leadT1ad

হিটলার থেকে হাসিনা: আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিবর্তন

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক

হিটলার থেকে হাসিনা: আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিবর্তন। স্ট্রিম গ্রাফিক

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণার জন্য প্রস্তুত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)। আজ সোমবার (১৭ নভেম্বর) বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এই ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করবেন।

২০২৪ সালের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রক্তক্ষয়ী দমন-পীড়নের পর, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে এই মামলার সূচনা হয়। প্রসিকিউশনের প্রধান অভিযোগ, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর মারণাস্ত্র ব্যবহারের সরাসরি নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই নির্দেশের ভিত্তিতেই তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়।

কাজেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই রায় কেবল ব্যক্তির ভাগ্য নির্ধারণ করবে না; বরং একটি জাতির ভবিষ্যৎ এবং বিশ্বজুড়ে বিচার ও জবাবদিহিতার ধারণাকে গভীরভাবে প্রভাব ফেলবে।

শেখ হাসিনার এই বিচারিক প্রক্রিয়া কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর শেকড় প্রোথিত আছে প্রায় ৮০ বছর আগের বিধ্বস্ত ইউরোপে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অ্যাডলফ হিটলার ও তাঁর নাৎসি বাহিনীর চালানো গণহত্যার পর বিশ্ববাসী এক মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিল: রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ছত্রছায়ায় চালানো গণহত্যার কি কোনো বিচার হতে পারে? রাষ্ট্রপ্রধান বা সেনাপতিদের কি তাদের কৃতকর্মের জন্য ব্যক্তিগতভাবে দায়ী করা যায়? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই জন্ম হয়েছিল ইতিহাসের প্রথম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের।

হিটলারের সহযোগীদের বিচার দিয়ে যে যাত্রার সূচনা হয়েছিল, সেই একই নীতির ওপর দাঁড়িয়ে আজ বিচার হতে চলেছে বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর। এই দীর্ঘ পথপরিক্রমাই আমাদের বুঝতে সাহায্য করবে, শেখ হাসিনার মামলার রায় কেন এত গুরুত্বপূর্ণ ও এর পরিণতি কতটা সুদূরপ্রসারী হতে পারে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কী

জাতিসংঘ সনদ মতে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা ট্রাইব্যুনাল হলো এমন বিচারিক সংস্থা যা আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার উদ্দেশ্যে গুরুতর আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার করে। সহজ কথায়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নির্দিষ্ট দেশের সীমানার ঊর্ধ্বে গিয়ে সমগ্র মানবতাকে আঘাত করে এমন অপরাধের বিচার করে।

এই অপরাধগুলোকে প্রধানত চারটি ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথমটি হলো গণহত্যা বা জেনোসাইড, যা কোনো জাতি, ধর্ম, বর্ণ বা গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হত্যাকাণ্ড বা নির্যাতন।

দ্বিতীয়টি হলো মানবতাবিরোধী অপরাধ বা ক্রাইম এগেইনস্ট হিউম্যানিটি, যেখানে কোনো বেসামরিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে আক্রমণ চালানো হয়। এর মধ্যে হত্যা, গুম, ধর্ষণ, নির্যাতন বা রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে নিপীড়নের মতো ঘটনা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

এরপর আসে যুদ্ধাপরাধ বা ওয়ার ক্রাইমস, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সংঘটিত অপরাধ। যেমন—যুদ্ধবন্দীদের হত্যা, বেসামরিক স্থাপনায় ইচ্ছাকৃত হামলা বা রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার।

সবশেষে রয়েছে আগ্রাসনের অপরাধ বা ক্রাইম অফ অ্যাগ্রেশন, যা এক রাষ্ট্র কর্তৃক অন্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ওপর বেআইনিভাবে সশস্ত্র হামলা চালানোকে বোঝায়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মূল ভিত্তি হলো ‘ব্যক্তিগত ফৌজদারি দায়বদ্ধতার নীতি’। এর অর্থ হলো, কোনো ব্যক্তি ‘রাষ্ট্রের নির্দেশে’ বা ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আদেশে’ অপরাধ করেও দায়মুক্তি পেতে পারেন না। রাষ্ট্রপ্রধান থেকে সাধারণ সৈনিক প্রত্যেককেই  নিজেদের অপরাধের জন্য ব্যক্তিগতভাবে দায়ী হবেন।

১৯৪৫ সালে জার্মানির নুরেমবার্গ শহরে বসে ইতিহাসের প্রথম আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনাল। ছবি: সংগৃহীত
১৯৪৫ সালে জার্মানির নুরেমবার্গ শহরে বসে ইতিহাসের প্রথম আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনাল। ছবি: সংগৃহীত

ইতিহাসের প্রথম অধ্যায়: নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে মিত্রশক্তি কেবল হিটলারের জার্মানিকে পরাজিত করেই থামেনি। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এমন ভয়াবহতার পুনরাবৃত্তি থেকে শিক্ষা দিতে তারা চেয়েছিল নাৎসিবাদের পেছনের দর্শন ও এর কারিগরদের বিচারের আওতায় আনতে । এই লক্ষ্যেই ১৯৪৫ সালে জার্মানির নুরেমবার্গ শহরে বসে ইতিহাসের প্রথম আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনাল। এর আগে যুদ্ধাপরাধের বিচার হলেও এই প্রথম পরাজিত দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, সামরিক নেতা ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের মানবতার বিরুদ্ধে করা অপরাধের জন্য কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। হিটলারের ডানহাত হিসেবে পরিচিত হারম্যান গোয়েরিং, রুডলফ হেসসহ নাৎসি জার্মানির শীর্ষ নেতাদের বিচার করা হয় এই ট্রাইব্যুনালে।

নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল দুটি যুগান্তকারী নীতি প্রতিষ্ঠা করে, যা আজ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। প্রথমত, অপরাধের দায় থেকে মুক্তির জন্য ‘আমি কেবল আদেশ পালন করেছি’ এই অজুহাত যথেষ্ট নয়। দ্বিতীয়ত, পদের কারণে রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারি কর্মকর্তা কেউই বিচার থেকে রেহাই পাবেন না।

নুরেমবার্গের পর দীর্ঘ সময় আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের ধারণা স্নায়ুযুদ্ধের শীতল রাজনীতিতে প্রায় চাপা পড়ে ছিল। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন জাতিগত সংঘাতের ভয়াবহতা নতুন করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জাগিয়ে তোলে। এই প্রেক্ষাপটেই জন্ম নেয় আধুনিক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালগুলো।

তবে, নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল একটি বড় আইনি বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। সমালোচকদের যুক্তি ছিল, এই আদালত পশ্চাদমুখী আইন (এক্স পোস্ট ফ্যাক্টো ল) প্রয়োগ করেছে—অর্থাৎ যে অপরাধগুলো সংঘটিত হওয়ার সময় যুদ্ধাপরাধ বা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে আন্তর্জাতিক আইনে স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত ছিল না, সেগুলোর জন্য দোষীদের বিচার করা হয়েছে। যদিও ট্রাইব্যুনাল এই যুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছিল, তবুও ইতিহাসের প্রথম আন্তর্জাতিক বিচার হিসেবে এটি আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছু মৌলিক প্রশ্ন রেখে গেছে।

টোকিও ট্রায়ালে বিচার কার্যক্রম নুরেমবার্গের চেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলে। ছবি: সংগৃহীত
টোকিও ট্রায়ালে বিচার কার্যক্রম নুরেমবার্গের চেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলে। ছবি: সংগৃহীত

টোকিও ট্রায়াল

নুরেমবার্গ ট্রায়ালের আদলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের নেতাদের বিচারের জন্য ১৯৪৬ সালের এপ্রিলে টোকিওতে এই ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। ‘টোকিও ট্রায়াল’ নামে পরিচিত এই আদালতে জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হিদেকি তোজোসসহ ২৮ জন উচ্চপদস্থ সামরিক ও রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছিল। এর বিচার কার্যক্রম নুরেমবার্গের চেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলে ও ১৯৪৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত চলে। এই ট্রাইব্যুনাল ১১টি দেশের (অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, চীন, ফ্রান্স, ভারত, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, ফিলিপাইন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র) বিচারকদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল। বিচারের রায়ে সাতজনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

তবে নুরেমবার্গের মতোই এই ট্রাইব্যুনালও ‘বিজয়ীর বিচার’ (ভিক্টর’স জাস্টিস) হিসেবে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছিল। সমালোচকদের যুক্তি ছিল, এখানে কেবল পরাজিত শক্তির অপরাধেরই বিচার করা হয়েছে, পারমাণবিক বোমা হামলাসহ মিত্রশক্তির দ্বারা সংঘটিত কোনো অপরাধ বিচারের আওতায় আনা হয়নি।

যুগোস্লাভিয়ার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটিওয়াই)

১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। এর সদর দপ্তর ছিল নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে। ১৯৯১ সাল থেকে সাবেক যুগোস্লাভিয়ায় (বর্তমানে এর ভূখণ্ডে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, ক্রোয়েশিয়া, উত্তর মেসিডোনিয়া, মন্টিনিগ্রো, সার্বিয়া ও স্লোভেনিয়া সহ একাধিক দেশ রয়েছে) সংঘটিত গুরুতর আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য।

এই ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বলকান যুদ্ধ চলাকালীন গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের মতো ঘটনাগুলোর বিচার করা হয়। বসনিয়া, ক্রোয়েশিয়া ও কসোভোতে সংঘটিত অপরাধের জন্য অনেক উচ্চপদস্থ রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাকে এই আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। বসনিয়ার সার্ব নেতা স্লোবোদান মিলোশেভিচ ও রাদোভান কারাদজিচের মতো ব্যক্তিদের বিচার এই ট্রাইব্যুনালের উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমের মধ্যে অন্যতম। ২০১৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এর কার্যক্রম শেষ হওয়ার আগে, আইসিটিওয়াই ১৬১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে ও ৯০ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে।

রুয়ান্ডার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটিআর)

১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় সংঘটিত গণহত্যা ও অন্যান্য গুরুতর আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে। এর সদর দপ্তর ছিল তানজানিয়ার আরুশাতে। ১৯৯৪ সালে মাত্র ১০০ দিনের মধ্যে প্রায় আট লক্ষ তুতসি ও মধ্যপন্থী হুতুদের হত্যা করা হয়। আইসিটিআর-এর মূল লক্ষ্য ছিল এই গণহত্যার জন্য দায়ী প্রধান ব্যক্তিদের বিচার করা। এই ট্রাইব্যুনালই প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক আদালত যা গণহত্যাকে আইনিভাবে সংজ্ঞায়িত ও প্রয়োগ করে রায় প্রদান করে। রুয়ান্ডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জ্যাঁ কামবান্দাকে দোষী সাব্যস্ত করা এই ট্রাইব্যুনালের একটি ঐতিহাসিক রায়, কারণ কামবান্দাই ছিলেন গণহত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়া প্রথম কোনো সরকারপ্রধান। ২০১৫ সালে বন্ধ হওয়ার আগে, এই ট্রাইব্যুনাল ৬২ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দিয়েছিল।

আইসিসি একটি স্থায়ী বিচারিক সংস্থা, যা ভবিষ্যতেও সংঘটিত অপরাধের বিচার করার ক্ষমতা রাখে। ছবি: সংগৃহীত
আইসিসি একটি স্থায়ী বিচারিক সংস্থা, যা ভবিষ্যতেও সংঘটিত অপরাধের বিচার করার ক্ষমতা রাখে। ছবি: সংগৃহীত

দ্য হেগ: প্রথম স্থায়ী আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)

আন্তর্জাতিক বিচার ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় বিবর্তন আসে ১৯৯৮ সালে, যখন বিশ্বজুড়ে গুরুতর অপরাধের বিচার করার জন্য নেদারল্যান্ডসের হেগ-এ স্থায়ী আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট- আইসিসি) গঠনের জন্য রোম সংবিধি (রোম স্ট্যাচুয়েট) গ্রহণ করা হয়। এই ট্রাইব্যুনালগুলো (যেমন আইসিটিওয়াই, আইসিটিআর) ছিল নির্দিষ্ট যুদ্ধ বা সংঘাতের জন্য গঠিত অস্থায়ী (এড-হক) আদালত, কিন্তু আইসিসি হলো একটি স্থায়ী বিচারিক সংস্থা, যা ভবিষ্যতেও সংঘটিত অপরাধের বিচার করার ক্ষমতা রাখে। আইসিসি কার্যকর হয় ২০০২ সালে এবং এর মূল লক্ষ্য হলো গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং আগ্রাসনের অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার করা, যখন কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিচার ব্যবস্থা তা করতে ব্যর্থ হয়। এটিই বর্তমান আন্তর্জাতিক বিচার ব্যবস্থার প্রধান স্তম্ভ।

সিয়েরা লিওনের জন্য বিশেষ আদালত (এসসিএসএল)

২০০২ সালে এই বিশেষ আদালত সিয়েরা লিওন সরকার ও জাতিসংঘের যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত সিয়েরা লিওনে চলা গৃহযুদ্ধের সময় সংঘটিত গুরুতর অপরাধের বিচারের জন্য এই আদালত গঠন করা হয়েছিল। এর এখতিয়ারের মধ্যে ছিল যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের অন্যান্য লঙ্ঘন। এই আদালতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিচার ছিল লাইবেরিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপতি চার্লস টেলরের বিচার। চার্লসই প্রথম আফ্রিকান রাষ্ট্রপ্রধান, যিনি আন্তর্জাতিক আদালতে যুদ্ধাপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হন। ২০১৩ সালে এর কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়। আন্তর্জাতিক ও জাতীয় আইনের সংমিশ্রণে গঠিত হওয়ায় সিয়েরা লিওনের বিশেষ আদালতকে একটি ‘হাইব্রিড’ ট্রাইব্যুনাল হিসেবে দেখা হয়।

বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল

এই তালিকায় বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক ও আলোচিত সংযোজন হলো বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর মডেল পূর্ববর্তী সকল উদাহরণ থেকে ভিন্ন। এটি কোনো আন্তর্জাতিক বা হাইব্রিড আদালত নয়, বরং সম্পূর্ণ দেশীয় ট্রাইব্যুনাল যা আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার করে। এর আইনি ভিত্তি ছিল ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩’। কিন্তু ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে এই বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে নিষ্ক্রিয় ছিল। অবশেষে ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার এই আইনকে পুনরুজ্জীবিত করে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। এর মূল লক্ষ্য ছিল ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে যারা গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে অংশ নিয়েছিল, সেইসব দেশীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা।

এই বিচার প্রক্রিয়ার জন্ম আসলে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গণহত্যার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দীর্ঘদিনের জাতীয় আকাঙ্ক্ষা থেকে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দেশীয় দোসররা যে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছিল, তার বিচার করার জন্যই শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার স্বাধীনতার দুই বছরের মধ্যেই 'আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩' প্রণয়ন করেছিল। দীর্ঘ চার দশক পর ২০১০ সালে বিচারিক কার্যক্রম শুরু করার তার ধারাবাহিকতা চালু থেকে।  

তবে, বিচারিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকেই এই ট্রাইব্যুনাল শুরু থেকেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিতর্কের জন্ম দেয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এর বিচারপ্রক্রিয়ার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তাদের প্রধান অভিযোগগুলোর মধ্যে ছিল—এখানে আন্তর্জাতিক বিচারকদের অনুপস্থিতি, আসামিপক্ষের সাক্ষীদের জন্য অপর্যাপ্ত সুরক্ষা এবং অভিযুক্তদের অধিকার পুরোপুরিভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে না। সমালোচকরা আরও দাবি করেন, এই বিচার প্রক্রিয়া রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও এর মূল লক্ষ্য হলো বিরোধী রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের নির্মূল করা।

এই বিতর্কের মধ্যেই ২০১৩ সালে ট্রাইব্যুনাল জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে। কিন্তু এই রায়কে অপর্যাপ্ত দাবি করে ঢাকার শাহবাগ চত্বরে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন, যা ‘শাহবাগ আন্দোলন’ নামে পরিচিতি লাভ করে। সরকার ১৯৭৩ সালের আইনটি সংশোধন করে। ফলে প্রসিকিউশনেরও আপিল করার ও সর্বোচ্চ শাস্তি চাওয়ার সুযোগ তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে আপিল বিভাগ কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে এবং তা কার্যকর করা হয়।

সমর্থকদের কাছে এটি ছিল ন্যায়বিচারের জন্য জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণ ও গণদাবির প্রতি রাষ্ট্রের সম্মান প্রদর্শন। অন্যদিকে, সমালোচকদের মতে এটি ছিল বিচারিক প্রক্রিয়ার ওপর নির্বাহী ও ‘মবের’ চাপের এক নগ্ন উদাহরণ, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

বিচার বনাম বাস্তবতা

আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালগুলোর রায় কার্যকর করার নজির মিশ্র। নুরেমবার্গে দোষীদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। যুগোস্লাভিয়া ও রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনালের বহু দোষী ইউরোপের বিভিন্ন দেশের কারাগারে সাজা খেটেছে। চার্লস টেলর ব্রিটেনের কারাগারে বন্দী। বাংলাদেশেও বেশ কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। তবে ব্যর্থতার উদাহরণও কম নয়।

আইসিসি সুদানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেও, তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। বরং বছরের পর বছর ধরে আইসিসির সদস্য ও তাকে গ্রেপ্তারে আইনত বাধ্য এমন দেশে প্রকাশ্যে সফর করেছেন। একইভাবে, লিবিয়ার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফির ছেলে সাইফ আল-ইসলাম গাদ্দাফির বিরুদ্ধেও আইসিসির পরোয়ানা রয়েছে কিন্তু লিবিয়ার অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও কার্যকরী কেন্দ্রীয় সরকারের অভাবে তাকে কখনোই হেগে হস্তান্তর করা সম্ভব হয়নি।

এর চেয়েও বড় ব্যর্থতা হলো শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলো, বিশেষ করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যরা (যেমন—আমেরিকা, রাশিয়া, চীন) প্রায়শই নিজেদের বা মিত্রদের স্বার্থ রক্ষায় এই বিচার ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে যায় বা এর কার্যকারিতাকে বাধাগ্রস্ত করে।

জুলাই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গঠিত ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিচার পূর্ববর্তী সকল উদাহরণ থেকে অনেক দিক থেকেই ভিন্ন। এখানে বিজয়ী কোনো বিদেশি শক্তি নেই, বিচার হচ্ছে দেশের নিজস্ব আইনেই ও অভিযুক্ত ব্যক্তি টানা ১৫ বছর দেশ শাসন করেছেন। 

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ এমন নির্ণায়ক মুহূর্ত খুব কমই দেখেছে। শেখ হাসিনার বিচারের রায় কেবল ব্যক্তির বিচার নয়; ক্ষমতার অপব্যবহার, দায়মুক্তি ও ন্যায়বিচারের সীমানা নির্ধারণের পরীক্ষা। নুরেমবার্গের ‘কোনো নেতাই আইনের ঊর্ধ্বে নন’ নীতির চূড়ান্ত পরীক্ষা এখন ঢাকার মাটিতে হতে চলেছে। 

Ad 300x250

সম্পর্কিত