দুচোখ হারিয়েছেন ইবাদ হোসেন। বয়স মাত্র ১৮। গত বছরের ১৯ জুলাই জেলখানা মোড়ে গুলি খেয়ে তাঁর চোখের আলো নিভে গেছে। তবু মনটা অন্ধকারে ডুবে যায়নি। সেই মনই তাকে হাতড়ে হাতড়ে নিয়ে এসেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের করিডোরে। ন্যায়বিচারের আশায় আজ তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন জীবন্ত শহীদদের সারিতে।
তিনি একা নন। কেউ কৃত্রিম পায়ে ভর দিয়ে, কেউ মেরুদণ্ডের ক্ষত নিয়ে, কেউবা সন্তানের ছবি বুকে চেপে গতকাল আদালতে এসেছিলেন শহীদ পরিবারের সদস্যরা।
বিকেল গড়িয়ে যখন ট্রাইব্যুনাল-১ গণ–অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করলেন, তখন এজলাসে নিস্তব্ধতা ভেঙে ওঠে কান্না আর নিয়মবিরুদ্ধ হাততালিতে।
একই সঙ্গে কক্ষের এক কোণে কালো ছায়ার মতো ঠায় বসে ছিলেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। তার প্রতি আদালতের পাঁচ বছরের সাজা শহীদ পরিবারগুলোর মনে নতুন ক্ষোভ জাগিয়েছে। যদিও তিনি নিজের অপরাধের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমি পুলিশ প্রধান হিসেবে লজ্জিত, অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী।’
রায়ের পর শহীদ আহনাফের মা হাত তুলে ফিসফিস করে বলেন, আলহামদুলিল্লাহ।
পাশেই থাকা শহীদ সৈকতের বোন সেবন্তী হতবাক হয়ে জানতে চান, ‘পাঁচ বছরের কারাদণ্ড কি ঠিক হলো ভাই?’
বাইরে বেরিয়ে তিনি আরও স্পষ্ট বলেন, রাজসাক্ষী বলে পাঁচ বছর দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এটা আমাদের সন্তুষ্ট করেনি।
একই অবস্থান শহীদ ফারহান ফাইয়াজের বাবা শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়ারও। তিনি বলেন, রায়ের জন্য আদালতকে ধন্যবাদ। কিন্তু পুরো নিশ্চিন্ত হবো তখনই, যখন এ রায় কার্যকর হবে।
ছেলে মুগ্ধকে হারানো মীর মুস্তাফিজুর রহমান যেন নিজের মনের জমাট বেদনা উগরে দিলেন। ছেলে ছিল ২৬ বছরের। সেটা আমার জীবনের অপূরণীয় ক্ষতি। শেখ হাসিনার রায়ে আমরা সন্তুষ্ট, কিন্তু আইজিপি মামুনের শাস্তি খুবই কম। প্রয়োজনে আমরা আপিল করব।
শহীদ মীর মুগ্ধের ভাই স্নিগ্ধের কথাও একই রকম, ‘রাজসাক্ষী বলে তাকে যে ছাড় দেওয়া হয়েছে, তা শহীদ পরিবার মেনে নিতে পারছে না।’
জুলাই আন্দোলনে নিহত শহীদ মিরাজের বাবা আব্দুর রব বলেছেন, ‘আমার ছেলেকে তো আমি আর পাবো না। ছেলেকে হত্যার জন্য খুনি শেখ হাসিনার যেন ফাঁসি হয়, সেটা নিজ চোখে দেখতে এসেছি। হাসিনার ফাঁসির আদেশ হলে আমার ছেলে মিরাজের কবরের কাছে গিয়ে বলব, বাবা তোমাকে হত্যার জন্য হাসিনার বিচার হয়েছে।’
আব্দুর রব বলেন, দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই। এই দেশে যেন আর কোনো সরকার এমন করতে না পারে। দেশে জবাবদিহিতা তৈরি করতে হবে এই বিচারের মধ্য দিয়ে।
আব্দুর রব বলেন, ‘আমার ছেলে মিরাজকে ৫ আগস্ট হত্যা করা হয়। আমার মিরাজ মাথায় পতাকা দিয়ে বের হয়েছিল। ছেলে সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থী ছিল। এ গণহত্যার হুকুমদাদের মৃত্যুর আদেশ যেন শুনতে পাই।’
আজকের আদালত প্রাঙ্গণ যেন এক জীবন্ত স্মারক। কৃত্রিম পায়ের ধাতব শব্দ আর সাদা ছড়ির খটখট শব্দে ভারী হয়ে ছিল চারপাশ।
গাজীপুরের মুরসালিন, বয়স ১৭; ৫ আগস্ট গুলি লেগে এক পা হারিয়েছে। তার কৃত্রিম পা আজও তাকে আদালত পর্যন্ত টেনে এনেছে।
পাবনার আলামিন, বরিশালের রিফাত, মাদারীপুরের জাকির, নারায়ণগঞ্জের রাকিব—সবাই ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সামনে গুলিতে পা হারানো তরুণ।
রাঙ্গামাটির আমান উল্লাহ, চট্টগ্রামের আমজাদ হোসেন, কারওয়ান বাজারের সাব্বির আহমেদ—তাদের চোখে আলো নেই, কিন্তু আজ তারা অন্ধকারের ভেতর দাঁড়িয়েই ন্যায়বিচারের খবর শুনেছেন।
আইজিপি মামুনের কম সাজা নিয়ে বিতর্কের পেছনে রয়েছে তার জবানবন্দি। গত ৩ সেপ্টেম্বর তিনি দোষ স্বীকার করে আদালতে জানান, আন্দোলন দমনে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ এসেছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে। তিনি আরও বলেন, মন্ত্রিসভার কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা এই হত্যাযজ্ঞে উৎসাহ ও সমন্বয়ের ভূমিকা রেখেছিলেন। র্যাবের টিএফআই সেলের মতো গোপন বন্দিশালার কথাও তিনি স্বীকার করেন।
আজ যারা আদালতে এসেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন শহীদ সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ সেবন্তী, শহীদ মুগ্ধের ভাই মীর স্নিগ্ধ, শহীদ আহনাফের মা শাফাক সিদ্দিকি, শহীদ নাফিজের বাবা গোলাম রহমান, শহীদ ফারহানের বাবা শহীদুল ইসলাম, শহীদ শাহরিয়ারের বাবা আব্দুল মতিন, শহীদ রাব্বীর বোন মীম আক্তার, শহীদ তাহির জামানের মা সামসি আরা জামান এবং আরও অনেকে।
দিনের শেষ আলো নিভে আসছিল। আদালত প্রাঙ্গণ থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন জুলাই-আহতরা। কৃত্রিম পায়ের ক্লান্ত শব্দ আর সাদা ছড়ির টোকা মিলিয়ে যাচ্ছিল সন্ধ্যার ভেতর। কিন্তু তাঁদের চাহনি বলছিল, ন্যায়বিচারের লড়াই এখানেই শেষ নয়।