leadT1ad

ভারত কি শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে বাধ্য, কী রয়েছে চুক্তিতে

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক

প্রকাশ : ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২১: ৩৫
স্ট্রিম গ্রাফিক

ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পরপরই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে হাসিনাকে প্রত্যর্পণের আহ্বান জানিয়েছে ভারতের কাছে। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, খুব শিগগিরই এ বিষয়ে ভারতে আনুষ্ঠানিক অনুরোধও পাঠানো হবে। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যান। তখন থেকেই তিনি সেখানে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন।

বাংলাদেশের দাবি, দুই দেশের একটি দ্বিপাক্ষিক প্রত্যর্পণ চুক্তির ভিত্তিতে এক্ষেত্রে ভারতের ‘বাধ্যতামূলক দায়িত্ব’ রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে ওই চুক্তি ২০১৩ সালে করা হয়। ওই চুক্তির পর শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশ সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলোর বেশ কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছিল।

বাংলাদেশের এই আহ্বানের পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও একটি বিবৃতি দেওয়া হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিষয়ে ঘোষিত রায় ভারত লক্ষ্য করেছে। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত সর্বদা বাংলাদেশের জনগণের উত্তম স্বার্থে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এর মধ্যে রয়েছে দেশের শান্তি, গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। এই লক্ষ্য অর্জনে ভারত সব পক্ষের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে সম্পৃক্ত থাকবে।’

এসব বক্তব্যের পর প্রশ্ন উঠেছে—ভারত কি সত্যিই আইনগতভাবে হাসিনাকে হস্তান্তর করতে বাধ্য? ঘরোয়া আইন, আন্তর্জাতিক বিধান এবং দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে কী বলা আছে?

ভারত–বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তি

২০১৬ সালে এর কিছু ধারা সংশোধন করা মূল প্রত্যর্পণ চুক্তিটি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ২০১৩ সালের ২৮ জানুয়ারি স্বাক্ষরিত হয়। প্রক্রিয়া আরও সহজ করার স্বার্থে সংশধনিগুলো আনা হয়। শেখ হাসিনার শাসনামল এবং ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সরকারের সময় এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির লক্ষ্য ছিল সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদ, বিদ্রোহ ও আন্তসীমান্ত অপরাধ দমন।

চুক্তিতে বলা আছে, যেসব অপরাধে দুই দেশে অন্তত এক বছরের কারাদণ্ড হতে পারে, সেগুলো প্রত্যর্পণের আওতায় পড়বে। একই সঙ্গে একাধিক অপরাধে গঠিত ‘কম্পোজিট অফেন্স’-ও এতে অন্তর্ভুক্ত। হাসিনার বিরুদ্ধে আনা হত্যাকাণ্ড ও মানবতাবিরোধী অপরাধও এসবের মধ্যে পড়ে। এসব কোনও রাজনৈতিক অপরাধ নয়। চুক্তিতে স্পষ্ট বলা আছে, সহিংসতা, হত্যা বা গুমের মতো ঘটনায় রাজনৈতিক অপরাধের ছাড় প্রযোজ্য হবে না।

ব্যতিক্রম ও প্রত্যাখ্যানের সুযোগ

রাজনৈতিক উদ্দেশ্য: যদি অপরাধ রাজনৈতিক চরিত্রের হয়, তবে প্রত্যর্পণ ‘নাকচ করা যেতে পারে।’ চুক্তিতে স্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে, অপরাধটির যদি রাজনৈতিক চরিত্র থাকে, তা হলে প্রত্যর্পণ করা হবে না।

চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, সেখানে স্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে যে, বিচারের নেপথ্যে যদি সৎ কোনও উদ্দেশ্য না-থাকে, তা হলে ভারত বা বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে প্রত্যর্পণ করবে না। যদি অনুরোধ সুস্পষ্টভাবে বৈষম্যমূলকও হয়, ভারত তা প্রত্যাখ্যান করতে পারে।

শেখ হাসিনার আইনজীবীরাও বলছেন, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে সৃষ্ট। শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণ না-করার জন্য এই যুক্তিগুলো খাড়া করতে পারে ভারত।

মৃত্যুদণ্ড ও মানবাধিকার ঝুঁকি: চুক্তিতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে প্রত্যর্পণে সরাসরি নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে আন্তর্জাতিক বিধান অনুযায়ী, মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ঝুঁকি বা নির্যাতনের আশঙ্কা থাকলে প্রত্যর্পণ নাকচ করা যায়। ভারত সাধারণত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের প্রত্যর্পণের আগে শাস্তি লঘু করার নিশ্চয়তা চায়। ভারত আইসিসিপিআর–এর সদস্য। তাই ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা ও নন-রিফাউলমেন্ট নীতিও বিবেচনায় রাখতে হবে।

‘নন-রিফাউলমেন্ট’ আন্তর্জাতিক আইনের একটি মৌলিক নীতি। এই নীতিতে কাউকে এমন স্থানে ফেরত পাঠানো নিষিদ্ধ যেখানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নির্যাতন, নিপীড়ন বা অন্যান্য গুরুতর ক্ষতির ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। এই সুরক্ষা আশ্রয়প্রার্থী, শরণার্থী ও অভিবাসীদের জন্য প্রযোজ্য। তাদের আইনগত অবস্থান যাই হোক না কেন, নীতিটি একইভাবে প্রযোজ্য হয়। শরণার্থী আইনের মূল ভিত্তিগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। নীতিটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তিতে লিপিবদ্ধ আছে এবং প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনেরও অংশ।

ভারতের আইনে কী বলা আছে?

ভারতের এক্সট্রাডিশন অ্যাক্ট, ১৯৬২-র মাধ্যমে প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়। এই আইনে ম্যাজিস্ট্রেটের তদন্ত এবং কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন বাধ্যতামূলক। আদালত দেখে যে অপরাধটি প্রত্যর্পণের যোগ্য কি না। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নির্বাহী বিভাগ নেয়।

ভারত অতীতে অপরাধীদের বাংলাদেশে প্রত্যর্পণ করেছে, বিশেষ করে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সদস্যদের। তাঁদেরকে আইনে সন্ত্রাসী হিসেবে গন্য করা হয়েছে। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বিশেষ করে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কাউকে কখনো প্রত্যর্পণ করেনি।

আবু সালেমকে পর্তুগাল থেকে ভারতে প্রত্যর্পণের ঘটনা একটি উদাহরণ। ফেরত দেওয়ার শর্ত ছিল যে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে না। ভারতও একই ধরনের নিশ্চয়তা চায়। ভারতের সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছে যে মানবিক কারণেও প্রত্যর্পণ প্রত্যাখ্যান করা যায়। এর মধ্যে ন্যায্য বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কাও অন্তর্ভুক্ত।

ভারতের সঙ্গে শেখ হাসিনার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ ছিল। নিরাপত্তা ও বাণিজ্য—দুই ক্ষেত্রেই তিনি ভারতের প্রধান সহযোগী হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। ফলে ভারতের পক্ষে তাঁকে প্রত্যর্পণ করা প্রায় অসম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে।

শেখ হাসিনাকে ফেরত না দিলে ইউনুস সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক তিক্ত হতে পারে। তবুও ভারত সাধারণত কৌশলগত স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়। বাংলাদেশি নেতাদের আশ্রয় দেওয়ার একটি ঐতিহাসিক ধারা ভারতের রয়েছে। তাছাড়া, মৃত্যুদণ্ডের সাজা বহাল থাকলে বাংলাদেশ ভারতের কাছে দণ্ড লঘু করার নিশ্চয়তা দেবে, এ সম্ভাবনা অত্যন্ত কম। ফলে প্রত্যর্পণের সম্ভাবনাও কমে যায়।

সব মিলিয়ে বলা যায়, চুক্তিটি প্রক্রিয়া নির্ধারণ করলেও, বিভিন্ন ব্যতিক্রম ও ভারতের বিবেচনাধিকার-নির্ভর অবস্থান একে বাধ্যতামূলক করে না। বিশেষ করে মৃত্যুদণ্ড থাকা অবস্থায় ভারত চাইলে সহজেই প্রত্যর্পণ প্রত্যাখ্যান করতে পারে। তাই সিদ্ধান্তটি হবে আইন, কূটনীতি এবং রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের সমন্বয়ে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত