leadT1ad

বিশেষ সাক্ষাৎকারে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

অমীমাংসিত বিষয়গুলো পার্লামেন্টে আসুক, নির্বাচনের ম্যানিফেস্টো হোক

বাংলাদেশের রাজনীতি এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যখন প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কৌশল, জোট গঠন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে, তখন দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপির অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই উত্তপ্ত রাজনৈতিক আবহে, দলটির নির্বাচনী প্রস্তুতি, প্রার্থী মনোনয়নের পেছনের চিন্তাভাবনা, 'জুলাই সনদ' নিয়ে দলের অবস্থান এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনা করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দুই পর্বের সাক্ষাৎকাটি নিয়েছেন ঢাকা স্ট্রিমের সম্পাদক ইফতেখার মাহমুদ। আজ প্রকাশিত হলো দ্বিতীয় পর্ব।

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক

ঢাকা স্ট্রিমের সঙ্গে বিশেষ সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। স্ট্রিম ছবি

মনোনয়ন দেওয়ার ব্যপারে দলের আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকা, জনপ্রিয়তা ও প্রার্থীর যোগ্যতাকে গুরুত্ব দিয়েছে বিএনপি। মির্জা ফখরুল বলেছেন, বিএনপি জাতীয় সরকার গঠনের লক্ষ্যে নির্বাচনী জোটে আগ্রহী এবং আসন ছাড়তেও প্রস্তুত। সাক্ষাৎকারে তিনি বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের সক্রিয় ভূমিকা এবং আগামীর অর্থনীতির রূপরেখাও তুলে ধরেন। নিচে সাক্ষাৎকারটি দেওয়া হল।

ইফতেখার মাহমুদ: নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি প্রার্থীদের মনোনয়ন চূড়ান্ত করেছে। দেশবাসীর আগ্রহের কেন্দ্রে থাকা এই বিষয়ে জানতে চাই, কোন বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে আপনারা প্রার্থী চূড়ান্ত করেছেন এবং মনোনীতদের প্রতি আপনার বার্তা কী? তাদের ব্যাপারে আপনার আত্মবিশ্বাস কতটুকু?

মির্জা ফখরুল: মনোনয়নের ব্যাপারে বিএনপি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে তাদেরকে যারা বিগত স্বৈরাচার বিরোধী ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। একই সঙ্গে আমরা গুরুত্ব দিয়েছি প্রার্থীর জনপ্রিয়তাকে। কাদের জনপ্রিয়তা আছে এবং মানুষের কাছে কারা সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। একই সঙ্গে আমরা এটাও দেখেছি যে তার যোগ্যতা কেমন, একটা পার্লামেন্টের মেম্বার হওয়ার জন্যে যে সমস্ত যোগ্যতা দরকার সেই যোগ্যতাগুলো তার কেমন আছে। সুতরাং জনগণের কাছে একসেপ্টেবিলিটি, তার নিজস্ব যোগ্যতা এবং একই সঙ্গে তার পার্টিসিপেশন ইন দা লাস্ট মুভমেন্ট, এগুলো আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি।

ইফতেখার মাহমুদ: এটা ঠিক যে, একটি বড় দলে সবাইকে মনোনয়ন দেওয়া সম্ভব নয়। যারা মনোনয়ন পাননি, তাদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষোভ বা হতাশা কাজ করতে পারে। এই পরিস্থিতি আপনারা কীভাবে সামাল দিচ্ছেন এবং তাদের প্রতি দলের অবস্থান কী?

মির্জা ফখরুল: বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুযায়ী একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলে প্রতিটি আসনেই অনেক প্রার্থী থাকেন, যা খুবই স্বাভাবিক। তো সেই ক্ষেত্রে সবাইকে তো মনোনয়ন দেওয়া যাবে না। এক একটা আসনে একজনকেই দিতে হবে। এই পরিস্থিতিকে সামনে রেখেই মাত্র কয়েকদিন আগে আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, জনাব তারেক রহমান, প্রতিটি বিভাগের সকল সম্ভাব্য মনোনয়ন-প্রত্যাশীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছেন। সেখানে তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, আমরা একটি ঐক্যবদ্ধ দল এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য। সুতরাং, প্রতিটি আসনে আমাদের প্রার্থী থাকবেন একজনই।

যিনি মনোনয়ন পেয়েছেন, তিনিই যে ওই এলাকার একমাত্র নেতা, বিষয়টি এমন নয়; সেখানে দলের আরও অনেকে আছেন। তাদেরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যেন তারা মনোনীত প্রার্থীকে নির্বাচনে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায়ও বিভিন্নভাবে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখেন। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে যে, মনোনয়ন ঘোষণার পর দু-এক জায়গায় কিছুটা প্রতিক্রিয়া দেখা গেলেও শেষ পর্যন্ত প্রায় সকলেই দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ শুরু করেন। তাছাড়া, যিনি প্রার্থী হন, তিনি তার নিজের জয়ের স্বার্থেই দলের বাকি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে মাঠে নামেন।

এনসিপির সঙ্গে আমাদের এখন পর্যন্ত সে ধরনের কোনো ঐক্য তৈরি হয়নি। কিন্তু তাদের সঙ্গে কথা বলছি আমরা। আমরা কথা বলার চেষ্টা করছি, তারাও করছে। ফলে যদি কোনো সমঝোতা হয় সেটা আপনারা জানতেই পারবেন। আর ইসলামিক দলগুলোর সঙ্গে অনেকগুলোর সঙ্গেই আমাদের আগে থেকেই সম্পর্ক আছে। সেগুলো তো আমরা অবশ্যই বিবেচনায় রাখব। কয়েকটা সিট আমরা খালিও রেখেছি তাদের জন্য।

ইফতেখার মাহমুদ: কিছু আসনে বিএনপি প্রার্থী দেয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, এগুলো নির্বাচনী জোট বা মিত্রদের জন্য রাখা হয়েছে। এই সম্ভাব্য নির্বাচনী মিত্র কারা এবং আসন ভাগাভাগির প্রক্রিয়াটি ঠিক কীভাবে এগোচ্ছে?

মির্জা ফখরুল: দেখুন, যারা এতদিন ধরে আমাদের সঙ্গে একযোগে আন্দোলন করেছেন, তাদের প্রতি আমাদের একটি সুস্পষ্ট অঙ্গীকার রয়েছে। আমাদের পরিকল্পনা হলো, নির্বাচনের পর আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে নিয়ে আমরা একটি 'জাতীয় সরকার' গঠন করব—এটি আমাদের ঘোষিত প্রতিশ্রুতি।

একইসাথে, যারা এই মুহূর্তে নির্বাচনে আমাদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী, তাদেরকেও আমরা সঙ্গে নিতে চাই। সেক্ষেত্রে, আমাদের তরফ থেকে অবশ্যই কিছু আসন ছেড়ে দিতে হবে। এই আসন ছাড়ার প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের জন্য আমরা ইতোমধ্যে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি এবং কোথাও কোথাও আমরা তাদের জন্য আসন সংরক্ষিত রেখেছি। এমনকি, আমাদের জোটকে শক্তিশালী ও অটুট রাখার স্বার্থে, ইতোমধ্যে ঘোষিত প্রার্থী তালিকাতেও প্রয়োজনে পরিবর্তন আনা হতে পারে—এই কথাটিও আমরা আমরা ঘোষণা করেছি।

ইফতেখার মাহমুদ: আন্দোলনের সময়ে যারা আপনাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ ছিল, নির্বাচনী জোটেও কি তারাই থাকছে? নাকি এখানে হিসাব-নিকাশ আরেকটু বদলাতে পারে?

মির্জা ফখরুল: বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করছে পরিস্থিতির ওপর। আন্দোলনে যারা আমাদের সঙ্গে ছিলেন, তারা তো থাকছেনই। এর পাশাপাশি, যদি নতুন কোনো দল বা গোষ্ঠী আমাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে চায় এবং আসন ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী হয়, তাহলে তাদের প্রস্তাব আমরা অবশ্যই বিবেচনা করব। তবে, এই মুহূর্তে কোনো কিছুই চূড়ান্ত নয়। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এখনও যথেষ্ট সময় আছে।

ইফতেখার মাহমুদ: এনসিপি এবং হেফাজতের মতো দল ও গোষ্ঠীর সঙ্গে আপনাদের নির্বাচনী জোট গঠনের কোনো আলোচনা চলছে কি না, এ নিয়ে অনেকের কৌতূহল রয়েছে।

মির্জা ফখরুল: প্রথমেই স্পষ্ট করতে চাই, হেফাজতে ইসলাম কোনো রাজনৈতিক দল নয়। এটি মূলত কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক আলেম-উলামাদের একটি সংগঠন।

তবে, এই ধারার মধ্যে বেশ কিছু সক্রিয় রাজনৈতিক সংগঠন রয়েছে; যেমন: নেজামে ইসলাম, ইসলামী ঐক্যজোট এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। তো তাদের মধ্যে একটা ঐক্য হয়েছে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে তারা ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামক একটি প্ল্যাটফর্ম বা সংগঠন তৈরি করেছে। সুতরাং, হেফাজতে ইসলাম নিজে কোনো রাজনৈতিক দল নয়, বরং এটি একাধিক রাজনৈতিক দলের একটি সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম।

ইফতেখার মাহমুদ: তাহলে এনসিপি বা অন্যান্য ইসলামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে আপনাদের নির্বাচনী ঐক্যের সম্ভাবনা কতটুকু?

মির্জা ফখরুল: না, এনসিপির সঙ্গে আমাদের এখন পর্যন্ত সে ধরনের কোনো ঐক্য তৈরি হয়নি। কিন্তু তাদের সঙ্গে কথা বলছি আমরা। আমরা কথা বলার চেষ্টা করছি, তারাও করছে। ফলে যদি কোনো সমঝোতা হয় সেটা আপনারা জানতেই পারবেন। আর ইসলামিক দলগুলোর সঙ্গে অনেকগুলোর সঙ্গেই আমাদের আগে থেকেই সম্পর্ক আছে। সেগুলো তো আমরা অবশ্যই বিবেচনায় রাখব। কয়েকটা সিট আমরা খালিও রেখেছি তাদের জন্য।

ইফতেখার মাহমুদ: জোনায়েদ সাকী, মাহমুদুর রহমান মান্না এবং নূরুল হক নূরের মতো নেতারা, যারা আপনাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে ছিলেন, নির্বাচনী জোটে তাদের অবস্থান কী হবে?

মির্জা ফখরুল: অবশ্যই, আমরা তো তাদেরকে সঙ্গে রাখতে চাই। আমরা চাই যে তারা পার্লামেন্টে আসুন।

সনদের বাইরের প্রতিটি বিষয়ে আমরা সবাই একমত হয়ে গেছি—বাস্তবতা তা নয়। যেসব বিষয়ে আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়ে গেছে, সেগুলোর ব্যাপারে আমাদের সুস্পষ্ট পরামর্শ হলো—সেগুলোকে আগামী সংসদে আলোচনার জন্য নিয়ে যাওয়া হোক। যেহেতু এটি একটি প্রজাতন্ত্র এবং রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, তাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জনগণই দেবে। গুটি কয়েক শিক্ষিত ব্যক্তি কোনো সিদ্ধান্ত জনগণের ওপর চাপিয়ে দিতে পারে না।

ইফতেখার মাহমুদ: বাংলাদেশের রাজনীতিতে সম্প্রতি বহুল আলোচিত বিষয় ‘জুলাই সনদ’। এটিকে ঘিরে আপনাদের অভিজ্ঞতা আমরা দেখতে পাচ্ছি যে আশাবাদী হওয়া এবং আশাভঙ্গ হওয়া, এরকম একটি ঢেউয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অনেকে বলেন যে মাঝপথে এসে এটা একটা পলিটিক্যাল ট্র্যাজেডির দিকে যাচ্ছিল কিন্তু বারবার ট্র্যাজেডিটা রিপিট হওয়ার কারণে এখন অনেকে বলছে এটা পলিটিক্যাল কমেডিতে পরিণত হলো কিনা। আপনি কিভাবে দেখেন?

মির্জা ফখরুল: না, আমি বিষয়টাকে সেভাবে দেখি না। বরং আমি বিষয়টাকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখি। রাষ্ট্রীয় সংস্কারের বিষয়টি আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়; আমরা শুরু থেকেই এর পক্ষে কথা বলে আসছি। বিএনপিই প্রথম রাজনৈতিক দল যারা মনে করেছে যে, বর্তমান রাষ্ট্র কাঠামো দিয়ে জনগণের প্রকৃত আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা সম্ভব নয়।

এ কারণেই ২০১৬ সালে, যখন বেগম খালেদা জিয়া জেলের বাইরে ছিলেন, আমরা রাষ্ট্র পরিবর্তনের রূপরেখা হিসেবে 'ভিশন-২০৩০' উপস্থাপন করেছিলাম। সেখানে আমরা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ (আপার হাউস), রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনা, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবগুলো তুলে ধরেছিলাম। এমনকি সংবিধান সংস্কারের জন্য একটি কমিশন গঠনের কথাও আমরা তখন বলেছিলাম। পরবর্তীতেও আমাদের এই সংস্কার প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল। ২০২১ সালে আমরা প্রথমে ১০ দফা, পরে সেটিকে বিস্তৃত করে ২৭ দফা, এবং সবশেষে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর সাথে আলোচনা করে ৩১ দফার একটি পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি দিয়েছিলাম। এই দফাগুলো ছিল মূলত সংবিধান এবং দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো সংস্কারের জন্যই।

সুতরাং, আপনি দেখতেই পাচ্ছেন, সংস্কারের ধারণাটি আমাদের কাছে নতুন নয়। তাই সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানের পর যখন জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যে কমিশন গঠন করা হলো, আমরা তাকে স্বাগত জানিয়েছি এবং প্রতিটি পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেছি।

ইফতেখার মাহমুদ: তাহলে আপনারা যে বিষয়গুলোতে একমত হয়েছেন, তার ভিত্তিতেই কি ‘জুলাই সনদ’-এ স্বাক্ষর করেছেন? সেক্ষেত্রে যেসব বিষয়ে এখনো মতপার্থক্য রয়ে গেছে, সেগুলোর ভবিষ্যৎ কী হবে?

মির্জা ফখরুল: আমরা আমাদের দলের নিজস্ব অবস্থান ও ধারণাগুলোই তুলে ধরেছি। অন্যান্য দলগুলোও তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছে। এর মধ্যে বেশ কিছু বিষয়ে আমরা সবাই একমত হতে পেরেছি, এবং সেই ঐকমত্যের ভিত্তিতেই আমরা 'জুলাই সনদ'-এ স্বাক্ষর করেছি।

কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, সনদের বাইরের প্রতিটি বিষয়ে আমরা সবাই একমত হয়ে গেছি—বাস্তবতা তা নয়। যেসব বিষয়ে আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়ে গেছে, সেগুলোর ব্যাপারে আমাদের সুস্পষ্ট পরামর্শ হলো—সেগুলোকে আগামী সংসদে আলোচনার জন্য নিয়ে যাওয়া হোক। যেহেতু এটি একটি প্রজাতন্ত্র এবং রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, তাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জনগণই দেবে। গুটি কয়েক শিক্ষিত ব্যক্তি কোনো সিদ্ধান্ত জনগণের ওপর চাপিয়ে দিতে পারে না।

এই অমীমাংসিত বিষয়গুলো নির্বাচনী ইশতেহারের অংশ হিসেবে জনগণের সামনে যাক। জনগণ যদি সেই ইশতেহারকে সমর্থন জানায়, তবে তা সংসদে আলোচনার মাধ্যমে আইনে পরিণত হবে। কাজেই, এটিকে 'কমেডি' হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। বরং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে ধারণাগত পার্থক্য (যেমন জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি বা বিএনপির নিজস্ব চিন্তা), এটি তারই একটি স্বাভাবিক প্রতিফলন। কতগুলো জায়গায় তো আমরা একমত হয়েছি। আমার মনে হয়, সেই জায়গাগুলো নিয়ে এগোলেই হয়। বাকিগুলো পার্লামেন্টে আসুক, নির্বাচনের ম্যানিফেস্টো হোক।

ইফতেখার মাহমুদ: একটি অঙ্গীকারনামাটা ডিক্লেয়ার করার পরেই জুলাই সনদের উদ্যোক্তারা আবার এটিকে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। সম্প্রতি সাত দিনের একটি সময়সীমার কথাও বলা হয়েছে। এই প্রক্রিয়াটিকে আপনারা কীভাবে দেখছেন?

মির্জা ফখরুল: দেখুন, অধ্যাপক আসিফ নজরুল সাহেব যা বললেন, যে তাঁদের ক্যাবিনেট সাত দিনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়িত্ব দিচ্ছে—এতে একটি প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই আসে। যদি শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোকেই এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তাহলে এতদিন ধরে এত কমিশন বা দীর্ঘ বৈঠক করার প্রয়োজনটা কী ছিল? এর তো কোনো দরকার ছিল না।

যাই হোক, এই প্রক্রিয়াটি যেহেতু এখন সম্পন্ন হয়েছে, আমাদের উচিত চূড়ান্ত সমাধানে আসা। আর সেই চূড়ান্ত পথ হলো, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল নিজ নিজ নির্বাচনী ইশতেহার বা ম্যানিফেস্টো তৈরি করবে এবং সেটি নিয়ে জনগণের সামনে নির্বাচনে যাবে। জনগণই তখন বিচার করে বেছে নেবে, তারা কোন পথটিকে সমর্থন করে। কোনো একটি সিদ্ধান্ত জনগণের ওপর জোর করে চাপিয়ে দিতে হবে—এই ধারণাটাই তো ভুল। এটি কেবল চাপিয়ে দেওয়ার প্রশ্ন নয়, এটি আরেকটি স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের পরিচায়ক।

আমরা বেগম খালেদা জিয়াকে মনে করি যে তিনি সমস্ত বিতর্কের ঊর্ধ্বে একজন অভিভাবক বাংলাদেশের জন্য এবং আমরা তাকে বলেছি যে তিনি গণতন্ত্রের মাতা। তিনি তার সমস্ত জীবনটাই গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে গিয়েছেন, সংগ্রাম করে গিয়েছেন। সুতরাং এটা আমাদের জন্য একটা বিরাট প্লাস পয়েন্ট যে বেগম খালেদা জিয়াকে আমরা ইলেকশনে আনতে পারছি। তার নির্বোচনে অংশগ্রহণ গণতন্ত্রের জন্য একটি বড় বিজয় হবে এবং এটা আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে অনেক বড় প্রাপ্তিও।

ইফতেখার মাহমুদ: দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে জনমনে ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। তিনি কবে নাগাদ ফিরছেন?

মির্জা ফখরুল: উনার দেশে ফেরার ব্যপারে কতগুলো সমস্যা ছিল, আদালতের সমস্যা ছিল, সেগুলো সমাধান হয়ে এসছে প্রায়। আর একটা জায়গা থেকে আরেকটা জায়গায় আসতে গেলেও তো কিছু সময় লাগে। তবে উনি খুব শিগগিরই চলে আসবেন। তারেক রহমানের ইতিমধ্যে বলেছেন যে তিনি একটা সিট থেকে নির্বাচন করবেন। আমরা তাকে রিকোয়েস্ট করেছি আরও বেশি সিট থেকে ইলেকশন করার জন্য।

ইফতেখার মাহমুদ: তাঁর ফেরার বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা আছে কি?

মির্জা ফখরুল: এটা তো বলা সম্ভব হচ্ছে না। আসলে ডেডলাইন বলতে কিছু নাই।

ইফতেখার মাহমুদ: বেগম খালেদা জিয়া অনেক অসুস্থ ছিলেন, তারপরও উনি বারবার নিজেকে রাজনীতিতে সক্রিয় দেখিয়েছেন, এখনও আছেন। এবার তিনি তিনটি আসনে নির্বাচন করছেন। রাজনীতিতে তার এই সক্রিয় অংশগ্রহণকে আপনারা কীভাবে দেখছেন এবং এটি দলকে কতটা অনুপ্রাণিত করবে?

মির্জা ফখরুল: আমরা বেগম খালেদা জিয়াকে মনে করি যে তিনি সমস্ত বিতর্কের ঊর্ধ্বে একজন অভিভাবক বাংলাদেশের জন্য এবং আমরা তাকে বলেছি যে তিনি গণতন্ত্রের মাতা। তিনি তার সমস্ত জীবনটাই গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে গিয়েছেন, সংগ্রাম করে গিয়েছেন। সুতরাং এটা আমাদের জন্য একটা বিরাট প্লাস পয়েন্ট যে বেগম খালেদা জিয়াকে আমরা ইলেকশনে আনতে পারছি। তার নির্বোচনে অংশগ্রহণ গণতন্ত্রের জন্য একটি বড় বিজয় হবে এবং এটা আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে অনেক বড় প্রাপ্তিও।

ইফতেখার মাহমুদ: আপনারা ‘অর্থনীতির গণতন্ত্রায়ন’-এর কথা বলছেন। ফ্যাসিবাদী আমলের ‘অলিগার্ক’ বা গোষ্ঠীতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো ভাঙার ব্যাপারে আপনাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা কী? এ ব্যপারে আপনার নিজস্ব রাজনৈতিক চিন্তা-দর্শনটা কেমন?

মির্জা ফখরুল: আমাদের নীতিমালায় 'অর্থনীতির গণতন্ত্রায়ন' বলতে আমরা যা বুঝি, তা হলো—সকলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা। এর মূল কথা হলো, যে কেউ ব্যবসা করতে চাইলে বা শিল্প স্থাপন করতে চাইলে, রাষ্ট্র তাকে সেই সুযোগ করে দেবে। তবে এই ব্যবস্থা সফল করার জন্য দুটি অপরিহার্য ভিত্তি প্রয়োজন—স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা। আমরা একটি সম্পূর্ণ স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই। এর অংশ হিসেবে, ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিয়ে নিশ্চিত করতে হবে যেন দেশের পুঁজি মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত না হয়।

আমাদের নীতি এমনভাবে সাজানো হবে, যেন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুফল বিস্তৃত হয় এবং সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা যায়। বেশিরভাগ মানুষের উপকার নিশ্চিত করতে আমরা ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের প্রকল্পগুলোকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করব। সবশেষে, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা 'শ্রম-নিবিড়' খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেব। কারণ, আমাদের দেশে জনসংখ্যা বেশি, তাই এমন শিল্প স্থাপন করতে হবে যেখানে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

ইফতেখার মাহমুদ: অসংখ্য ধন্যবাদ। ঢাকা স্ট্রিমের দর্শক এবং পাঠকদের জন্য যদি কিছু বলতেন…

মির্জা ফখরুল: ঢাকা স্ট্রিম একটি নতুন গণমাধ্যম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। আমি মনে করি, এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে, বিশেষ করে যারা আগ্রহী দর্শক এবং পাঠকদের মধ্যে তারা একটা ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবেন। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা তাদের ভূমিকা অক্ষুণ্ণ রাখবেন বলে আমি বিশ্বাস করি। তাদেরকে আমার অভিনন্দন, শুভেচ্ছা। তাদের চলার পথ সুন্দর হোক, এটাই আমি চাই।

Ad 300x250

সম্পর্কিত