leadT1ad

রুনা লায়লার দেওয়া কলম দিয়েই লেখা শুরু করি ‘মায়ার সিংহাসন’

আজ সুর-সম্রাজ্ঞী রুনা লায়লার জন্মদিন। রুনা লায়লা ও তাঁর গানে লুকিয়ে থাকা অনুভূতি, সময়ের আবেশ, প্রেম ও একাকিত্ব নিয়ে ‘মায়ার সিংহাসন’ গীতি-উপন্যাস লিখেছেন আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির। উপন্যাস লেখার ঘোরলাগা ভ্রমণ লেখক শেয়ার করেছেন স্ট্রিম পাঠকদের সঙ্গে।

আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির
আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির

প্রকাশ : ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ১৯: ০৪
স্ট্রিম গ্রাফিক

আমি এখন সত্যিই বিশ্বাস করি পুরোনো দিনের কথা মনে করার কাজটাকে পরিপূর্ণ শিল্পের মর্যাদা দেয়া উচিত। বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ আলোচিত ও সবচেয়ে উদার গায়িকা রুনা লায়লার সুর ও কিংবদন্তি অবলম্বনে ‘মায়ার সিংহাসন’ নামের গীতি-উপন্যাস লিখতে গিয়ে গত এক বছর নিবিড়ভাবে বাংলাদেশের সংগীত ইতিহাস পরিভ্রমণ আমাকে আরো শিখিয়েছে, পৃথিবীর প্রায় সকল মানুষই তাদের বর্তমানে কোনো না কোনো ভাবে দুঃখপ্রবণ, সবার ভবিষ্যতই কুয়াশার মতো ঘোলাটে শীতল। তাই অতীতের অন্তত একটা প্রবল উষ্ণতার স্মৃতি ছাড়া কেউ আসলে বাঁচতে পারে না। আবার অতীতের উষ্ণ অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি মনে রাখবার অন্তত শতাধিক উপায় আছে। আমার মতে, এর মধ্যে সর্বাধিক কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে গান। পৃথিবীতে মানুষের আবিষ্কৃত অনুভূতি প্রকাশের অন্য যেকোনো মাধ্যমের চেয়ে, ‘স্মৃতিচারণা শিল্প’ হিসেবে সংগীত তাই অনেক বেশি সফল।

বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের গর্ব করার মতো বিষয় হয়তো খুব অল্প। তবে সেই শৈশব থেকেই আমি এদেশের মাটি-বাতাসে জন্ম নেওয়া হাজার রকমের গান নিয়ে ভীষণ গর্বিত। বিদেশি গানের চেয়ে বাংলাদেশি গান আমি সারাজীবনই বেশি শুনেছি। শুরুটা হয়েছিল একটা লাল রঙের ওয়ান ‘ব্যান্ড’-এর রেডিওতে। পকেটে ছোট রেডিও সেটটা নিয়ে জারুল বা জামের ডালে দুলতে থাকা আমার একলা দুপুরগুলোর স্মৃতি তুলনাহীন সুরেলা।

রুনা লায়লা। ছবি: সংগৃহীত
রুনা লায়লা। ছবি: সংগৃহীত

‘১২১, কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ, শাহবাগ, ঢাকা’ ছিল আক্ষরিক অর্থেই আমার স্বপ্নের ঠিকানা। বাংলাদেশ বেতারের বানিজ্যিক কার্যক্রমের সূত্র ধরে একে একে জননন্দিত সব কণ্ঠস্বরের সাথে আমার পরিচয় ঘটে। সেই অনন্য কণ্ঠগুলোর কল্যাণে, সুরের মায়াময় শক্তির দেখা পাই আমি বেশ অল্প বয়সেই।

যমুনা নামের খরস্রোতা নদীর পাড়ে বড় হওয়ার কারণেই বোধহয়, ভেসে যাওয়ার কথা ভাবলেই চিরকাল আমার চোখে দুলত অজানা গন্তব্যে ছুটে চলা বিশাল বিশাল ঘোলা স্রোত। গানের নদীর প্রবল স্রোতে ভাসতে গিয়ে আমি একদিন আবিষ্কার করি হারিয়ে ফেলারও কেমন যেন একটা আনন্দ আছে। সুরের নৌপথে উজান চলতে গিয়েই অতীতের সুখ অথবা দুঃখ ঘিরে জমতে থাকা উষ্ণতার দেখা মেলে।

রেডিও থেকে উঠে আসা বাকি সব সুরেলা কণ্ঠ থেকে মহান রুনা লায়লাকে আলাদা করতেও আমার সময় লেগেছে খুব কম। ঠিক কবে প্রথম তাঁর গান শুনে যমুনায় ভেসেছিলাম, মনে করতে পারি না। তবে কৈশোরের হঠাৎ প্রেম আর অকাল বিরহের প্রতিটা ধাপে তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত আবেগি শব্দগুলো বারবার আমাকে সাহস ও সান্ত্বনার পরশ বুলিয়ে গেছে।

যেমন গ্রাম ছেড়ে মাত্র তখন শহরে গিয়েছি। রাজশাহী মহানগরীর পথে পথে একা একা ঘুরে বেড়াতাম। একাকিত্বকে বেশি অসহ্য মনে হলে একটা ওয়াকম্যান কিনলাম। স্পষ্ট মনে আছে প্রথমদিন রাজশাহীর ‘গীতাঞ্জলি’ থেকে তিনটা ক্যাসেট কিনেছিলাম ৬০ টাকায়। একটাতে রবীন্দ্রসঙ্গীত, আরেকটা সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত হিন্দি ছবির গান, শেষটার শিরোনাম ছিল, ‘রুনা লায়লা টিভি প্রোগ্রাম’।

‘মায়ার সিংহাসন’ উপন্যাসটা আমি লিখতে শুরু করি গত বছর নভেম্বরে। শেষ করতে সময় লেগেছে মাত্র দশ মাস। কিন্তু প্রয়োজনীয় গবেষণা শুরু হয়েছিল দুই দশক আগের রাজশাহী শহরে নামা সেই বৃষ্টিমুখর রাতে।

যতদূর মনে পড়ে, ভরা বর্ষা ছিল। এখন পর্যন্ত আমার জীবনে সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতির একটা হলো ওয়াকম্যানটা হাতে নিয়ে আমি হোস্টেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। সামনের সড়ক প্রচণ্ড বৃষ্টির জলে ভেসে যাচ্ছে। ক্ষণিকের অশান্ত নদী যেন। বাতাসের শব্দে একের পর এক তার ঢেউ ভাঙছে। সব ছাপিয়ে আমার কানে আকুল হয়ে বেজে চলেছে কবিতা। সেই ভেজা মুহূর্তে, রুনা লায়লার রাজকীয় কণ্ঠ আমার কিশোর মনের কাঁচা বিরহে মিশে মুহূর্তেই গড়ে তুলল স্বর্ণ- সিংহাসন।

‘যখন দখিন বাতাস গায় পরশ বুলাবে এসে
জেনো এসে গেছি আমি অবশেষে
বাসনার সেই নদীতীরে
চিনে নিও প্রিয় সাথীরে
স্বপ্ন ভেবে কেঁদোনাকো বেদনাতে’

খ.

‘মায়ার সিংহাসন’ উপন্যাসটা আমি লিখতে শুরু করি গত বছর নভেম্বরে। শেষ করতে সময় লেগেছে মাত্র দশ মাস। কিন্তু প্রয়োজনীয় গবেষণা শুরু হয়েছিল দুই দশক আগের রাজশাহী শহরে নামা সেই বৃষ্টিমুখর রাতে। এরপর কত বিকেল, সন্ধ্যা যে সব ভুলে কেবল প্রিয় গায়িকার বহু রঙের কণ্ঠ শুনে কেটে গেছে, হিসাব নাই।

রুনা লায়লার সঙ্গে লেখক। ছবি: লেখকের সৌজন্যে
রুনা লায়লার সঙ্গে লেখক। ছবি: লেখকের সৌজন্যে

রুনা লায়লার এমন অসংখ্য ভক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন প্রজন্মে, দেশ দেশান্তরে। আমিও তাদের একজন হয়ে দূর থেকে মুগ্ধতার রূপকথা রচনা করে যাচ্ছিলাম মনে মনে। সেই রূপকাহিনী কোনোদিন বই আকারে লিখে ফেলব ভাবিনি। ২০২৩ সালের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহের এক সন্ধ্যায় হঠাৎ লিখে ফেলার তাড়না অনুভব করলাম। পড়ালেখার উদ্দেশ্যে বিদেশযাত্রার আগে সেই সন্ধ্যায় আমি গিয়েছিলাম সুর-সম্রাজ্ঞীর আশীর্বাদ নিতে। আমার লেখা সর্বশেষ বই ‘দুনিয়া’ হাতে পেয়ে তাঁর চোখে আন্তরিক হাসি। এরপর আমাকে অবাক করে উপহার দিলেন কালো রঙের বাক্সে ভরা অভিজাত এক কলম। লন্ডনের মেয়রের কাছে থেকে পাওয়া কলমটা হাতে নিয়ে তৎক্ষণাৎ ছবি তুললাম। ময়মনসিংহে ফেরার পথে বাসে বসেই ছবিগুলো ফেসবুকে শেয়ার করলাম। শুভেচ্ছা, অভিনন্দনে ভরে গেল কমেন্ট বক্স। কিন্তু কিছুতেই যেন তৃপ্ত হতে পারছিলাম না। বিশেষ কলমটা দিয়ে বিশেষ এমন কী লেখা যায়? প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগেই ছুটতে হলো অচেনা মহাদেশে। নতুন দেশের বিস্ময় আর সংগ্রাম এরপর আমাকে এক বছরের বেশি সময় ভয়াবহ ব্যস্ত করে রাখলো।

কলমটা আবার হাতে নিতে নিতে পরের বছর নভেম্বর। ততদিনে এডমন্টন বরফে ঢেকে গেছে। দশ তারিখ সকাল দশটায় কলমটা হাতে নিয়ে বসলাম রুনা লায়লার কন্যা শিল্পী তানি লায়লার সঙ্গে আলাপে। অতঃপর শব্দায়ন নিবেদিত আমার পডকাস্ট ইয়েসটারডে’স ফোনকলের ঐ পর্বের শিরোনাম দিলাম ‘আমাদের রুনা লায়লা, বাংলাদেশের মায়ার সিংহাসন’। বিশেষ এই পর্বটাই মূলত আমার গীতি-উপন্যাসের সত্যিকারের সূচনা পর্ব। আমি দারুণ কৃতজ্ঞ তানি লায়লার প্রতি। তিনি যে নির্মোহ মুগ্ধতা নিয়ে তাঁর সুপারস্টার মায়ের ছবি এঁকেছেন, সে বর্ণনা ফিকশনের চেয়ে শ্রুতিমধুর।

মহান গায়িকার জন্মদিনে প্রকাশিত গীতি-উপন্যাস ‘মায়ার সিংহাসন’ আদতে, আজ ও আগামীর সকল স্মৃতি-চারণ শিল্পীর পক্ষ থেকে, রুনা লায়লার চিরসবুজ গানের চরণে বিনয়ী শ্রদ্ধাঞ্জলি।

এরপর পুরোদস্তুর গবেষণা টিম তৈরি করে শুরু হয় ‘প্রজেক্ট মায়ার সিংহাসন’। প্রথম কয়েকমাস এই প্রকল্পের গবেষণা সহকারীর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় চলে গান নির্বাচন। দেড় ডজন ভাষায় গাওয়া কিংবদন্তি এই গায়িকার। হাজার হাজার জনপ্রিয় গান থেকে পঞ্চাশটা নির্বাচন করা ছিল এই কাহিনীর রচনা-পথে কঠিনতম চ্যালেঞ্জ।
‘কতো শিউলির আনন্দ যায় ডেকে
দূর বনভূমি থেকে’

পরের পুরো প্রক্রিয়াটা ছিল আনন্দ-ভরপুর। প্রতি বিকেলে কানে হেডফোন দিয়ে হাঁটতে চলে যেতাম ব্লু কুইল এলাকার পাহাড়ি পথে। এতো নির্জন পথ যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটলেও অনেক সময় কোনো মানুষের দেখা মিলত না। শিল্পীর আঁকা ছবির মতো কানাডার আকাশের নিচে যখন আমি রুনা লায়লার কালজয়ী গানগুলো শুনতে শুনতে একা একা ঘুরে বেড়াতাম, মনে হতো সুরের চেয়ে সহজলভ্য আর কোনো বন্ধু নেই। ‘মায়ার সিংহাসন’ মূলত রুনা লায়লার যাদু নিয়ে মনোযোগী গবেষণা আর অভূতপূর্ব কিছু একাকিত্বের ফসল।

যেহেতু সামনাসামনি কারও সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেতাম কম; আড্ডা, ক্লাসের ব্যস্ততাও ধীরে ধীরে নাই হয়ে আসছিল; অবসরে তাই আমার প্রিয়তম কাজ হয়ে গেল শীত থেকে বসন্ত আসার প্রাকৃতিক যাদু উপভোগ, সঙ্গে শান্ত নিবিড় স্মৃতিচারণা। এই অতীত-যাত্রার বাহন হয়ে গেলো স্পটিফাই এবং ইউটিউব। বিভিন্ন বয়সে রুনা লায়লার একক কণ্ঠে ফুটে ওঠা শত রঙের বাসন্তী ফুল আমাকে ফেলে আসতে শুরু করলো জীবন নদীর নানান বয়সী কূলে।

‘মায়ের বুকে সুখে দুখে
নানা রঙের দিন
সেতো রয় না চিরদিন
খেলায় খেলায় যায় যে বেলা
ফুরায় সুখের দিন
থাকে ভালোবাসার ঋণ’

রুনা লায়লা ও তাঁর গানে লুকিয়ে থাকা অনুভূতি, সময়ের আবেশ, প্রেম ও একাকিত্ব নিয়ে ‘মায়ার সিংহাসন’ গীতি-উপন্যাস লিখেছেন আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির।
রুনা লায়লা ও তাঁর গানে লুকিয়ে থাকা অনুভূতি, সময়ের আবেশ, প্রেম ও একাকিত্ব নিয়ে ‘মায়ার সিংহাসন’ গীতি-উপন্যাস লিখেছেন আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির।

গ.

অতীত নিয়ে পড়ে থাকলে চলে না সত্য। আবার অতীতের যেকোনো ভালোবাসার কাছে আমরা চিরঋণী। ভালোবাসার শব্দ-ছবি-ঘ্রাণ মনে রাখাই হতে পারে সেই ঋণের প্রতি সবচেয়ে উপযুক্ত সম্মান। অতিমাত্রায় ইতিহাস নির্ভরতা জাতি হিসেবে আমাদের বারবার ভুগিয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত স্মৃতিকাতরতা সবার জন্যই কোনো না কোনো মাত্রায় ক্ষতিকর। কিন্তু অন্তত একটা আনন্দের সহজ স্মৃতি, ভালোবেসে কাছে আসার মুহূর্ত, বিপদে বন্ধুর হাতে রাখা হাত, ভোরের বাতাসে ফোটা রোদের হাসি ইত্যাদি মনে রাখার চেষ্টা করতে তো ক্ষতি নেই কোনো। বরং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসাগুলো বহুদিন ধরে স্মরণে রাখতে পারলেই কেবল চারিদিকে ক্রমাগত জ্বলতে থাকা ঘৃণার রেশ কমবেশি নেভানো সম্ভব।

সামাজিক ন্যায়বিচার নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা করতে গিয়ে, আমি একটা অনবদ্য বৈষম্য-বিরোধী জয়গান খুঁজে পেয়েছিলাম একবার। বাংলার লোকজ সুরের উপর, হিন্দি ভাষায় লেখা, ব্রিটিশ যন্ত্রশিল্পীদের বাজানো ‘দে দে পেয়ার দে’র সাম্যবাদী বাণীকে আমি ‘মায়ার সিংহাসন’ লিখতে গিয়ে মূল উপজীব্য করেছি।

‘উঁচ নিচ গোরে কালেকে সারে ভেদ মিটা দে
হার ইনসান কে দিল মে আ্যায়সি
পেয়ার কে জোত জাগা দে’

রুনা লায়লার এমন সব বিচিত্র গান নিয়ে এক বছরের বিনোদনমূলক গবেষণা আমাকে সত্যিই বাস্তব জগতের ঘৃণাবাদ থেকে অনেক দূরের কোনো সুরের মায়ায় বেঁধে রেখেছিল। বিভেদের রাজনীতি ভুলে মমতার এমন সীমানাহীন জয়গান আসলে কেবল রুনা লায়লা নামের সুর-সমুজ্জল রূপকথার রাজ্যেই সম্ভব।

মহান গায়িকার জন্মদিনে প্রকাশিত গীতি-উপন্যাস ‘মায়ার সিংহাসন’ আদতে, আজ ও আগামীর সকল স্মৃতি-চারণ শিল্পীর পক্ষ থেকে, রুনা লায়লার চিরসবুজ গানের চরণে বিনয়ী শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক:
কবি ও কথাসাহিত্যিক; সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

Ad 300x250

সম্পর্কিত