leadT1ad

৭ নভেম্বর: রাষ্ট্রচিন্তার পুনর্জাগরণ

সরদার ফরিদ আহমদ
সরদার ফরিদ আহমদ

স্ট্রিম গ্রাফিক

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তাৎপর্যপূর্ণ দিনগুলোর একটি হলো ৭ নভেম্বর ১৯৭৫। এই দিন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মোড়-ফেরানো দিন। দিনটিকে কেউ বলেন ‘সিপাহি-জনতার বিপ্লব’। বিরোধীরা বলেন, ‘রাষ্ট্রবিপর্যয়ের সূচনা’। কিন্তু রাজনৈতিক ইতিহাসের নিরপেক্ষ পাঠে এ দিনটি এমন এক মোড় পরিবর্তনের প্রতীক, যখন দেশের ক্ষমতা, রাষ্ট্রচিন্তা ও আদর্শিক দিকনির্দেশনায় একটি মৌলিক রূপান্তর ঘটে।

১৯৭৫ সালে একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা ‘বাকশাল’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। গণতান্ত্রিক বহুদলীয় রাজনীতির বদলে রাষ্ট্রের সব শক্তি একদলীয় নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। বন্ধ হয়ে যায় সংবাদপত্র, দমন করা হয় ভিন্নমত, প্রশাসন ও রাজনীতির পার্থক্য বিলীন হয়ে যায়।

জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্কে দেখা দেয় দূরত্ব। বিরোধিতা দমন, ভিন্নমতের অবকাশহীনতা এবং দলীয় আনুগত্য তখন রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হয়ে ওঠে। ৭৪-৭৫ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ও রাজনৈতিক নিপীড়নে জনমনে জমতে থাকে ক্ষোভ। স্বাধীনতার চেতনার সংকীর্ণ দলীয় ব্যাখ্যা এবং ভারতকেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতির নির্ভরতা অনেকের চোখে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে ভারতের আধিপত্য জেঁকে বসে।

এই পটভূমিতেই ১৫ আগস্ট ঘটে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড। রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে ৩ নভেম্বরে ঘটে জেলহত্যাকাণ্ড। সেই ধারাবাহিকতারই পরিণতি ৭ নভেম্বর ১৯৭৫—যে দিনটিকে অনেকেই বর্ণনা করেন ‘একদলীয় একনায়কতন্ত্র ও ভারতনির্ভর রাজনীতির অবসানের দিন’ হিসেবে।

সেদিন সেনাবাহিনীর সৈনিক ও কর্মকর্তাদের একাংশ বিদ্রোহে ফেটে পড়ে। আন্দোলনের মূল স্লোগান ছিল—‘সিপাহি-জনতার ঐক্য’। এই বিদ্রোহের মাধ্যমে মুক্তি পান তৎকালীন সেনা উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রীয় ভূমিকায় উঠে আসেন। যদিও ঘটনাটি সামরিক অভ্যুত্থান হিসেবে চিহ্নিত, তবে এর রাজনৈতিক ও আদর্শিক অভিঘাত ছিল বহুদূরগামী।

ভারতনির্ভর নীতিনির্ভরতা ও ফ্যাসিবাদী রাজনীতির প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র আবারও ফিরে আসে নিজের জনগণকেন্দ্রিক অক্ষের কাছে। এ যেন ১৯৭৫ সালের সেই বার্তাই নতুনভাবে প্রতিধ্বনিত হলো যে রাষ্ট্র একদলীয় শাসন, বৈদেশিক প্রভাব ও ভয়ভীতির ওপর দাঁড়ায়, তার ভিত্তি কখনো টেকে না।

৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশে শুরু হয় এক নতুন ধারা—বহুদলীয় রাজনীতির পুনরুদ্ধার, জাতীয়তাবাদের পুনর্নির্মাণ এবং পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা। জিয়াউর রহমান ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’-এর ধারণা সামনে এনে জাতির পরিচয়চেতনায় নতুন মাত্রা যোগ করেন। রাষ্ট্রের নীতি ভারতকেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্যসহ বহুমাত্রিক কূটনৈতিক সম্পর্কের দিকে ধাবিত হয়।

এ সময় একজন সেনাশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে যে একদলীয় নিয়ন্ত্রণ ও মতপ্রকাশের সংকীর্ণতা ভাঙা হয়, তা ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। সংবাদপত্র পুনরায় খুলে দেওয়া হয়, রাজনীতি আবার সংগঠিত হতে শুরু করে, এবং জনগণও রাষ্ট্রচিন্তার নতুন পরিসরে নিজেদের খুঁজে পায়।

ঐতিহাসিক বিচারে ৭ নভেম্বরের তাৎপর্য হলো এটি রাষ্ট্রীয় দিকনির্দেশনার নতুন সংজ্ঞা দেয়। স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ তার জাতীয় স্বাতন্ত্র্য, ভৌগোলিক কূটনীতি ও বহুমাত্রিক রাজনৈতিক বাস্তবতাকে পুনরায় মূল্যায়ন করে।

নভেম্বর তাই কেবল ক্ষমতা পরিবর্তনের দিন নয়, এটি ছিল রাষ্ট্রের মানসিক মুক্তির দিন—যখন বাংলাদেশ পুনরায় নিজস্ব পথ, নিজস্ব কণ্ঠ এবং নিজস্ব অবস্থান খুঁজে পেতে শুরু করে। জাতি ‘এক দলের এক নেতার এক মতের শাসন’ থেকে বেরিয়ে বহুমাত্রিক চিন্তা ও বিতর্কের রাজনীতিতে ফিরে আসে। ওই দিনই শুরু হয়েছিল একটি বাস্তববাদী, বহুমাত্রিক ও জনগণকেন্দ্রিক রাজনীতির যাত্রা।

আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর পরও ৭ নভেম্বর আমাদের মনে করিয়ে দেয়, রাষ্ট্র কখনো এক ব্যক্তির বা এক দলের একচেটিয়া সম্পত্তি হতে পারে না। স্বাধীনতা তখনই পূর্ণ হয় যখন মতের বহুমাত্রিকতা ও আত্মমর্যাদার স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়।

৭ নভেম্বর ১৯৭৫ তাই কেবল অতীতের অধ্যায় নয়, এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রচিন্তার পুনর্জন্মের দিন। যেদিন একনায়কতন্ত্রের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে একটি নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার সূচনা হয়েছিল।

৭ নভেম্বরের ইতিহাস বারবার ফিরে আসা একটি দিন, যা আমাদের শেখায়, রাষ্ট্রের শক্তি বন্দুক বা দল নয়, জনগণের বিশ্বাস ও অংশগ্রহণেই নিহিত।

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি: ৭ নভেম্বর থেকে ৫ আগস্ট ২০২৪

ইতিহাসের আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য হলো এটি প্রায়ই নিজেকে নতুন প্রেক্ষাপটে পুনরাবৃত্তি করে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সেই পুনরাবৃত্তির এক আধুনিক প্রতিফলন। যেমন ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর একদলীয় শাসন ও পরাধীনতার রাজনীতি ভেঙে দিয়েছিল, তেমনি ২০২৪ সালের আগস্টে জাতি আবারও মুক্তি খুঁজেছে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, ভয় ও বাহ্যিক আধিপত্যের বেড়াজাল থেকে।

দীর্ঘ দেড় দশকের বেশি সময় ধরে দেশে জমে উঠেছিল প্রশাসনিক কর্তৃত্ব, রাজনৈতিক দমন এবং মতপ্রকাশের সংকীর্ণতা। নির্বাচন, গণমাধ্যম, বিশ্ববিদ্যালয়—সবখানেই ভয়ের সংস্কৃতি ও দমনমূলক রাজনীতির বিস্তার ঘটে। এ অবস্থায় জনগণের নীরব ক্ষোভ রূপ নেয় আন্দোলনে, যা ৫ আগস্টের পরিণতিতে রূপ নেয় এক ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সূচনায়। সেই পরিবর্তন শুধু শাসনের পালাবদল নয়; এটি ছিল বাংলাদেশের জনগণের আত্মমর্যাদা পুনর্দাবির ঘোষণা।

ভারতনির্ভর নীতিনির্ভরতা ও ফ্যাসিবাদী রাজনীতির প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র আবারও ফিরে আসে নিজের জনগণকেন্দ্রিক অক্ষের কাছে। এ যেন ১৯৭৫ সালের সেই বার্তাই নতুনভাবে প্রতিধ্বনিত হলো যে রাষ্ট্র একদলীয় শাসন, বৈদেশিক প্রভাব ও ভয়ভীতির ওপর দাঁড়ায়, তার ভিত্তি কখনো টেকে না।

৭ নভেম্বর ১৯৭৫ ও ৫ আগস্ট ২০২৪-এই দুই দিন একে অপরের সময়-সেতু। প্রথমটি আমাদের দেখিয়েছিল একনায়কতন্ত্র থেকে মুক্তির পথ, দ্বিতীয়টি মনে করিয়ে দিয়েছে সেই মুক্তি রক্ষা করতে জনগণেরই হতে হবে চূড়ান্ত রক্ষাকবচ। ইতিহাসের এই পুনরাবৃত্তি তাই কেবল ঘটনাবলির সাদৃশ্য নয়, এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক গভীর পাঠ—রাষ্ট্রের প্রকৃত শক্তি বন্দুক বা ক্ষমতা নয়, জনগণের বিশ্বাস, আত্মমর্যাদা ও স্বাধীন ইচ্ছাতেই নিহিত।

লেখক: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন

Ad 300x250

সম্পর্কিত