১৮৭৭ সালের ৯ নভেম্বর মুহাম্মদ ইকবাল জন্মেছিলেন, পাঞ্জাবের সিয়ালকোটে—যা বর্তমানে পাকিস্তানের পশ্চিম পাঞ্জাব অঞ্চলে অবস্থিত। তাঁর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ। পরে সপ্তদশ শতকে মুঘল আমলে তাঁরা ইসলামে ধর্মান্তরিত হন।
ইকবালের পিতা শেখ নূর মুহাম্মদ পেশায় ছিলেন দর্জি, ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন গভীর ধর্মপ্রাণ এবং সূফি মনোভাবাপন্ন ব্যক্তি। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তিনি লাভ করেননি, তবে উর্দু ও ফারসি বই পড়তে পারতেন। সুফিদের সোহবত লাভ করেছিলেন। ইকবালের মা, ইমাম বিবিও ছিলেন নিরক্ষর।
ইকবালের পাঠজীবনের সূচনা হয়েছিল মক্তবে। চার বছর বয়সে শিয়ালকোট মাদ্রাসার শিক্ষক সৈয়দ মীর হাসানের কাছে। মীর হাসান প্রসিদ্ধ পণ্ডিত ছিলেন, আরবি সাহিত্যে অধ্যাপনা করতেন শিয়ালকোটের স্কটিশ মিশন কলেজে। ফলে ইকবাল মক্তবে কেবল কোরআন পাঠই নয়, ধর্মতত্ত্ব, সাহিত্য সম্পর্কেও ধারণা লাভ করতে পেরেছিলেন। মীর হাসান ইকবালের মেধার প্রখরতা বুঝতে পেরে তাঁর পিতাকে রাজি করান তাঁরই কলেজে ভর্তি করাতে। সেখান থেকেই ইকবাল এফএ পাস করেন।
এই কলেজে পাঠকালে ইকবাল সহচর্য লাভ করেন উর্দু গজলের অন্যতম প্রবাদ পুরুষ নওয়াব মির্জা খানের। মির্জা খান দাগ দেহলভী নামেই পরিচিত। তাঁকে বলা হত বুলবুল এ হিন্দুস্তান। মাওলানা মীর হাসানের কাছে আরবি সাহিত্য এবং দাগ দেহলভীর কাছে উর্দু কবিতা, আর পিতার কাছ থেকে সুফি ভাবাদর্শের শিক্ষা ইকবালকে পরিণত করে তুলেছিল অল্প বয়সেই।
ইকবাল সেই কৃতজ্ঞতাকে আজীবন প্রকাশ করেছেন। ১৯২২ সালে পাঞ্জাবের প্রাদেশিক সরকার ব্রিটিশ রাজকে নাইটহুডের জন্য ইকবালের নাম প্রস্তাব করে তখন ইকবাল তা গ্রহণের শর্ত হিসেবে তাঁর শিক্ষক মীর হাসানের স্বীকৃতি দাবি করেছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল মীর হাসানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ কোনটি? ইকবাল উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি’। ১৯২৩ সালে ইকবাল নাইটহুড লাভ করলে, মীর হাসানও পান ‘শামসুল উলামা’ উপাধি।
কোমায় গিয়ে তিনি মরতে চান না। মাতাল হয়ে তিনি রবের সঙ্গে মিলিত হতে চান না। সব কিছু দেখে শুনেই মরতে চান। ইকবাল মারা যাবার দিন রাতে জাভেদনামা পাঠ করিয়েছিলেন। নিজের লেখা কবিতা নিজেই শুনেছিলেন শেষবারের মতন।
ইকবালের সাহিত্যপ্রতিভা লাহোরের গভর্নমেন্ট কলেজে বিএ পড়াকালেই স্পষ্ট হতে শুরু করে। প্রথমদিকে তাঁর কবিতা গজল আকারে উপস্থাপন করলেও শিগগিরই তিনি নজম আকারে রচনা করতে শুরু করেন।
লাহোরের পাঠ চুকিয়ে ইকবাল বিলাত যাত্রা করেন। কেমব্রিজে পৌঁছান এবং ট্রিনিটি কলেজে গবেষণায় যোগ দেন। কেমব্রিজে থাকাকালীন প্রাচ্যবিদ রেনল্ড নিকলসনের সাথে তাঁর সখ্যতা হয়। নিকলসনই পরে ১৯২০ এ ইকবালের ফারসি কাব্যগ্রন্থ আসরার-ই খুদি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। কেমব্রিজ থেকে যে বছর তিনি এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন; সেই একই বছরের নভেম্বর মাসে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে পারস্য দর্শন নিয়ে গবেষণার জন্য পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করে। পরের বছর তিনি লন্ডনের লিঙ্কনস ইন থেকে আইনশাস্ত্র পাঠ সম্পন্ন করে আইনজীবী হিসেবে বিলেতের বার কাউন্সিলে অন্তর্ভুক্ত হন।
মাত্র তিন বছরের মধ্যে ইকবাল অর্জন করেন তিনটি সম্মানজনক ডিগ্রি—যা তাঁর সমকালীন মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ কিংবা অন্য কোনও খ্যাতিমান ব্যক্তিদের মধ্যেও কেউই এত স্বল্পসময়ে অর্জন করতে পারেননি।
আত্মজীবনীমূলক কবিতা তাওয়াব্বুদ আওর তাসাউউফ–এ ইকবাল ইকবাল এক প্রতিবেশীর কথা বলেছেন, তিনি ধর্মপণ্ডিত। সেই পণ্ডিত শুনেছিলেন যে ইকবাল ইসলামি আইন ও ধর্মে গভীর জ্ঞান রাখেন কিন্তু জীবনাচরণে সে অর্থে খুব ধার্মিক নন। তিনি ভোরে কুরআন তেলাওয়াত করেন, আবার গানও শোনেন, তাঁর দর্শনচর্চার প্রভাবে তিনি হিন্দুদের কাফের বলতে অস্বীকার করেন। সুন্দরী নারীসঙ্গও তিনি পছন্দ করেন। আবার তাঁর মধ্যে নাকি শিয়াপন্থী ঝোঁকও রয়েছে!
কবিতাতেই একদিন ইকবাল সেই ধর্মপণ্ডিতের মুখোমুখি হন, তখন তিনি স্বীকার করে নেন যে- তিনি নিজেও জানেন না- তার নিজের আসল সত্য কী! এবং একদিন তিনি চান ‘নিজেই ইকবালকে আবিষ্কার করতে।’
ইকবালের নিজের সঙ্গে নিজের এই দ্বন্দ, আত্মচেতনা, বিশ্বাস ও সামাজিক মূল্যবোধের সংঘাত, দ্বৈরথ যেন নিজেরই গভীর মানবিক স্বীকারোক্তি।
‘সারে জাঁহে সে আচ্ছা, হিন্দুস্তা হামারা’র রচয়িতা ইকবালের ভারতীয় মুসলমানদের জন্য পৃথক, স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে যে দর্শন তা বর্তমান পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টিতে প্রবল ভূমিকা রেখেছে। মুসলিমদের জন্য পৃথক আবাসভূমির চিন্তা কেবলই রাজনৈতিক ছিল না। তিনি আধ্যাত্মিকতাকেও এর ভিত হিসেবে নিতে চেয়েছেন।
শিক্ষা, আখলাক এবং উম্মাহর ঐক্যের মধ্য দিয়ে নিপীড়িত মুসলমানদের মর্যাদা তিনি পুনর্নির্মাণ করতে চেয়েছেন। ‘শায়েরে-এ-মাশরিক’ তথা প্রাচ্যের কবি উপাধিতে পরিচিত আল্লামা ইকবালের চিন্তাধারা অতিক্রম করে গিয়েছিল দেশ, জাতি ও ভাষার সীমান।
তাঁর প্রভাব শুধু দক্ষিণ এশিয়াতেই নয়- বরং মধ্য এশিয়া, ইরান, তুরস্ক এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্বকেই গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে। তামাম মধ্য এশিয়াজুড়ে ইকবালকে শ্রদ্ধা করা হয় তাঁর সর্বজনীন উম্মাহ কেন্দ্রীক চিন্তাধারার জন্য। ‘খুদী’ বা আত্মবোধনের তাঁর যে দর্শন, মুসলিম পরিচয়ের জাগরণের ওপর তাঁর যে গুরুত্ব, তা শুধুই উপমহাদেশ নয় বরং তুর্কি জাতিগুলোর মধ্যেও গভীরভাবে অনুরণিত হয়েছ। দীর্ঘ সময়ের ঔপনিবেশিক নিপীড়নের পর নিজেদের ঐতিহাসিক পরিচয় পুনরুদ্ধারে তাঁর দর্শন উৎসাহ সঞ্চার করেছে। উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান এবং আজারবাইজানের মতো দেশগুলোতে ইকবালের রচনাগুলো স্থানীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠ্যসূচির অংশ।
ফার্সি সাহিত্যে সৃজনশীলতার জন্য তিনি ফার্সি ভাষাভাষী অঞ্চল বিশেষ করে ইরানেও সমধিক প্রসিদ্ধ; তাঁকে সেখানকার মানুষেরা ইকবাল-ই-লাহোরি নামে ডাকতেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ছিল আসরার ই খুদী। তাঁর কবিতা এক বিস্ময়কর ক্ষেত্র যেখানে দর্শন ও নন্দন একীভূত হয়েছে।
ইসলামের ইতিহাস, দর্শন ও ধর্ম বিশ্বাসকে মেটাফোর ও মিথের মত প্রধান কাব্যিক উপাদানগুলোয় নতুনভাবে বিন্যস্ত করেছিলেন। তিনি লিখেছেন আসরার-এ খুদী, রুমূজ-এ বেখুদী, বাং-এ দারা, বাল-এ-জিবরিল, পায়াম-এ মাশরেক, জাবূরে-এ আজম, জাভেদ নামা, জারবে-এ কালিম, আরমাগান-এ হিজাজ। কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও তাঁর ইংরেজি বক্তৃতাসংগ্রহে নিয়েও হওয়া বইয়েও তাঁর দর্শন ও বোধ নিয়ে ধারণা পাওয়া যায়।
ড. ইকবালের সর্বাধিক উদ্ধৃত কাব্যগ্রন্থ বাল-এ-জিবরিল (জিবরাইলের ডানা) লিখেছিলেন, ‘নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যাও, যেন তুমি কিছু করার আগে খোদা নিজেই জানতে চান, বলো, তোমার আকাঙ্ক্ষা কী?’
ইকবাল নিজেকে সেই উচ্চতায় সম্ভবত নিতে পেরেছিলেন। আল্লামা ইকবাল মারা গিয়েছিলেন বৃহস্পতিবার ফজরের আজানের সময়। যেদিন তিনি মারা যান সে রাতে ব্যাথানাশক হিসেবে মরফিন দিতে চাইলে ইকবাল তা নেননি।
তিনি বলেছিলেন, কোমায় গিয়ে তিনি মরতে চান না। মাতাল হয়ে তিনি রবের সঙ্গে মিলিত হতে চান না। সব কিছু দেখে শুনেই মরতে চান। ইকবাল মারা যাবার দিন রাতে জাভেদনামা পাঠ করিয়েছিলেন। নিজের লেখা কবিতা নিজেই শুনেছিলেন শেষবারের মতন। জাভেদনামা ছিল প্রকৃত সত্যসন্ধানী, মারেফাতের খোঁজে থাকা এক রুহের যাত্রা।
আজানের সময় যখন যাবতীয় আধ্যাত্মিক সত্যের সবই উন্মোচিত হয়- মারেফাতের সব পথ হয় উন্মুক্ত। তখন ইকবালের আত্মা সত্যের সন্ধানে প্রকৃতই সফরে বেরিয়েছিল। একেবারে রবের দরবারে। ১৯৩৮ এর এক ফজরের আজানে ইকবালের কাব্যপ্রার্থনা পূর্ণ হয়েছিল। ইকবাল মারা যাবার আগে অসিয়ত করেছিলেন, যেন বাদশাহী মসজিদের প্রাঙ্গণে তাঁকে দাফন করা হয়।
পাঞ্জাবের রাজধানী লাহোরের সে বাদশাহি মসজিদের পাশে আজ তার মাজার আছে ঠিক। কিন্তু সে সময়কার একমাত্র পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত পাঞ্জাবের প্রথম মুসলিম গভর্নর, তদানীং মুখ্যমন্ত্রী স্যার সিকান্দার হায়াত খান ইকবালের কবরের জন্য জমি দিতে সম্মত ছিলেন না।
এমনকি কবরের পর সেখানে মাজার নির্মাণকালেও বাধা-বিপত্তি ছিল প্রচুর। ইকবালের মাজার নির্মাণে এবং শেষকৃত্যে সরকারের তরফে এক রুপিও বরাদ্দ ছিল না। কিন্তু জনগণের মনের বাদশাহ ইকবাল ঠিকই ছিলেন। সেই বাদশাহি মসজিদের পাশে ইকবালের যে কবর তার পাশেই স্যার সিকান্দার হায়াত খানের কবর আজও বিদ্যমান। কত হাজারও মানুষ প্রতিনিয়ত ইকবালের কবর জিয়ারত করেন। কিন্তু কেউই সিকান্দারের কবরের দিকে সেই শ্রদ্ধা নিয়ে ভিড় করে না।
ইকবালের মৃত্যু পর তার জানাজায় অংশ নিয়েছিল সাকুল্যে ৮০ হাজার লোক। সিকান্দার হায়াত খান তার ল্যান্ডস্লাইড ভিক্টোরির সেই ‘৩৭ এর নির্বাচনে যত ভোট পেয়ে মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ইকবালের জানাজায় লোক অংশ নিয়েছিল তারচেয়ে ছয়/সাত গুণ বেশি।
আজ আল্লামা ইকবালের ১৪৮ তম জন্মবার্ষিকী। তাঁকে শ্রদ্ধা।