.png)

জাভেদ হুসেন

রাশিয়াতে যখন ১৯১৭ সালে বিপ্লব ঘটল, তখন বহির্বিশ্ব তাৎক্ষণিকভাবে এর গভীরতা অনুধাবন করতে পারেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপক ডামাডোলের মধ্যে এটিকে অনেকেই আরেকটি সাধারণ ঘটনা হিসেবে গণ্য করেছিল। তবে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে মুক্তির সংগ্রামে লিপ্ত দরিদ্র দেশগুলোর কাছে এই বিপ্লব এক নতুন দৃষ্টিকোণ এনে দেয়। তাদের কাছে জাতীয় মুক্তির লড়াই ছিল প্রধান, কিন্তু শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির এই আওয়াজও ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে খেলাফত আন্দোলনের কর্মীরা সংযোগ গড়ে তোলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের সংগে। আর ভারত উপমহাদেশে মোহাম্মদ ইকবাল উদারভাবে স্বাগত জানান রুশ বিপ্লবকে।
রুশ বিপ্লবের গুরু কার্ল মার্ক্সকে নিয়ে ইকবালের আগ্রহ ছিল গভীর। তাঁর ফারসি কাব্যগ্রন্থ পায়ামে মাশরিক, মানে প্রাচ্যের বার্তায় তিনি মার্ক্সকে নিয়ে বলেন যে মার্ক্স, ‘নীস্ত পয়গাম্বার ও লাকিন দার বাঘাল দারাদ কিতাব’। অর্থাৎ, তিনি (মার্ক্স) নবী নন, তবে তাঁর হাতে রয়েছে এক কিতাব। এখানে ‘কিতাব’ বলতে মার্কসের বিখ্যাত গ্রন্থ ডাস ক্যাপিটালকে বোঝানো হয়েছে। ইকবাল মার্কসের দর্শনকে নবীর বাণীর মতো প্রভাবশালী ও কর্তৃত্বপূর্ণ হিসেবে স্বীকার করেন। তবে একে ঐশী মর্যাদা দিতে স্বীকার করেননি।
একই গ্রন্থে তিনি মার্ক্সকে নিয়ে বলছেন—ওহ কলিম-এ বে-তাজাল্লী, ওহ মসীহ বে-সলীব। অর্থাৎ, তিনি (মার্ক্স) ঐশী জ্যোতিহীন মুসা, ক্রুশবিহীন ঈসা।’ মার্ক্স হচ্ছেন মুসা (কলিমুল্লাহ) এবং ঈসা (মসীহ) নবীর মতো এক শক্তিশালী বিপ্লবী নেতা। কিন্তু তাঁর মধ্যে মুসার ঐশী জ্যোতি (তাজাল্লী) এবং ঈসার আত্মত্যাগের (ক্রুশ বা সলীবে) গভীর আধ্যাত্মিকতা নেই।
জাভিদনামা-য় বলছেন যে, সাহিবে সরমায়া আয নসলে খলিল ’য়ানে আঁ প্যায়গম্বর বেযিব্রিল। মানে, পুঁজি গ্রন্থের লেখক নিজেও নবী ইব্রাহিমের বংশধর। মনে করুন যে মার্ক্সের পিতৃপুরুষ ছিলেন ইহুদি—নসলে খলিল। এই মার্ক্সের হাতেও নবীদের মতোই কেতাব, মানে ডাস ক্যাপিটাল আছে। তবে তা বেযিব্রিল। এই গ্রন্থ জিব্রাইলের মাধ্যমে আসেনি। তা মার্ক্সের নিজের লেখা। মানে মার্ক্স এমন এক পয়গম্বর যার কাছে জিব্রাইল আসেনি।
বালে যিব্রিল সংকলনে ইকবাল আরও কৌতুহলোদ্দিপক কথা বলছেন মার্ক্সকে নিয়ে। ও ইয়াহুদী গার, ওহ রুহ-এ মাযদাক কা বরুজ—সেই ইহুদি (মার্ক্স) হলো মাযদাকের আত্মার পুনরাবির্ভাব। ইকবাল মার্ক্সকে প্রাচীন পারস্যের সাম্যবাদী নেতা মাযদাক-এর নতুন রূপ হিসেবে দেখেন। মাযদাক ব্যাক্তি সম্পত্তি বিলোপ, নারী-পুরুষের সমতার প্রচার করতেন। ইরানের সম্রাট এই মাযদাক ও তাঁর ত্রিশ হাজার অনুসারীকে জীবন্ত মাটিচাপা দিয়ে হত্যা করেছিলেন ন্যায়পরায়ন বলে খ্যাত পারস্য সম্রাট খুসরু।
একই গ্রন্থে ইকবাল বলছেন—হার ক্বাবা হোনে কো হ্যায় উসকে জুনূন সে তার তার। তাঁর (মার্ক্সের) উন্মাদনা বা আক্রোশে প্রতিটি পোশাক (পোশাক/ধর্ম/সংস্কৃতি) ছিন্নভিন্ন হতে চলেছে। মার্ক্সের বিপ্লব সমাজের প্রতিটি প্রচলিত রীতিনীতি, ধর্মীয় কাঠামো এবং ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে দেবে বলে ইকবাল মনে করেছেন।
মার্ক্স হচ্ছেন ইকবালের কাছে—দীন-এ আঁন পয়গাম্বরে হক না-শেনাস (পায়াম-ই মাশরিক)। মার্ক্সবাদ হচ্ছে এমন এক নবীর ধর্ম যে খোদার সত্যকে মানে না।
তবে কার্ল মার্ক্সকে নিয়ে ইকবালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন পাওয়া যায় তাঁর বালে যিব্রিল গ্রন্থের ‘কার্ল মার্ক্স কি আওয়ায’ (কার্ল মার্কসের কণ্ঠস্বর) কবিতায়:
জ্ঞান ও প্রজ্ঞার এই যে ছলনা, এই যে তর্ক-বিতর্কের প্রদর্শনী,
পুরাতন চিন্তাভাবনার এই প্রদর্শনী এখন দুনিয়া আর সহ্য করতে রাজি নয়।
ওহে অর্থনীতির পণ্ডিত (পুঁজিবাদী চিন্তাবিদ), তোমার কিতাবে আর আছেটা কী?
কেবল বক্র রেখাগুলোর প্রদর্শনী, অসুস্থ ও বাঁকা পথের প্রদর্শনী (অর্থনৈতিক জটিলতা)।
পশ্চিমা বিশ্বের মন্দিরগুলোতে, গির্জাগুলোতে, বিদ্যালয়গুলোতে,
লোভের রক্তপাতকে চাপা দেয় এই চতুর বুদ্ধির প্রদর্শনী।
(য়ে ইলম-ও-হিকমত কি মোহরা-বাজী, য়ে বেহেস ও তকরার কি নুমায়েশ
নেহিঁ হ্যায় দুনিয়া কো আব গাওয়ারা পুরানে আফকার কি নুমায়েশ
তেরি কিতাবোঁ মেঁ এয় হাকিমে মাআশ রাখা হি ক্য়াইয়া হ্যায় আখির
খুতূত-এ-খমদার কি নুমায়েশ, মরিয-ও-কাজদার কি নুমায়েশ
জেহান-এ-মাগরিব কে বুতকাদোঁ মেঁ, কলিসাওঁ মেঁ মদরিসোঁ মেঁ
হাওয়াছ কি খূনরেযিয়াঁ ছুপাতি হ্যায় অকল-এ-আইয়ার কি নুমায়েশ)
এই কবিতায় ইকবাল সরাসরি মার্ক্সের সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করে কথা বলেছেন। ইকবাল বলছেন, পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি যে প্রচলিত জ্ঞান ও তর্ক-বিতর্ক তা এখন আর শোষিত মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এই পুরনো চিন্তাধারা বিপ্লবের মুখে অকেজো। ইকবাল পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদদের সমালোচনা করে জানাচ্ছেন যে তাদের তত্ত্বে কেবলই জটিল, অসুস্থ এবং বক্র রেখা, মানে, গ্রাফ, চার্ট ও সূত্র রয়েছে। কিন্তু সেখানে মানুষের সমস্যা সমাধানের সরল পথ নেই। পশ্চিমের প্রতিষ্ঠান—গির্জা, স্কুল, ইত্যাদিতে যে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রদর্শনী করা হয়, তা আসলে লোভ ও শোষণের আসল রক্তপাতকে আড়াল করার জন্য চতুর বুদ্ধির একটি কৌশল মাত্র।
এ তো গেল মার্ক্সকে নিয়ে ইকবালের মুল্যায়ন। কিন্তু যখন ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মার্ক্সের ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া শুরু করল, তখন ইকবালের প্রতিক্রিয়া ছিল আরও চমৎকার। তাঁর দৃষ্টিতে, অক্টোবর বিপ্লব শুধু রাশিয়ার ঘটনা ছিল না। এটি ছিল পশ্চিমা পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মানবাত্মার এক অনিবার্য বিদ্রোহ। ইকবাল এই বিশাল রাজনৈতিক উত্থানকে কেবল রাজনৈতিকভাবে দেখেননি, বরং এটিকে ঐশী বিচারের একটি ঘোষণা হিসেবে উপলব্ধি করেছিলেন।
তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘বাল-এ-যিব্রিল’-এ তিনটি কবিতা এই বিপ্লবী চেতনার মূল দলিল। এই তিনটি কবিতা লেখা হয়েছে ঐশ্বরিক সংলাপ-এর মাধ্যমে।
প্রথম কবিতার নাম ‘খোদার দরবারে লেনিনের অভিযোগ’—লেনিন খুদা কে হুযুর মে। এ এক ব্যতিক্রমী নাটকীয় সংলাপ। বলশেভিক বিপ্লবের নেতা ভ্লাদিমির লেনিনকে এখানে সরাসরি খোদার দরবারে হাজির করা হয়েছে।
লেনিন কোনো কৈফিয়ত দিতে আসেননি, এসেছেন খোদার বানানো পৃথিবীর অবিচার নিয়ে কঠোর অভিযোগ জানাতে। তিনি অভিযোগ করেন যে, খোদার পৃথিবী আজ শোষণে জর্জরিত। তাঁর মূল বক্তব্য ছিল: ধর্মীয় কাঠামো ব্যবহার করে ধনীরা কীভাবে গরিবদের শোষণ করছে এবং তাদের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে।
কবিতার মূল কয়েকটি অংশ দেখা যাক।
মজুরের প্রতিটি মুহূর্ত বড়ই তেতো, বড়ই কঠিন (হ্যায় তলখ বহুত বান্দা-এ-মজদূর কে অওকাত। এটি কবিতার সবচেয়ে বিখ্যাত লাইন। লেনিনের জবানিতে ইকবাল শোষিত শ্রমিকের সীমাহীন দুঃখ-কষ্ট তুলে ধরেছেন।
আর কতদিন শ্রমিক পুরষ্কার ও আনন্দ থেকে বঞ্চিত থাকবে? (কাব তক রহে গাহ মাহরূম-এ-সাওয়াব-ও-লজ্জাত)। শ্রমিক তার কাজের ফল ও জীবনের আনন্দ থেকে কবে মুক্তি পাবে।
গীর্জার যাজকদের এই ব্যবস্থা কেবলই এক ধরনের জুয়াখেলা মানে শোষণ (য়ে এহলে-ই-কলিসা কা নিযাম-ই-কে-হ্যায় ফকত জুয়া) ।
এই ধর্মস্থানের গুরুরা! আত্মা এদের মাধ্যমেই অপবিত্র হয়েছে (য়ে পীর-ই-হরম! রুহ্ ইসি সে হি হুয়ি হ্যায় নাপাক)। অর্থাৎ, শুধু পশ্চিমা ধর্ম নয়, মুসলিম ধর্মীয় নেতাদেরও সমালোচনা করা হয়েছে, যারা শোষণের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন না।
আমিও (লেনিন) সর্বদা সেই আকাশ-ছোঁয়া চিন্তাভাবনা নিয়েই ব্যস্ত থাকি (ম্যায় ভি ইসি ফিক্র-এ-ফলক-গির মেঁ রেহতা হুঁ মুদাম)। লেনিন তাঁর বিপ্লবের মাধ্যমে যে চিন্তা ও দর্শন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন, তা প্রচলিত ব্যবস্থার চেয়ে অনেক বড় ও গভীর।
শেষে লেনিন স্বীকার করছেন যে, এই আত্মসত্তা (খুদি)-র স্থায়িত্বের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না (যি-ইস্তেহকাম-এ-খুদি কা ন করিসাঁ আমদাম)। অর্থাৎ, লেনিন খোদার কাছে স্বীকার করছেন যে তিনি খুদি বা আধ্যাত্মিক সত্তার ধারণাকে তাঁর বিপ্লবে স্থান দেননি।
দ্বিতীয় কবিতা ‘ফারিস্তোঁ কা গীত’ (ফেরেশতাদের গান) একটি সংক্ষিপ্ত বিরতি। এতে ফেরেশতারা পৃথিবীতে চলমান ভণ্ডামি, দুর্নীতি ও শোষণের কথা গানে গানে স্বীকার করে নেন। এই গান লেনিনের অভিযোগের সত্যতাকে যেন নিশ্চিত করে যে একটি বিপ্লবী পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা ছিল। ফেরেশতারা বলছেন:
হে প্রভু! পৃথিবীর এই সব মজলিস থেকে ক্লান্ত হয়ে গেছি (দুনিয়া কি মহফিলোঁ সে উক্তা গয়া হুঁ ইয়া রব!)
এই সব সমাবেশে কী-ই বা আনন্দ আছে যেখানে আয়োজন কেবলই লোভের! (লুতফ ইঁন আনজুমানোঁ মেঁ জাহাঁ সায-ও-সামান ফকত হাওয়াস কা)।
দুর্বল নিস্তেজ হয়ে গেছে এই মজলিসের সব সুর তাল (রনজুর ও-মুযমাহিল হ্যায় মহফিল কা যের-ও-বাম সব)।
পানোৎসাহী সাকি পালিয়ে বেড়াচ্ছে, আর সব ঠোঁটই খালি পেয়ালার মতো (সাকিয়ে গুরেজ পা হ্যায়, খালী হ্যায় জাম হার লব)।
আমাকে অনুমতি দাও যে এই বিষ পান করে মরে যাই (য়া মুঝকো ইয্ন দে কে ম্যাঁ য়ে যেহর পিকে মর জাউঁ।
অথবা আমাকে সেই মদিরা দাও যা আমাকে (ঐশী) মত্ততা এনে দিতে পারে (য়া মুঝকো ও শারাব দে জো মাস্তি মেঁ লা দেতি হ্যায়)।
চূড়ান্ত পর্ব আসে তৃতীয় কবিতায়, ‘ফরমান-এ-খোদা ফারিশতোঁ সে’ (ফেরেশতাদের প্রতি খোদার নির্দেশ)। লেনিন ও ফেরেশতাদের সাক্ষ্যের পর এবার আসে খোদার নিজের চরম বিপ্লবী ঘোষণা।
ওঠো! আমার দুনিয়ার গরীবদের ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলো (উঠো!মেরি দুনিয়া কে গরিবোঁ কো জাগা দো)।
ধনী ও অভিজাতদের প্রাসাদের দরজা ও দেওয়াল কাঁপিয়ে দাও (কূখ-এ উমারা কে দর-ও-দিওয়ার হিলা দো)।
নিশ্চিত বিশ্বাসের আগুন দিয়ে গোলামদের রক্ত গরম করে দাও (গারমাও গুলামোঁ কা লহু সোয-এ য়াকিঁ সে)।
যে খেতের ফসল থেকে কৃষকের রুজি জোটে না (জিস খেত সে দেহকাঁ কো মায়াস্সার নেহিঁ রোযি)।
সেই খেতের প্রতিটি গমের শীষকে পুড়িয়ে দাও (উস খেত কে হার খোশা-এ-গন্দুম কো জ্বালা দো)।
জনগণের সার্বভৌমত্বের যুগ আসছে (সুলতানিয়ে জুমহূর কা আতা হ্যায় যামানা)
যে প্রাচীন চিহ্নই তোমাদের চোখে পড়ুক, তা মুছে ফেলো (জো নক্শ-এ-কুহন তুম কো নজর আয়ে মিটা দো)
খোদা ঘুমন্ত শোষিত জনগণকে বিপ্লবে অংশ নেওয়ার জন্য জাগ্রত করার সরাসরি ঐশী নির্দেশ দিচ্ছেন। পুরাতন শোষক শ্রেণির ক্ষমতা ও স্থিতিশীলতাকে চূর্ণ করে দেওয়ার আহ্বান। দাসত্বে অভ্যস্ত শ্রমিকদের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা ও দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি করে তাদের আন্দোলনে নামার উৎসাহ যোগানোর নির্দেশ দিচ্ছেন তিনি। পুঁজিবাদী ভূমি-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্রোহের ডাক—যা মার্ক্সের ধারণার সঙ্গে মেলে। একনায়কতন্ত্র বা রাজতন্ত্রের অবসানের পর সাধারণ মানুষের শাসন বা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিচ্ছেন স্রষ্টা। দিচ্ছেন পুরনো ব্যবস্থা, শোষণ ও অবিচারের সমস্ত প্রতীককে মুছে ফেলার নির্দেশ।
মুহম্মদ ইকবাল রুশ বিপ্লব আর মার্ক্সের যে মূল্যায়ন করেছেন তা ছিল মূলত ডাস ক্যাপিটাল এবং রুশ বিপ্লবের তাৎক্ষণিক দর্শন-এর ওপর ভিত্তি করে। এই বিশ্লেষণেই ইকবাল মার্ক্সকে ‘ঐশী জ্যোতিহীন মুসা’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
তবে, যদি ইকবাল কার্ল মার্কসের প্রাথমিক লেখাগুলো, ১৮৪৪ সালের পাণ্ডুলিপি পড়ার সুযোগ পেতেন, তাহলে তাঁর মূল্যায়নে এক গভীর দার্শনিক সংযোগ তৈরি হতে পারত।
মার্ক্সের প্রাথমিক লেখায় পুঁজিবাদ কীভাবে শ্রমিককে তার কাজ, পণ্য এবং নিজের মানবিক সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়, তার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ইকবাল এই বিচ্ছিন্নতাকে তাঁর কেন্দ্রীয় দর্শন 'খুদি' (আত্মসত্তা)-এর ধ্বংস হিসেবেই দেখতেন। এক্ষেত্রে মার্ক্স ও ইকবাল দুজনেই পুঁজিবাদকে মানব-সত্তার প্রতি চরম আঘাত হিসেবে দেখতেন, যা তাঁদের মধ্যে একটি শক্তিশালী দার্শনিক সমান্তরাল তৈরি করতে পারত।
মার্ক্সের প্রাথমিক লেখাগুলোর মানবিক ও নৈতিক ভিত্তি ইকবালের কাছে স্পষ্ট করতে পারত যে মার্ক্সের আসল উদ্দেশ্য নিছক ‘পেটের সাম্য’ ছিল না। বরং মার্ক্সের উদ্দেশ্য ছিল মানুষের হারিয়ে যাওয়া মানবিক সারবস্তুটিকে পুনরুদ্ধার করা। ইকবাল হয়তো দেখতেন যে মার্ক্স এবং তাঁর নিজের লক্ষ্য একই—বিচ্ছিন্নতা দূর করে মানবিক সত্তার মুক্তি। যদিও তাঁদের পদ্ধতি ভিন্ন।
ইকবাল হয়তো তখন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতেন যে মার্ক্স বিপ্লবকে বস্তু দিয়ে শুরু করলেও, এর উদ্দেশ্য ছিল মানুষের আত্মিক মুক্তি। এইভাবেই ইকবাল মার্ক্সকে কেবল অর্থনৈতিক সমালোচক হিসেবে নয়, বরং মানবতা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে তাঁর সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক সহযাত্রী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারতেন।
জাভেদ হুসেন: লেখক ও অনুবাদক

রাশিয়াতে যখন ১৯১৭ সালে বিপ্লব ঘটল, তখন বহির্বিশ্ব তাৎক্ষণিকভাবে এর গভীরতা অনুধাবন করতে পারেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপক ডামাডোলের মধ্যে এটিকে অনেকেই আরেকটি সাধারণ ঘটনা হিসেবে গণ্য করেছিল। তবে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে মুক্তির সংগ্রামে লিপ্ত দরিদ্র দেশগুলোর কাছে এই বিপ্লব এক নতুন দৃষ্টিকোণ এনে দেয়। তাদের কাছে জাতীয় মুক্তির লড়াই ছিল প্রধান, কিন্তু শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির এই আওয়াজও ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে খেলাফত আন্দোলনের কর্মীরা সংযোগ গড়ে তোলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের সংগে। আর ভারত উপমহাদেশে মোহাম্মদ ইকবাল উদারভাবে স্বাগত জানান রুশ বিপ্লবকে।
রুশ বিপ্লবের গুরু কার্ল মার্ক্সকে নিয়ে ইকবালের আগ্রহ ছিল গভীর। তাঁর ফারসি কাব্যগ্রন্থ পায়ামে মাশরিক, মানে প্রাচ্যের বার্তায় তিনি মার্ক্সকে নিয়ে বলেন যে মার্ক্স, ‘নীস্ত পয়গাম্বার ও লাকিন দার বাঘাল দারাদ কিতাব’। অর্থাৎ, তিনি (মার্ক্স) নবী নন, তবে তাঁর হাতে রয়েছে এক কিতাব। এখানে ‘কিতাব’ বলতে মার্কসের বিখ্যাত গ্রন্থ ডাস ক্যাপিটালকে বোঝানো হয়েছে। ইকবাল মার্কসের দর্শনকে নবীর বাণীর মতো প্রভাবশালী ও কর্তৃত্বপূর্ণ হিসেবে স্বীকার করেন। তবে একে ঐশী মর্যাদা দিতে স্বীকার করেননি।
একই গ্রন্থে তিনি মার্ক্সকে নিয়ে বলছেন—ওহ কলিম-এ বে-তাজাল্লী, ওহ মসীহ বে-সলীব। অর্থাৎ, তিনি (মার্ক্স) ঐশী জ্যোতিহীন মুসা, ক্রুশবিহীন ঈসা।’ মার্ক্স হচ্ছেন মুসা (কলিমুল্লাহ) এবং ঈসা (মসীহ) নবীর মতো এক শক্তিশালী বিপ্লবী নেতা। কিন্তু তাঁর মধ্যে মুসার ঐশী জ্যোতি (তাজাল্লী) এবং ঈসার আত্মত্যাগের (ক্রুশ বা সলীবে) গভীর আধ্যাত্মিকতা নেই।
জাভিদনামা-য় বলছেন যে, সাহিবে সরমায়া আয নসলে খলিল ’য়ানে আঁ প্যায়গম্বর বেযিব্রিল। মানে, পুঁজি গ্রন্থের লেখক নিজেও নবী ইব্রাহিমের বংশধর। মনে করুন যে মার্ক্সের পিতৃপুরুষ ছিলেন ইহুদি—নসলে খলিল। এই মার্ক্সের হাতেও নবীদের মতোই কেতাব, মানে ডাস ক্যাপিটাল আছে। তবে তা বেযিব্রিল। এই গ্রন্থ জিব্রাইলের মাধ্যমে আসেনি। তা মার্ক্সের নিজের লেখা। মানে মার্ক্স এমন এক পয়গম্বর যার কাছে জিব্রাইল আসেনি।
বালে যিব্রিল সংকলনে ইকবাল আরও কৌতুহলোদ্দিপক কথা বলছেন মার্ক্সকে নিয়ে। ও ইয়াহুদী গার, ওহ রুহ-এ মাযদাক কা বরুজ—সেই ইহুদি (মার্ক্স) হলো মাযদাকের আত্মার পুনরাবির্ভাব। ইকবাল মার্ক্সকে প্রাচীন পারস্যের সাম্যবাদী নেতা মাযদাক-এর নতুন রূপ হিসেবে দেখেন। মাযদাক ব্যাক্তি সম্পত্তি বিলোপ, নারী-পুরুষের সমতার প্রচার করতেন। ইরানের সম্রাট এই মাযদাক ও তাঁর ত্রিশ হাজার অনুসারীকে জীবন্ত মাটিচাপা দিয়ে হত্যা করেছিলেন ন্যায়পরায়ন বলে খ্যাত পারস্য সম্রাট খুসরু।
একই গ্রন্থে ইকবাল বলছেন—হার ক্বাবা হোনে কো হ্যায় উসকে জুনূন সে তার তার। তাঁর (মার্ক্সের) উন্মাদনা বা আক্রোশে প্রতিটি পোশাক (পোশাক/ধর্ম/সংস্কৃতি) ছিন্নভিন্ন হতে চলেছে। মার্ক্সের বিপ্লব সমাজের প্রতিটি প্রচলিত রীতিনীতি, ধর্মীয় কাঠামো এবং ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে দেবে বলে ইকবাল মনে করেছেন।
মার্ক্স হচ্ছেন ইকবালের কাছে—দীন-এ আঁন পয়গাম্বরে হক না-শেনাস (পায়াম-ই মাশরিক)। মার্ক্সবাদ হচ্ছে এমন এক নবীর ধর্ম যে খোদার সত্যকে মানে না।
তবে কার্ল মার্ক্সকে নিয়ে ইকবালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন পাওয়া যায় তাঁর বালে যিব্রিল গ্রন্থের ‘কার্ল মার্ক্স কি আওয়ায’ (কার্ল মার্কসের কণ্ঠস্বর) কবিতায়:
জ্ঞান ও প্রজ্ঞার এই যে ছলনা, এই যে তর্ক-বিতর্কের প্রদর্শনী,
পুরাতন চিন্তাভাবনার এই প্রদর্শনী এখন দুনিয়া আর সহ্য করতে রাজি নয়।
ওহে অর্থনীতির পণ্ডিত (পুঁজিবাদী চিন্তাবিদ), তোমার কিতাবে আর আছেটা কী?
কেবল বক্র রেখাগুলোর প্রদর্শনী, অসুস্থ ও বাঁকা পথের প্রদর্শনী (অর্থনৈতিক জটিলতা)।
পশ্চিমা বিশ্বের মন্দিরগুলোতে, গির্জাগুলোতে, বিদ্যালয়গুলোতে,
লোভের রক্তপাতকে চাপা দেয় এই চতুর বুদ্ধির প্রদর্শনী।
(য়ে ইলম-ও-হিকমত কি মোহরা-বাজী, য়ে বেহেস ও তকরার কি নুমায়েশ
নেহিঁ হ্যায় দুনিয়া কো আব গাওয়ারা পুরানে আফকার কি নুমায়েশ
তেরি কিতাবোঁ মেঁ এয় হাকিমে মাআশ রাখা হি ক্য়াইয়া হ্যায় আখির
খুতূত-এ-খমদার কি নুমায়েশ, মরিয-ও-কাজদার কি নুমায়েশ
জেহান-এ-মাগরিব কে বুতকাদোঁ মেঁ, কলিসাওঁ মেঁ মদরিসোঁ মেঁ
হাওয়াছ কি খূনরেযিয়াঁ ছুপাতি হ্যায় অকল-এ-আইয়ার কি নুমায়েশ)
এই কবিতায় ইকবাল সরাসরি মার্ক্সের সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করে কথা বলেছেন। ইকবাল বলছেন, পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি যে প্রচলিত জ্ঞান ও তর্ক-বিতর্ক তা এখন আর শোষিত মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এই পুরনো চিন্তাধারা বিপ্লবের মুখে অকেজো। ইকবাল পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদদের সমালোচনা করে জানাচ্ছেন যে তাদের তত্ত্বে কেবলই জটিল, অসুস্থ এবং বক্র রেখা, মানে, গ্রাফ, চার্ট ও সূত্র রয়েছে। কিন্তু সেখানে মানুষের সমস্যা সমাধানের সরল পথ নেই। পশ্চিমের প্রতিষ্ঠান—গির্জা, স্কুল, ইত্যাদিতে যে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রদর্শনী করা হয়, তা আসলে লোভ ও শোষণের আসল রক্তপাতকে আড়াল করার জন্য চতুর বুদ্ধির একটি কৌশল মাত্র।
এ তো গেল মার্ক্সকে নিয়ে ইকবালের মুল্যায়ন। কিন্তু যখন ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মার্ক্সের ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া শুরু করল, তখন ইকবালের প্রতিক্রিয়া ছিল আরও চমৎকার। তাঁর দৃষ্টিতে, অক্টোবর বিপ্লব শুধু রাশিয়ার ঘটনা ছিল না। এটি ছিল পশ্চিমা পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মানবাত্মার এক অনিবার্য বিদ্রোহ। ইকবাল এই বিশাল রাজনৈতিক উত্থানকে কেবল রাজনৈতিকভাবে দেখেননি, বরং এটিকে ঐশী বিচারের একটি ঘোষণা হিসেবে উপলব্ধি করেছিলেন।
তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘বাল-এ-যিব্রিল’-এ তিনটি কবিতা এই বিপ্লবী চেতনার মূল দলিল। এই তিনটি কবিতা লেখা হয়েছে ঐশ্বরিক সংলাপ-এর মাধ্যমে।
প্রথম কবিতার নাম ‘খোদার দরবারে লেনিনের অভিযোগ’—লেনিন খুদা কে হুযুর মে। এ এক ব্যতিক্রমী নাটকীয় সংলাপ। বলশেভিক বিপ্লবের নেতা ভ্লাদিমির লেনিনকে এখানে সরাসরি খোদার দরবারে হাজির করা হয়েছে।
লেনিন কোনো কৈফিয়ত দিতে আসেননি, এসেছেন খোদার বানানো পৃথিবীর অবিচার নিয়ে কঠোর অভিযোগ জানাতে। তিনি অভিযোগ করেন যে, খোদার পৃথিবী আজ শোষণে জর্জরিত। তাঁর মূল বক্তব্য ছিল: ধর্মীয় কাঠামো ব্যবহার করে ধনীরা কীভাবে গরিবদের শোষণ করছে এবং তাদের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে।
কবিতার মূল কয়েকটি অংশ দেখা যাক।
মজুরের প্রতিটি মুহূর্ত বড়ই তেতো, বড়ই কঠিন (হ্যায় তলখ বহুত বান্দা-এ-মজদূর কে অওকাত। এটি কবিতার সবচেয়ে বিখ্যাত লাইন। লেনিনের জবানিতে ইকবাল শোষিত শ্রমিকের সীমাহীন দুঃখ-কষ্ট তুলে ধরেছেন।
আর কতদিন শ্রমিক পুরষ্কার ও আনন্দ থেকে বঞ্চিত থাকবে? (কাব তক রহে গাহ মাহরূম-এ-সাওয়াব-ও-লজ্জাত)। শ্রমিক তার কাজের ফল ও জীবনের আনন্দ থেকে কবে মুক্তি পাবে।
গীর্জার যাজকদের এই ব্যবস্থা কেবলই এক ধরনের জুয়াখেলা মানে শোষণ (য়ে এহলে-ই-কলিসা কা নিযাম-ই-কে-হ্যায় ফকত জুয়া) ।
এই ধর্মস্থানের গুরুরা! আত্মা এদের মাধ্যমেই অপবিত্র হয়েছে (য়ে পীর-ই-হরম! রুহ্ ইসি সে হি হুয়ি হ্যায় নাপাক)। অর্থাৎ, শুধু পশ্চিমা ধর্ম নয়, মুসলিম ধর্মীয় নেতাদেরও সমালোচনা করা হয়েছে, যারা শোষণের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন না।
আমিও (লেনিন) সর্বদা সেই আকাশ-ছোঁয়া চিন্তাভাবনা নিয়েই ব্যস্ত থাকি (ম্যায় ভি ইসি ফিক্র-এ-ফলক-গির মেঁ রেহতা হুঁ মুদাম)। লেনিন তাঁর বিপ্লবের মাধ্যমে যে চিন্তা ও দর্শন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন, তা প্রচলিত ব্যবস্থার চেয়ে অনেক বড় ও গভীর।
শেষে লেনিন স্বীকার করছেন যে, এই আত্মসত্তা (খুদি)-র স্থায়িত্বের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না (যি-ইস্তেহকাম-এ-খুদি কা ন করিসাঁ আমদাম)। অর্থাৎ, লেনিন খোদার কাছে স্বীকার করছেন যে তিনি খুদি বা আধ্যাত্মিক সত্তার ধারণাকে তাঁর বিপ্লবে স্থান দেননি।
দ্বিতীয় কবিতা ‘ফারিস্তোঁ কা গীত’ (ফেরেশতাদের গান) একটি সংক্ষিপ্ত বিরতি। এতে ফেরেশতারা পৃথিবীতে চলমান ভণ্ডামি, দুর্নীতি ও শোষণের কথা গানে গানে স্বীকার করে নেন। এই গান লেনিনের অভিযোগের সত্যতাকে যেন নিশ্চিত করে যে একটি বিপ্লবী পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা ছিল। ফেরেশতারা বলছেন:
হে প্রভু! পৃথিবীর এই সব মজলিস থেকে ক্লান্ত হয়ে গেছি (দুনিয়া কি মহফিলোঁ সে উক্তা গয়া হুঁ ইয়া রব!)
এই সব সমাবেশে কী-ই বা আনন্দ আছে যেখানে আয়োজন কেবলই লোভের! (লুতফ ইঁন আনজুমানোঁ মেঁ জাহাঁ সায-ও-সামান ফকত হাওয়াস কা)।
দুর্বল নিস্তেজ হয়ে গেছে এই মজলিসের সব সুর তাল (রনজুর ও-মুযমাহিল হ্যায় মহফিল কা যের-ও-বাম সব)।
পানোৎসাহী সাকি পালিয়ে বেড়াচ্ছে, আর সব ঠোঁটই খালি পেয়ালার মতো (সাকিয়ে গুরেজ পা হ্যায়, খালী হ্যায় জাম হার লব)।
আমাকে অনুমতি দাও যে এই বিষ পান করে মরে যাই (য়া মুঝকো ইয্ন দে কে ম্যাঁ য়ে যেহর পিকে মর জাউঁ।
অথবা আমাকে সেই মদিরা দাও যা আমাকে (ঐশী) মত্ততা এনে দিতে পারে (য়া মুঝকো ও শারাব দে জো মাস্তি মেঁ লা দেতি হ্যায়)।
চূড়ান্ত পর্ব আসে তৃতীয় কবিতায়, ‘ফরমান-এ-খোদা ফারিশতোঁ সে’ (ফেরেশতাদের প্রতি খোদার নির্দেশ)। লেনিন ও ফেরেশতাদের সাক্ষ্যের পর এবার আসে খোদার নিজের চরম বিপ্লবী ঘোষণা।
ওঠো! আমার দুনিয়ার গরীবদের ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলো (উঠো!মেরি দুনিয়া কে গরিবোঁ কো জাগা দো)।
ধনী ও অভিজাতদের প্রাসাদের দরজা ও দেওয়াল কাঁপিয়ে দাও (কূখ-এ উমারা কে দর-ও-দিওয়ার হিলা দো)।
নিশ্চিত বিশ্বাসের আগুন দিয়ে গোলামদের রক্ত গরম করে দাও (গারমাও গুলামোঁ কা লহু সোয-এ য়াকিঁ সে)।
যে খেতের ফসল থেকে কৃষকের রুজি জোটে না (জিস খেত সে দেহকাঁ কো মায়াস্সার নেহিঁ রোযি)।
সেই খেতের প্রতিটি গমের শীষকে পুড়িয়ে দাও (উস খেত কে হার খোশা-এ-গন্দুম কো জ্বালা দো)।
জনগণের সার্বভৌমত্বের যুগ আসছে (সুলতানিয়ে জুমহূর কা আতা হ্যায় যামানা)
যে প্রাচীন চিহ্নই তোমাদের চোখে পড়ুক, তা মুছে ফেলো (জো নক্শ-এ-কুহন তুম কো নজর আয়ে মিটা দো)
খোদা ঘুমন্ত শোষিত জনগণকে বিপ্লবে অংশ নেওয়ার জন্য জাগ্রত করার সরাসরি ঐশী নির্দেশ দিচ্ছেন। পুরাতন শোষক শ্রেণির ক্ষমতা ও স্থিতিশীলতাকে চূর্ণ করে দেওয়ার আহ্বান। দাসত্বে অভ্যস্ত শ্রমিকদের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা ও দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি করে তাদের আন্দোলনে নামার উৎসাহ যোগানোর নির্দেশ দিচ্ছেন তিনি। পুঁজিবাদী ভূমি-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্রোহের ডাক—যা মার্ক্সের ধারণার সঙ্গে মেলে। একনায়কতন্ত্র বা রাজতন্ত্রের অবসানের পর সাধারণ মানুষের শাসন বা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিচ্ছেন স্রষ্টা। দিচ্ছেন পুরনো ব্যবস্থা, শোষণ ও অবিচারের সমস্ত প্রতীককে মুছে ফেলার নির্দেশ।
মুহম্মদ ইকবাল রুশ বিপ্লব আর মার্ক্সের যে মূল্যায়ন করেছেন তা ছিল মূলত ডাস ক্যাপিটাল এবং রুশ বিপ্লবের তাৎক্ষণিক দর্শন-এর ওপর ভিত্তি করে। এই বিশ্লেষণেই ইকবাল মার্ক্সকে ‘ঐশী জ্যোতিহীন মুসা’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
তবে, যদি ইকবাল কার্ল মার্কসের প্রাথমিক লেখাগুলো, ১৮৪৪ সালের পাণ্ডুলিপি পড়ার সুযোগ পেতেন, তাহলে তাঁর মূল্যায়নে এক গভীর দার্শনিক সংযোগ তৈরি হতে পারত।
মার্ক্সের প্রাথমিক লেখায় পুঁজিবাদ কীভাবে শ্রমিককে তার কাজ, পণ্য এবং নিজের মানবিক সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়, তার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ইকবাল এই বিচ্ছিন্নতাকে তাঁর কেন্দ্রীয় দর্শন 'খুদি' (আত্মসত্তা)-এর ধ্বংস হিসেবেই দেখতেন। এক্ষেত্রে মার্ক্স ও ইকবাল দুজনেই পুঁজিবাদকে মানব-সত্তার প্রতি চরম আঘাত হিসেবে দেখতেন, যা তাঁদের মধ্যে একটি শক্তিশালী দার্শনিক সমান্তরাল তৈরি করতে পারত।
মার্ক্সের প্রাথমিক লেখাগুলোর মানবিক ও নৈতিক ভিত্তি ইকবালের কাছে স্পষ্ট করতে পারত যে মার্ক্সের আসল উদ্দেশ্য নিছক ‘পেটের সাম্য’ ছিল না। বরং মার্ক্সের উদ্দেশ্য ছিল মানুষের হারিয়ে যাওয়া মানবিক সারবস্তুটিকে পুনরুদ্ধার করা। ইকবাল হয়তো দেখতেন যে মার্ক্স এবং তাঁর নিজের লক্ষ্য একই—বিচ্ছিন্নতা দূর করে মানবিক সত্তার মুক্তি। যদিও তাঁদের পদ্ধতি ভিন্ন।
ইকবাল হয়তো তখন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতেন যে মার্ক্স বিপ্লবকে বস্তু দিয়ে শুরু করলেও, এর উদ্দেশ্য ছিল মানুষের আত্মিক মুক্তি। এইভাবেই ইকবাল মার্ক্সকে কেবল অর্থনৈতিক সমালোচক হিসেবে নয়, বরং মানবতা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে তাঁর সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক সহযাত্রী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারতেন।
জাভেদ হুসেন: লেখক ও অনুবাদক
.png)

১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের মতো কিছু মানবজাতির ইতিহাসে আগে কখনো ঘটেনি। বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদের আপাত বিজয় ঘটছে। সেই ডামাডোলে একটি ঘটনা যেন ভুলেই গেছে সবাই। আমি এমন একটি বিষয়ের উপর জোর দিতে চাই। আর তা হোল ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব। এই বিপ্লব ছিল মানবজাতির ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ঘটনা।
৩ ঘণ্টা আগে
৭ নভেম্বরের তাৎপর্য বুঝতে হলে এর পূর্ববর্তী ঘটনাবলি অনুধাবন করা জরুরি। ১৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর জাতি এক চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে। এর মধ্যেই ৩ নভেম্বর সংঘটিত হয় একটি পাল্টা অভ্যুত্থান, যার নেতৃত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ।
৬ ঘণ্টা আগে
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তাৎপর্যপূর্ণ দিনগুলোর একটি হলো ৭ নভেম্বর ১৯৭৫। এই দিন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মোড়-ফেরানো দিন। দিনটিকে কেউ বলেন ‘সিপাহি-জনতার বিপ্লব’। বিরোধীরা বলেন, ‘রাষ্ট্রবিপর্যয়ের সূচনা’।
৬ ঘণ্টা আগে
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান সংগঠক এবং নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। আন্দোলনের উত্তাল সময় পেরিয়ে রাজনৈতিক দল গঠনের পর বর্তমান বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন ঢাকা স্ট্রিমের সঙ্গে।
১ দিন আগে