অবশেষে যে আশঙ্কা আমরা মনের গভীরে লালন করছিলাম, তা সত্যি হলো। ফেসবুক নাকি অবশেষে কমেন্টের জন্য ‘ডিসলাইক’ বাটন এনেছে। হ্যাঁ, ওই বাটনটা! যেটা দেখলে প্রথমে মনে হবে, আহা, কী নিরীহ! ছোট্ট একটা থাম্বস নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু ভুলে যাবেন না, এই সেই বাটন, যা এক ক্লিকেই বন্ধুত্বে ফাটল ধরাতে পারে, আত্মসম্মান গলিয়ে দিতে পারে আর অহংকারে ছ্যাঁকা দিতে পারে।
যদিও এখনো সবার নিউজফিডে ৭ দশমিক ৫ রিখটার স্কেলের সেই মহাধ্বংসী বাটনটা দেখা যায়নি, তবে খবরটা বাতাসে ভাসছে। খুব শিগগিরই হয়ত একদিন সকালে চা হাতে ফোন খুলে দেখবেন, কমেন্টের নিচে একটা ছোট্ট থাম্বস নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। দেখে মনে হবে বাটনটি যেন ভদ্রভাবে বলতে চাইছে, ‘তোমার কথা কেউই পছন্দ করেনি।’
সেদিনই বুঝবেন, মানবসভ্যতা কোনো দিকেই এগোয়নি। বরং সৌজন্যবোধ নামের পাহাড় থেকে খুশিমনে গড়িয়ে পড়েছে সোজা ডিসলাইক উপত্যকায়। এই হলো আমাদের অগ্রগতি।
যা হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে
কিন্তু একটা কথা নিশ্চিত, ফেসবুকের কসম, এই বাটন আসার পর ফেসবুকাররা আর আগের মতো থাকবে না। ধরা যাক, আগে কেউ যদি লিখত, ‘ভাই, আমি আজ প্রথম নিজের হাতে পায়েস রান্না করলাম!’ তাহলে ৮টা লাইক, ৩০টা লাভ রিয়্যাক্ট আর ১টা কুকিং টিপস কমেন্ট পেত।
আর এখন?
প্রথম কমেন্টেই হয়তো কেউ লিখবে, ‘চিনি বেশি দিয়েছ মনে হয়।’ তার নিচে ঠাস করে পাঁচটা ডিসলাইক। অর্থাৎ পায়েস এখন জাতীয় বিতর্কের বিষয়।
সেদিন আমার এক বন্ধু ডিসলাইক বাটন আসার খবর শুনে বলল, ‘ডিসলাইক বাটন এলে মানুষের আসল চরিত্র বের হবে।’ আমি বললাম, ‘দোস্ত, মানুষের চরিত্র বের করার জন্য তো আমরা ফেসবুকেই এসেছিলাম!’ সে হেসে বলল, ‘না রে, এবার বুঝবি কে তোরে সহ্য করতে পারে, আর কে শুধু তোর স্ট্যাটাসে নাটক দেখতে আসে।’
ভাবলাম, ব্যাপারটা সত্যিই সিরিয়াস। এটা এখন সম্পর্ক মাপার নতুন যন্ত্র। বাংলাদেশের ফেসবুকার সমাজ এখন নতুন বিভাজনে পড়তে পারে। আগে যেমন ছিল ‘প্রো-লাইক’ বনাম ‘নো-রিয়্যাক্ট’। এখন হতে পারে ‘লাইকপন্থী’ বনাম ‘ডিসলাইকপন্থী’।
ফেসবুকে নতুন গৃহযুদ্ধের সূচনা যেন একদম দরজায় এসে থেমে আছে। সংগৃহীত ছবিএমনও হতে পারে, কোনো রাজনৈতিক দলের পোস্টে একদল একসঙ্গে ডিসলাইক দেবে, আরেক দল একসঙ্গে লাইক। পরদিন সকালে ‘আনোয়ার টিভি’তে ব্রেকিং নিউজ হতে পারে, ‘কমেন্টে লাইক-ডিসলাইক সংঘর্ষে আহত ৭, রিয়্যাক্ট তাণ্ডবের অভিযোগে ৩ আইডি সাসপেন্ড।’
নতুন এই ডিসলাইক বাটন ফেসবুকের সাইকোলজিক্যাল অর্থনীতিতেও বিপ্লব আনবে। কিন্তু কীভাবে? কারণ, আগে আমরা প্রায় সবাই পোস্ট দিতাম ‘লাইক পাওয়ার আশায়’। আর এখন পোস্ট দেব ‘ডিসলাইক এড়ানোর আশায়’। অর্থাৎ, ফেসবুকের আত্মবিশ্বাস-ভিত্তিক সমাজ এখন রূপ নিচ্ছে ‘ডিসলাইক আতঙ্ক’ আক্রান্ত সমাজে।
শুধু তাই নয়, অনলাইন কূটনীতি এক নতুন মাত্রা পাবে। সেলিব্রিটিরা এখন থেকে আর কমেন্ট সেকশন খুলে রাখবে না।
আগে কেউ যদি লিখত, ‘আপনার গান আর আগের মতো ভালো লাগেনা।’ তখন তিনি হয়ত কূটনৈতিকভাবে জবাব দিতেন, ‘ধন্যবাদ, চেষ্টা করছি।’ এখন ওই কমেন্টে হয়ত আরো ৪০০টা ডিসলাইক পড়ে যাবে। ‘যা জানা গেল ডটকম’ নিউজও করে ফেলবে, ‘শ্রোতারাও ক্ষুব্ধ, গায়ককে ঘিরে ডিসলাইক ঝড়। যা জানা গেল’
তবে এই বাটন সবচেয়ে বেশি কাজে লাগবে আত্মীয়দের মধ্যে। যেমন, আমার দূরসম্পর্কের খালা যদি কমেন্ট করে, ‘বাবা বিয়ে কবে করছ?’ এখন আমি নীরবে একটা ডিসলাইক দিতে পারব। এভাবেই ফেসবুক হয়তো পারিবারিক কূটনীতি বাঁচাবে।
কিন্তু সব চেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এখন মানুষ নিজেকেও ডিসলাইক দেবে। পাঁচ বছর আগে দেওয়া নিজের কমেন্টে গিয়ে কেউ বলবে, ‘এমন বাজে কথা আমি লিখেছিলাম?’ তারপর নিজের কমেন্টেই ডিসলাইক। অর্থাৎ, আত্মসমালোচনার নতুন মাত্রা।
তবে অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, এবার থেকে ফেসবুক কমেন্ট পড়া মানে হবে মানসিক জিমে যাওয়া। প্রতিদিন নিজের সহ্যশক্তির পরীক্ষা। কে জানে, হয়তো কয়েক মাস পর আমরা শুনব ‘ডিসলাইক অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার’ নামে নতুন মানসিক রোগ ধরা পড়েছে।
তবে সবই খারাপ নয়। এই বাটনের কিছু ইতিবাচক দিকও আছে। যেমন আগে মানুষ কমেন্টে ৭০০ শব্দের তর্ক লিখত। এখন? একটা ডিসলাইক, কাজ শেষ। অর্থাৎ, সময় বাঁচছে। রাগ ওঠার সময় তিনবার শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে ডিসলাইক দেওয়া, যেন আত্মশুদ্ধির মতো কিছু।
সবশেষে যখন কেউ আর কিছু বুঝবে না, তখন শুধু বসে থাকবে নিজের কমেন্ট সেকশন ঘেঁটে, কে কোথায়, কখন, কেন ডিসলাইক দিয়েছে। তখন হয়তো ফেসবুকে আরেকটি ডিজলাইকের নতুন নোটিফিকেশন আসবে। তারপরই আপনি গভীর নিঃশ্বাস ফেলে ভাববেন, ‘জীবনটা কি সত্যিই এত বাজে নাকি অ্যালগরিদম আমার বিপক্ষে?’ ধীরে ধীরে বুঝবেন, এখন আর কেউ কারও কথায় মনোযোগ দেয় না, শুধু রিয়্যাক্ট দেয়।