leadT1ad

হাতে তসবিহ, চেহারায় দুশ্চিন্তা, লঘু দণ্ডে স্বস্তি ফিরেছে সাবেক আইজিপি মামুনের

স্ট্রিম প্রতিবেদক
স্ট্রিম প্রতিবেদক
ঢাকা

প্রকাশ : ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২২: ২০
সকাল ৯টার দিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির হন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। সংগৃহীত ছবি

আজ সোমবার সকাল ৯টার দিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির হন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। মুখে মাস্ক, হাতে ডিজিটাল তসবিহ। দুপুর ১২টা ২৮ মিনিটে রায় পড়া শুরু হয়। পৌনে তিনটা পর্যন্ত রায়ের সারসংক্ষেপ পড়া চলাকালে হাফ হাতা শার্ট পরিহিত মামুনকে বিমর্ষ আর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখা যায়। এই পুরো সময়ের বেশিরভাগ তিনি মাথা নিচু করে একনাগাড়ে হাতে থাকা তসবিহ ঘুরাচ্ছিলেন। কিন্তু রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মুখে এক ধরনের স্বস্তি ফিরে আসে। কারণ, ছয়টি মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অভিযোগ প্রমাণিত হলেও রাজসাক্ষী হওয়ায় তিনি লঘু দণ্ড পেয়েছেন।

ট্রাইব্যুনাল সূত্র থেকে জানা যায়, মামলার মূল আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের মতোই মামুনের বিরুদ্ধেও দুটি অভিযোগের অধীনে ছয়টি কাউন্টে মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। তবে স্বেচ্ছায় রাজসাক্ষী হয়ে তদন্তে সহায়তা করায় এবং সত্য প্রকাশে ভূমিকা রাখার কারণে তাঁকে পাঁচ বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে।

রায়ে আইজি মামুনের স্বস্তি মিললেও আদালত কক্ষে উপস্থিত শহীদ পরিবারের সদস্যরা এই লঘু দণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

রায় শোনার পর এজলাসে থাকা শহীদ মাহমুদুর রহমান সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ সেবন্তী হতবাক হয়ে পাশের জনকে প্রশ্ন করেন, পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ঠিক হলো ভাই? তিনি বলেন, 'সাবেক আইজিপি মামুন যেহেতু রাজসাক্ষী হয়েছেন, সেই পরিপ্রেক্ষিতে তাকে পাঁচ বছরের সাজা দেয়া হয়েছে। তবে এই রায়ে আমরা সন্তুষ্ট নই। আমাদের দাবি, সে যতটুকু যা অপরাধ করেছে পাঁচ বছর কিছুই না।'

সেবন্তী আরও বলেন, যাঁরা ফাঁসির দণ্ড পেয়েছেন, তাঁদের দ্রুত ধরে এনে বিচারের রায় কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা সন্তুষ্ট নন। যাঁরা ভাই, সন্তান, অঙ্গ হারিয়েছেন, সেই মানুষের পরিবার শুধুই রায় শুনে শান্ত হবে না। দণ্ড কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।

শহীদ মীর মুগ্ধর বাবা মীর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'শেখ হাসিনার এই রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। এখন দ্রুত হাসিনাকে ভারত থেকে এনে ফাঁসি কার্যকর করতে হবে। তবে পুলিশের আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুনের রায়ে আমরা সন্তুষ্ট নই। এই রায় মানি না। কমপক্ষে যাবজ্জীবন দিতে হবে। আমরা প্রয়োজনে আবার আপিল করব।'

বিকেলে ট্রাইব্যুনালের সামনে রায়ের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে মীর মুগ্ধর ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ বলেন, রাজসাক্ষী হওয়ায় মামুনের সাজায় যে ছাড় দেওয়া হয়েছে তা শহীদ পরিবার মেনে নিতে পারছে না।

ট্রাইব্যুনালে এসে রায় দেখে ডাকসুর ভিপি সাদিক কায়েম বলেন, 'শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণাকে জুলাই বিপ্লবের বিজয়। তবে একই মামলায় সাবেক পুলিশ প্রধান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন যে মাত্রার অপরাধ করেছেন, তার শাস্তি এটা নয়। তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আমরা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাছে রায়ের পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানাব।'

মামলার সাক্ষী ইউনাইটেড পিপল বাংলাদেশের (আপ বাংলাদেশ) আহবায়ক আলী আহসান জোনায়েদ রায় নিয়ে বলেন, জুলাইয়ের ঘটনার আহত ও নিহতদের পরিবার যেভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন, তা আমি বুঝতে পারছি। মামুন পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ঘটনাগুলো ঘটেছে, তাই তাঁর ভূমিকা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। যদিও তিনি তথ্য প্রদান করে তদন্তে সহযোগিতা করেছেন—এটা অবশ্যই বিবেচনার দাবি রাখে। কিন্তু তবুও মাত্র পাঁচ বছরের সাজা অনেকের কাছে অপর্যাপ্ত মনে হয়েছে। আমার মনে হয় তার বিরুদ্ধে কমপক্ষে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলে সেটা অধিকতর উপযুক্ত শাস্তি হিসেবে প্রতীয়মান হতো।'

এদিকে আইজিপি মামুনের দণ্ড হ্রাসের পেছনে রয়েছে তাঁর চাঞ্চল্যকর জবানবন্দি। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তিনি দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হন। গত ১০ জুলাই ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের পর ৩ সেপ্টেম্বর রাজসাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন মামুন। এর আগে ১৩ নভেম্বর তিনি ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতে প্রথম জবানবন্দি দিয়েছিলেন।

জবানবন্দিতে ‘কোর কমিটি’র বৈঠকের বিষয়ে জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই থেকে প্রায় প্রতি রাতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ধানমন্ডির বাসায় ‘কোর কমিটি’র বৈঠক হতো। একটি বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের আটক করার সিদ্ধান্ত হয়। মামুন বলেন, তিনি এর বিরোধিতা করেছিলেন, কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘নির্দেশে’ পরে রাজি হন। আর সমন্বয়কদের আটকের দায়িত্ব ডিএমপির তৎকালীন ডিবি প্রধান হারুনকে দেওয়া হয়।

জবানবন্দিতে তিনি আরও বলেন, ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল তাঁকে ফোন করে বলেন যে আন্দোলন দমনে সরাসরি প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন শেখ হাসিনা। তখন তার সামনে ছিলেন তৎকালীন অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ারদার, যিনি এই নির্দেশনা সারা দেশে পৌঁছে দেন। মামুন বলেন, এই মারণাস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে ‘অতি উৎসাহী’ ছিলেন ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর ও ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ।

সাবেক আইজিপি তার জবানবন্দিতে বলেন, শেখ হাসিনাকে মারণাস্ত্র ব্যবহারে ‘প্ররোচিত করতেন’ ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম, ফজলে নূর তাপস ও মোহাম্মদ আলী আরাফাত।

২০২০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত র‌্যাব মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন মামুন। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, র‌্যাব সদর দপ্তর পরিচালিত উত্তরাসহ র‌্যাব-১-এর কার্যালয়ের ভেতরে টিএফআই সেল (টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন সেল) নামে একটি বন্দিশালা ছিল। র‌্যাবের অন্যান্য ইউনিটের অধীনেও অনেক বন্দিশালা ছিল। এসব বন্দিশালায় রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী এবং সরকারের জন্য হুমকি হয়ে ওঠা ব্যক্তিদের আটকে রাখা হত, যা একটা ‘কালচারে’ পরিণত হয়েছিল। তার ভাষ্য, অপহরণ, গোপন বন্দিশালায় আটক, নির্যাতন এবং ‘ক্রসফায়ারের’ নামে হত্যার মত কাজগুলো র‌্যাবের এডিজি (অপারেশন) এবং র‌্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালকরা সমন্বয় করতেন। আর র‌্যাবের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তিকে উঠিয়ে আনা, আটক রাখা কিংবা হত্যা করার নির্দেশনাগুলো ‘সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে’ আসত, যা সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকের মাধ্যমে আসার কথা ‘জেনেছিলেন’ বলেও জবানবন্দিতে দাবি করেন সাবেক আইজিপি।

জবানবন্দিতে তিনি বলেন, তিনি যখন আইজিপির দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন তাকে ব্যারিস্টার আরমানের (যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার আহমেদ বিন কাসেম আরমান) আটক থাকার বিষয়টি জানানো হয়। মামুন বলেন, 'র‌্যাবের সাবেক ডিজি বেনজীর আহমেদ বিষয়টি আমাকে অবহিত করেন। তাঁকে (আরমান) তুলে আনা এবং গোপনে আটক রাখার সিদ্ধান্ত সরকারের ছিল। বিষয়টি জানার পর আমি প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকের সঙ্গে কথা বলি। তিনি আমাকে বলেন, "ঠিক আছে, রাখেন। পরে বলব।" কিন্তু পরে আর কিছু তিনি জানাননি।'

২০২৪ সালের ৪ আগস্ট গণভবনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নিরাপত্তা সমন্বয় কমিটির বৈঠক এবং ওইদিন রাতেই গণভবনে ও পরে সেনাবাহিনীর অপারেশন কন্ট্রোল রুমে অনুষ্ঠিত বৈঠকের বিস্তারিতও জবানবন্দিতে তুলে ধরেন মামুন, যেখানে ৫ আগস্টের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঠেকানোর পরিকল্পনা করা হয়।

জবানবন্দিতে এ আইজিপি নিজের অপরাধের জন্য ক্ষমা চেয়ে বলেন, 'বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সরকারের আদেশে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করায় নৃশংস হত্যাকাণ্ড হয়েছে। আমি পুলিশ প্রধান হিসেবে লজ্জিত, অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী। জুলাই আন্দোলনে যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড হয়েছে, তার জন্য আমি অপরাধবোধ ও বিবেকের তাড়নায় রাজসাক্ষী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বিশেষ করে হত্যাকাণ্ডের পর আগুন দিয়ে লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার মত বীভৎসতা আমাকে ভীষণভাবে মর্মাহত করেছে।'

মামলার শুনানিতে প্রসিকিউশন পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, মিজানুল ইসলাম ও গাজী এস. এইচ. তামিম যুক্তিতর্ক করেন। পলাতক শেখ হাসিনা ও কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন এবং মামুনের পক্ষে আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন।

রায়ের পর শহীদ পরিবারগুলো বলছে, এই রায়ে বিচার শুরু হলো, শেষ নয়। যারা মৃত্যুদণ্ড পেয়েছেন তাদের দ্রুত দেশে ফিরিয়ে এনে সাজা কার্যকর করতে হবে। তারা শুধুই রায়ে সন্তুষ্ট নয়, বিচার চোখে দেখতে চায়।

Ad 300x250

সম্পর্কিত