leadT1ad

সিনেমা হলে পপকর্ন এল কীভাবে

আজকাল প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা দেখার কথা ভাবলেই নাকে এসে লাগে গরম পপকর্নের ঘ্রাণ। দুনিয়াজুড়েই এই খাবার ছাড়া আজকের সময়ে সিনেমা দেখাটা অসম্পূর্ণ মনে হয়। কিন্তু কীভাবে ভুট্টার খই কীভাবে হয়ে উঠল সিনেমা-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ? এর পেছনের গল্প কিন্তু সিনেমার কাহিনীর চেয়ে কম আকর্ষণীয় নয়।

প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ১৪: ২৩
ছবি: স্ট্রিম গ্রাফিক

সিঙ্গেল স্ক্রিনের সিনেমা হল বা মাল্টিপ্লেক্স মানেই সিনেমা শুরুর আগে ধীরে ধীরে আলো নিভে যাওয়া। প্রথমে একটুখানি গুঞ্জন, তারপর সব চুপচাপ। আর একটু পরেই ডায়লগকে ছাপিয়ে কানের কাছে ক্রমাগত আসতে থাকা ‘ক্রাঞ্চ ক্রাঞ্চ’ শব্দ।

আজকাল প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা দেখার কথা ভাবলেই নাকে এসে লাগে মাখন জড়ানো গরম পপকর্নের ঘ্রাণ। দুনিয়াজুড়েই এই খাবার ছাড়া আজকের সময়ে সিনেমা দেখাটা অসম্পূর্ণ মনে হয়। কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখেছেন, ভুট্টার এই সাধারণ খই কীভাবে হয়ে উঠল গোটা সিনেমা-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ? এর পেছনের গল্প কিন্তু সিনেমার কাহিনীর চেয়ে কম আকর্ষণীয় নয়।

পপকর্ন কীভাবে সিনেমা-সংস্কৃতির প্রতীক হলো!

সিনেমা হলে পপকর্ন জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস, অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও মানুষের অভ্যাস পরিবর্তনের চমৎকার গল্প। পপকর্নের বৈজ্ঞানিক নাম ‘জিয়া মেস এভার্টা’। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের খাদ্যতালিকায় থাকলেও সিনেমা হলের মতো ঝাঁ-চকচকে জায়গায় প্রবেশাধিকার ছিল না এই খাবারের। উনিশ শতকের দিকে আমেরিকায় মেলা, সার্কাস বা খেলাধুলার মাঠের বাইরে পপকর্ন ফেরি করে বিক্রি হতো।

১৮৮৫ সালে চার্লস ক্রিয়েটরস নামের এক মিষ্টির দোকানের মালিক বাষ্পচালিত পপকর্ন মেশিন আবিষ্কার করেন। সংগৃহীত ছবি
১৮৮৫ সালে চার্লস ক্রিয়েটরস নামের এক মিষ্টির দোকানের মালিক বাষ্পচালিত পপকর্ন মেশিন আবিষ্কার করেন। সংগৃহীত ছবি

১৮৮৫ সালে চার্লস ক্রিয়েটরস নামের এক মিষ্টির দোকানের মালিক বাষ্পচালিত পপকর্ন মেশিন আবিষ্কার করলে এর জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায়। ভ্রাম্যমাণ এই মেশিনের কল্যাণে যেখানেই মানুষের ভিড়, সেখানেই পৌঁছে যেত গরম পপকর্নের সৌরভ। কিন্তু অভিজাত সিনেমা হলগুলো তখনো এই সাধারণ খাবার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলছিল।

একসময় সিনেমা হলে খাবার নিষিদ্ধ ছিল!

বিশ শতকের শুরুর দিকে সিনেমা হলগুলো আজকের মতো ছিল না। নির্বাক চলচ্চিত্রের সেই যুগে সিনেমা দেখা ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। থিয়েটার বা অপেরা হাউসের আদলে তৈরি এই হলগুলোতে থাকতো দামি গালিচা, মখমলের পর্দা আর জমকালো আসন। হল মালিকেরা চাইতেন তাঁদের দর্শকেরা যেন পরিশীলিত পরিবেশে সিনেমা উপভোগ করতে পারেন।

দিন বদলেছে, সিনেমার প্রযুক্তি বদলেছে কিন্তু সিনেমা হলে পপকর্ন খাওয়ার ঐতিহ্য বদলায়নি। নির্বাক চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে আজকের থ্রিডি, ফোর-ডিএক্স সিনেমার যুগেও হাতে পপকর্নের বাক্স নিয়ে আসনে বসার অনুভূতিটা একইরকম রয়ে গেছে।

এমন পরিবেশে পপকর্নের মতো খাবার ছিল পুরোপুরি বেমানান। পপকর্ন চিবানোর শব্দ দর্শকের মনোযোগ নষ্ট করতে পারে, আর এর উচ্ছিষ্ট দামী কার্পেটগুলো নোংরা করে ফেলতে পারে—এমন ভয়ে হল মালিকেরা ভেতরে সকল ধরণের খাবার নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। পপকর্নকে তখন বিবেচনা করা হতো নিম্নবিত্তের খাবার হিসেবে। অভিজাত জায়গায় নয়, বরং রাস্তার পাশের মেলা বা সার্কাসের সঙ্গেই বেশি মানানসই।

তারপর এল মহামন্দা, পাল্টে গেল নিয়ম

১৯২৯ সালে আমেরিকায় শুরু হলো ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ নামে পরিচিত ইতিহাসের ভয়াবহতম অর্থনৈতিক সংকট। এই মহামন্দার আঁচ এসে লাগল প্রায় প্রতিটি ব্যবসায়, এমনকি চলচ্চিত্রের জগতেও। মানুষের হাতে পয়সা কমে গেলেও বিনোদনের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল না। বরং কঠিন বাস্তবতার থেকে কিছুক্ষণের জন্য পালাতে মানুষ আরও বেশি করে সিনেমার দিকে ঝুঁকতে শুরু করল।

একই সময়ে চলচ্চিত্রে আরেকটি বড় বিপ্লব ঘটে গেল। নির্বাক যুগের অবসান ঘটিয়ে সবাক চলচ্চিত্রের বা ‘টকিজ’র আগমন হলো। পর্দায় ভেসে ওঠা লেখা পড়ার বাধ্যবাধকতা আর না থাকায় সমাজের সব স্তরের মানুষ, শিক্ষিত বা অশিক্ষিত সিনেমার দর্শক হয়ে উঠল। দর্শক বাড়লেও মহামন্দার কারণে হল মালিকদের আয় কমে যাচ্ছিল। টিকে থাকার জন্য তাঁরা মরিয়া হয়ে নতুন আয়ের পথ খুঁজছিলেন।

সিনেমার প্রযুক্তি বদলেছে কিন্তু সিনেমা হলে পপকর্ন খাওয়ার ঐতিহ্য বদলায়নি। সংগৃহীত ছবি
সিনেমার প্রযুক্তি বদলেছে কিন্তু সিনেমা হলে পপকর্ন খাওয়ার ঐতিহ্য বদলায়নি। সংগৃহীত ছবি

ঠিক এই সময়েই তাঁদের চোখে পড়ল হলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা পপকর্ন বিক্রেতাদের ব্যবসা। তাঁরা দেখলেন, সিনেমা দেখতে আসা দর্শকেরা পকেটের সামর্থ্য অনুযায়ী পপকর্ন কিনছে। প্রথমে কিছু হল মালিক হলের বাইরে থেকে পপকর্ন কিনে হলে প্রবেশ করা আটকাতে দর্শকদের কোটের সঙ্গে পপকর্নের প্যাকেটও জমা রাখতে বাধ্য করত। কিন্তু পরে তাঁরা বুঝতে পারলেন এই স্রোতকে বাধা দেওয়ার চেয়ে এর সঙ্গে গা ভাসানোই বুদ্ধিমানের কাজ।

হল মালিকরা বুঝে গেলেন ‘পপকর্ন মানে লাভ’

খুব দ্রুতই সিনেমা হলের মালিকরা সহজ ব্যবসায়িক অঙ্ক বুঝতে পারলেন। ভুট্টার দানা বেশ সস্তা। অথচ ভুট্টা থেকে তৈরি পপকর্ন বিক্রি করা যেত অনেক চড়া দামে। যেখানে সিনেমার টিকিট বিক্রির লভ্যাংশের একটি বড় অংশ সিনেমার পরিবেশকদের দিয়ে দিতে হতো, সেখানে পপকর্ন বিক্রির পুরো লাভটাই হলের মালিকের পকেটে যেত।

এই বিশাল লাভের সম্ভাবনা দেখে হল মালিকরা বাইরের ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতাদের হটিয়ে দিয়ে নিজেদের লবিতেই পপকর্ন বিক্রির ব্যবস্থা করলেন। মহামন্দার সেই কঠিন সময়ে পপকর্ন বিক্রির টাকাই অনেক হলকে দেউলিয়া হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল।

এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন চিনি রেশনিংয়ের কারণে ক্যান্ডি বা সোডার মতো মিষ্টি জিনিসের আকাল দেখা দিল, তখন পপকর্নের জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায়। পপকর্ন হয়ে উঠল সিনেমা হলের প্রধান ও প্রায় একমাত্র সহজলভ্য খাবার।

পপকর্নের গন্ধে টিকে গেল সিনেমা হল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে পপকর্ন সিনেমা হলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠল। ১৯৪৫ সাল নাগাদ আমেরিকায় খাওয়া মোট পপকর্নের প্রায় অর্ধেকই বিক্রি হতো সিনেমা হলে। পপকর্নের মন ভোলানো গন্ধ, খাওয়ার সহজ ধরন (সিনেমা থেকে চোখ না সরিয়েই খাওয়া যায়), আর সাশ্রয়ী দাম—সব মিলিয়ে পপকর্ন সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতার এক অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠল।

পপকর্ন চিবানোর শব্দ দর্শকের মনোযোগ নষ্ট করতে পারে, আর এর উচ্ছিষ্ট দামী কার্পেটগুলো নোংরা করে ফেলতে পারে—এমন ভয়ে হল মালিকেরা ভেতরে সকল ধরণের খাবার নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন।

এই ব্যবসায়িক মডেলের সফলতা দেখে পরবর্তী সময়ে বিশ্বের প্রায় সব দেশের সিনেমা হলই পপকর্নকে সাদরে গ্রহণ করে। আজ অত্যাধুনিক মাল্টিপ্লেক্সে নানা ধরনের খাবারের সমাহার থাকলেও, পপকর্নের রাজত্বে কেউ ভাগ বসাতে পারেনি। এর পেছনে অর্থনৈতিক কারণ তো আছেই, পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক কারণও আছে। সিনেমা হলের লবিতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই নাকে আসা গরম সুবাসিত পপকর্নের গন্ধ দর্শকদের মধ্যে সিনেমা দেখার এক ধরনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে।

আজও সেই ঐতিহ্য

দিন বদলেছে, সিনেমার প্রযুক্তি বদলেছে কিন্তু সিনেমা হলে পপকর্ন খাওয়ার ঐতিহ্য বদলায়নি। নির্বাক চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে আজকের থ্রিডি, ফোর-ডিএক্স সিনেমার যুগেও হাতে পপকর্নের বাক্স নিয়ে আসনে বসার অনুভূতিটা একইরকম রয়ে গেছে। সাধারণ ভুট্টা দানার খই থেকে বিশ্বব্যাপী সিনেমা সংস্কৃতির প্রতীকে পরিণত হওয়ার এই যাত্রা সত্যিই বিস্ময়কর।

আসলে সিনেমা হলগুলো শুধু সিনেমা বিক্রি করে না, বিক্রি করে পরিপূর্ণ অভিজ্ঞতা। আর সেই অভিজ্ঞতার বড় অংশ জুড়ে রয়েছে পপকর্নের নোনতা-মিষ্টি স্বাদ আর মনমাতানো গন্ধ।

Ad 300x250

সম্পর্কিত