই দিবসের ঐতিহাসিক তাৎপর্য এবং গুরুত্ব অপরিসীম।
বিপ্লব-পূর্ববর্তী সংকট ও অনিশ্চয়তা
৭ নভেম্বরের তাৎপর্য বুঝতে হলে এর পূর্ববর্তী ঘটনাবলি অনুধাবন করা জরুরি। ১৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর জাতি এক চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে। এর মধ্যেই ৩ নভেম্বর সংঘটিত হয় একটি পাল্টা অভ্যুত্থান, যার নেতৃত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। তাঁর ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা বা ‘চেইন অব কমান্ড’ ফিরিয়ে আনা। কিন্তু এই অভ্যুত্থান দেশকে আরও গভীর সংকটে নিমজ্জিত করে। ৩ থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে কার্যত কোনো সরকার ছিল না। এই সরকারবিহীন অবস্থায় জনমনে চরম দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা ও শঙ্কা দানা বাঁধে।
এই প্রেক্ষাপটেই ৪ নভেম্বর ঢাকায় একটি মিছিল বের হয়, যার আয়োজনে ছিল তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি। আওয়ামী লীগের সমর্থনে আয়োজিত এই মিছিলের উদ্দেশ্য ছিল শেখ মুজিবের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো। সেই মিছিলে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের মা ও ভাইয়ের অংশগ্রহণ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। সাধারণ মানুষ এবং সিপাহীদের মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান মূলত আবারও বাকশালী শাসন এবং ভারতীয় আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার একটি প্রচেষ্টা। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব যখন এক চরম সংকটের মুখে, তখনই সংঘটিত হয় এক ঐতিহাসিক বিপ্লব।
সিপাহী-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান
ছয় নভেম্বর মধ্যরাতের পর ঢাকা সেনানিবাসে সিপাহীরা অভ্যুত্থান ঘটায়। তাঁদের প্রথম কাজটি ছিল তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্ত করা, যাঁকে খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের পর বন্দী করা হয়েছিল। এরপর সিপাহীরা ট্যাঙ্ক নিয়ে রাজপথে নেমে আসে। তাঁদের স্লোগানে প্রকম্পিত হয় ঢাকার রাজপথ—‘নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবার’, ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’, ‘জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ’, ‘সিপাহী-জনতার বিপ্লব জিন্দাবাদ’। হাজার হাজার সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে এসে সিপাহীদের অভিনন্দিত করে, ট্যাঙ্কের নলে ফুলের মালা পরিয়ে দেয়। পুরো জাতি যেন এক বিশাল বিপদ থেকে মুক্তির আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। এই বিপ্লবের রাতেই খালেদ মোশাররফ ও তাঁর দুই সঙ্গী নিহত হন। ৭ই নভেম্বরের এই সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জাতি তার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থেকে মুক্তি পায়।
৭ নভেম্বরের প্রত্যক্ষ ফল ছিল জিয়াউর রহমানের ক্ষমতার কেন্দ্রে পুনঃপ্রতিষ্ঠা। তিনি সেনাপ্রধানের পদে পুনর্বহাল হন এবং ডেপুটি চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে থাকলেও ক্ষমতার ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠেন জিয়াউর রহমান। এই অভ্যুত্থান প্রমাণ করেছিল যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের স্বাধীনতার স্পৃহাকে সাময়িকভাবে দমিয়ে রাখা গেলেও অনন্তকালের জন্য দাবিয়ে রাখা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে এটি ছিল একদলীয় শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের জন্য জনগণের আকুতির এক বলিষ্ঠ প্রকাশ। সার্বিকভাবে ৭ নভেম্বর ছিল আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষার এক সম্মিলিত বহিঃপ্রকাশ বা ‘The assertion of our independence and sovereignty and our assertion for democracy’।
৭ নভেম্বরের চেতনা ও ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান
এই ঘটনা যদি না ঘটত, তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপথ ভিন্ন হতে পারত। সম্ভবত, তৎকালীন ভারত সমর্থিত সরকারই ক্ষমতায় থাকত এবং বাংলাদেশ একটি অর্ধ-সার্বভৌম দেশে পরিণত হতো, যা তার জাতীয় আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হতো। এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব আমরা পরবর্তীতেও দেখেছি। যেমন, আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা প্রায় সাড়ে পনেরো বছর ভারতের সমর্থনে ফ্যাসিবাদী শাসন চালিয়েছেন। কিন্তু সেই পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে। এর মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশের জনগণ আধিপত্যবাদ এবং স্বৈরাচারকে দীর্ঘকাল মেনে নেয় না। প্রয়োজনে বুকের রক্ত ঢেলে তারা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করে। ২৪-এর অভ্যুত্থানকে এক অর্থে পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বরের চেতনারই এক নতুন সংস্করণ বলা চলে।
রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ ও গণতন্ত্রের নবযাত্রা
৭ নভেম্বরের আরেকটি বড় অবদান হলো, এটি তৎকালীন রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ করেছিল। শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সব রাজনৈতিক দল, এমনকি আওয়ামী লীগকেও নিষিদ্ধ করে একটি রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি করেছিলেন। চারটি রাষ্ট্রীয় সংবাদপত্র ছাড়া বাকি সব গণমাধ্যম বন্ধ করে দিয়ে রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল বাকস্বাধীনতা। ৭ নভেম্বরের পর সেই বদ্ধ দুয়ার খুলে যায়। বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চা শুরু হয়, রাজনৈতিক দলগুলো পুনরুজ্জীবিত হয় এবং জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠিত হয়। এভাবেই ৭ নভেম্বর রাজনৈতিক ভ্যাকুয়াম বা শূন্যতা পূরণ করে দেশে রাজনীতির নবযাত্রা শুরু করে।
এই বিপ্লবের মধ্য দিয়েই ক্ষমতার কেন্দ্রে আসা জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন ক্ষণজন্মা রাষ্ট্রনায়ক। একজন সামরিক শাসক হয়েও তিনি দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছেন, নির্বাচন দিয়েছেন এবং জনগণের ভোটাধিকার, বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে সম্মান জানিয়েছেন। ভঙ্গুর অর্থনীতিকে তিনি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর উদ্যোগ নেন। তাঁর দুটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি এবং পোশাক শিল্পের গোড়াপত্তন। তাঁর গৃহীত নীতির ফলেই আজ বাংলাদেশ রেমিট্যান্স ও পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছে। এছাড়াও, ‘খাল কাটা কর্মসূচি’ এবং কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে তিনি দেশকে খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে এগিয়ে নিয়ে যান।
বর্তমান প্রজন্মের কাছে ৭ নভেম্বরের তাৎপর্য
আজকের তরুণ প্রজন্মের কাছে ৭ই নভেম্বরের তাৎপর্য অপরিসীম। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই প্রজন্ম প্রমাণ করেছে যে, তাদের মধ্যে প্রচণ্ড দেশপ্রেম রয়েছে। যে যুবসমাজকে নিয়ে আমরা একসময় হয়তো আশা হারিয়ে ফেলেছিলাম, তারাই দেশের সার্বভৌমত্ব ও মুক্তির জন্য রুখে দাঁড়িয়েছে। যেহেতু তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের শিখা প্রজ্জ্বলিত, তাই ৭ নভেম্বরের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয়তাবাদের চেতনা তাদের কাছে খুব সহজেই গ্রহণযোগ্য। আমাদের জাতীয় দায়িত্ব হলো, এই প্রজন্মের কাছে ৭ই নভেম্বরের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা এবং তাদের চেতনায় এই বিপ্লবের তাৎপর্যকে প্রোথিত করা।
অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদ
.png)

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তাৎপর্যপূর্ণ দিনগুলোর একটি হলো ৭ নভেম্বর ১৯৭৫। এই দিন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মোড়-ফেরানো দিন। দিনটিকে কেউ বলেন ‘সিপাহি-জনতার বিপ্লব’। বিরোধীরা বলেন, ‘রাষ্ট্রবিপর্যয়ের সূচনা’।
২ ঘণ্টা আগে
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান সংগঠক এবং নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। আন্দোলনের উত্তাল সময় পেরিয়ে রাজনৈতিক দল গঠনের পর বর্তমান বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন ঢাকা স্ট্রিমের সঙ্গে।
১৮ ঘণ্টা আগে
হেমন্তের রাত। হালকা হিম পড়ছে আকাশ থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার জাতীয় বার্ন ইউনিটের ১ নম্বর গেটের বিপরীতের ফুটপাতে পোটলা বিছিয়ে শুয়ে পড়লেন এক বৃদ্ধ। কিন্তু নিরপরাধ ঘুমের স্পর্শ পাওয়ার আগেই উদ্ধত লাঠির দেখা পেলেন তিনি। কয়েকজন তরুণ লাঠি হাতে বৃদ্ধকে শাসাতে লাগলেন সেখান থেকে উঠে যাওয়ার জন্য।
২ দিন আগে
নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে জোহরান মামদানির বিজয় আসলে প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে এক নৈতিক জবাব। যে প্রাতিষ্ঠানিকতা আমাদের এতদিন বলে এসেছে, ক্ষমতার কাছাকাছি থাকাই পূন্য ও টাকা থাকাই যোগ্যতা, সেই প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে মামদানির বিজয় যেন এক সাক্ষাৎ চপেটাঘাত।
২ দিন আগে