দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সরকার শ্রম আইন সংশোধন করে নতুন অধ্যাদেশ জারি করেছে, যা দেশের শ্রমিক এবং শিল্প খাতের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে গঠিত শ্রম কমিশন এবং জাতীয় ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদে (এনটিসিসি) দীর্ঘ আলোচনার ফসল এই সংশোধনী। যদিও রাতারাতি সবকিছুর পরিবর্তন সম্ভব নয়, তবে এই গেজেটটি শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষায় নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক এবং যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
সংশোধিত আইনের সবচেয়ে বড় অর্জনগুলোর একটি হলো ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সহজ করা। এর আগে, ইউনিয়ন গঠনের জন্য একটি প্রতিষ্ঠানের ২০ শতাংশ বা প্রতিষ্ঠানপুঞ্জের ৩০ শতাংশ শ্রমিকের সমর্থনের প্রয়োজন হতো, যা ছিল অত্যন্ত কঠিন একটি শর্ত। নতুন অধ্যাদেশে এই শতকরা হারের পরিবর্তে সংখ্যা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এখন মাত্র ২০ জন শ্রমিক একত্রিত হয়ে ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন, যা পর্যায়ক্রমে সর্বোচ্চ ৪০০ জন পর্যন্ত নির্ধারিত থাকবে। এটি শ্রমিকদের সাংবিধানিক অধিকার তথা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংগঠিত হওয়ার পথকে সুগম করবে। এছাড়া, রেজিস্ট্রেশনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রত্যয়নপত্র এখন থেকে দশ কর্মদিবসের মধ্যে প্রদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যা হয়রানি কমাবে।
এই সংশোধনীতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যুক্ত হয়েছে, যা শ্রমিকের মর্যাদা এবং কর্মক্ষেত্রের সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয়। উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনগুলো হলো—
‘নারী’ শব্দের স্বীকৃতি: আইনে সর্বত্র ‘মহিলা’ শব্দের পরিবর্তে ‘নারী’ শব্দটি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এটি কেবল একটি আভিধানিক পরিবর্তন নয়, বরং নারী শ্রমিকদের প্রতি সম্মান ও মর্যাদার স্বীকৃতি, যা তাদের অবমূল্যায়ন করার মানসিকতার বিরুদ্ধে একটি বড় পদক্ষেপ।
যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ: আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কনভেনশন-১৯০ এর আলোকে যৌন নিপীড়ন ও সহিংসতাবিরোধী নীতিমালা, অভিযোগ সেল গঠন এবং নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটি কর্মক্ষেত্রে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।
বৈষম্য নিষিদ্ধকরণ: আইনের ৩২৫(ক) ধারায় নতুন করে শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্যকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ বা অন্য কোনো পরিচয়ের ভিত্তিতে বৈষম্যমূলক আচরণকে স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
শ্রমিকের সংজ্ঞার প্রসার: গৃহশ্রমিক এবং দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করা শ্রমিকদেরও শ্রমিকের সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশের ইনফরমাল সেক্টরের একটি বড় অংশ আইনি স্বীকৃতির আওতায় এল।
নতুন অধ্যাদেশে শ্রমিকদের জন্য বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। উৎসব ছুটি ১১ দিনের পরিবর্তে ১৩ দিন করা হয়েছে। মাতৃত্বকালীন ছুটি ১১২ দিন থেকে বাড়িয়ে ১২০ দিন করা হয়েছে। যদিও শ্রমিকদের দাবি ছিল ছয় মাস বা ১৮০ দিনের, তবুও এই বৃদ্ধিকে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তবে কিছু অতৃপ্তিও রয়ে গেছে। শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের দাবি, একটি স্থায়ী ‘জাতীয় ন্যূনতম মজুরি কমিশন’ গঠনের সুপারিশটি এই অধ্যাদেশে স্থান পায়নি। মজুরি কাঠামো পাঁচ বছরের পরিবর্তে প্রতি তিন বছর পর পর মূল্যায়নের বিষয়টিও চূড়ান্ত আইনে প্রতিফলিত হয়নি।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, কারখানার লাইসেন্স নবায়নের সময়সীমা এক বছর থেকে বাড়িয়ে পাঁচ বছর করা হয়েছে। রানা প্লাজা বা তাজরিনের মতো কাঠামোগত দুর্ঘটনার ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে, এত দীর্ঘ সময়ের জন্য লাইসেন্স নবায়নের সুযোগ কারখানার নিরাপত্তা তদারকিকে দুর্বল করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা থেকে যায়।
সার্বিকভাবে, এই শ্রম আইন সংশোধনীটি শ্রমিকপক্ষ, মালিকপক্ষ ও সরকারের ত্রিপক্ষীয় প্রচেষ্টার একটি সফল উদাহরণ। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বড় অর্জন, যা শ্রমিকদের অধিকার আদায় এবং মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নতুন মাত্রা যোগ করবে। আমি মনে করি, এই অর্জন আমাদের শ্রমিকদের যাঁরা গণ-আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছেন, যাঁরা বিভিন্ন মজুরি আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছেন, লড়াই সংগ্রাম করছেন এবং বাংলাদেশের শিল্প খাতকে যাঁরা আসলে বিকশিত করছেন, তাঁদের ত্যাগের ফল। শ্রমিকসহ সকল স্টেকহোল্ডার প্রত্যেকেরই কন্ট্রিবিউশন আছে এখানে। সবাই মিলেই আমরা এটা করতে পেরেছি।
তবে আইন প্রণয়নই শেষ কথা নয়; এর সঠিক বাস্তবায়ন এবং কর্মক্ষেত্রে একটি সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং এই অধ্যাদেশ সেই পথেই একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
লেখক:
শ্রমিক ও নারী অধিকারকর্মী, আলোকচিত্রী
অনুলিখন: মুজাহিদুল ইসলাম